somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছুরি ছোঁড়ার খেলা-দ্বিতীয় পর্ব

১৪ ই মে, ২০১২ রাত ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সার্কাসের দলে বশীরের অন্তরঙ্গ আর নির্ভরযোগ্য বন্ধু রায়হান শেখ। বেশ মজার ছেলে। সবসময় হাসি-ঠাট্টার মধ্যেই আছে। তাকে দেখলে মনে হতেই পারে, দুনিয়ায় দুঃখ-কষ্ট বলে কোন ব্যাপার নেই। আর তাবৎ বিষয়ে তার জ্ঞান। একদিন তাকে বিষয়টা বলেছিল বশীর। প্রথমে তো রায়হান হেসেই খুন। তারপর সে রায় দিল, তুই মাইয়াটার পিরিতে মজেছিস। বশীর ভাবে, একেই কি প্রেম বলে? বোধহয় তাই। রায়হানই পরামর্শ দেয়, মনের মধ্যে গুমড়ে না মরে তার উচিৎ সুমিত্রাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া।
তারপর থেকে প্রতিটি দিন বশীর কথাটা বলতে চায় সুমিত্রাকে। কিন্তু বশীরের কথা শোনার কোন আগ্রহই যেন নেই সুমিত্রার। অথচ বশীরও আর পারছে না। রাতে সার্কাস শো রয়েছে। তার আগে বিষয়টার একটা নিষ্পত্তি না হলে তারপক্ষে খেলা দেখানোই অসম্ভব হবে। যেভাবেই হোক আজ সে কথাটা বলবেই।
দুপুর বেলায় সুমিত্রাকে একলা পাওয়া গেল। মেয়েটা সারাদিন কান্তিহীন বকবক করতে পারে। সবসময় কারও না কারও সঙ্গে কথা বলছেই। স্নানের পর যখন সে চুল আঁচড়াচ্ছিল, তখন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল বশীর। কী যে সুন্দর লাগছে ওকে। যেন রাতের বৃষ্টির পর সকালের সোনারোদে ঝকমক করছে বৃরে কচিপাতা। গায়ের রঙটাও যেন সোনালী। লোকে সুমিত্রাকে শ্যামলা বলে। তবে বশীরের মনে হয়, তাদের দেখার চোখ নেই। সুমিত্রার সিক্ত শরীর থেকে কেমন মায়াবী এক আভা বের হচ্ছে। আর কেমন শরীর চনমন করা একটা সুগন্ধ আসছে। অবাধ্য আঁচলের ফাঁক গলে দৃশ্যমান হয়েছে সুডৌল স্তনের অবয়ব। এভাবে কতক্ষণ ঘোরগ্রস্ত হয়ে থাকত বশীর বলা মুশকিল। সুমিত্রার কণ্ঠস্বরে সে সংবিৎ ফিরে পেল।
ঃ কী ব্যাপার বশীর ভাই। এইখানে কী মনে কইরা?
ঃ কেন আসতে মানা আছে নাকি? পাল্টা প্রশ্ন করে বশীর।
ঃ না। তয় মাইয়াগো ঘরে হুটহাট ঢুইকা পড়াও কোন কামের কথা না।
ঃ তুই কী রাগ করলি সুমি? মানে আমি আইছিলাম...
ঃ রাগের কতা না। ঠিক আছে কী কইবা কও।
ঃ আসলে কেমনে কথাটা তোরে কমু ঠিক বোঝতে পারতাছি না।
ঃ কী এমুন কতা বশীর ভাই?
ঃ মানে...আমি...আসলে...
ঃ আরে লও, কইয়া ফালাও। আমি বাঘও না ভাল্লুকও না।
ঃ সুমি, তোরে আমি সবসময় চোখের সামনে দেহি। তোর লাইগা মনটা কেমুন আউলা-আউলা লাগে। আমি তোরে ভালোবাসি সুমী।
মনের সব জোর একত্রিত করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে রীতিমতো হাঁফাতে থাকে বশীর। সুমিত্রার তেমন কোন ভাবান্তর হয় না। মুখে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা যায়। একটু পর নিঃশব্দতা ভেঙ্গে সুমিত্রা বলে, আমি কয়েকদিন ধইরা তোমার ভাবসাব দেইখা এমন কিছুই আন্দাজ করছিলাম।
ঃ সুমি বিশ্বাস কর... আমি...
ঃ না বশীর ভাই এইডা হয় না।
ঃ ক্যান হয়না সুমী। আমি তোরে বিয়া কইরা সংসার পাতুম। সার্কাস ছাইড়া দিমু। অন্য কোন কাম নিমু। রাইতে ঘরে ফিইরা তোরে অনেক আদর করুম।
ঃ এইডা হয়না বশীর ভাই। আগের কথাই আরেকবার বলে সুমিত্রা।
ঃ ক্যান সুমী, ক্যান হয়না? আমি কি খুব খারাপ মানুষ?
ঃ সেইটা কথা না বশীর ভাই। তুমি আগপাছ কিছুই ভাবো নাই।
ঃ কী ভাবমু, তুই ক। তোর সব শর্তে আমি রাজী।
ঃ না শর্তের কোন ব্যাপার না। একটু থেমে সুমিত্রা যোগ করে-তুমি বোধহয় ভুইলা গেছ আমি হিন্দু ঘরের মাইয়া। সার্কাসে কাম করতে পারি। তাই বইলা জাত খোয়াইতে পারুম না।
বড়সড় একটা ধাক্কা খায় বশীর। তাইতো, আবেগের বশে সে তো এই কথাটা একবারও ভেবে দেখেনি। কিন্তু সুমিকে না পেলে যে তার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। জীবনের চেয়ে কী ধর্মই বড় কথা? সে বোঝানোর চেষ্টা করে-
ঃ সুমি, হিঁদু-মোসলমানে বিয়া কি একেবারেই হয়না? আমাগো দ্যাশে দ্যাখছিলাম, বেম্মন ঘরের মাইয়া নন্দিতা পালাইয়া গেছিল ঘড়ির মেকার রফিকুলের সাতে। তাইলে ক? শোন আমরা অচিন কোন জায়গায় যামু। যেহানে কেউ আমাগোরে চেনে না।
ঃ না বশীর ভাই, তা হয়না। তাছাড়া রণজিতের লগে আমার বিয়ার মোটামুটি পাকা কথা হইয়া গেছে।
ঃ রণজিত? মানে আমাগো দড়াবাজিকর?
ঃ হ। আমাগো জাইতের পোলা। তাছাড়া অর লগে আমার ভাবও আছে।
ঃ তাইলে আমার কী হইব সুমি? আমি যে তোরে না পাইলে বাঁচুম না।
ঃ এইসব সিনেমা-নাটকের কতা বাদ দ্যাও। এইটা লাইলী-মজনুর যুগ না। তুমি আমার চাইয়া অনেক ভালো মাইয়া পাইবা। মরণ অত সোজা না।
ঃ না সুমি, আমারে তুই চিনস নাই। আমি একটু অন্যরকম। আমি যেইটা কই, তার মইদ্যে কোন খাদ নাই।
ঃ দ্যাহো বশীর ভাই, কতা বারাইয়া কাম নাই। দুপরের খাবার খাইয়া একটু ঘুমামু। রাইতে আবার শো আছে। তুমি এহন যাও।
ঃ তাইলে তুই আমার বিষয়ডা একটু ভাইবা দ্যাখ।
ঃ না, ভাবাভাবির কিছু নাই। আমি তোমারে সব খুইলাই কইছি। এই কতা তুমি আর কহনও তুলবা না। আর যদি আবার কিছু কও তাইলে আমি সার্কাসের মালিকের কাছে নালিশ করুম।
ঃ সুমি এইটাই তোর শ্যাষ কতা?
ঃ হ শ্যাষ কতা। এহন যাও।

হতাশায় মুশড়ে পড়ে বশীর আলী। সুমি তাকে মুখের ওপর না করে দিল-এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার একটা আশঙ্কা ছিল, সুমি প্রথমে রাজী হবে না, এমনকি রেগেও যেতে পারে। কিন্তু সে আকুল হয়ে তার ভালোবাসা সমর্পণ করলেও সুমি তাকে ফিরিয়ে দেবে, এটা সে ভাবেনি। বশীর কি ওই লিকপিকে রনজিতের চেয়ে কোন অংশে কম যোগ্য? নাকি ধর্মই বড় হয়ে গেল সুমীর কাছে? বশীর নিশ্চিত, আর যাই হোক রনজিতের সঙ্গে সুমীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কারণ এমন কিছু ঘটলে এদিক-ওদিক থেকে কোন না কোনভাবে টের পেতই সে। সার্কাসের কর্মীরা তো সবাই মোটামুটি একটা পরিবারের মতো। কারোই এমন গোপন কিছু নেই যা অন্য কেউ জানে না। তাহলে সুমী কেন এমন করলো? একটু ভেবেও তো দেখতে পারত। বশীরের হৃদয়াবেগ কি তাকে একটুও স্পর্শ করলো না? তবে লোকে কেন ভালোবাসার এত কদর করে?
এসব হাজারো প্রশ্ন তীরবিদ্ধ করতে থাকে বশীরের মনকে। দুপুরে তার আর খাওয়া হয়ে ওঠে না। সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। রায়হানের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তার। বিকেল হয়ে গেছে। কিছু সময় পরেই সার্কাস শুরু হবে। হাত-মুখ ধুয়ে খেলা দেখানোর জন্য প্রস্তুতি নেয় বশীর। প্যান্ডেলের নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে বসে। একসময় তার খেলা দেখানোর জন্য ডাক পড়ে। যথারীতি কাঠের পাটাতনের সামনে এসে দাঁড়ায় সুমিত্রা। গভীরভাবে তার চোখের দিকে তাকায় বশীর। না সেখানে তার কোন স্থান নেই। বশীরের বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ছুরিগুলো হাতে তুলে নেয়। কালো কাপড়ে বেঁধে দেওয়া হয় তার চোখ। যন্ত্রের মতো সে খেলা দেখানো শেষ করে।
রাতেও তার ক্ষুধা অনুভব হয় না। রায়হানের প্রশ্নের জবাবে বলে, শরীর খারাপ। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। মাথার ভেতর সেই এক চিন্তা ঘুরপাক করতে থাকে। রাত বাড়তে থাকে, কিন্তু বশীরের চোখে ঘুম আসে না। একপর্যায়ে তাঁবুর বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরায় সে। চিন্তাগুলোকে যতই সে মাথা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কওে, সেগুলো ততই যেন গেড়ে বসে তার ভেতর। হঠাৎ তার মাথায় খেলা করে এক ভয়ংকর ধবংসাত্নক চিন্তা। হ্যাঁ এটাই উচিৎ। সুমি যদি তার জীবনে না আসে, আর কারও কাছে সে সুমিকে যেতে দেবে না। প্রয়োজনে মেরে ফেলবে। হ্যাঁ মেরেই ফেলবে। সুমিকে মারার পর সেও আত্নহত্যা করবে। কারণ সুমিকে না পেলে তার বেঁচে থাকার কোন অর্থ থাকবে না।
আরেকটা সিগারেট ধরায় বশীর। চিন্তাটাকে সে পাকাপাকি সিদ্ধান্তে রূপ দেয়। কিন্তু কিভাবে মেরে ফেলবে সুমিকে? সবার সামনে একটা কান্ড ঘটানো ঠিক হবে না। এক কাজ করা যায়, জরুরী কথা বলার কথা বলে আশেপাশের কোন নির্জন স্থানে ডেকে নিয়ে গলা টিপে মেরে ফেলবে। নাকি ঝামেলা না করে একটা চাকু ঢুকিয়ে দেবে পেটের ভেতর? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বশীর। ভাবতে ভাবতে তার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটা পরিকল্পনা আসে। আরে সবচেয়ে সহজ রাস্তাটাই তো তার জন্য খোলা রয়েছে। খেলা দেখানোর সময় একটা ছুরি সুমির বুক বরাবর ছুঁড়ে দিলেই তো হলো। ব্যস, কেল্লা ফতে। আর এজন্য তাকে কোন সমস্যায় পড়তেও হবে না। কারণ চোখ বাঁধা অবস্থায় খেলা দেখাতে গিয়ে হাত তো সামান্য সরে যেতেই পারে। পরিকল্পনাটা চুড়ান্ত করে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে যায় বশীর।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৌলবাদ: ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ প্রযুক্তি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫১




মজার বিষয়—

আজকের মৌলবাদীরা রোকেয়া বেগমকে মুরতাদ ঘোষণা করে বুক ফুলিয়ে হাঁটে, অথচ নিজেদের অস্তিত্ব টিকেই আছে যাদের ঘৃণা করে— সেই “কাফেরদের” বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে। ইতিহাস পড়লে এদের বুকফুলা হাওয়া বের... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতী এখন পুরোপুরিভাবে নেতৃত্বহীন ও বিশৃংখল।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩



শেরে বাংলার নিজস্ব দল ছিলো, কৃষক প্রজা পার্টি; তিনি সেই দলের নেতা ছিলেন। একই সময়ে, তিনি পুরো বাংগালী জাতির নেতা ছিলেন, সব দলের মানুষ উনাকে সন্মান করতেন। মওলানাও জাতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট

লিখেছেন আরোগ্য, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৬



ওসমান হাদী অন্যতম জুলাই যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, স্পষ্টবাদী কণ্ঠ, প্রতিবাদী চেতনা লালনকারী, ঢাকা ৮ নং আসনের নির্বাচন প্রার্থী আজ জুমুআর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×