কাজের কাজ কিছুই না হলেও ডায়েরীটা পড়ে মজাই পাচ্ছেন ইন্সপেক্টর মোখলেছুর রহমান। আবার তিনি পড়তে শুরু করলেন।
ঘরে ঢুকে রায়হান সাহেব বললেন, মামণি, তোমার ছুরি নিয়ে এসেছি।
রাণী বললো, বাবা এটা তো ফল কাটার ছুরি। আমি তোমাকে বড় ছুরি আনতে বলেছিলাম।
ঃ ও। তাই নাকি? বড় ছুরি দিয়ে তুমি কি করবে?
ঃ দরকার আছে বাবা।
ঃ ঠিক আছে, কাল তোমাকে বড় ছুরি এনে দেব। বলে তিনি আমার দিকে তাকালেন। আরে, তুমি এসেছ?
ঃ জি স্যার। বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
ঃ বসো-বসো।
ঃ না স্যার, আমার হোটেলে যেতে হবে।
ঃ ঠিক আছে যাও। তবে সময় পেলেই চলে এসো। আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করেছে।
ঃ জ্বি আসবো। বলে আমি দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এলাম ওই বাসা থেকে।
রাতে বাসায় ফিরে দেখি দীর্ঘদিন পর বাবা বাসায় এসেছেন। তবে তাকে দেখে অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। মনেহয় মদ-টদ কিছু খেয়েছেন। মার মুখটাও গম্ভীর। কী করবো বুঝতে না পেরে ঘরে ঢুকে চুপচাপ বসে আছি। পাশের ঘর থেকে বাবা-মার কথাবার্তা সবই শোনা যাচ্ছে।
বাবা বলছেন, আমি এক সপ্তাহের বেশি সময় দিতে পারবো না।
মা বলছেন, ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব?
ঃ সেটা আমার দেখার বিষয় না। যেখানে খুশি যাও। এটা আমার বাসা। আমি বাসা খালি চাই।
ঃ তুমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে? আমি তোমার জন্য কী করিনি?
ঃ এত কথা শুনতে চাই না।
ঃ সজীব কি তোমার ছেলে নয়? তার প্রতি তোমার কোন দায়িত্ব নেই।
ঃ অ্যাই মাগী, কথা বাড়াচ্ছিস কেন? আমার কথা বুঝতে তোর সমস্যা হচ্ছে?
বাবা বোধহয় মাকে মারছেন। মার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মা বলছেন, তোমার পায়ে পড়ি। এমন করো না। আমি কোথায় যাব বলো। ঠিক আছে আমার সঙ্গে তুমি সম্পর্ক রেখো না। কিন্তু আমাকে একটু সময় দাও।
বাবা অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিলেন। সেইসঙ্গে হাত তুললেন। মার আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। দৌড়ে পাশের ঘরে ঢুকে দেখি, মা মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছেন। তার চুলের মুঠি ধরে টানছেন বাবা। আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। দরজার পাশে রাখা বিড়াল তাড়ানোর লাঠি নিয়ে আমি বাবার দিকে তেড়ে গেলাম। চিৎকার করে বললাম, মাকে ছেড়ে দেন, নাহলে খুন করে ফেলবো।
বাবা আমার দিকে ফিরে বললেন, সাবাস, বাপকে মারবি? আয় মার।
ঃ ছাড়েন। ছেড়ে দেন বলছি।
ঃ কী করবি রে তুই বেজন্মা। বলেই মার বুকে সজোরে লাথি দিলেন। মা ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো। তারপরও মা আমাকে বললো, ছি বাবা, গুরুজনদের সঙ্গে এরকম করতে নেই। যাও, ওঘরে যাও।
মার ওপরই আমার রাগ হলো। পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। তবু কিছু বলতে দেবে না। আমি বললাম, তোমাকে যে মারছে?
মা এবার একটু কঠিন স্বরেই বললেন, সে আমি বুঝবো। তুমি যাও।
বাবা বললেন, যেমন চরিত্রহীন মা। তেমনই তো হবে ছেলে। মনে করেছিস আমি বুঝি না। এই ছেলে আমার না। সেটা আমি শুরু থেকেই জানি।
মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, তুমি এসব কী বলছো? তোমার জন্য আমি বাপের বাড়ীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম। ভুলে গেছ সেসব দিনের কথা।
ঃ ছাড় মাগী, তোর সব ন্যাকামো আমার বোঝা হয়ে গেছে। কার সাথে কী করিস জানতে আর বাকী নেই।
আমি ততক্ষণে আবার পাশের ঘরে চলে এসেছি। মার নিচু স্বরের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমার কী করা উচিৎ বুঝতে পারছি না। বাবার এরকম আচরণ আমি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়েনা। দু’জনের ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু এত বাজে কথা আর গালাগাল বাবার মুখে কখনো শুনিনি। একটু পরে বাবা হেলে-দুলে বেরিয়ে গেলেন। মা তখনও কাঁদছেন। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম।
মা বললেন, সজীব, তুই খুব কপাল পোড়া রে। বাবার ভালোবাসা কোনদিন তোর কপালে জুটলো না।
আমি চুপ করে থাকলাম।
মা আবার বললেন, এ বাসাটা আমাদের ছেড়ে দিতে হবে সজীব।
ঃ কেন?
ঃ তোর নতুন মা এখানে থাকবেন।
ঃ তাহলে আমরা কোথায় যাবো?
ঃ জানি না রে বাবা।
এক সপ্তাহের মাথায় আমরা শহরতলীর একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিলাম। মা সারাদিন বাসায় বসে কাগজের ঠোঙ্গা বানায়। আমি হোটেলে কাজের ফাঁকে-ফাঁকে সেগুলো বাজারের দোকানে গিয়ে বিক্রি করে আসি। তাতেও সংসার চলে না। দিনে শুধু একবেলা বাসায় রান্না হয়-রাতে। মা-ছেলে মিলে একসঙ্গে বসে খাই। আমি অবশ্য সকাল আর দুপুরে হোটেলে খেতে পাই। কিন্তু মা এই দু’বেলা কী খায় আমি জানি না। দিন-দিন তার শরীর শুকিয়ে যেতে থাকে। মাঝে-মাঝে ভাবি, আমার অনেক টাকা হলে মাকে রাজার হালে রাখবো। কোন কাজ করতে দেব না। কিন্তু কবে আমার অনেক টাকা হবে?
এখন আমি একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করি। বেতন হোটেলের চেয়ে কিছু বেশি। পরিবেশটাও ভালো। তবে পরিশ্রমও বেশি। একদিন রাতে কাজ শেষ করে বের হয়েছি। একটা লোক আমাকে পিছন থেকে ডাক দিল, এই ছেলে শোন।
আমি ফিরে তাকালাম। প্যান্ট-শার্ট পরা একজন ভদ্রলোক। আশেপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম, তিনি আমাকেই ডাকছেন। এগিয়ে গেলাম। বললাম, কিছু বলছেন?
ঃ তোমার নাম সজীব?
ঃ হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
ঃ তোমার মায়ের নাম জাহানারা? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তিনি আবারও জানতে চাইলেন।
ঃ হ্যাঁ। কেন বলেন তো?
ঃ না এমনিতেই। কোথায় থাকো তোমরা?
ঃ কুনিপাড়ার তিন নম্বর গলির শেষ মাথায়।
ঃ জাহানারা, মানে তোমার মা কেমন আছেন?
ঃ ভালো। কিন্তু আপনি কে?
ঃ আমি...আমি তোমার মায়ের পূর্ব পরিচিত।
ঃ ও। কী নাম আপনার?
ঃ নাম শুনে কাজ নেই। শোন এই ৫০০টাকা রাখ।
ঃ কেন? আপনি আমাকে টাকা দেবেন কেন?
ঃ মনে করো, আমি তোমার একজন আত্নীয়। টাকাটা রাখ।
ঃ না। আমি টাকা নেব না।
ঃ বাব্বা, মায়ের মতোই স্বভাব হয়েছে। ঠিক আছে টাকা নিয়ো না। তবে আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে। বলেই উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো লোকটা।
বাসায় ফিরে মাকে ঘটনাটা বললাম। মা সাবধান করে বললেন, ছেলেধরারা নাকি নানারকম ছলচাতুরি করে ছোটদের প্রলুব্ধ করে। তারপর ধরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। অথবা কিডনি-চোখ এসব তুলে নিয়ে মেরে ফেলে। শুনে আমার বেশ ভয়ই লাগলো। ছেলেধরার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে লোকটা কার্যকলাপের অনেক মিলও পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কোনদিন দেখা হলে কথা না বলে ঝেড়ে দৌড় দিতে হবে। আর তারপরও যদি পিছু নেয় তাহলে চিৎকার করে লোক জড়ো করবো।
আজ শুক্রবার। সপ্তাহে এই একটা দিন আমার কাজ থাকে না। তা বলে যে দিনটা খুব আনন্দে কাটে তাও নয়। আসলে আমার তো কোন বন্ধুবান্ধব নেই। তাই সারাদিন বাসায় বসে থেকেই কাটাই। আজ হঠাৎ মনে হলো, রাণীর কথা। অনেকদিন ওদের বাসায় যাই না। মাঝে দু’দিন গিয়েছিলাম। তবে ওর বাবা উপস্থিত থাকায় রাণী তার ভয়ংকর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলেনি। বিকেলের দিকে রাণীর বাসায় গিয়ে দেখি, ও একা-একা খেলছে। অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কোন কথাই বলল না। একপর্যায়ে আমি বললাম, রাণী আমি তাহলে যাই।
ঃ কোথায় যাবে?
ঃ বাসায় ফিরে যাই।
ঃ এসেছিলে কেন?
ঃ এমনিতেই। ভাবলাম তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই।
ঃ তাহলে যেতে চাচ্ছ কেন?
ঃ না মানে, দেখা তো হলোই। আর তুমিও বোধহয় ব্যস্ত।
ঃ তুমি একটা বুদ্ধু। বেশ জোর দিয়ে শব্দ তিনটি উচ্চারণ করলো রাণী।
ঃ কেন? কী করলাম আমি?
ঃ তুমি আসো না কেন?
ঃ আমি তো এক জায়গায় চাকরি করি। ইচ্ছে করলেই আসা যায় না। তাছাড়া আমার অনেক ঝামেলা।
ঃ কী তোমার ঝামেলা?
ঃ সেসব তুমি বুঝবে না। আচ্ছা তুমি যে বলেছিলে তোমার বাবাকে কী যেন শাস্তি দেবে। সে ব্যাপারে তো কিছু বললে না।
ঃ বলবো না। আমার মন খারাপ।
ঃ কী হয়েছে তোমার?
ঃ বাবা বকেছে।
ঃ কেন, কী করেছ তুমি?
ঃ আমি বাবাকে বলেছিলাম, তোমাকে আমাদের বাসায় রাখতে।
ঃ মানে? আমি তোমাদের বাসায় কেন থাকবো?
ঃ বাবা বলেছে, তুমি অনেক গরীব। তোমার থাকার জায়গা নেই।
রায়হান সাহেব একথা বলেছে শুনে আমি অবাক হলাম। আমি গরীব ঠিকই। তাই বলে থাকার জায়গা নেই এমন তো নয়। আমি বললাম, আমার থাকার জায়গা আছে রাণী।
ঃ তবু তুমি এখানে থাকবে। আমার সঙ্গে খেলবে।
ঃ বোকা মেয়ে। তাই হয় নাকি?
ঃ বাবাও তো সেকথাই বলছিল। বলে, আমি নাকি কিচ্ছু বুঝতে শিখিনি।
ঃ এজন্য তোমাকে বকা দিয়েছে?
ঃ হ্যাঁ। কিন্তু আমি বোকার মতো কী বললাম, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
ওর কথা শুনে আমার মজাই লাগল। বুঝলাম, বাইরের নিষ্ঠুর দুনিয়া আমাকে এই বয়সেই বাস্তবমুখী করে তুলেছে। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে তা হয়নি। রাণী হঠাৎ দৌড়ে পাশের ঘরে গেল। একটু পরই একটা প্লেটে দু’ খণ্ড পুডিং নিয়ে হাজির। আমাকে বলল, পুডিং আমার পছন্দের খাবার। তোমার ভালো লাগে?
ঃ লাগে।
ঃ আমারও তাই মনে হয়েছিল। এজন্য তোমার জন্য পুডিং রেখে দিয়েছি।
ঃ আমার জন্য?
ঃ হ্যাঁ। নাও খাও।
কথা না বাড়িয়ে আমি পুডিং খেলাম। বেশ সুস্বাদু। খাওয়া শেষ হলে জানতে চাইল, কেমন লাগল? আমি বানিয়েছি।
ঃ কী? তুমি পুডিং বানাতে পারো? আমি সত্যি বিস্মিত হলাম।
ঃ কেন আমাকে দেখে মনে হয়, শুধু পুতুল খেলি?
ঃ না ঠিক তা নয়। তবে তুমি এত ছোট মানুষ।
ঃ মোটেই ছোট না। আমার বয়স ১০ বছর।
ঃ ও মা তাই নাকি? আমি বড়দের মতো করে বললাম।
‘দাঁড়াও’ বলেই আবার দৌড়ে ভেতরে গেল রাণী। ফিরে এলো হাতে বড় একটা ছুরি নিয়ে। জানতে চাইলো, কেমন ছুরিটা?
ঃ ভালো। কিন্তু এটা দিয়ে কী হবে?
ঃ জবাই করবো।
আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী জবাই করবে তুমি?
‘তোমাকে’-বলেই আমার দিকে একধাপ এগিয়ে এলো রানী। আমি আতঙ্কিত হয়ে পায়ে-পায়ে পেছাতে শুরু করলাম। এসময় কে যেন পেছন থেকে আমার দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে ফেলল।
[ক্রমশঃ]
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১২ রাত ৩:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




