[প্রিয় পাঠক, এবার তৃতীয় পর্ব। কিছু সময় আগে এটি পোস্ট করা হয়েছিল। তবে সামান্য কিছু সংশোধনী থাকায় আবারো পোস্ট করা হলো। আপনাদের সুচিন্তিত মন্তব্য আমার লেখাকে উৎসাহিত করবে।]
আমি আতঙ্কিত হয়ে পেছনে ফিরে দেখি রায়হান সাহেব। তিনি কখন এ ঘরে এসেছেন লক্ষ্য করিনি। আমার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বললেন, কী ব্যাপার এভাবে পেছনে হাঁটছ কেন? পড়ে গেলে আঘাত পাবে যে। এরপর মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ছুরি নিয়ে খেলা করা ঠিক না মামনি। রেখে দাও। নাহলে হাত কেটে যেতে পারে।
রাণী বাধ্য মেয়ের মতো তার নির্দেশ পালন করল। কীসব দরকারি কাগজপত্র নিয়ে একটু পরই বেরিয়ে গেলেন রায়হান সাহেব। রাণী আবার আমার দিকে ছুরি উচিয়ে বলল, তুমি একটা ভীতুর ডিম। মজাও বোঝ না।
আমি বললাম, তুমি বরং ছুরিটা রেখেই আসো রাণী। একথা শুনে রাণী খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর ছুরিটা ভেতরের ঘরে রেখে এসে বসল আমার কাছে।
আমি বললাম, তুমি স্কুলে যাও না কেন বললে নাতো?
ঃ বাবা যেতে দেয় না।
ঃ কেন?
ঃ ওই যে, যদি আমি স্কুলে গিয়ে কাউকে মায়ের খুন হওয়ার ব্যাপারটা বলে ফেলি।
ঃ এটা কোন কথা হল? তাই বলে স্কুলে যেতে দেবে না? জানো, আমার না খুব স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে।
ঃ তো যাও না কেন?
ঃ আমার যে কাজ করতে হয় রানী। নাহলে যে খাবার জুটবে না। আমার তো মা ছাড়া আর কেউ নেই।
ঃ তোমার খুব কষ্ট না?
ঃ না। কিসের কষ্ট? এখন আর আমার কোন সমস্যা হয় না। তবে প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। এর আগে কখনও এরকম অবস্থায় পড়িনি তো। বাদ দাও। তাহলে তুমি পড়াশোনা একেবারেই করো না?
ঃ করি তো। বাবা আমাকে সকালে আর রাতে পড়ান।
ঃ ওমা, এভাবে পড়া হয় নাকি?
ঃ কেন হবে না? আমি তো কাস থ্রি পর্যন্ত সব বই পড়ে ফেলেছি। সব অঙ্ক করতে পারি।
ঃ বেশ তো। তোমার বাবা তোমাকে মারেন না?
ঃ না, কনো না।
ঃ তাহলে তো খুবই ভালো মানুষ। তাকে তুমি শাস্তি দিতে চাও কেন?
ঃ না ভালো না। আমার মাকে মেরে ফেলেছে।
ঃ তুমি নিজের চোখে দেখেছ?
ঃ হ্যাঁ দেখেছি।
ঃ কী দেখেছ শুনি?
রাণী বর্ণনা শুরু করল, তিন-চার বছর আগের কথা। তখন আমি অনেক ছোট। কিন্তু সেদিনের ঘটনা আমি কোনদিনই ভুলব না। সকাল থেকেই বাবা-মার মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল। তাই আমি মার কাছে যেতেও পারছিলাম না। প্রতিদিন দুপুরে মা আমাকে খাইয়ে দিত। সেদিন কাজের লোকের হাতে আমাকে খেতে হল। বিকেলে খেলতে-খেলতে আমার বোধহয় একটু ঘুম ধরেছিল। হঠাৎ মার চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রথমে ভাবলাম, বোধহয় স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছি। কারণ আর কোন শব্দ নেই। একটু পরই আবারও মার গোঙ্গানির মতো আওয়াজ পেলাম। ওঘরে ছুটে গিয়ে দেখি, মার মুখে বাবা বালিশ চেপে ধরে আছেন। আর মা দুই হাতে সেটা সরানোর চেষ্টা করছেন। আমি এ দৃশ্য দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। কী করব বুঝে ওঠার আগেই মা বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এসময় আমি ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। আমি পেছনে থাকায় বাবা এতণ আমাকে দেখতে পায়নি। এবার বাবা দ্রুত আমাকে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, তোমার মার শরীর ভালো না। এখন ওঘরে যেও না। আমি এখনই আসছি। ১৫/২০ মিনিট পর মার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাবা। তাকে অনেক কান্ত দেখাচ্ছিল। এরপর বাবা আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলেন। একটা দোকানে থেমে আমাকে অনেকগুলো চকলেট কিনে দিলেন। ফেরার পথে বাবা বলল, তোমার মা খুবই অসুস্থ। মনেহয় বাঁচবে না। আমি বললাম, তাহলে তাড়াতাড়ি চলো বাসায়। মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। বাপ-বেটি মিলে এরপর দ্রুত বাসায় ফিরলাম। কিন্তু মার ঘরের দরজা খুলে দেখি, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে মার শরীরটা ঝুলছে। তখনই আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম বাসায় অনেক পুলিশ। তারা বাবাকে নানারকম জেরা করছে। আমাকেও একজন জিজ্ঞেস করল, আমি বাবার সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলাম কিনা? ফিরে কী দেখলাম ইত্যাদি।
ঃ তারপর কী হলো? জানতে চাইলাম আমি।
ঃ কিছুই হলো না। পুলিশ কী যেন পরীক্ষার জন্য মার লাশ নিয়ে গেল হাসপাতালে। পরদিন মাকে কবর দেওয়া হলো। পুলিশ আরও কয়েকদিন আমাদের বাসায় যাতায়াত করল। তারপর সব আগের মতোই। শুধু মা নেই।
ঃ কিন্তু তাহলে তোমার বাবার দোষটা কোথায়?
ঃ আরে, তুমি তো দেখি বড্ড বোকা। অবশ্য আমিও তখন বুঝতে পারিনি। আমাকে পরে বুঝিয়ে বলেছে বুম্মা।
ঃ বুম্মা কে?
ঃ আমাদের বাসায় একজন মহিলা তখন কাজ করত। তাকে আমি বুম্মা বলে ডাকতাম। পরে বাবা তাকে ছাড়িয়ে দেয়।
ঃ ও। তা বুম্মা তোমাকে কী বলল?
ঃ বুম্মা বলল, বাবা বালিশ চাপা দিয়ে মাকে মেরে ফেলেছে। পরে বাবাই লাশটা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। এটা ছিল বাবার কৌশল।
ঃ বুম্মা সেকথা কী করে জানল?
ঃ তখন তো বুম্মা বাসায় ছিল। পরে আমারও মনে হয়েছে, বুম্মা ঠিক বলছে। কারণ অসুখ হলে মা গলায় ফাঁস দিতে যাবে কেন? আর বাবা আমাকে সেই থেকে মিথ্যে কথা শিখিয়ে রেখেছে। বাইরের কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে মা আমার জন্মের সময়ই মারা গেছে।
ঃ সেটা যদি হয়ও, তারপরও উনি তোমার বাবা। তোমাকে তিনি অনেক আদর করেন, তাইনা?
রাণী কোন জবাব দেয় না। বোঝাই যাচ্ছে, আমার কথা তার পছন্দ হয়নি। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে? অসুখ কি কমেছে?
ঃ আমি তো ভালোই আছি। এক সপ্তাহ পর পর রক্ত পরীক্ষা করে দেখছে ডাক্তার। কী যে হলো, বাবা তো কিছু বলে না।
ঃ চিন্তা করো না। তাহলে নিশ্চয়ই সব ভালোই আছে। আজ আসি তাহলে।
ঃ আহা বসোই না। তুমি থাকলে আমার খুব ভালো লাগে। আমরা বড় হলে দু’জন একসঙ্গে থাকব, আচ্ছা?
ঃ কেন একসঙ্গে কেন?
ঃ আমার ইচ্ছা।
ঃ তাহলে তুমি কি আমার বাসায় থাকবে?
ঃ না। তুমি এখানে এসে থাকবে। আমাদের বাসায় তো থাকার লোকজন নেই।
ঃ তোমার বাবা যদি থাকতে না দেয়?
ঃ তাহলে আমি তোমার বাসায় চলে যাব।
ঃ বাব্বা, মেয়ের সাহস দেখি ভালোই!
ঃ হ্যাঁ আমার অনেক সাহস। জানো, কাল একটা তেলাপোকা মেরেছি। রান্নাঘর থেকে বের হয়েছিল। আমি ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। কাজের মেয়েটা যা ভীতু না। ও তো চেচামেচি শুরু করে দিয়েছিল তেলাপোকা দেখে।
আমি মনে মনে হাসি। সামান্য তেলাপোকা নিয়ে এত কাণ্ড। আমাদের ঘরে মাঝেমধ্যে বিচ্ছু পর্যন্ত বের হয়। আসলে জীবন আমাকে এমন যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছে, এখন বোধহয় সামনে বাঘ এলেও ভয় পাব না। কিন্তু রাণী তো আর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। ওকে বললাম, তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে। রাণী কিছু না বলে একটু হাসল। বড় নিষ্পাপ আর সুন্দর সে হাসি।
‘আমি যাই তাহলে-’ বললাম আমি।
ঃ আবার কবে আসবে?
ঃ দেখি সুযোগ পেলেই চলে আসব।
ঃ কচু। তুমি এখানে আসতে ইচ্ছেই করে না। তাই না?
ঃ ওমা, তা কেন হবে। আমি তো নিজের ইচ্ছাতেই আসি।
ঃ ঠিক আছে যাও। তাড়াতাড়ি না আসলে কিন্তু...। কথাটা শেষ করল না রাণী।
ঃ কিন্তু কী? জানতে চাই আমি।
ঃ সামনের বার আসলে আর যেতে দেব না।
ঃ পাগলী। আচ্ছা গেলাম।
ঃ অ্যাই শোন-শোন, বাবাকে শাস্তি দেওয়ার একটা বুদ্ধি বের করেছি। তোমাকে তো বলাই হলো না।
ঃ আরেকদিন শুনব রাণী। এখন বাসায় না গেলে মা চিন্তা করবে।
রাণী এবার মাথা দুলিয়ে সায় দিল। আমি বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
নতুন উপন্যাসের শুরু-তৃতীয় পর্ব (সংশোধিত রিপোস্ট)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মৌলবাদ: ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ প্রযুক্তি

মজার বিষয়—
আজকের মৌলবাদীরা রোকেয়া বেগমকে মুরতাদ ঘোষণা করে বুক ফুলিয়ে হাঁটে, অথচ নিজেদের অস্তিত্ব টিকেই আছে যাদের ঘৃণা করে— সেই “কাফেরদের” বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে। ইতিহাস পড়লে এদের বুকফুলা হাওয়া বের... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতী এখন পুরোপুরিভাবে নেতৃত্বহীন ও বিশৃংখল।

শেরে বাংলার নিজস্ব দল ছিলো, কৃষক প্রজা পার্টি; তিনি সেই দলের নেতা ছিলেন। একই সময়ে, তিনি পুরো বাংগালী জাতির নেতা ছিলেন, সব দলের মানুষ উনাকে সন্মান করতেন। মওলানাও জাতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
সাময়িক পোস্ট

ওসমান হাদী অন্যতম জুলাই যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, স্পষ্টবাদী কণ্ঠ, প্রতিবাদী চেতনা লালনকারী, ঢাকা ৮ নং আসনের নির্বাচন প্রার্থী আজ জুমুআর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদিকে গুলি করলো কে?
হাদিকে গুলি করলো কে?

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন
মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।