কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা প্রত্যেক মুসলমানদের চির চেনা এক উত্সব. আর বাংলাদেশে এই উত্সব জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মিশেগেছে. অনেক দিনের ইচ্ছা যে এর সম্পর্কে লিখব এবং তাই শুরু করলাম.
আসলে আমরা যারা ইটকাঠের শহরে বসবাস করি সেই সমাজের শিশুদের কাছে পশু-পাখির সাথে একাত্ততা হবার সুযোগ হয়না, যদিও হয় তাও আবার কদাচিত. কিন্তু যদি একবার হয়ে যায় তবে তা হয় আনন্দের. সেই দিক থেকে চিন্তা করলে সেই শিশুকাল থেকে যখন কিছু বুঝিনা ঠিক তখন থেকে কোরবানির ঈদ যতনা কোরবানির ত্যাগ বুঝি তার চেয়ে কোরবানির প্রস্তুতি মানে কোরবানির পশু খরিদ ও তার লালন-পালন এর ব্যাপারে খেয়াল থাকত, থাকেও বেশি. এর মূল কারণ হলো অবচেতন মনে ওই বিষয়টি চলতে থাকে.
এই জন্যই কোরবানির ঠিক ১৫ অথবা ৭ দিন আগে থেকেই খরিদ করবার পশুটির জন্য প্রহরগোনা এবং বাড়ির কর্তা ব্যক্তির কাছে বার বার ধরনা দেওয়া. এর সাথে কয়েকটি অতি পরিচিত প্রশ্ন করে কান ঝালাপালা করে দেওয়া তার মধ্যে যেগুলো বিদ্যমান: ১. যে আব্বু/আম্মু আমাদের গরু/ছাগলটা কবে কেনা হবে? ২. আমি কি তোমাদের সাথে হাটে যাচ্ছি নাকি ? ৩. আমদেরটা কত বড় হবে ? ৪. কত দিয়ে কেনা হবে ? ৫. কোথায় রাখা হবে? ইত্যাদি. যার ফলে আমার বাবা যার পরনাই অত্যন্ত রেগে যেত এবং গরু কোথাকার বলে গালি দিত. যাই হোক আমরা কি আর বুঝি যে সারা মাসের খেরো খাতা শেসে সব মিলিয়ে অবশিষ্টাংশে কোরবানির হিসাব মিলানো যে কতটা কঠিন ?! তারপর ও যেহেতু কোরবানী দিতেই হবে ওয়াজিব অনুসারে তাই ঠিক ঈদের ২/৩ দিন, অনেক সময় চাদ রাতে কিনতে যেত আমাকে নিয়ে.
যাই হোক হাটে যাবার পর আমার যত স্মৃতি আছে আমি শুধু তন্ময় হয়ে দেখতাম আমার বাবা আর খালুর দর কষাকষির ও পশু নির্বাচনের পদ্ধতি. কোরবানির হাটে পশুর দামাদামিটা যে একটা শিল্প তা দেখে আমি প্রায় মুগ্ধ হয়ে যেতাম. কোনো সময় বেপারীর কানে, কখনো হাতে আঙ্গুল দেখিয়ে, চা-ঝাল মুড়ি খাইয়ে, মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে বা ফাকা কোনো স্থানে নিয়ে দাম বলা এই সব আমি তাদের কাছ থেকেই শিখি! তার উপর হাসিল কমানোর জন্য বেপারী কে হাসিল ঘরে দাম কমিয়ে বলতে বলা তো এক অবাক জিনিস !
পশুটি কেনার পর রাস্তায় নিয়ে যাবার সময় দাম বলাটা তো গলা ব্যাথা হবার প্রধান কারণ !
*** এখানে কয়েকটা ঘটনা আমি উল্লেখ করছি:
১. রিয়েল স্টিল বলদ! :
শুনে যা মনে হবে তারচেও অবাক আমি হয়ে গিয়ে ছিলাম আমি দেখে, ইন্ডিয়ানরা যে স্টিলের রোবট বলদ চাষ করে জানা ছিল নাহ! সময়টা প্রায় ৭-৮ বছর আগে গাবতলীর হাটে যাবার সময় দেখি হটাত ৮-৯ ফিট উচা বলদ রাখালের হাত থেকে ছুটে গেল এবং রাস্তার উল্টা দিকএর ডান থেকে ছুটে আসছে সামনা সামনি একটা ৭ নম্বর বাসের সাথে সরাসরি ধাক্কা ! আমরা মনে করলাম যে বলদ শেষ ! এর মধ্যে বাস কিন্তু ভয়ে সাথেসাথে ব্রেক করে, কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলদ আবারও দুরন্ত গতিতে ছুটছে ! যেখানে বাসের উইন্ডশিল্ড পুরো ভেঙ্গে গ্যাছে!
২. মাইক্রোবাসে করে গরু আনা!:
জি! এই অবাক করা কান্ড তা ঘটায় আমার বাবা নিজেই, তা ১৯৯৩-৯৪ সালে আমি তখন ৪-৫ বছর, আমাদের দোকানের কাজে ব্যাবহৃত মাইক্রোবাসে করে আমাদের সেবারের গরু আনা হয়, আমার মনে আছে আব্বু সকাল ১০টায় গাবতলীতে যায় গরু কিনতে কিন্তু যখন দুপুর ২ টায় যখন শুন্য হাতে ফিরে আম্মুকে বলে যে গরু কিনেছি তখন আম্মু ও আমি বলি কই ?! আব্বু বলে গাবতলীতে ! মানে ?! এর পর সে বলতে সুরু করে যে সে একটা অস্ট্রেলিয়ান গরু কিনেছে এবং তা এতটাই দুর্বল যে তিনটা দড়ি ছিড়ে পালিয়ে কই আছে সে জানে না তবে আসে পাশের কোনো এলাকায় আছে সেটা সিওর ! আমরা বললাম এখন কি করবে ! আব্বু বলল যে আমাদের সব কর্মচারীদের সেখানে লাগিয়ে রেখেছি তারা খুঁজে পেলে ফোন করবে ! এসবশুনে আরো অস্থির ! বেলা ৩ তার দিকে ফোন আসলো যে, “স্যার গরু পাইসি গরু পাশের এক ডোবায় নেমে কচুরি পানা খাচ্ছে” ! সাথে সাথে আব্বু এক অবাক করা প্লান করে ফেলল যে এই গরু কে অক্ষত অবস্থায় আনতে গাড়ির বিকল্প নাই আর সেটা হবে আমাদের মালামাল আনবার মাইক্রোবাস ! যাই হোক রাত ৮ টায় দেখলাম এক অবাক কায়দায় বাসার সামনে মাইক্রোর পেছন থেকে ১০-১৫ জন লোক মিলে এক গরু কে নামাচ্ছে যেটার সারা সরীরে দড়ি আর দড়ি !
৩.অগ্নি মূল্যের খেসারত:
সময়টা ১৯৯৮-২০০০ সালের হবে সেবার গরুর দাম একে বারে আকাশে চড়ে গিয়েছিল, ঈদের দুইদিন আগে আব্বুর মুখে শুনছি গরুর খুব দাম যাচ্ছে, এভাবেই যাচ্ছে, আগের দিন সকালে খালু আর আব্বু হাটে গেল কিন্তু দুপুরেই দুজন শুকনো মুখে ফিরল কারণ তারা যে বাজেট নিয়ে গিয়েছিল তাতে হয়নি! পড়ে সন্ধায় বাজেট বাড়িয়ে আরো একজন শরিক নিয়ে সেই প্রথম একটি গাভি নিয়ে আসে! আমরা তো পুরা চুপ! পরে ঘটনা শুনি প্রতিটি হাটে গরু প্রতি ক্রেতা ছিল ১০-১৫ জন, গাবতলীতে মাত্র ১০০০ টির মত গরু ছিল ! উপায় না পেয়ে তারা গাভি কিনে! সেই বাচ্চা সহ গাভি কোরবানী করেও আরেক বিপত্তি সেই বাছুর সহ কোরবানী করা! সেবার শুনেছি অনেকে ছোট খাটো বাছুর বিক্রি করেও অনেকে লাভবান হয়েছিল !অন্যদিকে অনেকই সেবার কোরবানী দিতে পারে নাই! সেই থেকে কোনোবারই চাদ রাতে গরু কিনতে যাই নাহ আর অস্বাভাবিক দাম কমলে পৈচাশিক আনন্দ-কষ্ট দুইটাই পাই !
এরপর শুরু হয় আমার নিজ দায়িত্ব: গরুর সার্বিক লালন-পালন নিজহাতে করা! ফলে সারাদিন শেষে সন্ধায় বাসায় ফেরা সাথে নোংরা জামা কাপড় যাকিনা পিওর গরুর গন্ধ যুক্ত. এইসবের জন্য কত যে কথা শুনতে হয়েছে যেমন: তুই একটা আস্ত গরু, রাখাল হবি নাকি?, তোকেও গরুর সাথে বেধে রাখি যা গিয়ে রাতে গরুর সাথে থাক. ইত্যাদি .
চাদ রাতের কম্পিটিসন মানে কার গরু কত বড়?কত দামী গরু কেনা হয়েছে ?! কে কত জিতলো বা হারল? ইত্যাদি! এগুলা যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক আনন্দ ও মনোযোগের সাথে করতাম. এখন মনে হয় কিছু জিনিস যেমন ১. দাম জিগ্যেস করা, ২.বেশি দামের গরু কেনার প্রবণতা, ৩. বড়–ছোট গরুর তুলনা, ৪. অতিরিক্ত দেখানোর জন্য পশুটিকে সাজানো, ৫. কে জিতলো কে হারল তুলনা, এইসকল জিনিস সব হচ্ছে পুজিবাদী সমাজের বৈশিষ্টই নয় বরং আসল কোরবানী থেকে অনেক দূরে এসে লোক দেখানো ! যা কিনা আল্লাহ না করুন আমাদের কোরবানীটি যেন অকবুল না থেকে যায় !
এর পর আসি ঈদের দিনে একদিনের এক্সপার্ট কসাইয়ের পারদর্শিতায়! স্যার ১.৫-২ ঘন্টায় সাইজ করে দিব, স্যার ১২ টায় আপনি বাসায় মাংস খাবেন, স্যার আপনারটা ৩ নম্বর সিরিয়ালে হলেও ১২ টায় মাংস রেডি থাকবে, স্যার হাজারে কত দিবেন?! এইসব করতে গিয়ে পুরা দিন শেষ করে নিজেরাই সাইজ হয়ে যায় ! গরু ঠিকমত ফেলার জন্য বানতেই পারে না ফেলবে কি ?! গত বারের ঈদে আরেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গরু ফেলার সময় আমাদের হেড কসাই নিজেই পরে যায়. পরে এক্সরের খরচ ও আমাদের দিতে হয়, বোঝেন অবস্থাটা !
এবার আসি মৌসুমী চামড়া ব্যবসাইদের দৌরত্তে! এই ব্যবসায়ীরা এত টাই যন্ত্রণা করে যে তাদের যন্ত্রনায় টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে! কারণ এরা একে তো ঠকানোর ধান্দায় থাকবে তার উপর জালাতন করবে কখন তাকে এবং অবস্যই তাকেই যেন চামড়াটা দেওয়া হয়! পারলে যেন আমার অকোরবানীকৃত পশুর চামড়া টাই নিবে আর নইলে আমারটা নিবে! কিছু এলাকায় এই চামড়ার ভাগাভাগি নিয়ে লাগে মারামারি, আমি ছোট বেলা থেকে এই চামড়ার ব্যবসা নিয়ে অনেকবার কোপাকোপি ও গোলাগুলি তে আহত নিহত হতে দেখেছি!
শেষে আসি মাংস বিলানোর বিরক্ত নিয়ে! একবার যদি মিসকিনেরা টের পায় যে আপনি মাংস বিলাচ্ছেন তাহলেই হয়েছে! একেবারে আপনার বাইরের গেট ভেঙ্গে পারলে পাচিল ও ভেঙ্গে ফেলে ! যাহোক আপনার সখের ঈদের পাঞ্জাবি ছিড়ে অতি কষ্টে মাংস বিলিয়ে যখন একটু ক্লান্তি কাটাতে বাইরে হাটতে বেরোবেন তখন দুইটা বিরম্বনায় পরবেন, একটি হলো গলি বা বড় রাস্তার মোড়ে ওই যাদের আপনি মাংস দিয়েছেন তাদের মাংস বিক্রির হিরিক দেখে! এগুলা অনেকে আবার কিনে নেয়! আরেকটি হলো চারিদিকে দমআটকানো কোরবানির বর্জের দুর্গন্ধ! সাথে দুদিন যেতে না যেতেই ফ্রি ফ্রি মশাত বেড়ে যাবেই !
এই তরুণ বয়সে এসে কেউ আর হাটে যাওয়া আটকায় না, আব্বু নিজেই বরং ডেকে নিয়ে হাটে যায় ! এখন সত্যি গন্ধর জন্য গরুর কাছে থাকতে ভালো লাগে নাহ, কাউকে বলাও লাগে না বরং ঠিক সময়ে গরু চলে আসে ! না চাইলেও আমাকে নিজ দায়িত্তেই গরুর কেনা থেকে শুরু করে কোরবানির পরেও কি হবে সব দেখতে হয় ! সময় আসলে কিভাবে দ্রুত পরিবর্তন হয় তাইনা !? কিন্তু হাট প্রীতির তৃষ্ণা তো আর মেটেনা, কিন্তু একদিন হটাত করে “ফেসবুকে গরুর হাট” গ্রুপ এর সদস্য হলাম আর এর পর নোতিফিকেসনের জালায় আর বাচিনা !
পরিশেষে বলতে চাই এটা একান্তই আমার নিজের এত বছরের জমানো অভিজ্ঞতা. কোরবানী করবেন উত্তম কিন্তু যেন তা কোরবানির পবিত্রতা রক্ষা করে আমরা সম্পন্ন করি. আমার অভিজ্ঞতার সাথে হয়ত অনেকের মিলে যেতেই পারে যা কিনা খুব সাভাবিক শহরবাসীদের জন্য. আমাদের সবার কোরবানী যেন মহান আল্লাহর নিকট কবুল হয়. সবাইকে আমার পক্ষ থেকে ঈদ মোবারক.
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩০