somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাকপিয়ন, কবে তোমার ছুটি ?? ( যত সব হারিয়ে যাওয়া -২ )

২৮ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বালকের পিতা গম্ভীর মুখে তার সামনে বসে আছে । বালকের মুখও ততোধিক গম্ভীর । বিষয় গুরুতর । আজ বালক পত্র লিখা শিখবে । প্রথম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে নানির নিকট পত্র । বালকের পিতা চোখ বুজে বলে যাচ্ছেন, স্রদ্ধেয় নানি প্রথমে আমার সালাম নিবেন, বালক একমনে লিখে যাচ্ছে। তখনও সে জানেনা এই চিঠি লিখতে লিখতে তার ভিতরে চিঠির প্রতি জমে যাচ্ছে আজন্ম অনুরাগ।

গল্পটা আমার । কিন্তু হয়তো সবারই চিঠি লিখা শুরু হয় এইভাবেই , খুব কাছের কাউকে কোনও খবর জানাতে । কিংবা কারও কারও শুরু হয় প্রেমপত্র দিয়ে । আহ প্রথম প্রেমপত্র ! বুকের ভিতর সব মরা ঘাসের ভিতরেও এক টুকরা কোমল প্রজাপতি হয়ে বেঁচে থাকে প্রথম প্রেমপত্র । অবশ্য আমার প্রথম প্রেমপত্র লিখার অভিজ্ঞতা খুব বেশী সুখকর না । এক বন্ধুকে পচানোর জন্য নাম লুকিয়ে প্রেমপত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম তার স্কুল ব্যাগে । চিঠি পেয়ে তো বেচারা বাকবাকুম , কে তাকে চিঠি পাঠালো এই ভেবে সারাক্ষণ রঙ্গিন কল্পনায় বিভোর । কিন্তু এতো সুখ কপালে সইল না, ধরা পড়ে গেলো আঙ্কেলের হাতে । আঙ্কেল গাছের দাল ভেঙ্গে তাড়া করলেন আমার সেই বন্ধুটিকে! সে কি কান্ড! বন্ধুকে বাঁচাতে স্বীকার করতে হল চিঠি আমার লিখা । তারপর সে বন্ধুটার সাথে যে মারামারিটা হয়েছিলো তা আর বলার নয় । আর প্রথম যে মেয়েটাকে চিঠি লিখেছিলাম সেটাও একটা উপাখ্যান । মেয়েটার বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি সামনে । বিকেলে ছাদে এসে দাঁড়ালে চোখে চোখ পড়তো কতবার । আর কোনোদিন রাস্তায় রিক্সার অপেক্ষায় দাঁড়ালে কথা হতো দু চারটে । একদিন এমনই কথার পর যখন সে রিক্সাই উঠে চলে গেলো, কি এক হাহাকারে ভেঙ্গে গেলো বুকের ভিতরটা । আগের দিনেও যে শুধুই একটা মেয়ে ছিল সেদিনের পর থেকে সে হয়ে গেলো বিকেল বেলার উদাসীনতা , সারাটা দিনের মেঘলা কবিতা । যখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম এই মেয়েকে ছাড়া বেঁচে থাকার কোনও কারনই নেই তখন আমিও হৃদয়ের আবেগকে শব্দগুচ্ছতে পরিনত করার চেষ্টা করলাম । যদিও খুব কম আবেগই ভাষা পেলো সাদাটে কাগজের উপর তবুও মনে হলো এর চেয়ে সুন্দরতম প্রেমপত্র কেউ লিখেনি কোনওকালে ! কিন্তু সেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ (!) প্রেমপত্রটি সর্বকালের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটির হাতে দেওয়ার সাহস করে উঠতে পারলাম না । তাই ডাকঘরে যেয়ে পোস্ট করে দিলাম । তারপরের কয়েকদিন আর বাসা থেকে বের হতে পারিনা । বের হলেই মনে হয় সবাই বুঝি আমার দিকেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ একদিন আমাকে হতভম্ব করে বাড়ি পরিবর্তন করে ফেলল তারা। মেয়েটার সাথে আর কথাও হলো না, চিরটাকালের মতো বন্দি হয়ে রইল স্মৃতির ফ্রেমে । জানাও হলো না মেয়েটা শেষপর্যন্ত চিঠিটা পেয়েছিলো কিনা ।


সবার কাহিনি নিশ্চয়ই এমন নয় । শুধু চিঠি দিয়ে প্রেম শুরু এমন গল্প আছে কতজনের জীবনেই , তা নিয়ে চলচিত্র উপন্যাসও কম হয়নি । শুধু চিঠি চেয়ে লিখা হয়েছে গান, চিঠি চেয়ে আর্তি করেছেন কবিরা । এখনকার দিনের ফেসবুক প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না, একসময় পত্রমিতালি করতে চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হতো পত্রিকায় । আর সেসব বিজ্ঞাপনেরও কি ভাষা, সুন্দর মনের সুশ্রী চেহেরার মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন ! বন্ধুত্ব করতে সুশ্রী চেহেরা কেনও লাগবে কে বলবে কিন্তু এইভাবেও বন্ধুত্ব হতো । একটা বন্ধুত্বর জন্য অনেক সময় ব্যয় করে মাথা খাটিয়ে লম্বা সব চিঠি লিখতে হতো বলেই কিনা এখনকার এক ক্লিকের বন্ধুত্বর চেয়ে তার আবেদন ছিল অন্যরকম । আর কখনও কখনও তা জন্ম দিতো বিচিত্র সব গল্প । যেমন, আমার এক মামার এক মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলো, মামা মেয়েটার ছবি চেয়ে পাঠালেন । মেয়েটা শুধু ডান চোখের ছবি পাঠাল । তারপরের চিঠিতে বাম চোখ। তারপর একটা একটা করে নাক ঠোঁট কান ভ্রু কপাল থুতনির ছবি পাঠিয়ে বললেন, এইবার সব জোড়া দিয়ে দেখে নাও!!! এরপর তার সাথে মামার প্রেম হয়ে যায় !

আর প্রেমের দিনগুলোতে চিঠি ছাড়া চলতই না । এক শহরে থেকেও চিঠি লিখা হতো, লিখা হতো প্রতিদিন দেখা হলেও । সব কথা বলার পরেও কিছু কথা একান্ত থেকেই যায় । সেগুলো কি আর চিঠি ছাড়া বলা যায় ! আর সে চিঠির জন্য অপেক্ষা ছিল এক অদ্ভুত যন্ত্রণা আর তীব্র আনন্দের । যে এই অপেক্ষা করেনি তার পক্ষে কোনোদিনও বোঝা সম্ভব না একটা চিঠি কত বিচিত্র অনুভূতিরই জন্ম দিতে পারে ! আমার এক বোনকে দেখতাম, যেদিন ওর ভালবাসার মানুষটির চিঠি আসতো মুখের রঙই বদলে যেতো । চিঠি আসার সাথে সাথে ও কখনই খাম খুলত না । ও বলতো, খাম খুললেই তো ফুরিয়ে গেলো ! আর যখন চিঠি পড়তো বারবার নাক লাগিয়ে কাগজের গন্ধ নিতো, স্পর্শ করতো অক্ষরগুলো ,চিঠি তো শুধু চিঠি নয় যেনও তার একটা অংশ চলে এসেছে ।


বিয়ের পরের দিনগুলোতেও চিঠির আবেদন ফুরাতো না । আব্বাকে দেখতাম যেদিন আম্মার সাথে ঝগড়া হতো অফিসে যাওয়ার আগে চিঠি লিখে একটা জায়গায় রেখে চলে যেতেন। আর আমি চুপি চুপি সে চিঠি পড়তাম । কেবল বানান করে পড়তে শিখেছি তখন, কিছুই বুঝতাম না প্রায় । আম্মা যখন গোপনে ছলছল চোখে আব্বার চিঠি পড়তো তখন আমি হাসি আটকাতে মুখের সামনে বই তুলে ধরতাম ! তবে চিঠি কখনও কখনও খুব বেদনাদায়ক ব্যাপারেরও জন্ম দিতো । আমার দাদার অসুস্থতার খবরের চিঠি আমার চাচার হাতে পৌঁছায় দাদার মারা যাওয়ার দিন! এমন মানুষকেও জানি যার কাছে চাকরির ইন্টার্ভিউর চিঠি গেছে তারিখ পেরুবার পর । কখনও কখনও হৃদয় ভাঙ্গার খবর এসেছে চিঠিতে । তবুও মানুষ চিঠির জন্য অপেক্ষা করেছে পরম আগ্রহে । নিস্প্রান সাদাটে কাগজের টুকরোতে বুনেছে বুকের গোপনতম নকশিকাঁথা । তাই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও পরম যত্নে রেখে দিয়েছে চিঠিগুলো । হারিয়ে যাওয়া কারও সবকিছু হারিয়ে গেলেও শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে কিছু চিঠি, খুব গোপন জায়গায় কিংবা অনেক হইচই এর ভিতরে!


আমার চিঠির প্রতি অনুরাগের কথা তো আগেই বলেছি । আমি নিজেও প্রচুর চিঠি লিখেছি। সবই বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের । আমার চিঠি লিখতে ভালো লাগতো তাই প্রতিটা চিঠিতেই অন্যরকম কিছু করার চেষ্টা থাকতো । একটা চিঠি যেনও আরেকটা চিঠির সাথে না মেলে । কিন্তু চিঠির বিনিময়ে আমি চিঠি পেয়েছি খুব কম! আমাকে বলতে গেলে হাতে গোনা ২/১ জন বাদে কেউই লিখেনি । আস্তে আস্তে আমিও লিখা ছেড়ে দিলাম । আমাকে সর্বশেষ চিঠি লিখেছিল এক প্রবাসী বন্ধু । লিখেছিলো, ইমেইল এসএমএস এর যুগে এখনও চিঠি পেতে কেমন অদ্ভুত লাগে । লিখেছিলো আরও, “তোর মনে আছে আমাদের হাতে ঘড়ি ছিলো না ?? কখন ক্লাস শেষ হবে বোঝার জন্য আমরা তাকিয়ে থাকতাম জানালা দিয়ে । ৪টা বাজার ঠিক আগে আগে সাইকেলে করে এক ডাকপিয়ন চলে যেতো রাস্তা দিয়ে । আমরা বুঝতাম এখুনি বাজবে ছুটির ঘণ্টা” । ও বড় অদ্ভুতভাবে শেষ করেছিলো, “ একদিন যাকে দেখে বুঝতাম কখন আমাদের ছুটি হবে, আজ কি সেই ডাকপিয়নেরই ছুটির ঘণ্টা বাজলো ??”



জানি কেউ লিখবে না আর । চিঠির বাক্সে জমবে না আর কোনও চিঠি । তবুও মনে হয়, কোনও মেঘ মেঘ দুপুরে ঘুম ভাঙবে ডাকপিয়নের ডাকে । তেল চিটচিটে পকেট থেকে বের হবে হলদেটে খাম । কোনও অদ্ভুত আবদারের চিঠি নিয়ে ।

ডাকপিয়ন, প্রিয় ডাকবন্ধু, তোমার ছুটি নাইবা হলো!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:২৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×