somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ চাঁদের বুড়ির মেয়ে

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দস্যি মেয়ে জিনাঃ

মেয়েটা কেমন যেন। একাকী, স্বাধীনচেতা। পৃথিবীর বুকে একা একা ঘুরে বেড়াতেই তার যত আনন্দ। অপরূপ সুন্দরী মেয়েটা রাত-বিরাতে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সমুদ্রে ডুব মেরে ঝিনুক কুড়িয়ে মুক্তো বের করে, খাড়া পাহাড় বেয়ে চূড়ায় উঠে মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ নেয়। অন্ধকার রাতে বাতাসে রিনিঝিনি করে ভেসে বেড়ায় তার পাগল করা হাঁসি। সে হাঁসি শুনে ভয়ে কেঁপে উঠে বনের মাঝ দিয়ে চলা কোন কাফেলা। ভাবে, এ বুঝি কোন ডাকিনী’র মায়াজাল।

আসলে সে কিন্তু এরকম কোন মায়াজালে ঘেরা মেয়ে নয়। জিনা চাঁদের বুড়ি’র একমাত্র মেয়ে। পৃথিবী’র রুপকথার সেই চাঁদের বুড়ি যে কিনা চড়কা কাটে সারা রাত ধরে। পৃথিবী’র মানুষের রূপকথা আর উপকথায় তো সেই রকমই লেখা আছে। বুড়ি চড়কা কাটে না ছাই, সে আসলে চাঁদের রাজার বোন। বিপদে-আপদে চাঁদের রাজা তারই শরণাপন্ন হোন। তখন তারা গুনে আর নক্ষত্ররাজির অবস্থান বুঝে রাজ্যের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেন জিনার মা- চাঁদের বুড়ি। আর, এই অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানবীকেই কিনা পৃথিবী’র মানুষ চড়কা কাটে বলে হেয় করে! সত্যিই এন্ড্রোমিডা, কি বিচিত্র এই পৃথিবী’র মানুষ!

চাঁদবাসীরাও কম যায় না। পৃথিবী’র মানুষকে নিয়ে প্রায়ই হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠে চাঁদবাসীরা। এ নিয়ে মজা করে ছড়া কাটে-
ওগো পৃথিবীর মানুষ,
উড়াচ্ছো কত ফানুশ।
বলছে চাঁদের বুড়ি,
‘ছাড়ো কথার ঝুড়ি।‘

চাঁদের বুড়ির অবশ্য এ নিয়ে কোন কষ্ট নেই। তার যত চিন্তা মেয়েকে ঘিরে। মেয়ের দস্যিপনায় অতিষ্ঠ তিনি। সারাদিনের বেশ খানিকটা সময় তাকে ব্যয় করতে হয় মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে। তার মৃত্যুর পরে জিনাকেই তো তার জায়গায় বসতে হবে। সেজন্যে শিখতে হবে অনেক কিছু। কোন নক্ষত্রের কোথায় অবস্থান, কোনটার প্রভাবে কি হয়, কোন ঔষধি গাছের কি গুণ, এসবই তো শেখা চাই। নাহলে চাঁদের মানুষ তাকে মানবে কেন। অথচ, সেই দিকে মেয়েটার কোন খেয়াল নেই। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, শুধুই ঘুরাঘুরি!

তাই একদিন, গোপনে মেয়ের খবর নেওয়ার জন্যে পৃথিবীতে ঝিঁঝিঁপোকা আর জোনাকি পাঠালেন চাঁদের বুড়ি। সেই ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো সারা রাত ঘুরে বেড়ায় জিনার পিছু পিছু। যখনই পৃথিবী’র বুকে নেমে এসে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় মেয়েটি, পোকাগুলো তার উপর গোয়েন্দাগিরি করে, নিঃশব্দে অনুসরণ করে বেড়ায় সব জায়গায়। বন ছেড়ে জিনা অন্য কোথাও চলে গেলে, বুনো ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে থাকা ঝিঁঝিঁপোকাগুলো একসাথে ডেকে উঠে। ঝিঁঝিঁ শব্দ করে চাঁদের বুড়িকে জানিয়ে দেয়-
‘তোমার চঞ্চল মেয়ে এখন আর এখানে নেই, চলে গেছে অন্য কোথাও’।

তখন জিনার পিছু নেয় জোনাকিগুলো। নদী-সাগর কি পাহাড়, যেখানেই সে যাক না কেন, জোনাকিগুলো তার পিছু নিবেই। মেয়েটাও কম যায় না। এই একুশ বছর বয়সেই মায়ের কাছ থেকে অদৃশ্যবিদ্যা শিখে নেওয়া জিনা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। তখন তাকে খুঁজে পেতে নিজের গায়ের আলো জ্বালিয়ে দিতে হয় জোনাকিগুলোকে। সেই আলো জ্বালিয়ে অন্ধকারে ইতি-উতি খুঁজে বেড়ায় তারা দস্যি মেয়েটিকে।

এভাবেই লুকোচুরি চলছিলো অনেক দিন ধরেই,। শেষে বিরক্ত হয়ে জিনা সিদ্ধান্ত নিলো একদিন, পালিয়ে যাবে। পালিয়ে এমন জায়গায় যাবে যেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া কষ্ট হবে। কোথায় যাওয়া যায়? অনেক ভেবে বের করলো, বাংলাদেশে যাবে। শুনেছে দেশটি মানুষে ভর্তি। এতো মানুষের ভিড়ে তাকে খুঁজে পেতে নিশ্চয় কষ্ট হবে মায়ের গোয়েন্দাবাহিনীর। আর, তাছাড়া, ঐ দেশটির মানুষগুলোও খুব সহজ-সরল। অপরূপ প্রাকৃতিক শোভার দেশটিতে নদী-নালা, পাহাড়-জঙ্গল সবই আছে। সেখানে গিয়ে তাই মজাই পাবে সে।

যেই ভাবা সেই কাজ। কোন এক অমাবস্যার রাতে বুড়ি মা যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, জিনা তখন পালিয়ে রওনা হয় বাংলাদেশের পথে। সাত সমুদ্র আর তেরো নদী’র উপর দিয়ে রথের ঘোড়াগুলোকে দাপিয়ে উড়ে যেতে থাকে দেশটির দিকে।

রাখাল ছেলে নাজঃ

সুরমা নদী’র ধার ঘেষে যে পথটি গেছে, তার কিছু দূরেই একটি জঙ্গল। আর এই জঙ্গল মতো জায়গা পার হলেই একটি হ্রদ চোখে পড়ে। তিন দিক পাহাড় ঘেরা এই জায়গাতেই ছাগল আর ভেড়া চড়ায় নাজ নামের এক রাখাল। সে ছিলো অতি সাধারণ একটি মানুষ। না আছে কারো সাতে, না আছে পাছে। এমনই ছিলো সে।

উঁচু পাহাড়গুলোর চড়াই-উতরাইগুলোতে ছাগল চড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বাঁশি বাজাতো নাজ। জীবনের চলার পথে এই বাঁশিটিই ছিলো তার একমাত্র বন্ধু ও সাথী। বাপ-মা হারা ছেলেটি বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ পেতো। ব্যস্ত শহুরে জীবন ফেলে সেই পাহাড়গুলোর কোলে ছুটে এসে ঝর্ণাধারা আর পাখ-পাখালীর গান তার বাঁশির সুরে ফুটে উঠতো।

সিলেট শহর থেকে বহু দূরে সেই চারণভূমিতে তার বাঁশির আওয়াজ কেউ শুনতে পেতো না। একাকী পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে আবার নাজের কাছেই ফিরে আসতো সুরগুলো। এ নিয়ে অবশ্য মনে কোন খেদ নেই তার। কি হবে মানুষকে শুনিয়ে যেখানে বনের পশু-পাখি তার শ্রোতা! সে যখন বাঁশি বাজাতো, গাছের পাখিগুলো চারপাশে এসে ভিড় করে বলতো-
‘কি সুন্দর বাঁশি বাজাও তুমি!’

তাদের এই প্রশংসায় খুশি হয়ে গানের সুর ধরতো নাজ। বাঁশি বাজাতে বাজাতে এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো গাছের ছায়ায়।
এভাবেই চলছিলো তার দিনকাল। কিন্তু, হঠাৎ করেই সব কিছু পাল্টে গেলো। নাজের শান্ত জীবনে শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়।

নাজের জীবনে জিনার আগমন

একদিন রাতে আনমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলো নাজ। তার বাঁশিতে তখন কাজী নজরুল ইসলামের ‘আজো মধুরও বাঁশরী বাজে’ গানটির সুর। সুরের ঝংকারে আকাশে-বাতাসে সে কি মিষ্টি এক আবেশ ছড়িয়ে পরেছে! ঐ সময়েই সেই জায়গার আকাশ দিয়ে নিজের রথে চড়ে উড়ে যাচ্ছিলো জিনা। কিছুক্ষণ আগেই মাত্র বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করেছে সে। নাজের বাঁশির অপূর্ব সুর এ সময়ে শুনতে পায় জিনা। ওটা কিসের সুর? এরকম মধুর সুর কে বাজাচ্ছে এতো রাতে?

অদৃশ্য রথ থেকে নিচের দিকে দৃষ্টি মেলে জিনা। তার মায়াবী চোখ জোড়া খুঁজে ফিরে শব্দের উৎস। সে দেখতে পায়, গাছে হেলান দিয়ে এক যুবক হাতে ধরা কোন কিছু দিয়ে এমন সুর বাজিয়ে চলেছে। সুঠাম দেহী, লম্বা চুলো যুবকটির দিকে চেয়ে কেমন যেন ঘোর লেগে যায় জিনার। এ কি গ্রীক কোন দেবতা? না তা হবে কেন! তারা এখানে আসবে কি করে! তাহলে নিশ্চয় বাংলাদেশেরই কোন মানুষ হবে ছেলেটি।

নিচের গহীন বনে রথ নামিয়ে আনে জিনা। নাজ যেখানে বাঁশি বাজাচ্ছিলো, তা থেকে কিছু দূরে গাছের আড়ালে ঘোড়াগুলোকে লুকিয়ে রেখে সামনে এগোয়। চারদিকে কেমন যেন শুনশান নিরবতা, সবই যেন বাঁশির সুমধুর সুর শুনে শ্বাস আটকে আছে। আস্তে আস্তে সেই আওয়াজের দিকে এগিয়ে যায় জিনা। মনের মাঝে যুবকটিকে কাছ থেকে দেখার দুর্নিবার এক আকাংখা।

এতো সাবধান না হলেও চলতো, কারণ জিনা তো অদৃশ্য! কিন্তু , তারপরও ঘোর লাগা পায়ে এগিয়ে নাজ থেকে এক গাছ দূরে এসে থেমে যায় সে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে যুবকটিকে। মনে মনে বলে, কে বা কোনটা বেশি সুন্দর- বাংলাদেশের ঐ ছেলেটি নাকি তার হাতের ঐ বাদ্য যন্ত্র থেকে বের হওয়া সুর? ভেবে পায় না জিনা। এতো সুন্দর পুরুষ মানুষও হয়!

এভাবে কতক্ষণ গিয়েছে কেউ বলতে পারে না, একসময় ঘুমিয়ে পড়ে নাজ। তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে জিনা। পায়ে পায়ে হেঁটে এসে বসে পড়ে নাজের পাশে। অদৃশ্যাবস্থা থেকে নিজেকে প্রকাশ করে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নাজের দিকে।

এভাবে সারা রাত কেটে যায়। সূর্য যখন তার লালিমা রেখা দেখিয়ে পূর্বাকাশে উঠার ঘোষণা দিচ্ছে, তখন আবার নিজেকে আড়ালে নিয়ে যায় জিনা। গাছের ফাঁকে নিজেকে লুকিয়ে দেখতে পায়, যুবকটি তার ছাগল আর ভেড়ার পালকে ডাকছে। এরপর সে সেগুলো নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় পাহাড়ের ফাঁকে। এদিকে সারা রাতের ক্লান্তি এসে ঝাপিয়ে পড়ে জিনার দেহে। ঘুমিয়ে যায় সে গাছের কান্ডে ভর দিয়ে।

সেই রাতেই আবার বাঁশির সুর শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় জিনার। তারপর নাজ ঘুমিয়ে পড়লে, তার পাশে এসে মাটিতে নিজেকে এলিয়ে দেয় সে। পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে নাজের ঘুমন্ত মুখের দিকে।

আস্তে আস্তে করে বাংলাদেশী যুবকটির প্রেমে পড়ে যায় চাঁদের বুড়ির মেয়ে, চাঁদের ভবিষ্যত আধ্যাত্মিক নেত্রী জিনা। প্রতি রাতে নাজ যখন ঘুমিয়ে পড়তো, তার পাশে এসে নিজেকে এলিয়ে দিতো মেয়েটি, চুমু খেতো বংশীবাদক রাখালের ঘুমন্ত শরীরে। গভীর রাতে চাঁদ যখন মেঘে ঢেকে যেতো, নিজের আলো দিয়ে প্রেমিকের অজান্তে গভীর আবেগে আলিঙ্গন করতো তাকে।

এভাবেই চলছিলো প্রতি রাতেই। একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো নাজের। চোখ খুলে দেখতে পেলো অপরুপ সুন্দরী জিনাকে। কে এই মেয়েটি যে তাকে আলিঙ্গন করে তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে? ভয় পেয়ে যায় নাজ। ওদিকে জিনারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম জড়ানো চোখে জিনা দেখতে পায়, নাজ দৌড়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। মুহূর্তে রথে চড়ে তাকে অনুসরণ করে সে। নাজ যেখানেই যায়, তাকে সেখানেই অনুসরণ করে দস্যি মেয়েটি। ক্লান্ত হয়ে এক সময় মাটিতে বসে পড়ে যুবক। মুচকি হেসে তার পাশে এসে বসে জিনা।
নিজের পরিচয় দিয়ে বলে-
‘আমি চাঁদের দেশের মেয়ে। তুমি কি আমায় ভালোবাসবে?’
মাথা নিচু করে বসে থাকা নাজ চোখ তুলে তাকায় মেয়েটির দিকে। বলে,
‘কি করে! তোমাকে দেওয়ার মতো আমার কিছু যে নেই।‘

কিন্তু, জিনা নাছোড়বান্দা।
‘আমি শুধু তোমাকে চাই। আমার আর কিছু লাগবে না।‘

তবু নাজ রাজি হয় না। বলে,
‘তা হতে পারে না, জিনা। তোমাকে নিয়ে রাখার মত আমার যে কোন ঘর নেই।‘

‘আমার কিচ্ছু লাগবে না। তোমাকে নিয়ে আমি চলে যাবো চাঁদ রাজ্যে। মাকে বলে সেখানেই বিয়ে করবো আমরা। ওখানে গেলেই দেখতে পাবে, আমাদের কিছু’র অভাব হবে না।‘

জিনার অপার সৌন্দর্যে বাঁধা পড়ে নাজ। ভালবেসে ফেলে মন থেকে। দুজনের কামহীন এই ভালোবাসা পাহাড়ি সেই জায়গাকে অপার্থিব এক আনন্দে ভরিয়ে তুলে।

সারাদিন তারা হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ায়। ছাগল আর ভেড়াগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় পাহাড়ের কোলে। সূর্য যখন মাথার উপর উঠে চোখ রাঙায়, গাছের ছায়ায় বসে বাঁশিতে সুর তুলে নাজ। আর তা শুনতে শুনতে নাজের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে জিনা।
কিন্তু, তাদের এই ভালোবাসা বেশি দিন অজানা থাকলো না। কোন এক অশুভ রাতে ঝিঁঝিঁ পোকারা এসে হাজির হলো বনে। নাজের সাথে জিনাকে দেখে খবর পাঠালো চাঁদের বুড়িকে- ‘দেখে যাও, তোমার মেয়ে কি করছে।‘

সিলেটে অশান্তির কালো মেঘ

খবর পেয়ে সেই রাতেই সিলেটের মাটিতে নেমে আসেন চাঁদের বুড়ি। গাছের আড়াল থেকে দেখতে পান নিজের মেয়ে আর নাজকে। একি হচ্ছে এখানে!

চাঁদরাজের ছেলে ডোমিনোও তো ভালোবাসে জিনাকে। তাই বুড়ির সাথে কথা বলে চাঁদের রাজা নিজের ছেলের সাথে জিনার বিয়ের পাকা ব্যবস্থা করে রেখেছেন। দু’দিন পরে হবে চাঁদের রাণী, আর তুই এখন কি না এক পৃথিবীর রাখালের প্রেমে মজে বসে আছিস! রেগে গিয়ে ভাবলেন জিনার মা। এখন চাঁদের রাজা যদি শুনেন এই অবস্থা, তখন কি হবে ভেবে পান না চাঁদের বুড়ি।

তাই, নিজের গোয়েন্দাবাহিনীকে বললেন,
‘ব্যাপারটা আপাতত চেপে যা তোরা। আমাকে কিছু দিন ভাবতে দে এ নিয়ে।‘

কিন্তু, জিনার মা জানেন না, ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোর মাঝেই ছিলো ডোমিনোর গুপ্তচর। সে গোপনে ডোমিনোর কাছে খবর পাঠিয়ে দেয়। তার কাছ থেকে খবর পেয়ে পৃথিবী’র মাটিতে নেমে আসে ডোমিনো। নাজের সাথে জিনাকে দেখে ঈর্ষায় ফেটে পড়ে। নিজের রক্ষীবাহিনীকে নির্দেশ দেয়,
‘যাও, মেয়েটিকে বন্দি ধরে নিয়ে আসো। আর ছেলেটিকে বেঁধে রেখে দাও গাছের সাথে। পরে তার ব্যবস্থা করা যাবে।‘

নাজকে গাছের সাথে বেঁধে রেখে জিনাকে নিয়ে চাঁদে ফিরে যায় ডোমিনো। সাথে চাঁদের বুড়ি। চাঁদে ফিরে নিজ প্রাসাদে বন্দি করে রাখে জিনাকে। সেখানেই মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা করেন মা। কিন্তু, শত বুঝানোতেও যখন কোন লাভ হলো না, তখন এক কূট চক্রান্ত করলো চাঁদরাজের ছেলে।

দু’দিন পর রাতের বেলা আবারো সে নেমে এলো পৃথিবী’র বুকে। একাকী গেলো বেঁধে রাখা নাজের সামনে। তার বাঁধন খুলে বললো-
“দেখো, পৃথিবী’র ছেলে। তুমি যাকে ভালোবাসো সে তো অমর। আর, তুমি ক’দিন পরেই মারা যাবে। তোমার দেহ যাবে মাটিতে মিশে। এই ব্যথা কিভাবে জিনা সহ্য করতে পারবে?”

কেঁদে ফেলে নাজ। কথাটা তো সত্যি! সে তো জিনার মনে কোন কষ্ট দিতে চায় না। তাহলে? কি করবে সে এখন?
নাজের অবস্থা দেখে ডোমিনো বুঝতে পারে ছেলেটিকে কাবু করা গেছে। এখন প্রয়োজন মক্ষম একটি আঘাত।
‘তোমাকে আগে অমর হতে হবে, যুবক। তাহলেই সম্ভব তোমাদের মিলন।‘

এই বলে নিজের পকেট থেকে একটি শিশি বের করে ডোমিনো।
‘এতেই আছে সেই অমৃত যা তোমাকে অমর করবে। এই বোতল থেকে কয়েক ঢোক গলায় দাও। দেখতে পাবে আমার কথা সত্যি কি না।‘

সরল বিশ্বাসে শিশিটি হাতে তুলে নেয় নাজ। তার তো হারানোর কিছু নেই! পান করে সেই অমৃত নামের তরল পদার্থটি।
এরপর?

ডোমিনো তার সাথে মিথ্যা বলেনি। আসলেই ওটা ছিলো অমৃত পানীয়। কিন্তু, যা সে লুকিয়েছিলো তা হচ্ছে, যে ঐ তরলটি পান করবে তাকে চির জীবনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। যদিও তার দেহে প্রাণ থেকে যাবে সারা জীবন।

ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে নাজের। ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখতে পায় ডোমিনোর ক্রূর হাঁসি। বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে তার দেহে। একটা হাহাকার করা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে। আর কি দেখে হবে প্রিয়তমার সাথে? আর ভাবত এপারে না সে, মাটির গায়ে হেলে পড়ে তার দেহ।

আর, জিনা? তার কি হলো?
তাকে কিছুতেই রাজি করা না পেরে একদিন অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে ডোমিনো। জিনাকে ছেড়ে দেয় তার মায়ের কাছে। যাওয়ার আগে অট্টহাসি দিয়ে বলে,
‘যাও এবারে তোমার প্রেমিকের কাছে। সে যে তোমার জন্যেই অপেক্ষার প্রহর গুনছে!’

সে হাসে শুনে কুকড়ে যায় জিনা, বুঝতে পারে তাদের জীবনে বড় কোন অঘটন ঘটে গিয়েছে। বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে মায়ের অনুমতি নিয়ে পৃথিবী’র বুকে নেমে আসে সে প্রেমিকের খোঁজে। ছুটে যায় সিলেটের সেই নাম না জানা পাহাড়ি এলাকায়। খুঁজে পায় প্রেমিকের ঘুমন্ত শরীর।

প্রথমে জিনা ভেবেছিলো নাজ হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। কিন্তু তারপর, সে দেখতে পায় সেই ঘুম পারিয়ে দেওয়া তরল পদার্থের শিশিটি। নাজের পাশেই পড়ে ছিলো ওটা। বুঝতে পারে কি সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, তখন তার আর কিছু করার নেই।

তবু সেই জায়গায় থেকে যায় জিনা। প্রেমাস্পদের চির ঘুমন্ত শরীর কোলে নিয়ে সারা রাত কাটিয়ে দেয় নির্জন সেই স্থানে। বুনো গাছের পাতা ঝড়ে পড়ে ঢেকে দেয় তাদের শরীর।

প্রতি পূর্ণিমা রাতে বাতাসে কান পেতে থাকে জিনা। পাহাড়ের গায়ের ফাঁকে ফাঁকে যেন শুনতে পায় নাজের বাঁশির একাকী সুর।


পরিশেষ
সিলেটের সেই জায়গা আজো একই রকম আছে। জঙ্গলে ঘেরা, শুনশান, নীরব। শুধু মাঝে মাঝে বনের পাখ-পাখালীর আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। সিলেটের মানুষ যখন ঐ এলাকার পাশ দিয়ে যায়, অভিশাপ দেয় ডোমিনোকে। আর, দোয়া করে যেন নাজের চির ঘুমন্ত শরীরে প্রাণ ফিরে আসে।

কিন্তু, তাদের সে দোয়া সৃষ্টিকর্তার দরবারে কবুল হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৬
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×