somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Casablanca: যুদ্ধকালীন জীবন দর্শন (মুভি রিভিউ)

২৭ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সিনেমা ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মুভি প্রতিনিয়ত মুক্তি পেয়েছে এবং পাচ্ছে। মোটা দাগে সেগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করি - বিশাল বাজেটের ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তি দেয়া মুভি আর একবারেই মাঝারী প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তি পাওয়া মাঝারী মানের মুভি। তো অনেক সময়ই দেখা যায় যে এই মাঝারী প্রত্যাশার মুভিগুলোর একটা হয়ত অবিশ্বাস্য কোন কীর্তি করে ফেলল - ব্যাবসা করল সারা দুনিয়া জুড়ে আর স্থান করে নিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মুভিগুলোর তালিকায়। এখন কথা হচ্ছে, একটা মুভি যখন মানুষের মনের কোণে সারাজীবনের জন্য যায়গা করে নেয় তখন কিন্তু সেটাকে কোন ভাবেই মাঝারী মানের মুভি বলা যায় না। অনেক সময় তো এমনও হয় যে যখন প্রথম মুক্তি পেয়েছিল তখন সমসাময়িক দর্শক আর মুভি ক্রিটিকরা এই মুভিটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু পরের প্রজন্মগুলো তন্ময় হয়ে উপভোগ করেছে এবং প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছে সেই ভালোলাগা। তো সারা দুনিয়ার মুভিখোরেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখার পরও যখন এই 'মাঝারী মানের' মুভির আবেদন ফুরায় না তখন সেটাকে বলতেই হয় সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম 'মাস্টারপিস'।

আমাদের আজকের মুভি রিভিউ এরকমই একটা মাস্টারপিস মুভি নিয়ে যেটা কিনা মুক্তি পেয়েছিল আর আট - দশটা মুভির মতই মাঝারী প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু ১৯৪২ সালের এই মুভি খুব দ্রুতই জয় করে নিয়েছিল দর্শক-সমালোচকের মন আর জিতে নিয়েছিল ৩ ক্যাটাগরীতে অস্কার। বলতে দ্বিধা নেই আজ প্রায় ৭০ বছর পরেও এই মুভির আবেদন কমেনি বিন্দুমাত্র যার প্রমাণ হচ্ছে মাত্র কিছুদিন আগে মুভিতে দেখানো পিয়ানোটি বিক্রি হয়েছে ৬ লাখ ডলারেরও বেশী দামে। সিনেমা ইতিহাসের স্বর্ণযুগের এই মুভি সর্বকালের সেরা মুভির মোটামুটি সব তালিকায় একেবারে উপরের দিকে থাকে।

প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই রেগে যাচ্ছেন এই আদ্ভুত কেতার রিভিউ দেখে। এখনো পর্যন্ত যে মুভির নামটাই বলা হল না! আসলে নাম ঘোষনার আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড তুলে ধরার চেষ্টা করলাম আর কী!

আমাদের আজকের মুভিটির নাম হচ্ছে Casablanca
চলুন তাহলে একটু আলোকপাত করি স্টোরী লাইনে।
সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র যদিও তখনো যুদ্ধে যোগ দেয় নি, ইউরোপ কিন্তু মোটামুটি ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছে। আর এই যুদ্ধের বিভিষীকা থেকে বাঁচার আশায় দলে দলে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ থেকে। তাদের গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেখানে তো সরাসরি যাবার উপায় নেই। যেতে হয় প্যারিস, মার্সেই, ভূমধ্যসাগর, ওরান, ক্যাসাব্লাঙ্কা, লিসবন, যুক্তরাষ্ট্র - এই রুট অনুসরণ করে। এখন সমস্যা হচ্ছে ক্যাসাব্লাঙ্কা পর্যন্ত আসতে পারলেও এখান থেকে থেকে লিসবন যাওয়ার অনুমতি পত্র জোগাড় করা খুবি কঠিন। তাই ক্যাসাব্লাঙ্কায় দিন দিন বাড়ছে উদ্বাস্তুর ভীড়, যারা কিনা বৈধ-অবৈধ যেকোনো উপায়ে অনুমতি পত্র জোগাড় করেতে ইচ্ছুক। আর এটা যোগার করে দেয়া নিয়ে কালোবাজারে চলছে রমরমা ব্যাবসা। শুধু টাকাই নয় সেই সাথে উঁচু পর্যায়ের দহরম মহরম ছাড়া এই অনুমতি পত্র জোগাড় করা মোটামুটি অসম্ভব।

তো এহেন ক্যাসাব্লাঙ্কা শহরে যে নাইট ক্লাব আর জুয়ার আসরের রমরমা ব্যাবসা চলবে এতে আর সন্দেহ কি! কালোবাজারী আর ধান্দাবাজদের জন্য মোক্ষম স্থান এগুলো! এরকম একটা ক্লাব - "Rick's Café Américain" এর মালিক হচ্ছে প্রবাসী আমেরিকান রিক ব্লেইন (হামফ্রে বোগার্ট ) স্থানীয় দুর্নীতিবাজ পুলিশ আর উটকো বদমাশদের সামলে ভদ্রলোক কঠোর হাতে তার ক্লাব চালায়। এখানে বলে নেওয়া উচিত যে ক্যাসাব্লাঙ্কা ঐ সময় ভিসি ফ্রান্সের অধীনে ছিল। জার্মানী ফ্রান্স দখল করে নেওয়ার পর ভিসি লিডাররা জার্মানদের অধীনে পুতুল সরকার গঠন করে ফ্রান্স শাসন করতে শুরু করেন। যেহেতু ক্যাসাব্লাঙ্কা ভিসি রেজিমের অধীনে, সেখানে জার্মান প্রতাপ এর কথা বলাই বাহুল্য। তো আমাদের ক্লাব মালিক রিক সাহেব আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ একটা অবস্থান বজায় রেখে বেশ ভালো ভাবেই ক্লাব চালিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু তার নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ করেই ফিরে এল তার নিজেরই অতীত। নিতান্তই কাকতালীয় ভাবে রিকের প্রাক্তন প্রেমিকা এলসা লুন্ড (ইনগ্রিড বার্গম্যান ) স্বামীসহ তার ক্লাবে এসে উপস্থিত হল একদিন। ভদ্রমহিলার স্বামী জার্মান বিরোধী রেজিস্ট্যান্স নেতাদের মধ্যে বেশ একজন কেউকেটা - পালিয়েছে জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে। অতএব, জার্মানরা যে তাঁকে ধরে নেয়ার জন্য ক্যাসাব্লাঙ্কা পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা ধাওয়া করে আসবে তা তো বলাই বাহুল্য।

এই যখন অবস্থা তখন ঘটনাচক্রে রিকের হাতে চলে আসে এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। এই ক্ষমতাবলে একমাত্র সেই পারে প্রাক্তন প্রেমিকা আর তার স্বামীকে বাঁচাতে। কি করবে এখন রিক? সে কি ছিনিয়ে নিবে তার ভালোবাসাকে নাকি পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিবে তাকে। প্রেমিকার স্বামীর ব্যাপারেই বা কি পদক্ষেপ নিবে সে?

এই উত্তর গুলো পেতে আপনাকে দেখতে হবে মুভিটা। আমি এখানে শুধুমাত্র একটু ধারণা দেবার চেস্টা করলাম স্টোরীলাইন নিয়ে। মোটামুটি সব চমকই এড়িয়ে গেছি যেন মুভি দেখার সময় পানসে না লাগে।

প্রিয় পাঠক, স্টোরীলাইন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা তো পেলেন। এখন আসুন একটু তলিয়ে দেখি কেন মুভিটা এত জনপ্রিয়। এখানে আমি আমার ধারণাটুকুই দেবার চেষ্টা করলাম -

প্রথমত, মুভিটা যে পটভূমিতে বানানো হয়েছে এবং যে সময়ে মুক্তি পেয়েছে তা একেবারে নিখুঁত ভাবে অ্যাডজাস্টেড হয়েছে। ১৯৪২ সালে মুক্তি পাওয়া মুভিটা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটেই তৈরী। ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধের ঘনঘটা চলছে। রাস্তায় রাস্তায় উদ্বাস্তু মানুষের ঢল আর যুক্তরাষ্ট্র তখনো যুদ্ধে জড়ায়নি।
দ্বিতীয়ত, অসাধারণ শক্তিশালী একটা স্টোরীলাইন। গল্পে একবার ঢুকে গেলে বেরোতে পারবেন না। সাধারণত রোমান্টিক মুভিগুলো এতটা থ্রিলিং হয় না। এই মুভিটা সেদিক দিয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন ফ্লেভার দিবে।
তৃতীয়ত, শুভবোধ আর বিবেকের সাথে দেশপ্রেম এবং রোমান্স মিশিয়ে মূল চরিত্রগুলোর অসাধারণ রসায়ন চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সবগুলো চরিত্রই কম-বেশী শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ন। বাহুল্য একেবারেই নেই বলে - চরিত্রগুলোর পরিণতি স্বার্থক।
চতুর্থত, অসাধারণ অভিনয় করেছেন সবাই। সেই সাথে ছিল চমৎকার সব হিউমার। এক মূহুর্তের জন্যও বোর হবার উপায় নেই। মুভিটা দেখে হামফ্রে বোগার্টের পুরো ফ্যান হয়ে গেছি। সেই সাথে ইনগ্রিড বার্গম্যানও অসাধারণ। দুর্ণীতিবাজ পুলিশ অফিসারের অভিনয়ের প্রশংসা তো না করলেই নয়।

এবং সব শেষে বলি, একান্তই আমার ব্যাক্তিগত মতামত - হলিউডের গোল্ডেন এজের মুভিগুলোর স্পেশাল চার্মের সবটুকুই এই মুভিতে পাবেন। তাই ভাল না লেগে কোন উপায় নেই।

কয়েকটা স্টীল দিয়ে দিলাম নিচে -


রিক


এলসা


রেনাল্ট - পুলিশ চীফ
আমার রেটিং: ১০ এ ৯
তো দেখে ফেলুন মুভিটা। জানিয়ে যান আপনার ভালোলাগা - মন্দলাগা।

বিঃদ্রঃ মুভিটা নিয়ে একই নামে বার্টি হিগিন্সের অসাধারণ একটা গান আছে। এই গানটার খোঁজ দিয়েছিলেন অসম্ভব প্রিয় ব্লগার স্নিগ
নিচে লিঙ্ক দিয়ে দিলাম। মুভিটা দেখার পরে গানটা শুনলে ভালোলাগাটা পুরোপুরি অনুভব করতে পারবেন।
Casablanca - Bartie Higgins
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৩
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×