somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাওন আহমাদ
স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়,তাকে সঙ্গে নিয়ে চলি।ভালো লাগে ভাবতে, আকাশ দেখে মেঘেদের সাথে গল্প পাততে, বৃষ্টি ছুঁয়ে হৃদয় ভেজাতে, কলমের খোঁচায় মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে প্রকাশ করতে...

আঁচলে বাঁধা সংসার

১১ ই মে, ২০২৫ সকাল ১০:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি তখন কলেজে পড়ি। সবেমাত্র যৌথ পরিবার ভেঙে মায়ের সঙ্গে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হয়েছে। নতুন সংসার গুছিয়ে নিতে, মা দিনের প্রায় সবটা সময় ঘরকন্নার কাজে পার করে দিতেন। ঘরের কোন কোণে কোন আসবাব বসবে, উঠোনের কোথায় লাউ-কুমড়োর মাচা হবে, কোন দিকে ফলের গাছ লাগাবে—এসব নিয়ে নানা ব্যস্ততায় দিন গড়িয়ে যেত তার।


ওদিকে আবার আমাদের মুখে বাহারি খাবার তুলে দেওয়ার মহাযজ্ঞ তো ছিলই। মুঘলদের পাকের ঘরের ব্যস্ততা নোঙর করেছিল আমার মায়ের রসুইঘরে। মা রাঁধতে ভালোবাসতেন খুব। নানা পদের ভর্তা-ভাজি, মাছের ঝোল, চচ্চড়ি, মাছ ভুনা, সবজির ব্যঞ্জন, মাংসের রকমারি পদ-সহ সকল প্রকার বাঙালি রান্নার আখড়া ছিল মায়ের রসুইঘর।


মা দিনমান খুন্তি-কড়াইয়ে ঠুকঠাক শব্দ করে রান্নায় মজে থাকতেন। রান্নার ঘ্রাণ রসুইঘরের সাথে যুদ্ধ করে বাড়িজুড়ে আধিপত্য করত। আমি সময় পেলেই মায়ের পাশে টুল পেতে বসে রান্না করা দেখতাম। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা আমাকে বুঝিয়ে দিতেন কোন রান্নায় কতটুকু মসলা ব্যবহার করতে হবে, ভেজে রাখা মাছের টুকরোগুলো কখন ঝোলে দিতে হবে, কীভাবে গোটা জিরে দিয়ে ডালে দিতে হবে ফোঁড়ন, তরকারির রং কেমন হলে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে ইত্যাদি। আমি রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে এসব শুনতাম। স্মৃতির বয়ামে তুলে নিতাম সেসব রান্নার রেসিপি।


রক্ষণশীল এক যৌথ পরিবারের বড় বৌ হয়ে এসেছিলেন আমার মা। ছোট্ট কাঁধে দায়িত্ব ছিল তার অনেক আর পায়ে ছিল নিয়মের বেড়ি। দায়িত্বের ভারে কখনো কখনো নুইয়ে পড়লেও অবহেলা করার উপায় ছিল না। চৌকাঠ পেরোতে চাইলে পায়ে জড়ানো নিয়মের বেড়িতে টান পড়ত। তার আর চৌকাঠ পেরোনো হতো না।


জীবনের অনেক সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। আনন্দে থাকার মুহূর্ত কাটিয়ে দিয়েছেন বেদনার চাদর গায়ে জড়িয়ে। নানা বিধি-নিষেধ আর শাসন-বারণের চার দেয়ালে বন্দি ছিল তার অন্তর-আত্মা। এভাবে হাঁটা যাবে না, ওভাবে কথা বলা যাবে না, ওই ঢঙে কাপড় পরা যাবে না, অবেলায় শুয়ে থাকা যাবে না-সহ অসংখ্য না ঘিরে রেখেছিল তাকে। নিজের মতো করে কিছু করতে গেলেই শুনতে পেতেন ‘না না’ চিৎকার। আর নিজের জন্য কিছু করা হতো না তার।


মা যখন নিজের একটা সংসার পেলেন, তখন জীবনের অপূরণীয় ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে শুরু করলেন। অবশ্য এর কোনোটাই তার নিজের জন্য ছিল না। সবটাই বরাদ্দ ছিল সংসার আর আমাদের জন্য। তার কাছে সুখের সংজ্ঞা ছিল, নিজের মতো করে আমাদের রেঁধেবেড়ে খাওয়ানো। যে সুখের ছাপ আমরা স্পষ্ট তার মুখে দেখতে পেতাম। এ কারণে বাড়ি ছেড়ে এক মুহূর্তও কোথাও যেতে চাইতেন না। ভেবে আকুল হতেন, তিনি কোথাও গেলে আমরা কী খাব? কীভাবে থাকব? আরও কত কী চিন্তা!


হঠাৎ একদিন নানাবাড়ি থেকে জরুরি খবর এলো। মাকে নানা বাড়ি যেতে হবে পারিবারিক আলোচনার জন্য। আমার মাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন মাকে যেতেই হবে। যাওয়ার আগে বারবার করে বলে গেলেন, মিটসেফের কোথায় দুপুরের খাবার ঢাকা দেওয়া আছে, ফ্রিজের কোন তাকে রাতের খাবার রাখা, সকালের জন্য রুটি সেঁকে কোন বক্সে রাখা হয়েছে এবং কীভাবে সেটা গরম করে খেতে হবে ইত্যাদি।


বিকেলে মা বেরিয়ে গেলেন। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বিষণ্ন আঁধার নেমে এলো বাড়িতে। একদম নিস্তব্ধ নীরব হয়ে গেল চারপাশ। বাড়িসুদ্ধ মায়ের গায়ের গন্ধ টের পাচ্ছি। যেখানে হাত দিচ্ছি সেখানেই তার ছোঁয়া পাচ্ছি। কিন্তু মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো রকমে এপাশ-ওপাশ করে রাত পার হলো। কিন্তু ভোরের আলো যেন আরও বিষণ্নতায় ডুবিয়ে দিল আমাকে। কী এক অজানা বেদনায় সারা বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। ভাবলাম, এই বাড়িতে এভাবে থাকতে পারব না। বেরিয়ে গেলাম কলেজের উদ্দেশে, যদি কিছুটা ভালো লাগে।


বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি, বিষাদের রাত কীভাবে পার করব? বাড়ির গেটের সামনে আসতেই নাক ছুঁয়ে গেল অতি পরিচিত এক ঘ্রাণে। এ আমার মায়ের হাতের রান্নার ঘ্রাণ। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখি, মা আমাদের জন্য রাতের খাবারের আয়োজন করছেন। মনে হচ্ছিল, এক কোটি বছর পর মাকে দেখছি। আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম, আনন্দ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে আমার চোখের পাতা। টের পেলাম, মা’র চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়ছে একই অশ্রু।


যে মানুষটার সঙ্গে এক দিনের বিচ্ছেদ সহ্য করা আমার জন্য কঠিন ছিল। সেই মানুষটা নয় বছর হলো আমাকে রেখে অন্ততকালের পথে যাত্রা করেছেন। আর আমি হয়ে গেছি পৃথিবীর অন্যতম নিঃসঙ্গ মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২৫ সকাল ১০:২০
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×