
আমি তখন কলেজে পড়ি। সবেমাত্র যৌথ পরিবার ভেঙে মায়ের সঙ্গে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হয়েছে। নতুন সংসার গুছিয়ে নিতে, মা দিনের প্রায় সবটা সময় ঘরকন্নার কাজে পার করে দিতেন। ঘরের কোন কোণে কোন আসবাব বসবে, উঠোনের কোথায় লাউ-কুমড়োর মাচা হবে, কোন দিকে ফলের গাছ লাগাবে—এসব নিয়ে নানা ব্যস্ততায় দিন গড়িয়ে যেত তার।
ওদিকে আবার আমাদের মুখে বাহারি খাবার তুলে দেওয়ার মহাযজ্ঞ তো ছিলই। মুঘলদের পাকের ঘরের ব্যস্ততা নোঙর করেছিল আমার মায়ের রসুইঘরে। মা রাঁধতে ভালোবাসতেন খুব। নানা পদের ভর্তা-ভাজি, মাছের ঝোল, চচ্চড়ি, মাছ ভুনা, সবজির ব্যঞ্জন, মাংসের রকমারি পদ-সহ সকল প্রকার বাঙালি রান্নার আখড়া ছিল মায়ের রসুইঘর।
মা দিনমান খুন্তি-কড়াইয়ে ঠুকঠাক শব্দ করে রান্নায় মজে থাকতেন। রান্নার ঘ্রাণ রসুইঘরের সাথে যুদ্ধ করে বাড়িজুড়ে আধিপত্য করত। আমি সময় পেলেই মায়ের পাশে টুল পেতে বসে রান্না করা দেখতাম। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা আমাকে বুঝিয়ে দিতেন কোন রান্নায় কতটুকু মসলা ব্যবহার করতে হবে, ভেজে রাখা মাছের টুকরোগুলো কখন ঝোলে দিতে হবে, কীভাবে গোটা জিরে দিয়ে ডালে দিতে হবে ফোঁড়ন, তরকারির রং কেমন হলে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে ইত্যাদি। আমি রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে এসব শুনতাম। স্মৃতির বয়ামে তুলে নিতাম সেসব রান্নার রেসিপি।
রক্ষণশীল এক যৌথ পরিবারের বড় বৌ হয়ে এসেছিলেন আমার মা। ছোট্ট কাঁধে দায়িত্ব ছিল তার অনেক আর পায়ে ছিল নিয়মের বেড়ি। দায়িত্বের ভারে কখনো কখনো নুইয়ে পড়লেও অবহেলা করার উপায় ছিল না। চৌকাঠ পেরোতে চাইলে পায়ে জড়ানো নিয়মের বেড়িতে টান পড়ত। তার আর চৌকাঠ পেরোনো হতো না।
জীবনের অনেক সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। আনন্দে থাকার মুহূর্ত কাটিয়ে দিয়েছেন বেদনার চাদর গায়ে জড়িয়ে। নানা বিধি-নিষেধ আর শাসন-বারণের চার দেয়ালে বন্দি ছিল তার অন্তর-আত্মা। এভাবে হাঁটা যাবে না, ওভাবে কথা বলা যাবে না, ওই ঢঙে কাপড় পরা যাবে না, অবেলায় শুয়ে থাকা যাবে না-সহ অসংখ্য না ঘিরে রেখেছিল তাকে। নিজের মতো করে কিছু করতে গেলেই শুনতে পেতেন ‘না না’ চিৎকার। আর নিজের জন্য কিছু করা হতো না তার।
মা যখন নিজের একটা সংসার পেলেন, তখন জীবনের অপূরণীয় ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে শুরু করলেন। অবশ্য এর কোনোটাই তার নিজের জন্য ছিল না। সবটাই বরাদ্দ ছিল সংসার আর আমাদের জন্য। তার কাছে সুখের সংজ্ঞা ছিল, নিজের মতো করে আমাদের রেঁধেবেড়ে খাওয়ানো। যে সুখের ছাপ আমরা স্পষ্ট তার মুখে দেখতে পেতাম। এ কারণে বাড়ি ছেড়ে এক মুহূর্তও কোথাও যেতে চাইতেন না। ভেবে আকুল হতেন, তিনি কোথাও গেলে আমরা কী খাব? কীভাবে থাকব? আরও কত কী চিন্তা!
হঠাৎ একদিন নানাবাড়ি থেকে জরুরি খবর এলো। মাকে নানা বাড়ি যেতে হবে পারিবারিক আলোচনার জন্য। আমার মাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন মাকে যেতেই হবে। যাওয়ার আগে বারবার করে বলে গেলেন, মিটসেফের কোথায় দুপুরের খাবার ঢাকা দেওয়া আছে, ফ্রিজের কোন তাকে রাতের খাবার রাখা, সকালের জন্য রুটি সেঁকে কোন বক্সে রাখা হয়েছে এবং কীভাবে সেটা গরম করে খেতে হবে ইত্যাদি।
বিকেলে মা বেরিয়ে গেলেন। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বিষণ্ন আঁধার নেমে এলো বাড়িতে। একদম নিস্তব্ধ নীরব হয়ে গেল চারপাশ। বাড়িসুদ্ধ মায়ের গায়ের গন্ধ টের পাচ্ছি। যেখানে হাত দিচ্ছি সেখানেই তার ছোঁয়া পাচ্ছি। কিন্তু মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো রকমে এপাশ-ওপাশ করে রাত পার হলো। কিন্তু ভোরের আলো যেন আরও বিষণ্নতায় ডুবিয়ে দিল আমাকে। কী এক অজানা বেদনায় সারা বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। ভাবলাম, এই বাড়িতে এভাবে থাকতে পারব না। বেরিয়ে গেলাম কলেজের উদ্দেশে, যদি কিছুটা ভালো লাগে।
বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি, বিষাদের রাত কীভাবে পার করব? বাড়ির গেটের সামনে আসতেই নাক ছুঁয়ে গেল অতি পরিচিত এক ঘ্রাণে। এ আমার মায়ের হাতের রান্নার ঘ্রাণ। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখি, মা আমাদের জন্য রাতের খাবারের আয়োজন করছেন। মনে হচ্ছিল, এক কোটি বছর পর মাকে দেখছি। আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম, আনন্দ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে আমার চোখের পাতা। টের পেলাম, মা’র চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়ছে একই অশ্রু।
যে মানুষটার সঙ্গে এক দিনের বিচ্ছেদ সহ্য করা আমার জন্য কঠিন ছিল। সেই মানুষটা নয় বছর হলো আমাকে রেখে অন্ততকালের পথে যাত্রা করেছেন। আর আমি হয়ে গেছি পৃথিবীর অন্যতম নিঃসঙ্গ মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২৫ সকাল ১০:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


