আমার দাদীকে দেখলেই আমার শতবর্ষী বৃক্ষের কথা মনে পড়ে। তার কুঞ্চিত ঝুলে পড়া চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে কালশিটে দাগ আর হাতের গাঁট ও পায়ের পাতার রুক্ষ কঠিন কড়াগুলো দেখে তাকে আমার বহু বছর অযত্নে অবহেলায় ঝড়ঝাপ্টা সামলে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মহীরূহের মতনই মনে হয়। মহীরূহ যেমন অনঢ় অটল স্থির দাঁড়িয়ে রয় তার বহু বছরের ঘাত প্রতিঘাত সয়ে চলা দৃঢ় কঠিন কুঞ্চিত কান্ডের বাকলে শরীর জড়িয়ে। তেমনি আমার দাদীমার শরীরে ছড়িয়ে থাকা বাকল দেখি আমি। সাদা ধপধপে চুলের কয়েকটি ধারা ঝুলে থাকে তার পানপাতা মুখী তোবড়ানো গালের আশপাশ জুড়ে। দাদীমার পরণে থাকে সরু নীল পাড় সাদা বকের মত শাড়ী।
দাদীমা সারা দিনমান উদয় অস্ত বসে থাকেন তার শোবার ঘরের জানালার ধারে। কোনো কথা বলেন না তিনি। তাকে কেউ দেখলে ভাববে খুব মন দিয়ে তিনি কিছু ভাবছেন। হয়তো বা অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে। কে জানে? কেউ খুব কাছে গেলে বা খাবারের সময় ডাক দিলে ঘোলা চোখে ফিরে তাকান তার দিকে। তার ক্ষীন হয়ে আসা দৃষ্টির ভাঁজেও খেলে যায় এক অজানা সন্মোহন। অনেকেই ভয় পেয়ে যায়। বিশেষ করে বাড়ীর নতুন কোনো কাজের মানুষ এলে তার ধারে কাছেই কেনো যেন ঘেষতে চায় না কেউ। অথচ দাদীমা কাউকে কিছুই বলেন না। যেন মৌনব্রত নিয়েছেন উনি। কখনও অস্ফুটে কোনো শব্দও করেন না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় উনি মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছেন।
অথচ দিনের পর দিন একই ভাবে বসে থাকেন তিনি। জানালার ধারে, আকাশ আর মাটির মিলনস্থনে যেন কোনো অদেখা সীমান্তে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। গভীর রাতে ঢুলে পড়েন ঘুমে। খুব ভোরে উঠে মা তার দাঁত মাঁজিয়ে দেন, গোসল করিয়ে কাঁপড় পালটে বসিয়ে দেন জানালার ধারে। সময় মত খাবার আসে। কয়েক গ্রাস মুখে তুলে খাইয়ে দেন মা । একা একা নানা কথা বলেন তার সাথে। কিন্তু দাদীমার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। মৌনব্রত নিয়েছেন তিনি অথবা খুব গভীর মনযোগে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছেন।
Picture
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৯ রাত ৮:৪৯