বিরানপুর ছোট্ট একটি গ্রামের নাম- যা বাংলাদেশের শাশ্বত গ্রামের প্রতীক। নানান সংগ্রাম করেও বিরানপুর গ্রামের শব্দ-সৈনিকরা লিখে যাচ্ছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা গান। আমার দৃষ্টিতে এইসব শব্দ-সৈনিকরাই বিরানপুরের সহযাত্রী। অজান্তে তাঁরা বেঁচে থাকবেন দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রাণে। কিন্তু অনেকের কাছেই হয়তো থাকবে অজানা অচেনাই তাদের জীবন। আমার শ্রদ্ধা প্রতিনিয়ত নত হয় সেইসব কবি-সাহিত্যকদের প্রতি। এই পর্বে আমি আমার এক সিনিয়র ভাই শ্রদ্ধেয় কবি, বন্ধু এবং সহযাত্রী মোস্তফা আনোয়ার পাশা-র কথা বলবো।
মোস্তফা আনোয়ার পাশা পড়তেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের শিক্ষায়তনে আসতেন মাঝে সাঝে। তাঁর ছোটো সহোদর মোস্তফা কামাল পাশা ছিলেন আমার তিন বছরের সিনিয়র। দারুণ সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা ছিলেন দু'ভাই-ই। ভালো আবৃত্তি এবং কৌতুক বলতে পারতেন মোস্তফা কামাল ভাই। আর মোস্তফা আনোয়ার পাশা ভাই লিখতেন ভালো কবিতা। আমি কবিতা লিখতাম। সেই সূত্রে তাঁর খুব ভক্ত ছিলাম আমি। তাঁর কবিতা পড়তাম নিয়মিত। লিটন ম্যাগাজিন এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন পত্রিকায়ও পেতাম তাঁর লেখা। আমাকে একটি বইও উপহার দিয়েছিলেন তিনি। সেই বইটিই এখনও আমার কাছে রয়ে গেছে। বইটির নাম- জ্যোৎস্নায় বর্ণমালা। অবশ্য তাঁর আর একটি বই- নদী, কাশবন ও শাহানা- প্রকাশের কথাও শুনেছিলাম আগে।
জ্যোৎস্নায় বর্ণমালা বইটির প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি 1986; বাংলা 1392 সালের ফাল্গুন মাসে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন মৃত্যুঞ্জয় রায়। আলোকচিত্র গ্রহণে সাইফ উদ্দিন আহমেদ। মুদ্রণ হয়েছে মাতৃছায়া প্রিন্টিং প্রেস, জয়দেবপুর এবং দেশ মুদ্রণ, ময়মনসিংহ-এ। বইটির মূল্য রাখা হয়েছিলো মাত্র বারো টাকা। বইটির শেষ প্রচ্ছদে মোস্তফা আনোয়ার পাশা সম্পর্কে বলা আছে- কবিতায় যার নদীর কথকতা, শব্দ বিনির্মাণে যার বিশেষত্ব সময়ের সাথে সমান্তরাল হয়ে চলে গেছে বহুদূর এবং হঠাৎ হঠাৎ ঘুঙুরের মত বাজতে বাজতে যার ছন্দ অলৌকিকভাবে পাঠকদের নিয়ে যায় ধানসিঁড়ি নদীটির কাঁচা স্বপ্নের ভেতর, সেইসব শব্দের জ্যোৎস্নায় অবগাহন মোস্তফা আনোয়ার পাশার এই কাব্যগ্রন্থ- যা সত্যিই পাঠকদের দেবে এক অনাস্বাদিত কবিতার মৌরি গন্ধ।
মোস্তফা আনোয়ার পাশার কবিতার মৌরি গন্ধ এখনও রয়ে গেছে আমার মনে। দুই ফর্মার বই -জ্যোৎস্নার বর্ণমালা-য় মোট তেইশটি কবিতা রয়েছে। সব কবিতাগুলোও লিরিকধর্মী। দু'একটা ছড়াও আছে এতে। লেখাগুলো আশির দশকের। ছড়াগুলোতে তৎকালীন স্বৈরশাসনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাই। মূলত প্রেমধর্মী লিরিকগুলা সুখপাঠ্য। সেখান থেকে তিনটি কবিতা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম-
[রং=0অ00অঅ]1. [গাঢ়]একদিন[/গাঢ়]
একদিন তোমাকে দেখবো বলে
ঘর থেকে বেরোলাম।
দেখলাম তোমার হাতের আঙ্গুল, নখ
তোমার চিবুক, গ্রীবা
ঠোঁটের বাঁক, নাকের গড়ন।
নিতল দিঘীর মতো তোমার চোখে
রেখে আমার চোখ
খুঁজে নিলাম আমারি ছায়া।
এবং তখনি
নার্সিসাসের মতো আমারো মৃত্যু হলো।
2. [গাঢ়]ওরা আসে[/গাঢ়]
ওরা আসে। ওরা এসে সমবেত হয়
ওরা সমবেত হয় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে।
ওরা কথা বলে অনুচ্চ কণ্ঠে। ওদের ছায়াগুলো কাঁপে।
ওদের একজনের মনে পড়ে যায় তার প্রেমিকার কথা
শ্যামলা রঙের সুচিক্কন মুখ তার কতদিন দেখেনি আহা!
জয়নালের কশেরুকায় বিধে থাকা বুলেট
নতুন করে যন্ত্রণা ছড়ায় সারাদেহে
বেদনায় নীল হয়ে যায় ফর্সা মুখ তার।
মা! মা! বলে ডেকে ওঠে একজন
তার চোখে ভাসে জননীর ছবি।
শেষবার গ্রাম থেকে ফেরার সময়
সজল চোখে তাকিয়েছিলো তার দিকে।
মোজাম্মেলের মনে পড়েঃ
ছোট বোনের জন্যে ট্যুশনির টাকা বাঁচিয়ে কেনা
চাঁপ রঙ শাড়ীটির কথা।
প্রথম শাড়ী পড়ার পুলকে
কেমন দেখাতো ওর লাজুক মুখটি।
ওদের চারপাশ ঘিরে থাকা সুমসাম নীরবতা ভেঙ্গে
একজন নির্বোধ কবির কথা ভেবে ওরা হেসে ওঠে সজোরে
সে হাসির গমকে কেঁপে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর।
ঢাকা। সারা বাংলাদেশ এবং বঙ্গভবন।
3.[গাঢ়] জেনারেল ট্রাক[/গাঢ়]
চারদিক হৈ চৈ
হুঁশিয়ারি হাঁক
ঐ আসে ঐ আসে
জেনারেল ট্রাক।
জনতা জনতা
জেগেছে জনতা
নয় নির্বাক।
হুঁশিয়ার জেনারেল
সামানেই বাঁক
ঐখানে উল্টাবে
তোমার-ই ট্রাক।[/রং]
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৬ রাত ১১:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



