বাবা, তোমায় দেখি না কতদিন। তুমি এত দুরে থাক কেন বাবা, আমায় কি তোমার দেখতে ইচ্ছা করে না- নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলাগুলোর সঙ্গে কথা বলে অরণ্য। সে গালে হাত দিয়ে চেয়ে থাকে আকাশপানে, ভাবে তার বাবার কথা। পনের বছর বয়স হতে চলল অরণ্যের। বাবাকে সেই কবে দেখেছে সে, কারণ বাবা তো থাকে দুর দ্বীপবাসে। আবার যে কবে আসবে বাবা, জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে, চকোলেট আর খেলনা আনবে সেই প্রতীক্ষা করে অরণ্য। তার মনের মধ্যে থাকা বাবার ছবিটা ভেসে উঠে মেঘের মধ্যে।
পরি তার বাবাকে অনেক ভালোবাসে, বাবা তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ছোট্ট পরির এখন ডানা ঝাপটানোর বয়স, তার মন চায় উড়ে বেড়াতে দিগ্গ্বিদিক, বাবাই তাকে সামলে রাখে। হুট করে ঘুরতে নিয়ে যায় বাবা। বাবার সঙ্গে পরি বসে পড়ে কোনো এক অচেনা জায়গায়, যেখানে শুধু বাবা এবং মেয়ে আর মাঝখানে মায়াবী মিটিমিটি মোমের আলো। বাবার ভালবাসায় পুরোদমে হারিয়ে যায় পরি। আবার পরি যখন কোনকিছু সামলে উঠতে পারে না, বাবাকে কিছু খাইয়ে দিতে ফেলে দেয় তখন বাবা আদার করে বলে, আমার মেয়েটা এখন ছোট্টমণি রয়ে গেল। বাবার কাছে ছেলেমেয়েরা কখনও বড় হয় না, সেই ছোট্ট বাবু সোনা মনে হয়। ছেলেমেয়েরা যতই বড় হোক না কেন বাবা-মায়েরা যেন সব সময়ের জন্য বুকে আগলে রাখেন। কখনও যেন বাচ্চাদের কোনো কষ্ট না হয়। ইভান বয়সে অনেক বড়, বেশ ভালো একটি কোম্পানীতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করে। তার বাবার মুখ থেকেই শুনতে পেলাম, ‘আমার এখনও মনে হয় যেন কিছুদিন আগেই আমার ছেলের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে গিয়েছি।’ বাবা তো আসলে এমনই, চিরচেনা, চির অম্লান, আমাদের আদর্শ, আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ম্ব, আমাদের মহান মহান কর্মের অনুপ্রেরণা, আমাদের সাহস, আমাদের ভরসা, আমাদের ভালোবাসা।
বাবাকে ভুলে থাকা সত্যিই কঠিন। সাথীর বাবা গত হয়েছে অনেক দিন হলো। তার অশ্রু এখন সাগরে মিলিয়ে গেছে। শুধু তারাদের দিকে তাকিয়ে সে বাবাকে বলে, তোমাকে অনেক মিস করি বাবা। বাবার কোলে মাথা রাখার যে তৃপ্তিটুকু তা মিস করি, ভুল করলে বাবার শাসন মিস করি, বাবা তোমার আদরটুকু অনেক বেশি মিস করি, অনেক ভালবাসি বাবা!!!
আমাদের বাবারা সব সময় অনেক কাছের একজন মানুষ। আমরাই অনেক সময় তাদের কাছ থেকে দুরে সরে যাই; কিন্তু তারা বারবার আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। বাবাদের স্মরণ করার দিন আসলে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। তারপরও বছরের একটি দিনে বিশ্বে বাবাদের আলাদাভাবে স্মরণ করা হয়। শুধু বাবাদের জন্য সারা বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় বাবা দিবস, জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস পালন করা হয় আমাদের বাবাদের স্মরণে। পৃথিবীর যত সন্তান এ পৃথিবীতে মুখ তুলে তাকিয়েছে তারা শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করে বাবাদের। বাবা দিবসটা আসলে সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া যে, বাবারা আমাদের মাথার ছায়া, আমরা যেন তাদের কষ্ট না দেই। বাবা দিবসের কথায় একটু পেছনে ফিরে যাই। সন্তানরা তার বাবাকে সন্মান জানাতে একটি দিন ঠিক করা দরকার, এমন পরিকল্কপ্পনা প্রথম আসে ‘ওয়াশিংটন’-এর সেঙাকেন থেকে। ১৯০৯ সালে যখন মা দিবস হয় তখন ‘সনোরা স্ট্মার্ট ডট’ প্রথম চিন্তা করেন বাবা দিবসের কথা। সনোরার মা যখন মারা যান তখন তার বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন স্ট্মার্ট তার একমাত্র সঙ্গী হয়। তিনি তখন বুঝতে পারেন তার কাছে বাবা কত গুরুত্তপূর্ণ। একজন সন্তানের কাছে তার বাবা কতটা সাহসী, আত্ম্রানুরাগী আর আবেগী তা তিনি বুঝতে পারেন তার বাবাকে দেখে। সনোরার বাবার জন্ম হয়েছিল এ জুন মাসেই। তাই তিনি ঠিক করলেন সেঙাকেনে উদযাপন করবেন তার বাবাকে ঘিরে ‘বাবা দিবস’।
তথন সময়টা ছিল ১৯১০, ১৯ জুন। বাবাদের জন্য একটি দিন ধার্য হয়ে যায়, শুধু বাবাদের জন্য নানা আয়োজন। সন্তানরা তার বাবাকে খুশি করবে নানাভাবে এ দিনটিতে। এরপর অনেকদিন কেটে যায়। ১৯২৬ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে জাতীয় বাবা দিবসের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং কংগ্রেসে এটি স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালে। এরপর ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন স্থায়ীভাবে বাবা দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেন প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার। আর এভাবেই সনোরার স্বপ্ন পূরণ হয়, যেখানে তার বাবা এবং সব ভালো বাবাকে বিশ্ববাসী সন্মান প্রদর্শন করবে একটি বিশেষ দিনে যেভাবে মা দিবস পালিত হয়। আর তখন থেকেই শুরু হয় বিশ্ব বাবা দিবস।
ইতিহাস হাতড়ে আরও একটু পেছনে গেলে জানা যাবে বাবা দিবসের খবরটা জেনেছিল প্রায় চার হাজার বছর আগে এলমেসু কার্ভড নামের ছোট্ট এক বালক তার বাবার লেখা মাটি দিয়ে তৈরি এক কার্ডে। সেই জায়গাটি ছিল ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ। যদিও এর কোন বিবরণী নেই, তারপরও এলমেসু এবং তার বাবার প্রতি শ্রদ্ধাকে স্বরণ করে বিশ্বের অনেক দেশে বাবা দিবস পালন হয়ে থাকে।
এছাড়াও আবার অনেকে মনে করেন, ১৯০৮ সালে পশ্চিম ভারজিনিয়ার চার্চ থেকে বাবা দিবসের শুরু হয়। মতভেদ যাই থাকুক না কেন আমাদের বাবারা আমাদের কাছে সব দিনেই সমান। কারণ বাবাকে আমরা অনেক ভালোবাসি। বাবা আমাদের কাছে চিরসতেজ, চিরসজীব।
অরণ্য আবারও আকাশ পানে চেয়ে থাকে। কোথা থেকে একটি গাঙচিল উড়ে চলে যায় আর তার মনে হয় ওকে কিছু বলে যায় গাঙচিলটা। ফোনের শব্দে অরণ্যের ভ্রম ভাঙে, ফোনের ওপাশ থেকে আবেগী সুর ভেসে আসে। আব্বু কেমন আছ তুমি, আমি আসছি কিছুদিন পরই। আনন্দে কেঁদে দেয় অরণ্য।
বিশ্বের সকল বাবাদের জন্য বিনম্র শ্রদব্দা এবং ভালোবাসা রইল বিশ্ব বাবা দিবসে।