somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আয়রনম্যনের গল্প - পর্ব ২

০১ লা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১২/১০/২০২৪

রেইসের দিন

ভোর সাড়ে তিনটায় এলার্ম বেজে উঠলো। আজকে পরীক্ষার দিন, রেইস ডে। আগেরদিন খাবার দাবার নিয়ে বেশ গবেষণা হয়ছে। রাফাত আর আতাউর ভাই ভাত ডিম খাবে, নাহিদ কলা রুটি, খেজুর, সামিউল ভাইয়ের রুমে গিয়ে দেখি চিকেন শরমা, ভাত-মাংস দিয়ে মাখানো গোল্লা সব টেবিলে সাজিয়ে রেডি করে রাখা। উনি অবশ্য ফুল আয়রনম্যন দিবেন, তাই তাদের প্রস্তুতিপর্ব আরো নিখুঁত ভাবে করতে হয়। ফুল যারা দিবেন তাদের এক্সট্রা ব্যগ দেওয়া হয় রেইসের মধ্যে নিজের খাবার বা প্রয়োজনীয় হাইড্রেশন যেনো রেডি রাখতে পারে। নিদ্দিষ্ট জায়গায় তা সময়মত পৌঁছে দেওয়া হয়। আমিও একটা শরমা নিয়ে নিলাম। পেলাঙি হোটেল এর নিচে একটা তার্কিস শরমা হাউজ ছিলো, সেখানে সিলেটের এক ভাই শরমা বানায়। বেশ কয়েকবার সেখানে খেয়েছি, তাই আর অন্য কিছুতে গেলাম না।
আজকের দিনের প্রতিটি সময় গুরুত্বপূর্ণ, তাই বিছানা থেকে জলদি উঠে ফ্রেস হয়ে গরম পানি দিয়ে মধু পান করলাম এরপর শরমা খেয়ে নিলাম। হাতে কিছু সময় থাকলো যদি পেটে চাপ আসে এবং খাবারটাও হজম হয়। সব রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু হাতে লাগানোর জন্য বিব নাম্বারটা কোথায় হারিয়ে ফেললাম। যদিও মার্কার দিয়ে লিখে দিবে তারা। গায়ে বিডিট্রাই এর জার্সিটা পরে নিলাম, ভোরবেলা হাল্কা ঠান্ডা লাগে তাই জ্যকেট চাপালাম। সুইমিং গ্লাস আর ক্যাপ সঙ্গে নিলাম। একটা কালো ব্যাগ দিয়েছিলো তাতে বিব নাম্বার লাগানো আছে, সেখানে পাম্পার, সাইকেল পরিষ্কার করার জিনিসপত্র, সেন্ডেল সব রেখে আরেকটা গাড়িতে ফেলে দিতে পারবো। রেইস শেষে তা সংগ্রহ করতে হবে। জুতা আগেই টি-টুতে রেখে এসেছিলাম তাই একটা স্লিপার কিনে নিয়েছিলাম ১০ রিঙ্গিত দিয়ে। ৫টার মধ্যে সাকলাইন ভাই গাড়ি নিয়ে হাজির চেনাং ভিউ এর সামনে। হাফিজ মালয়শিয়ার দক্ষ ড্রাইভার, সাককাইন ভাই কয়েকবছর থেকে তাঁকে সঙ্গে রাখেন। ইংরেজিতে ভালোই কথা বলতে পারে। আমাদের রেগুলার রুট ছেড়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলো হাফিজ, কারন রেইসের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আয়রনম্যান আয়োজনের জন্য আজকে সব কিছু শিথিল করা হয়েছে। লানকাউইতে আজকে সাজ সাজ রব। পুরা শহর জেগে উঠবে প্রতিযোগিদের উতসাহ দেওয়ার জন্য।
এক ঘন্টা লাগলো 'ডানা লানকাউই'- তে পৌঁছাতে, তখনো আকাশে আলো ফুটেনি। শাটল বাস একেরপর এক আসছে প্রতিযোগী আর তাদের সঙ্গী সারথীদের নিয়ে। রেইসের সময় মোবাইল ফোন বা ক্যমেরা ব্যবহার এর অনুমতি নেই তাই সঙ্গী সাথীদের কাছে অনেকে তা রেখে যাচ্ছে যেনো কাছাকাছি দেখা পেলে ছবি তুলতে পারে। গতকাল যেখানে সাইকেল রেখে এসেছিলাম প্রথমে সেখানে চলে গেলাম। বৃষ্টি হয়েছে রাতে, সাইকেল ভালোমতো মুছে চেইনে লুব দিলাম। হাওয়া কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিলাম, যেনো রোদে অতিরিক্ত গরমে টিউবের ক্ষতি না হয়। রাফাত বড় পাম্পার নিয়ে এসেছে সেটা দিয়ে সবার কাজ হয়ে গেলো। সবার সাইকেল কাছাকাছি জায়গায় ছিল তাই একে অন্যের সহোযোগিতা করতে সুবিধে হলো। ফ্লাডলাইট এর আলো আর লাউড মিউজিক শরীর মনকে চনমনে রাখার উপাদেয় হলো। সময় কমে আসছে, মাইকে বার বার বলা হচ্ছে ইলেকট্রনিক চিপ পেয়ে গেলে ধীরে ধীরে সমুদ্র সৈকতের স্টার্টিং পয়েন্ট এর দিকে চলে আসতে। গোধূলির আলো ফোটার পরেই প্রথম ব্যচ সাঁতার শুরু করবে। আমার ক্যাপ এর রঙ নীল, সময় ৫০ মিনিট। লাল রঙের ক্যাপ যারা তাদের আরো দশ মিনিট কমে সাতার শেষ করতে হবে। আর সাদা ক্যাপ যাদের তারা সময় পাবে ১ঘন্টা ১৫মিনিট। গ্যাপ দিয়ে দিয়ে প্রতিযোগীদের পানিতে নামতে হবে নাহলে ভজঘট লেগে যাবে। একে অন্যের গায়ের উপর পড়বে বা হাত-পা লেগে ইঞ্জুরি হবার চান্স আছে।
পায়ে চিপ পরিয়ে দেওয়ার পর গুটি গুটি পায়ে আগাতে লাগলাম। রাস্তায় লাইন ধরে টেম্পরারি টয়লেট রাখা রয়েছে, সুন্দর ব্যবস্থা চাইলে কাজ সেরে নিতে পারে। কালো ব্যাগটা গাড়িতে দিয়ে সৈকতের বালুতে পা দিলাম। এখন আমি শুধু আমাতে আছি, এই যাত্রা শুধু আমার, আমাকেই একা সবকিছু শেষ করে ফিনিশ লাইনে দাঁড়াতে হবে এবং সবকিছু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। একে একে লাল ক্যপ পড়া প্রতিযোগীদের ডেকে নিচ্ছেন স্টার্ট পয়েন্ট এর দিকে। মাইকে উতসাহ উদ্দিপনামূলক কথা বলে হসলা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রথমের অনুভূতি সবসময়ই অনন্য। কেমন জানি একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করে। আমারও ডাক পড়লো, সবার সাথে গিয়ে দাড়ালাম। বিশ্বের কত দেশের মানুষ একত্র হয়েছে। অনেকের আয়রনম্যন দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক বার অনেক দেশে। আমার পাশে জার্মানির এক তরুন সেও প্রথমবার বেশ উচ্চসিত দেখাচ্ছিলো, আমরা পরিচিত হয়ে নিলাম। আরেকজন বেশ কয়েকবার আয়রনম্যন৭০.৩ দিয়েছেন তিনি বললেন, দুই -তিন বার হাফ দেওয়ার পর ফুল আয়রনম্যন এর জন্য যাওয়া উচিত। এটা সত্যি কঠিন কাজ। জেসন এর সাথে দেখা হয়ে গেলো, মালয়শিয়ার বাসিন্দা ৪বার হাফ আয়রনম্যন আর একবার ফুল দিয়েছেন। বয়স ৫০ এর উপরে। এক্সপোতে পরিচয় হয়েছিলো, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বেশ উতসাহ দেখিয়েছিলো। আজকের জন্য সুভ কামনা আর সাহস দিলো। ভেতরটা ধুকপুক করছে, আমাদের সময় এলে বাঁশি বাজানো মাত্র ঝাপ দিলাম সমুদ্রে। আমার সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেলাম তাই দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে থাকলাম। দড়ি দিয়ে সীমানা করে দেওয়া আছে, বিশাল আকারের হলুদ বয়া তাতে বাধা, কায়াকে ভভলান্টিয়াররা ঘুরছে আর কেউ লাইন ক্রস করলে বাশি বাজিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে। কেউ ক্লান্ত অনুভব করলে বয়া ধরে বিশ্রাম নেওয়ার অনুমতি আছে।
আজকে থামার বা স্লো হবার কোন অবকাশ নেই। প্রানপন সাঁতার কেটে যাচ্ছি, কেউ কেউ হাতে পায়ে বাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। আমি কখনো এগিয়ে যাচ্ছি অথবা সরে যাচ্ছি। সবাই দিশেহারার মত শুধু হাত-পা ছূড়ছে। সাঁতার এর প্রস্তুতি ভালোই নিয়েছিলাম তাও মনে হচ্ছিল আমার দম কমে আসছে, পথ আর কত দূর বাকি। বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার সময় তামিম আমাকে বলেছিলো ভাই যে সংখ্যা মাথায় আসে গুনতে থাকবেন তাতে করে একঘেয়ামি কাজ করবে না। আমি মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলতে সংখ্যা গোনা শুরু করলাম, ২০, ২১, ২২, ২৩ যা ইচ্ছে তা। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি সামনে বিচ দেখা যাচ্ছে, এইত পেরে গেলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৪৭মিনিটে সাঁতার শেষ করলাম। আমার টার্গেট সময়ের আগেই শেষ হলো। জাহিদ ভাই এর গার্মিন ওয়াচ আর হেলমেট এর জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তার জিনিগুলো আয়রনম্যান ঘুরে এলে তিনিও তৈরি হবার অনুপ্রেরণা পাবেন।
সাঁতার থেকে উঠে মাথা ভনভন করছিল। টি-ওয়ান এ ব্যগের কাছে গিয়ে খেই হারিয়ে মাথার ক্যপ কোথায় ফেলে দিলাম। পানি খেয়ে নিজেকে ঠিক করে, ব্যাগে রাখা টাওয়াল দিয়ে গা মুছে জুতা মোঝা পরে নিলাম। চশমা,ওটস বার সব জার্সিতে গুজে মুখে সানস্ক্রিন গায়ে ভেজলিন লাগালাম। টেবিলের উপর সব রাখা আছে। সুইমিং ক্যপটা মাটিতে খুঁজে পেলাম, চশমা আর ক্যপ সেই ব্যগে রেখে সাইকেলের দিকে ছুটলাম। এর মধ্যে ১০মিনিট চলে গেলো চোখের পলকে। একে ট্রানজিশন টাইম বলে, যা মোট সাড়ে আট ঘন্টার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সাইকেলে হেলমেট রাখা ছিলো, চশমা হেলমেট সব কিছু ঠিকঠাক দেখে নিয়ে ডানা থেকে রাস্তায় উঠে মনে পড়লো হ্যন্ড পাম্পারটা ব্যগে ফেলে এসেছি। সিওটু কার্টিজ যা দ্রূত হাওয়া দিতে কাজে লাগে তাও কেনা হয়নি। এখন উপরওলাই একমাত্র ভরসা। কারন পথে লিক হলে রেইস কর্তৃপক্ষের সাহায্যের আশায় বসে থাকলে সময় সব ফুরিয়ে যাবে। শুরু করলাম যাত্রা, সাঁতার এর পর সাইকেলে ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগলো। এনার্জি বাঁচিয়ে পথ চলতে হবে এর পরে আরো কঠিন দৌড়ের পর্ব বাকি আছে। ৯০কিলোমিটার পথ আগেই আমরা দেখে ফেলেছি সুতরাং এখন রাস্তা কোথায় কেমন কিছুটা মাথায় আছে। পাহাড়ের আপ-এ আমি কোথাও ঠেলে উঠলাম। ডাউনে স্প্রিড এ নামলাম আবার সেই গতি ঠিক রেখে চড়াই উঠে গেলাম চালিয়ে। সাঁতার এর সময় কিছুটা মাসলপুলের আলামত দেখা দিয়েছিলো তাই রিস্ক না নিয়ে সাইকেলের সময় হাইড্রেশন পয়েন্ট থেকে পায়ে স্প্রে করে নিলাম। কলা খেলাম, ইলেকট্রোলাইডের বোতল নিয়ে নিলাম, হাই ফাইভ জেল খেলাম। আমার টার্গেট ৪ঘন্টার মধ্যে সাইকেল শেষ করা। যুদ্ধ কর‍তে করতে মরে যাওয়া যাবে না। রাস্তায় দেখলাম অনেক ভালো মানের দামী সব সাইকেল পাংচার হয়ে উপর করে অপেক্ষা করছে সাহায্যের আশায়। যারা পাচ্ছে তারা সত্যি ভাগ্যবান। গ্রাম জঙ্গল পাহাড়ের মাঝখানে কখন চাকা লিক হবে কেউ যানে না। পথে আকিক কে ক্রস করার সময় বলল তারও চাকা লিক হয়েছিলো। সে মাউন্টেন বাইক নিয়ে গেছে তবে চাকা সরু। পরে শুনলাম নাহিদেরও লিক হয়েছে সিওটু দিয়ে কোনরকমে পার পেয়েছে। অর্ধেক পথে এসে আমাকে একে একে পিজুশ, রাফাত, আতাউর ভাই ক্রস করেছে। তারা সাইকেল অনেক ভাল চালায় তাই সাঁতারে একটু দেরি হলেও সাইকেলে আমাকে ধরে ফেলেছে। আমি আমার পেইস ঠিক রেখে চালিয়ে যাচ্ছি, এই যুদ্ধ যেহেতু আমার একার সুতরাং কাউকে চেজ করার প্রয়োজন নেই। শুধু কামনা করি সবাই যেনো ভালোভাবে ফিনিশিং লাইন ক্রস করতে পারে। আরাফাত কেও পথে পেলাম, ফুল আয়রনম্যন প্রতিযোগীরা আমাদের প্রায় আধাঘন্টা পরে শুরু করেছে। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের রেইস চলবে। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে লোকালয়ে ঢুকে গেলাম, রাস্তায় দোকানের সামনে বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়েরা সবাই দাঁড়িয়ে আমাদের হাততালি দিচ্ছে। বাচ্চারা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ক্ল্যাপ করতে চাইছে। কেউ আবার নিজ উদ্যোগে পানি খাবার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। আয়নম্যান বলে বলে আমাদের উজ্জীবিত করে চলেছে। আয়োজকদের দেওয়া সাদা বোতল বাচ্চাদের দিয়ে দিচ্ছে কোন কোন প্রতিযোগিরা।
মুসুরি এক্সিবিশন সেন্টার এর কাছে এসে বেলাল ভাই এর দেখা পেলাম। তিনি রাস্তা ভূল করে ২০কিমি অতিরিক্ত চালিয়ে ফেলেছেন এবং আয়োজকরা পেনাল্টিতে অপেক্ষারত রেখেছেন। এক ঝলকে তার আর্তনাদ শুনলাম, "দেখেন ভাই আমাকে আটকে রেখেছে"। তিনি এই লানকাউইতেই আরো কয়েকবার আয়রনম্যান সম্পন্ন করেছেন, তারপরও রাস্তা কিভাবে ভূল হয় এটাই ভেবে পেলামনা। আসলে রেইসের সময় অনেক কিছুই হতে পারে, সব ঘটনার জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। বেলাল ভাই আরো ২০কিমি বেশি মোট ২২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এরপর আবার কাটঅফ টাইমের মধ্যে ৪২কিমি রান করে আয়রনম্যান শেষ করেছিলেন। এক্সিবিশন সেন্টার এ প্রবেশ করে মনটা শান্ত হলো। হিমশীতল হাওয়ায় লাল গালিচার মধ্যে দিয়ে হেটে যেতে বেশ রাজকীয় মনে হলো নিজেকে। সাইকেল টি-টু এর স্থানে রেখে রান এর ব্যাগ থেকে ক্যাপ, বিব আর দেশের পতাকা নিলাম। মজা পাল্টে নিলাম। শীতল হাওয়া ছেড়ে বের হওয়া মাত্রই বুজতে পারলাম দোযগে প্রবেশ করেছি। বেলা একটা বেজে গেছে, মাথার উপর প্রখর সূর্য এর মধ্যে দৌড়ে যেতে হবে ২১কিমি। পুলিশ ট্রেনিং একাডেমির রাস্তা ধরে এয়ারপোর্টের দিকে ট্রেক চলে গেছে। রানওয়ে বলতে গেলে উন্মুক্ত, এক পাশে প্লেন উড়ে যাচ্ছে অন্যপাশে সমুদ্র, কি সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু এই গরমে দৌড়াতে দৌড়াতে দৃশ্য যে হজম হয়না। তপ্ত রোদে এই দৌড় শেষ হলেই এই যাত্রায় পরীক্ষায় পাশ। গরমের জন্য সব ব্যবস্থা তারা করে রেখেছেন। ৩কিলোমিটার পর পর হাইড্রোশন পয়েন্টে বরফ ঠান্ডা পানি বালতি দিয়ে ঢেলে দিলো, ঠান্ডা তরমুজ সাজিয়ে রাখা গপাগপ খেয়ে নিলাম। কোক রাখা আছে ইনিস্ট্যান্ড এনার্জি আর জেল তো ছিলই। রানির শুরুর সময়ই জেল খেয়ে নিলাম। মেডিকেল বুথ থেকে মাসেলে স্প্রে করে জামার ভেতর বরফ ঢুকিয়ে দিলো। এত জল শরীরে যাওয়ার পরেও দেখছি মূত্র বিসর্জনের কোন খোঁজ নেই। শরীরে অসস্থি শুরু হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দৌড়ের গতি কমতে থাকলে আট ঘন্টার মধ্যে শেষ করা কঠিন হয়ে যাবে। শহরের মধ্যে দিয়ে দুইবার পাক খেতে হয়, চারপাশের দোকানীরা সবাই রাস্তায় নেমে ঘন্টা বাজাচ্ছে আর আমাদের চিয়ারআপ করছে। মন আবার চাঙা হয়ে উঠলো। ১০কিলোমিটার রান শেষে সতির্থদের সাথে দেখা হওয়া শুরু হলো। নাহিদ, রাফাত, সৌরভ দা, আতাউর ভাই আমাকে ক্রস করে যাচ্ছে। তারা আমার আগেই ফিনিশ লাইনে পৌঁছে যাবে। আমি এবার আরেকটু গতি বাড়িয়ে দিলাম। পা যেনো চলতেই চাইছে না। একপাক ঘুরে এসে লেংগুরা বিচের কাছে ফিনিশ লাইনে পৌঁছে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ঘড়ি দেখে মনে হচ্ছিল আমারত এখন দৌড় শেষ হবার কথা না। ভলেন্টিয়াররা ঠিক পাশ দিয়ে রস্তা দেখিয়ে দিলো এরপর বুজলাম আরো এক চক্কর একি পথে ঘুরে আসতে হবে, যা খুবই বোরিং। একটা পিংক কালারের ব্যান্ড হাতে পরিয়ে দিলো। এই চক্করের পর সব উত্তেজনার অবসান হবে।
সময় যত যাচ্ছে সূর্যের তাপ আরো বেড়ে চলেছে। পানিয় যা আছে গিলে যাচ্ছি, জেল ও খেয়ে ফেললাম। নিচের দিকে সব অবস হয়ে গেলো মনে হচ্ছে। কিন্তু দৌড় তো থামানো যাবে না, বার বার মনকে তাই বুঝালাম। এয়ারপোর্টের রাস্তায় মারিয়াকে দেখতে পেলাম। তখন সে আমার আগেই ছিলো। একটা জায়গায় এসে ইউটার্ণ নিতে হয় আয়রনম্যান৭০.৩ প্রতিযোগীদের, আর যারা ফুল দিচ্ছে তারা চলে যাবে সামনে। খুব সুন্দর করে সব ধরনের সাইন দেওয়া আছে এবং ভভলেন্টিয়াররাও বেশ সচেষ্ট সব ধরনের সহযোগিতায়। লক্ষ্য করলাম মারিয়াকে আর দেখা যাচ্ছেনা সামনে। সে ফুল আয়রনম্যান এর ট্রেকে ডুকে গেছে। এখন পুলসিরাত পার হবার মত অবস্থা, কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। আমি প্রাণপণে গতি ঠিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আর বার বার ঘড়ির দিকে তাকাই। হাইড্রোশেন পয়েন্টে আর থামার চেষ্টা করলাম না। শহরের দোকানিদের হাততালি পার হয়ে বালির রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। ৮ ঘন্টা শেষ হতে আরো ১০মিনিট বাকি আছে। আমি ফিনিশ লাইন দেখতে পাচ্ছি, পকেট থেকে লাল সবুজ পতাকা বের করে দুহাত উঁচু করে যতটুকু শক্তি বাকি আছে দৌঁড়াতে থাকলাম। আমার চোখে পানি চলে এলো। ফিনিশিং লাইনে ঢুকার মুখে লাল গালিচা বিছানো, সাজ সাজ রব, সংগীতের মূর্ছনায় উত্তেজনায় ভরপুর। আমি ফিনিশ লাইনে দাড়ালাম, মাইকে আমার নাম বলা হলো, আমার দেশের নাম বলা হলো, বুকটা ভরে গেলো আনন্দে। আট ঘন্টার আগেই শেষ করলাম আয়রনম্যান৭০.৩মাইল। স্বপ্নের মত এত দিনের পরিশ্রম আজ স্বার্থক হলো। নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হলুদ আর নীলের মিশেলে সুন্দর মেডেল আমার গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো। আয়রনম্যান৭০.৩ ফিনিশার লিখা একটা টাওয়াল জড়িয়ে দিলো শরীরে। জীবনের এই অনন্য অনুভূতি হয়ত কখনো ভুলতে পারবো না।
....
যারা এই যাত্রায় আমাকে নানা দিক থেকে সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। ইমতিয়াজ ইলাহি ভাই, রিপন ভাই এর কাছ থেকে গল্প শুনতে শুনতে আর উতসাহ পেয়ে এই ফিনিশ লাইনে এসে দাড়াতে পারবো তা কল্পনাও করি নাই। অনেক ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা। আর্থিক প্রতিকূলতা পার করতে ক্রাউড ফান্ডিং করতে হয়েছে। সহযোগিতা যেভাবে পেয়েছি, নিজেকে সৌভাগ্যবান বলবো।
রেজিষ্ট্রেশন এর সময় হেদার আমাকে ইউএস থেকে টাকা পাঠিয়েছে। এরপর টাকা পাঠিয়েছে কানাডা থেকে বন্নি, জার্মানি থেকে আমার বন্ধু সুস্মিতা, জাহিদ ভাই, প্রবাল দা, জিয়া ভাই, সাহেদ, আমিদ, সুলতান রিপন ভাই, নাজু আন্টি, সুমিট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ভিসার জন্য আরিফ ভাই অনেক দিন আমার একাউন্টে টাকা রেখেছেন। এত ভালোবাসা পেয়ে যা কিছু বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাও কম হবে। ধন্যবাদ আমার উপর বিশ্বাস রেখেছেন। আশাকরি ভবিষ্যতেও বড় কোন অভিযানে যাওয়ার আগে প্রপার কোন প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর পাবো। এই অর্জন যদি তরুণদের এবং সমাজের কাজে লাগে তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×