somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাবছি কিডনিটা বিক্রি করে দেব

১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রথম অংশ:

একরাশ হতাশা নিয়ে রাস্তায় নামলাম।শোঁ শোঁ করে ছুটে চলেছে আন্তঃজেলা পরিবহনের বাস গুলো। লোকাল সার্ভিস রাস্তায় জটলা পাকায় আর বিশ্রী শব্দে হর্ণ দিতে থাকে। কিচ্ছু সহ্য হয়না। একেবারেই ভালো নেই - ভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় না। চেনা বাস গুলো চেনা রুট ধরে ছুটে যায় , আমি দিকভ্রান্তের মত দিশাহীন দাঁড়িয়ে থাকি একা। চেনা গন্তব্য অচেনা লাগে।হাত একেবারে খালি। কিছু টাকার খুব প্রয়োজন। পরিচিতজনরা মুখ ফিরিয়ে নিলো খুব সহজেই। ভাবছি কিডনিটা বিক্রি করে দেব।কবিদের কিডনির কেমন দাম কে জানে?

বাসের জানালার কাঁচে ঝাপসা
আমার অর্বাচীন চোখ।
ফেলা আসা বহুদূর
বহুদূর থেকে ভেসে আসা
সকরুণ আকুতি।
চেয়েছে কি বেশি কিছু?
শুধু শূন্যস্থানে বেড়ে
যাওয়া ব্যবধান।
সেখানে কেউ নেই
ছিলোনা কেউ, আগের মতই।

শেষ অংশ:
১৯৯৬ সালে আম্মার ক্যান্সার ধরা পড়লো।সদ্য বিলেত ফেরত ডাক্তার শাহেদা পারভীন আম্মার খোঁজ খবর নেন। ছুটে বেড়ান। তার বসার কোন জায়গা নেই , চেম্বার বলতে ঘাড়ে ঝোলানো ব্যাগ।কেউ তেমন তাকে পাত্তা দিতে চাইনা। ডাক্তার শাহেদা ম্যাডামের কাছে আমরা ঋণী। অন্যান্য ডাক্তারের সাথে মোটামুটি ঝগড়া করেই তিনি ভ্যাকসিন (Taxotere) পুশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন আম্মার সাথে কথা বলে। আম্মা শুধু একটা কথায় বলেছিলেন ডাক্তারদের ," আমার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে শুধু আমার সাথেই আলোচনা করবেন। আমি রুগী , আমার চেয়ে আমার ব্যাপারে কেউ ভালো ডিসিশন নিতে পারবে না। এবং সব কিছু খোলাখুলি বলবেন। কিছু গোপন করবেন না। বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। "

এক একটা ভ্যাকসিন ৭৫০০০ টাকা করে। সরাসরি আসতো বিমানে। অনেক টাকার বিষয়। একজন হেডমাস্টারের সম্মান অনেক টাকা কম। আমার আব্বার সন্মানের কমতি ছিল না। তবে তার নামে কোন ব্যাঙ্ক একাউন্ট ছিল কিনা আমার জানা নেই , ছিল হয়তো। আব্বার জমিজমাও নেই। দাদার যা ছিল সেটা যুদ্ধের পরে দখল হতে লাগলো মহাউৎসবে। আব্বা দাদা কে একদিন বললেন , '' আব্বা।রায়টার জমি গুলো তো দখল হয়ে যাচ্ছে। একটু খোঁজ নেয়া দরকার। ''
পরহেজগার দাদা শুধু বললেন , ''আল্লাহ কি আমাদের খাওয়াচ্ছে না ?''
আমার আব্বা আর কোন কথা বললেন না। জমি নিয়ে মাথা ব্যাথা আব্বার ছিল না। স্কুলে দুপুরে একটা সিঙ্গারা , একটা মিষ্টি আর এক কাপ চা খেতে পারলেই তিনি খুশি। আমার আব্বা হেড স্যার হিসেবে ৩৬ বছর চাকুরী করেছেন দুপুরে সিঙ্গারা আর মিষ্টি খেয়ে। আমি দেখতাম আব্বা বাড়ি ফিরতেন বিকালের পরে , হাতে পাউরুটি কলা আর বগলে খবরের কাগজ নিয়ে। আমি অপেক্ষায় থাকতাম।

শুনেছি , তখন যুদ্ধ শেষ ! আমাদের বাড়িতে আশ্রিত অনেক মানুষ। অনেকজনের খাবারের ব্যবস্থা। খরচ পাতি। বেশির ভাগ খরচের অংশ আব্বার বহন করতে হয়। একদিন আব্বা দাদার কাছে গিয়ে বললেন , ''আব্বা। যুদ্ধ তো শেষ। সবাই না হোক যে যার বাড়ি ফিরে যাক।''
দাদা চুপ করে থেকে বললেন , ''তোমার কি ধারণা , তুমি খাওয়াচ্ছ ? ''
আব্বা কিছু বললেন না। আসলেই তিনি খাওয়াচ্ছেন না । তিনি তো উসিলা মাত্র।
দাদা বললেন , '' আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আল্লাহ তোমার ভালো করবেন। ''
দাদা জানালার পাশে বসে থাকেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ কে ডাকেন। উনার কাছে রুগী আছেন উনি নাম কা ওয়াস্তে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা দেন , ছাত্রদের ইংরেজি শেখান। আর আমার দাদি একটা রুটি চার জনকে ভাগ করে খাওয়ান। তার কাছ থেকে কোন ভিক্ষুক ফিরে যায়না। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন , সেই নিঃশ্বাসে উড়ে বেড়ায় পোড়া বাড়ির গন্ধ। ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে আম্মার চিকিৎসার জন্য আব্বা তাঁর রিটায়ারমেন্টের টাকাটা আগাম তুলে ফেললেন। আমার আম্মাও প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন , তার ফান্ড প্রায় নিঃস্ব হলো। এরপর একসময় অপরেশনের সময় হলো। (Taxotere) তে বেশ সুফল পাওয়া গিয়েছিলো। তা নাহলে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো না। এই সময় হুটহাট করে অনেক টাকার দরকার হতো। আম্মা অনেকের ভরসায় ঢাকায় আসতেন। অনেকেই বলতো আসেন ব্যবস্থা করবো। অপরেশনের দুইদিন আগে এক পরিচিতজন জানালেন , তিনি টাকাটা দিতে পারছেন না।
আম্মা বললেন , ''টাকাটা আমি সামনের মাসেই ফেরত দিব। জেসমিনের (আমার বড় বোন ) আব্বা ভেড়ামারা থেকে ব্যবস্থা করবে। ফান্ডের টাকা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। ''
পরিচিতজন কিছু বললেন না।মৃত্যু পথযাত্রীকে কেউ টাকা ধার দিতে চায় না। টাকা হারানোর ভয় থাকে।
৩০০০০ অনেক টাকা। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আচ্ছা , আব্বা -আম্মার মানসিক অবস্থা তখন কেমন ছিল ?

আমার আম্মু একজন ক্যান্সার সার্ভাইভার। তিনি বেঁচে আছেন এবং বাঁচতে শেখান। ওই টাকার ব্যবস্থা কিন্তু হয়েছিল। দাদা একবার আব্বা কে বলেছিলেন , '' আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আল্লাহ তোমার ভালো করবেন। ''
এই ঢাকা শহরে মানুষের ভীড়ে ফেরেস্তারা ঘুরে বেড়ান।

মাথা থেকে গল্পের প্রথম অংশটা মুছে ফেলতে ইচ্ছা হয়। বাসের জানালায় অস্পষ্ট দৃষ্টিতে বাইরে তাকায়। বিজয় সরণীর চিরচেনা সিগন্যালে গাড়ি আটকে আছে। বকুল ফুলের মালা বিক্রেতা মেয়েদের দল এ গাড়ি থেকে ও গাড়ি ছুটে যায় বাঁচার আশায়। বিক্রি হয়না মোটেও। আচমকা একটা বিক্রি হয়ে গেলে মুখে হাসি ফুটে উঠে। কি মায়াময় সে হাসি ! কি যে মায়া !!



সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৩
১৯টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×