আমার আব্বা অনেক কিছুই লিখতে চাইতেন। বিভিন্ন কারণে শেষ করতে পারেননি। অনেক জায়গাতেই টুকরো টুকরো লেখা আছে। কোন লেখায় শেষ হয়নি। এই লেখাটা কয়েক দিন আগের লেখা। উনি লেখেন নি। এখন আর সেই ক্ষমতা নাই।
আমার কাছে ভয়েজ রেকর্ড পাঠিয়েছিলেন। আমি পাতায় হুবহু লিখেছি মাত্র। আজ কিছু অংশ দিলাম। যখন ক্ষমতা ছিল লেখার , তখন হয়তো অনেক কিছুই লিখতে পারতেন। আমার ভীষণ অপরাধবোধের একটা হচ্ছে আব্বার কথা গুলো না লিখতে পারা।
১.
ফজরের নামাজের পর আব্বা ডাকছেন- " ও গো ওঠো ওঠো। তোমার কাছে কে যেন এসেছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। "
এই ভোরে আমার কাছে কে আসবে ? আমি দরজা খুলে বাইরে গেলাম। দেখি একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে । বুঝলাম অনেক দূর থেকে এসেছে । চোখ দুটো বড় , ফোলা। বোঝা যায় সারারাত ঘুম হয়নি । দীর্ঘ ভ্রমন আর না ঘুমানোর ক্লান্তি স্পষ্ট লেগে আছে চোখে। উনার হাতে একটা চিঠি। আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
তাতে লেখা--
" আমার যদি ভুল না হয় তুমি আবুল কাসেমের ভাই - রুহুল ইসলাম । পত্র পাওয়া মাত্রই বাহকের সাথে চলে আসো।"
চিঠিটা লিখেছেন তেঁতুলিয়া হাইস্কুলের হেডমাস্টার ।
সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করলাম না । বাবার দেয়া সাহস আর আগ্রহে যাত্রা শুরু করলাম সূদুর তেঁতুলিয়ার পথে। সেই সাথে একজন হেডস্যারের ৩৮ বছরের যাত্রা শুরু হলো। তখন আমার বয়স ছিল ২১!
২.
তেঁতুলিয়াতে কাজ বুঝে নিতে সমস্যা হয়নি। ভেড়ামারা স্কুলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগলো। তেঁতুলিয়া হাইকুল কে সাজানোর চেষ্টা করলাম। বয়স কম ছিল বলে কখনো দ্বিধায় পড়িনি। অনেকেই তাচ্ছিল্য করে বলতো , আপনিই হেডস্যার ? পারবেন তো।
আমি বলতাম , জ্বী আমিই হেডস্যার। এতে কোন সন্দেহ নাই।
তেঁতুলিয়ায় যেখানে আমি থাকতাম। তার কিছুটা দূরেই চায়ের দোকান। সারাদিন চা বিক্রি হয়। নোনতা বিস্কুট , মিষ্টি বিস্কুট , মুড়ি , চানাচুর। সকল ধরনের মানুষ ওখানে চা খেত। বয়োজ্যেষ্ঠ , মুরুব্বি , দড়িপাকা বুড়ো এবং নানা বয়সী মানুষ।
আমি দোকানে চা খেতে যেতাম। আমাকে দেখলেই দোকানি চায়ের কাপ গরম পানি দিয়ে ধোয়া শুরু করতো , ‘হেডস্যার আসছে’ বলে সবাই উঠে দাঁড়াতো , এমনি কি চায়ের বিল দিতে দিতো না। বাবার বয়েসী মানুষদের থেকে এই ধরনের আচারে আমি স্বাভাবিকভাবেই বিব্রতবোধ করতাম।
একদিন দোকানিকে ডেকে বললাম। সম্ভব হলে আমার চাটা তুমি আমার ঘরে দিও। দোকানে আমার ঘরেই চা দিয়ে আসতো। এরপর থেকে আমি কোনদিন চায়ের দোকানে চা খায়নি।
৩.
একদিন অফিসে বসে আছি দপ্তরি একটা খাম দিয়ে গেল। ইন্টারভিউয়ের জন্য সিরাজগঞ্জ হাই স্কুল থেকে ডেকেছে হেড মাস্টার পদের জন্য । কিছুক্ষন চিঠি নিয়ে বসে থাকলাম। তারপর একটা চিঠি লিখলাম ,
“আপনারা যে পদে আমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছেন , আমি ঠিক সেই পদেই কর্মরত আছি। তাই আবার সেই পদেই ইন্টারভিউ দেয়াটা আমার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেইসাথে যাতায়াতে সময় নষ্ট , অর্থ নষ্ট , শারীরিক পরিশ্রম। তাই হেড মাস্টার পদে ইন্টারভিউ দিতে যেতে খুব একটা আগ্রহ পাচ্ছি না। “
মাসখানেক পরে একটা চিঠি এলো। তাতে লেখা ,
“আমরা তোমার চিঠি পড়েছি। আমাদের ইন্টারভিয়ের পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। আমরা কাউকে সিলেক্ট করতে পারিনি। আমরা হেড মাস্টার পদে তোমাকেই যোগ্য মনে করছি। তোমার ইন্টারভিউ নেয়ার প্ৰয়োজন নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি সিরাজগঞ্জ হাইস্কুলে স্কুলে যোগদান করো। “
চিঠিটা নিয়ে আমি তেঁতুলিয়া স্কুল কমিটির কাছে গেলাম। তারা বললো – “ তোমাকে ছাড়তে আমাদের খুব খারাপ লাগবে। তাই বলে আমরা চাইনা জীবনের ভালো সুযোগ গুলো তুমি কাজে না লাগাও। তেঁতুলিয়াকে ভুল না। “
আমি তেঁতুলিয়া কে ভুলি নি। ওখানকার মানুষের কাছে অনেক সন্মান অর্জন করেছি , ভালোবাসা পেয়েছি। আমার খুব ইচ্ছা জীবনের শেষ সময়ে হলেও যেন তেঁতুলিয়া ঘুরে আসতে পারি। সেই স্কুল তাকে দেখতে পারি। আমি জানি আমার ছাত্ররা নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করবে।
৪.
হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে টিনের ট্রাঙ্ক আর ঘাড়ে ব্যাগ। সামনেই সিরাজগঞ্জ হাইস্কুলের ঘর। আমাকে দেখে এক বয়োজ্যেষ্ঠ লোক এগিয়ে এসে বললেন , আপনার পরিচয় ?
আমি বললাম , আমি এই স্কুলের হেডমাস্টার। আমার নাম মোঃ রুহুল ইসলাম।
উনি সালাম দিয়ে বললেন , আসুন স্যার আসুন।
আপনার নাম কি ? আমার নাম বসন্ত। আমিদপ্তরি।
তিনি আমাকে স্কুল রুমে নিয়ে গেলেন। সিরাজগঞ্জে আমার নতুন যাত্রা শুরু হলো।
সম্পর্ক তৈরী হয় সম্মানের মাধ্যমে , সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ। দপ্তরি বসন্ত বয়স্ক মানুষ , স্কুলের অনেক পুরোনো মানুষ। স্কুলের প্রতি তাঁর দরদ আর সন্মান দেখেই বোঝা যায় স্কুলের সাথে তাঁর সম্পর্ক কতটুকু। স্কুলের ভালো মন্দ , ফাঁক ফোকর সব কিছু বসন্ত জানত।
ওর সাথে আমার অনেক কথা হতো। স্কুল ছুটির পর মাঠে হাঁটতাম কথা হতো স্কুল নিয়ে। একদিন তার বেতনের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বলল , ১২ টাকা।
কমিটিকে একদিন বললাম , উনার বেতন বাড়িতে দিন। অনেক পুরোনো লোক, সৎ । স্কুলের সব খবর জানে , পরিশ্রম করে, দায়িত্ব পালন করে , স্কুলের প্রতি প্রচন্ড রকম দরদ আছে। ওর বেতন ৫০ টাকা করে দিন।
কমিটি অবাক হয়ে বললো, আপনার বেতন ই তো ৫১ !
আমি বললাম, হোক! এই স্কুলে আমার চেয়ে বেশি বেতন পাওয়ার যোগ্যতা রাখে সে।
স্কুল কমিটি আমার কথা রেখেছিলো।
এর আগে সম্মানের কথা বলেছিলাম। বসন্তকে আমি বয়জেষ্ঠ হিসাবে এবং স্কুলের প্রতি তার দায়িত্ববোধ , ভালোবাসার প্রেক্ষিতে যেমন সন্মান করতাম ঠিক তেমন ই সে হেডস্যার হিসেবে আমাকে সন্মান করত। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না।
বসন্ত যেদিন মারা যায় আমি আমার চেয়ারে বসে খুব কেঁদেছিলাম। হুহুকরে কেঁদেছিলাম। অভিবাবক , বন্ধুত্ব কিংবা বিশ্বস্ততা .... সম্পর্কের সংজ্ঞা কি?
৫.
সপ্তাহের একদিন একটা ভিক্ষুক আসতো। আমি পয়সা দিতাম। একদিন দেখি আসে না। আমি অপেক্ষা করলাম , এলো না। পরদিন আসতে দেখে পয়সা বের করলাম। ভিক্ষুক বললো , স্যার আজ ভিক্ষা নিতে আসিনি। দাওয়াত দিতে এসেছি। স্কুলের সবাইকে দিয়েছি।
পরেরদিন দপ্তরির নিয়ে গেল ভিক্ষুকের বাড়িতে। গিয়ে তো অবাক। টিনের পাঁকা বাড়ি। আমাদের বাড়ির চেয়েও অনেক ভালো।
পরের সপ্তাহে ভিক্ষুক আবার এলো। আমি বললাম , তোমার অবস্থা এতো ভালো তবুও ভিক্ষা করো কেন ?
ভিক্ষুক বললো , স্যার। ভিক্ষা আমাদের বংশগত পেশা। অবস্থা যতো ভালোই হোক না কেন ভিক্ষা আমরা করবো।
আমি বললাম, আমি তোমাকে আর ভিক্ষা দেব না।
৬.
বাড়ি থেকে আব্বা চিঠি দিচ্ছে। বলছে তুমি চলে এসো। ভেড়ামারা স্কুলের হাল ধর। ভেড়ামারা ছেড়ে কোথাও চাকুরী করতে হবে না। ভেড়ামারার মুরুব্বি বয়জেষ্ঠ এবং প্রভাবশালী মানুষগুলো আব্বাকে বলেছেন চলে আসতে।
সিরাজগঞ্জ থেকে আমি চলে আসলাম।বিশাল এক অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি জমা হলো। আমার প্রাণের একটা অংশ রেখে ওখানে এলাম।
জয়েনিং লেটার হাতে পেলাম। আব্বা বললো, যাও বড় চাচার সাথে দেখা করে আসো।সবার আগে চিঠি টা তাকে দেখাও।
আমি বড় চাচার কাছে গেলাম।চিঠিটা দিলাম। দিয়ে বললাম , বড় চাচা আমি ভেড়ামারা ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না !
বড় চাচা আবেগ সামলাতে না পেরে সবাই কে ডাকলেন। বললেন , দেখো ভেড়ামারা হাইস্কুলের নতুন হেডস্যার এসেছে।
ভিএম সাহেব চাচার ওখানে থাকতেন। তিনি ছুটে এলেন নতুন হেডস্যার দেখতে। দেখে কিছুটা অবাক হলেন।
স্কুলের প্রথমদিন। হাফেজ সাহেব সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আমি উনাকে খুঁজলাম । পেলাম না। শুনলাম উনি স্কুলের ছাত্রাবাসে শুয়ে আছেন। আমি গিয়ে বললাম , হাফেজ সাহেব উঠুন। একসাথে কাজ করতে হবে না ?
হাফেজ সাহেব চুপ করে কিছুক্ষন বসে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। সেইযে উঠে দাঁড়ালেন , মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
দাপ্তরিক, সামাজিক , ব্যক্তিগত সব ক্ষেত্রেই এই মানুষটা আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। ঈদের নামাজের পরে আমি উনার কাছে চলে যেতাম। ওই একটা মানুষের কাছেই যেতাম।
উনি যেদিন মারা যান।ঠিক মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে। কথা বলতে কষ্ট হতে ছিল।
সবাই যখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে। আমি ছলছল চোখে শুধু এটুকুই বলতে বলতে পেরেছিলাম , "আমার একটাই বন্ধু ছিল। সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। '
সম্পর্ক নিয়ে একটা কথা বলেছিলাম। আবার বলবো - অভিবাবক, বন্ধুত্ব কিংবা বিশ্বস্ততা....সম্পর্কের সংজ্ঞা কি?
শেষঃ
ভেড়ামারা পাইলট হাইস্কুলের শেষ দিনের কথা , স্মৃতির কোন কিছুই আজ বললো না।
শুধু বলতে পারি - শেষ দিন স্কুল থেকে ফিরে আসতে আসতে ভেবেছিলাম, “স্কুলকে পিছনে রেখে আমি শেষ দিনটাই গেট পার হয়েছি ঠিকই কিন্তু আমার হেডস্যার হিসাবে যাত্রাটা চলমান থাকবে। স্কুলে লিখিত কোন পদ থাকবে না ঠিক কিন্তু 'অলিখিত' হেডস্যার পদের দায়িত্বটা পালন করে যেতে হবে আজীবন। এটাই নিয়তি কিংবা ভীষণ প্রাপ্তি!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৩:২২