খুব ভোরে মা বাবার ফিসফাস কথা পাশের ঘরে দরজা খোলার শব্দ, বারবার বাইরে যাওয়া আর ঘরে আসার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। খানিক বিছানায় শুয়ে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। মা বাবার পাশে দাঁড়ালাম ডিসেম্বরের শীতে জোড়সোড়ো হয়ে। তখনো ভোরের আলো ফুটেনি। আধো অন্ধকারের স্নিগ্ধ পবিত্র সময়। এমন ভোরে দরজা খুলে বাইরে আসা হয় না কত দিন। বাইরে আসাই তো নিষিদ্ধ। গোট বছরটা ঘরের ভিতরে কেটে গেলো। বন্ধ দরজা জানালা ভেন্টিলেটর কাগজে ঢাকা। দিনের বেলায়ও দিনের আলো না দেখার মতন বন্দী ঘরের ভিতর।
এত ভোরে রাস্তা দিয়ে কিছু মানুষ এদিক থেকে ওদিকে চলেছে। কিছু মানুষ পরিবারসহ যাচ্ছে। খানিক পরে ভোরের আলো ফুটছে। এক সময় বাবা এগিয়ে গেলেন উঠান পেরিয়ে বড় রাস্তার কাছে। ছুটে যাওয়া মানুষদের কছে জিজ্ঞাস করে কিছু সংবাদ জানার চেষ্টা করলেন। আর্মিরা নাকি আমাদের শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আরো অন্য বাহিনী আসছে কিনা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না কী হচ্ছে। সবাই অন্য রকম কিছুর আশংকায় ভীত। নিরাপত্তার খুঁজে ছুটছে। কি হবে কি হচ্ছে কেউ ভালো করে কিছু জানে না।
দুপুরের দিকে বারবার প্লেন ছুটে যাচ্ছে ফাইটার প্লেন প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে আমরা ছুটে ছুটে বাংকারে ঢুকছি। কতক্ষণ পর বাংকারের ঘর থেকে বাইরে আসছি। আবার প্লেন আসলে দৌড় দিচ্ছি, মাটির নীচের ঘরে। দশ বারো বার কী তারও বেশী মনে নাই। এক সময় বাবা দেখার চেষ্টা করলেন প্লেনের দিকে তাকিয়ে কোন দেশের প্লেন। প্লেন যাচ্ছে আসছে কিন্তু কোন গুলি ছুড়ছে না। এক সময় বাবা বললেন, ইণ্ডিয়ার প্লেন। তার মানে মিত্রপক্ষ। আমাদের বাংকারে ঢুকার ছুটাছুটি বন্ধ হলো।
প্লেন আরো অনেকবার যাওয়া আসা চক্কর দেওয়ার পরও কিন্তু আমাদের কুকুর ভুলুর দৌড় থামল না। যতবার প্লেন যায় ততবার প্রাণ পণে দৌড়ে লুকাতে চেষ্টা করে। ও হয়ত ভীষণ ভয় পেয়েছিল শব্দে। কত মাস ধরে এমন শব্দের সাথে বসবাস। শব্দে শব্দে ওর হৃদপিণ্ড কেমন করত কে জানে। বোঝার চেষ্টা করিনি তখন। পরদিন ভোরে ভুলুকে মৃত পাওয়া গেল। যখন "একাত্তরের দিনগুলি" পড়লাম। তখন জেনেছিলাম, জাহানারা ইমামের কুকুরটিও যুদ্ধ শুরুর দিনে, গোলাগুলির শব্দে অস্থির হয়ে মারা যায়। শুধু মানুষ নয়, পশু পাখিরাও যুদ্ধের কারণে নির্যাতিত হয়েছে।
বিকালের দিকে খই ফোটার মতন বিরামহীন গুলাগুলির শব্দে আমরা তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে নিজেদের বন্দী করলাম আবার। গুলি ছুটছে অফূরন্ত অগনিত এক সাথে। বাবাই আবিষ্কার করলেন আবার শব্দ শুনে শুনে। মনে হচ্ছে ফাঁকা গুলি হচ্ছে । আমার পড়ার টেবিলের উপর চেয়ার তুলে ভেন্টিলেটারের কাগজ সরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বাবা দেখার চেষ্টা করছেন কারা এমন অদ্ভুত গুলি করছে আজ। আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছি উপর দিকে চোখ তুলে বাবার দিকে। নিঃশ্বাস মনে হয় বন্ধ হয়ে আছে। ঘরে পিন পতন নিরবতা। বাইরে অফূরন্ত গুলির শব্দ। খানিক পরে দেখতে পেলেন কিছু বাবা আর এক গাল হাসি নিয়ে, কিছু বলতে বলতে নেমে এলেন চেয়ার থেকে টেবিল থেকে মেঝেতে। উৎফুল্ল হাসির আড়ালে কথা ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল বাবার।
কতদিন পর এমন মুখ ভরা হাসি বাবার মুখে। প্রায় অন্ধকার ঘরে সে হাসিতে উজ্জ্বল মুখ এখনো আমার চোখে তেমনি সতেজ ভাসছে। অস্থির বাবা মুক্তিযোদ্ধা এসেছে আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি, আমরা মুক্ত বলতে বলতে লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লাল সবুজ পতাকা বের করে একটা লাঠির মাথায় বাঁধতে বাঁধতে, ভাই কে নিয়ে মুক্তি যোদ্ধাদের গুলির পটকা ফুটানো মিছিলে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে মুক্ত স্বাধীন হওয়ায় এতদিনের বুকের ভিতর জমিয়ে রাখা সব কষ্ট, জয় বংলা, জয় বাংলা উচ্চারণে স্বাধীন দেশের বাতাসে ছাড়িয়ে দিতে দিতে মুক্তির মিছিলে মিশে গেলেন।
ষোল ডিসেম্বর সারা দেশ স্বাধীন হলেও অনেক জায়গায় যুদ্ধ চলছিল অরো কয়েকদিন। আমাদের শহর স্বাধীন হয়েছিল ছয় ডিসেম্বর। খরগোশ অভিযানে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ নাম ছিল খোরগোশ বাহিনী। সারা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমাদের শহর মুক্ত হয়েছিল পাকি মিলেটারির কবল থেকে। স্বাধীনতার গোলাপ ফুটে ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০৭