কোন এক উজ্জ্বল বিকেল দেখে বেরিয়ে পড়ি নতুন জায়গা এক্সপ্লোরের উদ্দেশ্যে। ঢাকার আশেপাশে, কাগজেকলমে ঢাকা সিটি করপোরেশন এর মধ্যেই আছে বেশ কিছু গ্রাম, যেখানে নগরায়নের ঢেউ এখনো উপচে এসে পড়েনি, বরং রয়ে গেছে আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগের গুলশান কিংবা মালিবাগ গ্রামের মতন। সেখানে গেলেই যেন আমি অতীতের ঢাকার গ্রামগুলো দেখতে পাই। আজ থেকে হয়তো ৫০-৬০ বছর পর এই গ্রামগুলোর রাস্তা দিয়ে বাস চলবে, হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো এসে ভাগাভাগি করবে আকাশ, গাড়ির হর্ণ ঢেকে দেবে দোয়েলের শিস ...
এবার নতুন জায়গা আবিষ্কার করলাম ডেমরা-বনশ্রী রোডের পূর্ব দিকে নেমে যাওয়া এর পাকা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে। চার বছর আগেও এই রাস্তা ছিল কাঁচা। তখন অবশ্য এই রাস্তায় আসতাম না, কারণ আসার দরকার হত না। শেখের জায়গা ছেড়ে আমুলিয়ার আশেপাশেই পাওয়া যেত গ্রামের সবুজ। আর বর্ষায় জলে ডোবা আমুলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল বড় মুগ্ধকর। পশ্চিমে সূর্য নামলেই তার রঙগুলো সেই জলে মিশিয়ে এক অপূর্ব ছবি তৈরি করত। কিন্তু আজ আমুলিয়ায় বাড়ি তৈরির বালু পড়েছে, মাটি ফেলে রাস্তা হয়েছে, বালু তোলার পাইপ, কয়েকটা বাড়ি, একটা স্কুল আর ডায়গনিস্টিক সেন্টারে মুছে গেছে সেইসব জলছবি। তাই এখন আমুলিয়া ছেড়ে গ্রামের ছবি পেতে এগোতে হয় আরো ভেতরে।
গ্রামের খোঁজে আমরা নামি ডেমরা-বনশ্রী রোডের পূর্ব দিকে। এখানে পাকা রাস্তা ধরে যত ভেতরে যেতে থাকি, গ্রাম যেন আরো ধরা দিতে থাকে, মানে শহরের কোলাহল আর দালানকোঠা কমে যেতে থাকে। রাস্তাটা পাকা হলেও নেই তেমন গাড়ির উৎপাত। একেক জায়গাতে দুপাশের গাছপালা রাস্তাকে ঘিরে ফেলে বানায় দর্শনীয় দৃশ্য। পেছন ফিরলে দূরে দেখা যায় বনশ্রী ডেমরা সংযোগসড়ক, রোডটির ব্যস্ততা আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে গাড়ির চলাচল মনে করায় ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কথা। হাঁটতে হাঁটতে পাওয়া যায় প্রকৃতির আদি অধিবাসিদের। দেখি ফড়িংকে, কলমিলতায় সে তার শূঁড় লাগিয়ে বিশ্রাম করছে। পথের ঢেঁড়সফুলের হলুদ আর অড়হর ডালফুলের হালকা হলুদে বিকেলের সূর্যের সোনা রোদ যুক্ত হয়ে উজ্জ্বলতর হয়। রাস্তায় কয়েকজন স্কুল বা কলেজপড়ুয়া ছাত্রদের দেখা যায়, একটা অসমাপ্ত ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে তারা ডিএসেলারে ছবি তোলে। বিকেলের রোদে আমাদের স্বল্প কায়ার দীর্ঘছায়া সেই পাকা রাস্তায় আছড়ে পড়ে। আমরা তা অনুসরণ করে এগোতেই থাকি।
ছায়াঘেরা পাকাপথে রোদ
অড়হর ডালের ফুল
এগোতে এগোতেই একসময় আমরা দেখি দুইদিকে দুটি রাস্তা চলে গেছে। বামে এগোই। দেখি জমজমাট এক বাজার। এখানে এসে রাস্তা চিরাচরিত বাঙালি রূপ পেয়েছে। ডেমরা-বনশ্রী রোড থেকে নেমে এই তিন রাস্তার মাথা পর্যন্ত রোডটি বানানো হয়েছে ২০১৫ সালে, একটা ফলকে দেখি তা। কিন্তু বামে গেলেই বাজারের যে রোডটা, তা সম্ভবত অনেক আগের, তাই সংস্কারবিহিন। আমরা ভাংগা রাস্তায় বর্ষার জমে থাকা কাদাপানি সাবধানে এড়িয়ে আরো ভেতরে যাই।
বাজারে রাস্তার দুপাশেই অনেক দোকান। দুএকটা দোকান বাদে কোন দোকানেই নেই সাইনবোর্ড। একটা জেনারেল স্টোরে রবি আজিয়াটা সাইনবোর্ড থেকে পাই জায়গার নাম। ধীৎপুর, খলাপাড়া। এক দোকানের সামনে ভ্যানভর্তি শাপলাডাটা দেখা যায়, হয়তো কাছেই কোন জলাশয় থেকে সংগ্রহ করা। একটা মাদ্রাসা পাই, তাহফিজুল কুরআন মাদ্রাসা। এরপর ডানদিকে এগিয়েই দেখি নদি। এই বাজারের পাশ দিয়ে বালু নদ ঘেঁষে গেছে। বালু তোলার অনেক বড় ট্রলার ঘাটে ভেড়ানো। এখানে স্থানীয় লোকজন বাদে আর কাউকে তেমন দেখা যায় না। তারাই হাতে চালানো নৌকার পাটাতনে বিছানো মাদুরে বসে পার হয়ে চলে যায় নদির ওপারে।
ধীৎপুর বাজারে বালুনদে ট্রলার
অসমাপ্ত বৃজ
মাদুরের এই ব্যবহার আমরা দেখি বাজারের দোকানগুলোতেও। এখানে চা দোকানে বাইরে একটা বেঞ্চ থাকলেও সবাই গিয়ে ভেতরে মাদুরে বসে চা খায়। বৈঠকি আড্ডার একটা ভাব আছে এসব দোকানে। মানুষজনের অনেক আপন যেন এই চা আড্ডা। আমরা আরো ভেতরে এগোই। গ্রামের আবহ থাকলেও মানুষজনের ঘরবাড়ি তেমন নজরে আসে না৷ বাজার এলাকা বলেই হয়তো! আমরা এরপর বামে বাঁক নিয়ে হাঁটি। এখানে হঠাৎ দেখা পাই মিঠাইওয়ালার। এটা এমন এক মিঠাই যা আমি জীবনে প্রথম দেখলাম এবং আমি নিশ্চিত অনেক মানুষই এটা দেখেনি, স্বাদ নেয়া পরের কথা! এর বর্ণনা দেয়া প্রয়োজন।
বামহাতে একটা ঝুনঝুনি বাজাতে বাজাতে আর ডানহাতে একটা বাঁশ কাঁধের ওপর ভর দিয়ে রেখে ফেরিওয়ালাটি যাচ্ছিল। ডাক শুনে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান তিনি, কালো দাড়িওয়ালা ও শার্টপরা এক যুবক। দুধের রঙের মত মিঠাই ঢেকে রাখা হয়েছে পলিথিন ও লাল কাপড় দিয়ে। কৌতুহল নিয়ে অর্ডার দিতেই উনি কাপড়ের আড়ালে থাকা মিঠাই স্থিতিস্থাপক রাবারের মত টেনে টেনে বের আনেন। তারপর বাঁশের খাঁজে রাখা ছোট বাঁশের স্টিক বের করে তাতে বেশ আর্টিস্টিক উপায়ে সাপের মত পেঁচাতে থাকেন সেই মিঠাই। প্রথম টানটি স্টিকে জড়ানো হয়, পরের টানে মিঠাই পেঁচিয়ে একটা সুন্দর সাদা হাঁস এর আদল দেন তিনি। তারপর তা বসিয়ে দেন স্টিকের ওপরে। উনি জানালেন, এই মিঠাই অনেক পুরনো, তবে এখন কমতাসে। আগে কালারিং ছিল, এখন কোন কালারিং দেয় না। স্বাদে আহামরি না, গুঁড়া দুধের মত দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকে, কিন্তু তবুও এই মিঠাই দেখে ও চেখে আমার নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ হতে থাকে!
ধীৎপুর বাজারের হাওয়াই মিঠাই
এরপর আমরা রাস্তায় হাঁটতে থাকি। ম্যাপে দেখাচ্ছে, এই রোড চলে গেছে ত্রিমোহনীর দিকে। আমাদের সেদিক যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তাই ব্যাক করি বাজারের দিকে। এবার ঐ তিন রাস্তার মাথায় এসে ডানদিকে যাব। এতক্ষণ বামদিকে ধীৎপুর ঘুরেছি।
ডানে এসে একটু ভেতরে গিয়ে দেখি, এটাই একটা গ্রাম, রোডের পাশজুড়ে ও ভেতরে মানুষের ঘরবাড়ি। একটা পাকা বাড়ির গেইটে নামফলক লেখা, গ্রাম ঠুলঠুলিয়া, পোস্ট ডেমরা। তার মানে আমরা ঠুলঠুলিয়া গ্রামে প্রবেশ করেছি।
শুক্রবার বলে এক বাড়ির গেইটে দেখি গ্রামের মত রঙিন কাপড়ে বানানো বিয়ের গেট। আরেকটু আগে আসলে হয়তো খেতে পারতাম পোলাওমাংস! আমরা যাবার পথে আধুনিক মসজিদও দেখি, ঠুলঠুলিয়া মসজিদ, ২০০৯ সালে এমন আধুনিকায়ন করা হয়েছে। খানিক যাওয়ার পর আরেকটা বিয়েবাড়ি দেখি, কে জানে এটা হয়তো কনেপক্ষের বাড়ি! গ্রামের মেঠোপথ বলে কিছু এখন বিরল। তাই এখানেও ইটের খোয়া বিছানো রাস্তা। তবে আমরা ঠুলঠুলিয়াতে গ্রামের সৌন্দর্যের অনেকখানিই পাই।
কান পাতলে কোন গাড়ির প্যাপো শব্দ নেই, আছে পাখির ডাক। হঠাত হঠাত নাকে এসে লাগে গরুর গোবরের গন্ধ, হয়তো পাশেই আছে গরুর খামার। কচুরিপানায় পূর্ণ পুকুর বেড়া দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে, কালো পানিতে জীবনের স্পন্দনের মত মাছেরা ছটফট করছে। প্রায়ই রাস্তার সামনে দিয়ে দৌড়ে যায় মুরগি, হয়তো খাবার খুঁজছে। কোথাও দেখি মা মুরগির পেছনে দলবেধেঁ যাচ্ছে ছানারা।
আরো ভেতরে এসে আমরা এক হিন্দুপাড়ায় প্রবেশ করি। এখানে সব মহিলার হাতে শাখা, সিঁথিতে সিদুর। অদূরে একটা কালীমন্দিরও দেখা যায়। যদিও এটা গ্রাম, যাবার পথে দোকান পরে দুএকটা৷ একটা দোকানের পাশেই চারজন বয়স্কলোক গাছের ছায়ায় বসে লুডু খেলে, ওখানে খানিক দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখি, দখিনা বাতাসকে সামনে রেখেই তারা এই আরামদায়ক বিকেলে জড়ো হয়েছে। বিকেলে খেলতে বের হয়েছে গ্রামের ছেলেরাও, একটা উন্মুক্ত ঘাসের মাঠে তাদের ফুটবল খেলতে দেখা যায়।
ঠুলঠুলিয়া গ্রামের বর্ষার রূপ
আমরা তাদের পার করে আরেকটু সামনে যাই। অনেক হাঁটা হয়েছে, এবার আমরা রাস্তার পাশেই ঘাসে বসে পড়ি ও জিরোই। আমাদের সামনে পানি ভরা জলাশয়, দূরে ডানদিকে মাঠ যেখানে ফুটবল চলছে, পেছনে মাছেভর্তি একটা পুকুর। সূর্য তখন ডুবতে থাকে, চার বছর আগের আমুলিয়ার মত এখানেও পানিতে রঙের খেলা চলে। সাদাটে আকাশে কালো একগুচ্ছ ভ্রাম্যমাণ মেঘ উড়তে থাকে, সাথে নীরব পরিবেশে দখিন হাওয়ার নাচন।
সূর্য ডুবলে ফেরার সময় হয়। ঠুলঠুলিয়া গ্রাম ছেড়ে আমরা আবার ধীৎপুর বাজারে আসি কিছু খাওয়াদাওয়া করতে। সাইনবোর্ডবিহিন একটা মিষ্টি ও পুরির দোকানে ঢুকি। গরম গরম পুরি আর পেঁয়াজুর সাথে আসে বিশেষ সালাদ। দোকানের চটপটে ছেলেটা বলে, এই সালাদ খেয়ে দেখেন, এটা আর কোথাও পাইবেন না। এটা খাওয়ায় জন্য ঢাকা আর অনেক দূর থেকে লোক আসে! আমাদের দেখে হয়তো বুঝে ফেলছে আমরা বাইরের লোক। যদিও খেয়ে বিশেষ কিছু মনে হয়নি। সাধারণ সালাদ, টকদইয়ে ভেজানো কিছু শসার টুকরো। এরপর দই অর্ডার দেই, প্লাস্টিকে পোরা দই খেয়ে কিছুটা শান্তিভাব আসে। আরো ভাল হত, এখানকার বৈঠকি দোকানগুলোতে চা আড্ডা দিতে পারলে।
সন্ধ্যা নেমে রাত আসতেই নিরিবিলি গ্রামটা আরো নিরিবিলি হয়ে ওঠে, বাজারটাও লাগে ফাঁকা ফাঁকা। আমরা একটা রিকশা নিয়ে সেই নীরবতা খানখান করে বিশ মিনিট দূরের ঢাকা নগরীর দিকে চলে যেতে থাকি।
নীরব সন্ধ্যার জলছবি
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকার বনশ্রী-স্টাফ কোয়ার্টার-ডেমরা সংযোগসড়ক ম্যাপে দেখে নিন। এই রোডের পশ্চিমে আড়াআড়ি শেখের জায়গা-স্টাফ কোয়ার্টার রোড চলে গেছে। সেই রোডের মাথায় এসে ঠিক বিপরীত পূর্ব দিকের পাকা রাস্তায় নামুন। এরপর বিশ পচিশ মিনিট হাঁটলেই বামে ধীৎপুর বাজার আর ডানে ঠুলঠুলিয়া গ্রাম। খাওয়ার জন্য বিশেষ কিছু নেই। বাজারে সন্ধ্যায় গরম গরম পুরি আছে, দইয়ের স্বাদ নিতে পারেন আর হাওয়াই মিঠাই পাওয়া ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে! এছাড়া চা দোকানগুলোতে মাদুরে বসে রিলাক্সে চা খেতে পারেন। আছে বালুনদ, গ্রাম ও বাজার ঘোরার পর চাইলে বালুনদে নৌকাভ্রমণ করতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৩৩