somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বনগ্রামের কাউয়ার বিরানি ও ধোলাইখালের খেতাপুরি

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তানভীর মামার কাউয়ার বিরানি। (মাংস বিরানির মাঝে লুকিয়ে আছে, দেখতে আমি পাইনি)

ওয়ারি দিয়ে কলতাবাজার হয়ে সদরঘাট.. নতুন একটা পথ এক্সপ্লোর করে আজ আমাদের; প্রিতম, লিওন আর আমার পুরান ঢাকা যাওয়ার কথা। এ বছরে তৃতীয়বার সদরঘাট, তিনবারই বলাইবাহুল্য লিওন সাথে। সদরঘাটে তার আত্মার একটি অংশ লুকানো, প্রতি সপ্তাহে তাকে পেতে হয়। আর প্রিতম জীবনে এই প্রথম আমাদের সাথে সদরঘাট যাচ্ছে। তার মিনি ট্রিপ।

ওয়ারি, পুরান ঢাকার অভিজাত এলাকা। রাস্তার দুধারে বেইলি রোডের মতন অসংখ্য ফাস্টফুড আর ফ্যাশন হাউজের দোকান। দেখে এখানে লিওন একসময় থাকবে বলে ইচ্ছা প্রকাশ করে। ওয়ারিতে জ্যামিতির ভার্টিকাল হরাইজন্টাল কাটাকুটির মতন রাস্তা দিয়ে আমরা তিনজন হাঁটা দেই। তারপর বনগ্রাম, একসময় যে গ্রাম ছিল বেশ বোঝা যায় পুরান কিছু বনেদি বাড়িঘর দেখে। বনগ্রামের নাম শুনে গত বছরের সাড়াজাগানো ১০টাকার বিরানির কথা মনে আসে। নেট ঘেঁটে, মানুষজনকে জিজ্ঞাস করে সেই বিরানির দোকান খুঁজে বের করতে আধা ঘন্টা চলে যায়৷

বনগ্রাম মসজিদের একেবারে পাশেই, মেইন রোডেই নাকি দোকানটা৷লিওন একবার এসেছে। তার স্মৃতি থেকে ধার করে মানুষকে বলি, তানভীর মামার দোকান চিনেন? কেউ চিনে না। নেটে দেখা ৩০ বনগ্রাম, ঠিকানাও খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে একজন বলে, ওহ, কাউয়ার বিরানি খুঁজতাসেন? বুঝা গেল, এই নামটাই এখানে পরিচিত।
কিন্তু নাম কাউয়ার বিরানি কেন? নামকরণের রহস্য নিয়ে নানারকম হাইপোথিটিক্যাল ভাবনা আমরা দিতে থাকি। প্রিতম বলে, কাউয়ার মাংস দিয়ে বানায় মনে হয়, একেবারে কাউয়ার বিরানি নামের আক্ষরিক অনুবাদ করে সে। আমি বলি, কাক যেমন অতি অল্প পরিমাণ খায় তেমনি অল্প পরিমাণ বিরানি বলেই হয়তো এই নাম। লিওন মনে হয় প্রিতমের আক্ষরিক অনুবাদকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। তাই আশেপাশের দোকানে জিগ্যেস করার সময় ভুলেও বলে না, কাউয়ার বিরানির দোকান কোথায়? পাছে তারা অফেন্সিভলি নেয়।

তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে মনে হওয়া এই অফেন্সিভ নাম জিগ্যেস করেই দোকানটা খুজে পাই। অথচ এই দোকানের পাশ দিয়েই একটু আগে হেটে গেলাম ৫-৬বার! দোকানে কোন নামফলক নেই, চিপা শ্রীহীন একটা দোকান আর ঝাপটা নামানো, কাজেই চোখে না পড়াই স্বাভাবিক। মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে ঝকঝকে উপস্থাপনা একটি বড় ভূমিকা রাখে।

দোকান খোলে ৭টায়, এখনো ২০মিনিট বাকি। এতদূর এসে, এত খুঁজে অবশেষে পেয়েও যদি না খেয়ে যাই তবে লিওনের ভাষায় তা পণ্ডশ্রম। কাজেই সময় কাটতে আমরা আবার যাই সামনে, মাহিয়া টি স্টল। সেখানে দুধ দেয়া চা খাই। লিওন এ নিয়ে তিনবার এল এখানে। প্রথমবার একলা, দ্বিতীয়বার দোকলা, তৃতীয়বার তোকলা..মানে আমরা তিনজন, চমৎকার সিকোয়েন্স! ছোটখাট চা আড্ডা দিয়ে ২০মিনিট পার করি। কাউয়ার বিরানির দোকান ততক্ষণে খুলে গেছে।

দশ টাকার মালাই চা।

পৌঁছে আমি বলি, এটাই সেই দোকান? মানে বিশ্বাস হচ্ছিল না! মসজিদের সিঁড়ি আর পিলারের সাইডটুকু ভাড়া নিয়ে এই দোকান, পাশাপাশি দুই কলামের বেঞ্চে লোক বসলে আর হাঁটা যায় না.. এরই মধ্যে ভেতরে একজন বসে আছে, রেগুলার কাস্টমার হয়তো। অথচ আমরা ভেবেছিলাম আমরাই প্রথম হব। প্রথম না হবার দুখের মাঝে রেগুলার কাস্টমার লোকটা নুনের ছিটা দেয়। সে আমার কথা শুনে বলে ওঠে, হ্যাঁ ভাই এটাই সেই দোকান, ফেসবুকে আপনারা যেটার নাম শুনছেন...ফেমাস..আসেন আসেন, বসে যান।
আমরা ভেতরে ঢুকি। লেবু, মরিচ, সিদ্ধ ডিমের অর্ধেক আর গিলা কলিজা মেশানো ভেজা পোলাও খেয়ে আমরা সেই বিখ্যাত ২০টাকার তেহারির স্বাদ সন্ধান করতে থাকি।
২০টাকায় যেমনটা হওয়া উচিত ঠিক তেমনটাই, পেট ভরবার মত খাবার। আমাদের খাওয়া চলতে চলতেই আরো অনেক মানুষ এসে তানভীর মামার কাছ থেকে বিরানি প্যাকেট করে নিয়ে যাচ্ছে।

দোকানের অন্দরমহল।

এরপর আবার হাঁটা। এত অলিগলি, নতুন নতুন রাস্তা, যেখানে আগে আসা হয়নি। একলা আসলে নিশ্চিত হারাতাম, নাহয় গুগল ম্যাপ তো লাগতোই। কিন্তু আমাদের সাথে আছে জীবন্ত গুগল ম্যাপ, লিওন। তবে সেও যে সব রাস্তা চেনে তা নয়। উলটো আমাদের বলে গুগল ম্যাপ ইউজ না করতে! কাজেই তার কনফিডেন্স দেখে মনে হয়, আমরা হারিয়ে যাব না নিশ্চিত। তাই শুধু মাথায় দিকজ্ঞান রেখে একটা এডভেঞ্চারের মতন নতুন নতুন রাস্তা আবিষ্কার করে সদরঘাট পৌছাটাই আমাদের কাছে আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রিতম দেখে বলে, যতদিন লিওনের হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ। মানে আমরা হারাব না।

কিন্তু দ্রুতই এডভেঞ্চার শেষ হয়ে এল। বনগ্রামের সংকীর্ণ রাস্তা পেরিয়ে রায়সাহেব বাজারের বড় রাস্তা এসে পড়ল। খুব দ্রুত মজা শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রিতম একটা এডাল্ট রূপক দিল, লিওন অনেক ভাল ফোরপ্লে করতে পারবে..করতে করতে তারপর আসল কর্মে ঢুকবে। এতক্ষণ ছোটছোট রাস্তাগুলো এডভেঞ্চারের মত পার হওয়া ছিল ঐ ফোরপ্লের মতনই। তারপর ঢুকলাম আসল কর্ম মানে সদরঘাট যাওয়ার মেইন রাস্তায়।

এরপর যাব ধোলাইখাল হয়ে কলতাবাজার। তারপর সদরঘাট।

ধোলাইখালে আসি এই প্রথম। সেখানে হাজার হাজার মেশিন আর ডিগ্রিবিহীন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের ছড়াছড়ি। ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পেয়ে যাই অদ্ভূত এক খাবার। বড় এক তাওয়ায় ভাপা পিঠার মতন অনেকগুলো বস্তু ছড়িয়ে রাখা। দেখেই মনে হয়, নতুন কিছু। জীবনে যেহেতু প্রথম দেখি, টেস্ট করতে মন চাইল, তাই দাঁড়াই। যিনি তাওয়ায় এই পিঠা সেঁকছেন, তিনি আমাদের থমকে দাঁড়ানো ও আগ্রহ দেখে বললেন, আরে আংকেল খেয়ে দেখেন, অনেক মজা। জিনিসটা কি, জিগ্যেস করায় বললেন, আটার ডাইল রুটি। ভাবি, বাপরে, নামটাও যে প্রথম শুনলাম, সন্দেহ নেই। তিনি আমাদের হাতে পিঠা মনে করা 'আটার ডাইল রুটি' ধরিয়ে দিলেন। খেয়ে দেখি ঝরঝরে আটার গুড়োর ভেতরে ডালের পুর। বললেন, মসুরের ডাল সিদ্ধ করে এই পুরির ভেতর দেয়া হয়। ভেতরে দুজন বসে এই কাজটিই করছে।

আটার ডাইল রুটি এবং খেতাপুরি

পুরিগুলোর আমি কয়েকটা ছবি তুলতেই ভদ্রলোক বললেন, খালি পুরির ছবি তুললেন, কারিগরের ছবি তুলবেন না? পরে তুললাম তার ছবি। এবং এই প্রথম চেহারা খেয়াল করলাম। মাথায় টুপি, চোখে চশমা, মুখে ছাগলশ্মশ্রু। তার দোকানের পাশে বড় করে সাইনবোর্ড টাঙানো, মুসলিম বাবুর্চি, নিচে ফোন নাম্বার। বুঝা গেল, তিনি প্রচার ভালোবাসেন।
পুরি খেয়ে বুঝি, আমরা যেমন পুরি খেতে অভ্যস্ত, সেরকম তেলে ভাজা নয়, তাওয়ায় সেকা পুরি। এটাও কি পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নাকি ইনোভেটিভ কিছু? খেয়ে বুঝলাম ইনোভেটিভই, কারণ পুরিও যে এভাবে বানানো যায়, মাথায়ই আসে না।

এরপর তিনি আমাদের খেতাপুরি দেখান। তাওয়ার পাশেই তেলে পূর্ণ আরেকটা তাওয়া। এই তাওয়াতেই হালকা ভেজে আবার তাওয়াতে সেঁকা হবে। সেই পুরিই হবে খেতাপুরি। এতদিন শুনেছি, রেগে গেলে মানুষ বলে, তোর খেতা পুরি। তার সাথে কি এই খাবারের কোন সম্পর্ক আছে? নাকি কাঁথা পোড়ানোকে বোঝানো হয়েছে!
খেতাপুরিও খেতে ভুলি না আমরা। এই জিনিসটার স্বাদও মুখে লেগে থাকে। আর এদিকে আমাদের মূল গন্তব্য সদরঘাট যাওয়া পিছিয়ে যেতে থাকে। বরিশালের লঞ্চগুলো হয়তো এতক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে।


জনৈক খেতাপুরি বিক্রেতা।

যেভাবে যাবেনঃ ওয়ারিতে এসে বনগ্রাম মসজিদে আসুন। সেখানে গিয়ে দোকানদারকে জিগ্যেস করুন, কাউয়ার বিরানি দোকান। একটা কনফেকশনারি দোকানের পাশেই পেয়ে যাবেন তা।
আর খেতাপুরি পুরান ঢাকার অনেক জায়গাতে পাবেন। এটার ঠিকানা নাহয় পুরান ঢাকা এক্সপ্লোরের একটা রহস্য হিসেবেই থাকুক। তবে ক্লু হল, ধোলাইখালের ভেতর দিয়ে কলতাবাজারের পথে বেরোতে কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবেন এই খেতাপুরি। সাথে আটার ডালরুটিও খেতে পারেন।
টিপসঃ কাউয়ার বিরানি দোকানে ১০টাকা থেকে শুরু করে ৫০টাকার প্যাকেজ পাওয়া যায়। ১০টাকা করে বাড়লে বিরানির সাথে যুক্ত হবে আধেক ডিম, ফুল ডিম, মুরগির ডানা আর বাড়তি মাংস, স্পেশাল ঝোল। কাজেই এই প্যাকেজগুলো নিজের মত পছন্দ করে অর্ডার করা উচিত। ঠিক সন্ধ্যা ৭টায় দোকান খোলে, সে সময়ে যাওয়াই ভাল।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫১
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×