somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি বিজয় দেখেছি...

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৫ই ডিসেম্বর সিলেট শহর মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয়-সেনাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে পড়ে। বাসার সামনের বাগানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ট্রাকে করে হই-হল্লা, হাতে অস্ত্র উচিয়ে গান গাইতে গাইতে তারা যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ৬ মাস আমরা মৌ্লভীবাজারে কাটালেও শেষের ৩ মাস ছিলাম সিলেট শহরে আমার এক ফুফুর বাসায়। আমাদের কোন গ্রামের বাড়ী ছিলোনা। যখন মৌ্লভীবাজারে আমাদের বাড়ীওয়ালা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়িতে পাক আর্মির সরগম তখন আব্বা আমাদের ঢাকা পাঠিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে সিলেট নিয়ে আসেন। ভাবনা পরিকল্পনা ছিল ঢাকা থেকে আমরা নানার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর যাবো। কিন্তু সিলেটে এসে দেখা গেল ফ্লাইট বন্ধ। ট্রেন লাইন তো অনেক আগেই নষ্ট। অগত্যা আমাদের ফুফুর বাসায় রেখে আব্বা মৌ্লভীবাজারে ফিরে যান। এসব কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি।

শুনেছিলাম শহরের এক প্রান্তে দুবলীর হাওরে ভারতীয় হেলিকপ্টার নেমেছে। মুক্তিবাহিনীর মর্টার-শেলের আঘাতে হাওয়াপাড়ায় দুটি বাড়িতে নাকি বিশাল পুকুরের মত গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। আব্বা বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হলে আমাদের দেখাতে নিয়ে যাবেন। ভাইয়া কখনো নিজে আব্বাকে কিছু বলতো না, সব সময় আমাকেই ওর মুখপাত্র হতে হতো। এখনও তাই হল। আমার পিঠে খোচা দিয়ে ফিসফিস করে বল্লো, “এই, আব্বাকে বলনা আমাদের স্বাধীনতা দেখাতে নিয়ে যেতে”। তোতা-পাখির মত সে কথা আউড়ে যেতেই আব্বা সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, কাল তোমাদের নিয়ে বের হবো”।
আমরা তো অস্থির হয়ে গেলাম কখন আমরা স্বাধীনতা দেখতে যাবো। রাতে শুয়ে শুয়ে দু ভাইবোনে সে কথাই জল্পনা কল্পনা করছিলাম। হঠাৎ শুনলাম আব্বা বলছেন, “এবার মিছিরউল্লাহ মোক্তার (আমাদের বাড়িওয়ালা) ঠ্যালাটা টের পাবে”। আম্মা ঝাজিয়ে উঠলেন, “আপনার কি তার জন্য দরদ লাগছে”? আব্বা একটি দীর্ঘশ্বাষ ছেড়ে বললেন, “না দরদ লাগবে কেনো, যেমন কর্ম তেমনই তো ফল ভোগ করা লাগে। এটাই নিয়ম”। কিন্তু এটাই যে নিয়ম নয় তা যুদ্ধ-পরবর্তী এই ৩৯ বছর ধরেই দেখছি।

“আচ্ছা আব্বা, যুদ্ধ তো শেষ, এখন আমরা আমাদের বাসায় যেতে পারবোনা”?
“অবশ্যই যেতে পারবো। কয়েকদিনের মাঝেই আমরা নিজেদের বাড়ি-ঘরে ফিরে যাবো”। আব্বা বললেন। চিন্তিত স্বরে আম্মা বললেন, বাড়ি-ঘরে গিয়ে কি কিছু পাবো? লুটপাট হয়েছে কিনা কে জানে!! ( ফিরে গিয়ে আমরা শুন্য ঘরই পেয়েছিলাম। সব কিছু লুট হয়ে গিয়েছিলো)
আমার পাশ থেকে ভাইয়া আস্তে করে বল্লো, ‘যুদ্ধ শেষ। এখন আবার আমরা মাংস খেতে পারবো”। আব্বা হেসে ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, “ হ্যা, বড় মিয়া আবার তুমি মাংস খেতে পারবে”।
১৬ই ডিসেম্বর সকালে একঘেয়ে খিচুড়ি কোনমতে গিলে আমরা বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মানুষ আর মানুষ। মনে হচ্ছে ঈদের মেলা বসেছে। মাঝে মাঝে বিরাট কনভয় আস্তে আস্তে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। তাতে অস্ত্র হাতে ভারতীয় মিলিটারি। কিছু হুড খোলা জীপে অস্ত্র হাতে লোকজন। আব্বা বললেন," ঐ দেখ মুক্তিযোদ্ধা"। অবাক হয়ে দেখলাম কন্ঠার হাড় বের করা, অবিন্যস্ত কাপড় পড়া ক্লান্ত কিন্তু খুশীতে ঝলমল মুখগুলো।তারা হাসিমুখে চিৎকার করে গান গাইছে। “ জয় বাংলা বাংলার জয়”। পুর্ব দিগন্তে সুর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল, জোয়ার এসেছে কাল সমুদ্রে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল...

আস্তে করে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আব্বা স্বাধীনতা কই”? আব্বা বাম হাতে আমাকে উনার কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে কত কথা বললেন, যার অর্থ কিছুই বুঝলাম না, আর কিছু কথা উড়ে চলে গেলো জন-সমুদ্রের গর্জনে। কানে মন্ত্রের মত গুনগুন করতে লাগলো একটি কথা- "আমরা বিজয় অর্জন করেছি। আমরা আর মাথা নত করে থাকবনা। আমরা বিজয়ি জাতি"।

এতো কলরব, এতো হইচই তারপরও প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে আনন্দ ঝলমল করছে। আব্বা, আম্মার মুখেও দেখলাম অনাগত সুখ-স্বপ্নের পেলব ছায়া। সবাই আনন্দে আত্মহারা। ভুলে গেলাম দীর্ঘ নয়টি মাসের বিভিষিকার কথা, যখন তখন গুলির শব্দ, বোমার শব্দের কথা, গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ানোর কথা। অজানা অচেনা মানুষের বাড়িতে সংকুচিত অন্ন ভক্ষনের কথা। এক সাগর রক্তের কথা। আর কোন চিন্তা নেই, ভয় নেই। যেন কোন অলিক যাদু-মন্ত্রে সবাই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। সবার অন্তরাত্মা গাইছে, “ আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন আকাশে...।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৪
৪৪টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×