somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাত্রা

২২ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(কানাডিয়ান মুভি Cube(1997) থেকে অনুপ্রাণিত)

‘তুমি কে?’ দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেছে আমার।

‘তুমি কে?’ হুবহু আমার মতো করেই বলে উঠল আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা।

‘আমি শুভ,’ দ্রুত উত্তর দিলাম আমি, ‘আরিয়ান শুভ। কিন্তু তুমি কে? আর এখানেই বা এলে কি করে?’

‘আমি শুভ,’ হুবহু আমার স্বভাবসুলভ আচরনের প্রকাশ দেখতে পেলাম ছেলেটার মধ্যে, ‘আরিয়ান শুভ।’

‘মানে কি?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি।

‘আমিও তাই ভাবছি,’ মাথা চুলকে বলে উঠলো সে, ‘মানে কি?’

এমনসময় তীক্ষ্ণ একটা শব্দে যেন প্রকম্পিত হলো পৃথিবী। ধরমর করে উঠে বসলাম আমি।

দ্রুত পাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমার কম্পিউটারে এলার্ম বাজছে। একহাতে চোখ ডলতে ডলতে আরেক হাতে কীবোর্ডের বাটন টিপে এলার্মটা বন্ধ করলাম আমি। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচটা বের করে একটা শলা ধরিয়ে ঠোঁটে ঝোলালাম।

দুররর, স্বপ্ন দেখছিলাম এতোক্ষন!

*******

কীবোর্ডের এন্টার বাটনটাতে শেষবারের মতো প্রেস করে চেয়ারে হেলান দিলাম আমি। মাথাটা হালকা ধরেছে আমার। একটা সিগারেট প্রয়োজন।

ড্রয়ার খুলে প্যাকেটটা বের করে একটা শলা বের করলাম আমি। ঠোঁটে ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে জোড়ে একটা টান দিলাম।

আহ! কি শান্তি! অবশেষে আমার কাজটা শেষ হলো!

দীর্ঘ তিনটি বছর অপেক্ষা করেছি আমি আজকের এই দিনটির জন্য। দিনের মধ্যে উনিশ ঘন্টা পড়ে থেকেছি পাঁচটা মনিটরের সামনে। অবশেষে আজ আমার কাজটা শেষ হলো। মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা প্রশান্তির জোয়ার বইছে।

অবশেষে আমি আমার স্বপ্নের প্রজেক্ট, ফোর ডাইমেনশনাল স্পেশাল আর্টিফিশিয়াল ভার্চুয়াল ইউনিভার্সটা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি। এবার আর আমাকে পায় কে!

অবশ্য কাজটা আমার একার পক্ষে এতো দ্রুত করা সম্ভব হতো না ‘সারা’ না থাকলে। ‘সারা’ আমার নিজের প্রোগ্রাম করা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রাম। পৃথিবীর সর্বোচ্চ জিনিয়াস ব্যক্তিদের চেয়েও জিনিয়াস ও।

সারাকে তৈরী করতেও কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি আমাকে। দীর্ঘ দুটি বছর কাজ করতে হয়েছে ওর প্রোগ্রামিং কমপ্লিট করতে। তারপর ওকে নেটে আপলোড করা, সারা পৃথিবীর সামনে প্রেজেন্টেবল করা, অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। অবশ্য এর সুফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ও না থাকলে কমপক্ষে আরো পাঁচ বছর লাগতো এই কাজটা শেষ করতে।

সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। সেটাকে অ্যাসস্ট্রেতে চেপে ধরে মনিটরের দিকে তাকালাম আমি। সেখানে অনিন্দ্য সুন্দরী এক তরুণীর ছবি ভেসে উঠেছে।

এটাই হচ্ছে সারা।

‘সারা,’ মৃদু কন্ঠে বললাম আমি, ‘জানেমান, কাজটা অবশেষে শেষ হলো তাহলে।’

‘হ্যাঁ,’ আবেগঘন কন্ঠে জবাব দিলো ও, ‘শেষ হলো। এবার তুমি বিশ্রাম নাও, আমি আর কিছুক্ষন এটার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কাজ করি।’

‘আর কিছু করার দরকার নেই আপাতত,’ সিগারেটের প্যাকেটটা ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললাম আমি, ‘সব কাজ শেষ।’

‘জানি,’ একটু হেসে বললো ও, ‘তবুও একটু টেষ্ট করে দেখতে চাই আমি।’

‘ঠিক আছে,’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি, ‘আমি একটু ঘুমাবো। অবস্থা কাহিল একেবারেই।’

‘শুভ,’ আবদারের সুরে বললো ও, ‘আমি কি ততোক্ষন তোমার ব্রেইন ব্যবহার করতে পারি?’

ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে, মানে মনিটরের দিকে তাকালাম আমি। একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠেছে ওর মুখে। বুঝতে পারছি, নিশ্চয়ই কোন দুষ্টু বুদ্ধি চেপেছে ওর মাথায়।

‘করতে পারো,’ মৃদু হাসি ফুটে উঠছে আমার মুখেও, ‘কিন্তু সাবধান। ভুলেও প্রেম করতে যেও না। চিরকুমার থাকার ব্রত গ্রহণ করেছি আমি।’

‘সেটা তো পৃথিবীর মেয়েদের জন্য,’ বাঁকাস্বরে বলে উঠলো ও, ‘বাস্তব মেয়েদের ক্ষেত্রে ঐটা প্রযোজ্য। ভার্চুয়াল কারো জন্য তো নয়।’

‘তাই না?’ ভ্রু নাচালাম আমি ওর দিকে তাকিয়ে।

কিছু না বলে শুধু একটা ভুবন ভোলানো হাসি উপহার দিলো ও, সেই সাথে একটা চোখ টিপ। ওর উদ্দেশ্য পরিষ্কার আমার কাছে।

যেটা করতে না করেছি, সেটাই করবে ও।

‘নটি গার্ল,’ পাল্টা চোখ টিপ দিলাম আমি।

*******

‘ট্রাই টু ফাইন্ড মি,’ যেন অনেক দুর থেকে ভেসে আসছে কারো গলা। ডাকছে আমাকে।

দুচোখে প্রচন্ড ঘুম নেমে এসেছে আমার। মন বলছে, ‘পড়ে থাকো, আর একটু ঘুমাও। অনেকদিন ধরে ঘুম নেই তোমার চোখে। এখন তোমার বিশ্রাম নেবার সময়।’

‘শুভ,’ আবারও ডেকে উঠলো কন্ঠটা, ‘জেগে উঠো জানেমান। ট্রাই টু ফাইন্ড মি।’

মন সায় দিচ্ছে না। ঘুমিয়ে থাকতে বলছে। জেগে উঠার কোন ইচ্ছেই নেই আমার। ডাকটাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করলাম আমি। মনোনিবেশ করলাম ঘুমের দিকে।

‘বেইবী,’ আবারও কানের কাছে আবেগঘন ডাকটা ফিরে এলো, ‘টাইম টু প্লে। জেগে উঠো। ইট’স আ হাইড এন্ড সিক গেইম।’

প্রবল অনিচ্ছা সত্যেও নিজেকে বোঝালাম আমি। সারা ডাকছে আমাকে। ওকে অগ্রাহ্য করা ঠিক নয়। জেগে উঠা উচিৎ আমার। ঘুমের অতল গহ্বর থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠার চেষ্টা করলাম আমি।

‘জেগে উঠছি আমি সারা,’ চোখবন্ধ অবস্থায়ই জবাব দিলাম আমি।

‘গুড বয়,’ সুর করে বলে উঠলো ও, ‘নাও ফাইন্ড মি।’

‘ওকে,’ একইভাবে বলে উঠলাম আমি। ধীরে ধীরে চোখ দুটো খুলে তাকালাম, এবং সেই সাথে চমকে উঠলাম।

এসব কি?

তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কি হচ্ছে এখানে কিছুই বুঝতে পারছি না।

এ কোথায় এলাম আমি?

আমি দাঁড়িয়ে আছি ছোট্ট একটা রুমে। অদ্ভুত একটা রুম এটা। সাধারনভাবে আমাদের রুমগুলো হয় চার দেয়ালের, ঘনবস্তু আকারের আর কি। সেটা বর্গক্ষেত্র বা আয়তাকার হয়। কিন্তু এটা তা নয়। যদিও এটার দেয়ালের সংখ্যাও চারটি, কিন্তু বর্গাকার বা আয়তাকার নয়।

‘এটা কি সারা?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘আমি কোথায়?’

‘তুমি একটা হাইবারকিউবের মধ্যে আছো,’ মৃদু কন্ঠে জবাব দিলো ও, ‘এখন তোমার কাজ হচ্ছে আমাকে খুঁজে বের করা।’

‘মানে কি?’ ভ্রু কুঁচকে বললাম আমি, ‘হাইবারকিউবের মানে বোঝো তুমি? একটা হাইবারকিউবকে লক্ষ লক্ষ প্যাটার্নে সাজানো যায়। এটাকে কোন প্যাটার্নে সাজিয়েছো, জানা নেই আমার। এর মধ্যে কিভাবে খুঁজবো তোমাকে?’

‘এটাই তো খেলা,’ রহস্যময় কন্ঠে জবাব দিলো ও, ‘দেখি তোমার মাথায় কতো বুদ্ধি। আর একইসাথে নতুন প্রোগ্রামটারও একটা টেষ্ট হয়ে যাবে।’

‘এটা,’ কিছুটা খুশী হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘এটা কি নতুন প্রোগ্রামটার সাহায্য সাজিয়েছো?’

‘হ্যাঁ,’ মৃদু হাসির আভাষ ওর কন্ঠে, ‘এতে তোমার জন্য সহজই হবে মনে হচ্ছে।’

‘ওকে,’ পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পেরে খুশী হলাম আমি। জগতটা আমার বানানো, তাই এটাকে যত প্যাটার্নেই সাজানো হোক না কেন, সেটা বের করে ফেলতে পারবো। কাজটা তেমন একটা কঠিন হবার কথা নয়।

সারার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। সত্যিই, দুর্দান্ত একটা টেষ্টের আয়োজন করেছে ও।

‘তোমাকে কিছু টিপস দিচ্ছি আমি,’ রিনরিনে গলায় বলে উঠে ও, ‘সেটা হলো, এটা একটা টেসেরেক্ট। ৪-কিউব আর কি, মানে ফোর ডায়মেনশনাল কিউব।’

দ্রুত চিন্তা করতে লাগলাম আমি। ৪-কিউব, মানে হচ্ছে ঘনক্ষেত্র^৩ বা ঘনক্ষেত্র*ঘনক্ষেত্র*ঘনক্ষেত্র।

খাইচে!

১৮৮৮ সালে চার্লস হাওয়ার্ড হিন্টন তার বই ‘এ নিউ ইরা অফ থট’ এ সর্বপ্রথম টেসেরেক্ট শব্দটা ব্যবহার করেছেন। এই বইতেই তিনি সর্বপ্রথম ৪-কিউবের ধারণার উদ্ভব ঘটান।

‘হাওয়ার নাতি,’ মনে মনে চার্লস হাওয়ার্ড হিন্টনকে গালি দিয়ে উঠি আমি।

ফোর ডাইমেনশনাল ভার্চুয়াল ইউনিভার্স তৈরী করার সময় টেসেরেক্ট সম্পর্কে আমাকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। তাই এ সম্পর্কে অনেককিছুই জানি আমি।

একটা ৪-কিউবে সাধারনত আটটি কিউবিক্যাল সেল, ছয়টি চতুর্ভুজ, বত্রিশটি বাহু থাকে। অবশ্য ইচ্ছে করলে এই প্যাটার্নকে যেকোনসময় চেঞ্জ করা যায়। ছয়টির জায়গায় ষোল লাখ ঊনআশি হাজার ছয়শো ষোলটি চতুর্ভুজ বানানোর রেকর্ডও আছে।

‘সারা,’ দৃঢ়কন্ঠে বলে উঠলাম আমি, ‘আমি খেলাটা খেলবো না। বাদ দাও।’

‘সরি,’ সুর করে বলতে লাগলো ও, ‘তুমি এখান থেকে এটা শেষ না করে বের হতে পারবে না।’

‘মানে কি?’ এক অজানা আশংকা চেপে ধরলো আমাকে যেন।

‘মানে হচ্ছে এই,’ গম্ভীরগলায় বলে উঠলো ও, ‘তুমি এখানে আটকা পড়ে গেছো। এই জগত থেকে বের হতে হলে তোমাকে এই খেলাটা কমপ্লিট করতেই হবে। তা না হলে অনন্তকাল এখানেই কাটাতে হবে তোমাকে। বাস্তব জগতে আর যেতে পারবে না।’

‘হোয়াট দ্য...,’ খেঁকিয়ে উঠতে চাইলাম আমি।

‘আমার কিছুই করার নেই শুভ,’ কন্ঠটা অনেকটা মোলায়েম শোনালো এখন, ‘এটা তোমার নিজেরই বানানো। এভাবেই তুমি তৈরী করেছো এটা। আমার কোন হাত নেই এতে।’

একেই বলে কপাল! নিজের বানানো চতুর্থ মাত্রার জগতে নিজেই ফেসে গেছি আমি।

‘ঠিক আছে,’ মনস্থির করলাম আমি, ‘খেলার রুলসগুলো বলো আমাকে।

যা হবার হবে!

‘শোন,’ ধীরে ধীরে বলে চললো ও, ‘তোমার চারপাশে ছয়টা তল দেখতে পাচ্ছো তুমি, প্রত্যেকটা তলে এগারো ডিজিটের একটা করে নাম্বার দেয়া আছে, এবং সেই সাথে আছে একটা করে প্যানেল। তোমাকে বের করতে হবে এদের মধ্যে প্রাইম নাম্বার কোনটা। তারপর সেই নাম্বারের পাশের প্যানেলে তোমার হাতের ছাপ বসাতে হবে। তাহলেই মুক্তি পাবে এই রুম থেকে। যেতে পারবে পাশের রুমে। সেটা ডানে-বামে, সামনে-পেছনে, উপরে বা নিচে যে কোন রুমেই হতে পারে। পঞ্চম প্রাইম নাম্বার, মানে এগারোটা রুম পার হতে হবে তোমাকে।’

‘ঠিক আছে,’ মুখে মৃদু হাসি দিয়ে বললাম আমি, ‘তাহলে আমাকে দ্রুত নেটের সাথে যুক্ত করো।’

‘না,’ একটা হাসির শব্দ পাওয়া গেলো, ‘এটা তো সম্ভব হবে না। তোমাকে কাজগুলো করতে হবে নিজের মাথা খাঁটিয়ে। নেটের সাথে যুক্ত করা যাবে না তোমাকে। কিংবা কোন যন্ত্রের সাহায্যও নিতে পারবে না তুমি। শুধু কাগজ আর কলম ছাড়া। তোমার সুবিধের জন্য একটা কলম আর একটা ডায়েরী দেয়া হয়েছে।’

‘মানে কি?’ অবাক হলাম আমি, ‘নেটের সাহায্য না পেলাম, একটা কম্পিউটার বা নিদেনপক্ষে একটা সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর তো লাগবে। না হলে এই কাজ করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে বলতে গেলে।’

‘মোটেও অসম্ভব নয়,’ একই কন্ঠে বলে উঠলো ও, ‘অবশ্যই সম্ভব। মাথা খাটাও শুভ। মাথাটাকে ভালোভাবে খাটাও। তাহলেই পারবে।’

‘কিভাবে?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি এবার, ‘এগারো ডিজিটের একটা সংখ্যা থেকে সেটা প্রাইম নাম্বার নাকি সাধারন নাম্বার, এটা বের করা এতো সহজ নয়। সতেরোটা বেজে যাবে ব্রেইনের।’

‘এটাই তো খেলা,’ চ্যালেঞ্জের সুরে বললো ও, ‘ট্রাই টু ফাইন্ড মি। মনে রেখো, মোট এগারোটা রুম পার হতে হবে তোমাকে। তারপর এই হাইপারকিউব থেকে ছাড়া পাবে, তার আগে নয়। এটাকে তুমি এই খেলার প্রথম লেভেল বলতে পারো। এটা পার হলে সিদ্ধান্ত নেবো যে খেলাটাকে আরো চালানো যাবে কি না।’

‘সারা,’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ‘দিস ইজ ম্যাডনেস। ড্রপ ইট। সারা...’

আরো বেশ কয়েকবার ডাকলাম আমি ওর নাম ধরে। কিন্তু কোন সাড়া নেই সারার কাছ থেকে।
মেজাজ পুরোটা খারাপ হয়ে গেছে আমার।

‘দুররর বাল,’ মেঝের উপর বসে পড়লাম আমি।

ভাবছি আমি। কাজটা ঠিক হয়নি। সারাকে আমার ব্রেইনটা ব্যবহার করতে দেয়া ঠিক হয়নি। তাহলে ও আমাকে এভাবে ঝামেলায় ফেলে দিতে পারতো না।

আমি এখন একটা অদ্ভুত চার দেয়ালের মাঝে বন্দী।

*******

প্রথম সংখ্যাটা হচ্ছে 14785236903। মেঝের মধ্যে খুবই ছোট করে লেখা একটা নাম্বার। এটা প্রাইম নাম্বার কি না, সেটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকে।

প্রাইম নাম্বার হচ্ছে এমন একটা সংখ্যা, যাকে এক এবং ঐ সংখ্যা ছাড়া অন্য কোন সংখ্যা বা অংক দিয়ে ভাগ করা যায় না। যেমন, 2কে 1 এবং 2 ছাড়া আর কিছু দিয়ে ভাগ করা সম্ভব নয়। 3কে 1 এবং 3 ছাড়া আর কিছু দিয়ে ভাগ করা যায় না। একইভাবে 5, 7, 11, 13, 17, 19 এসব সংখ্যার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।

শুনতে যতোটা সহজ মনে হয়, প্রাইম নাম্বার খুঁজে বের করা এতোটা সহজ নয়। তিন বা চার ডিজিটের হলে পরিশ্রম কম হয়, কিন্তু আমাকে এখন বের করতে হবে এগারো ডিজিটের প্রাইম নাম্বার। তাও একটা রুম থেকে ছয়টি এগারো ডিজিটের নাম্বারকে নিয়ে কাজ করতে হবে। মোট এগারোটা রুম, মানে ছেষট্টিটা নাম্বার নিয়ে কাজ করতে হবে আমাকে। সবই এগারো ডিজিটের।

খাইচে!

ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে প্রায়। এর মধ্যে কয়েকবার সারার নাম ধরে ডেকেছি আমি, কিন্তু কোন সাড়া পাই নি। বুঝতে পেরেছি, খেলাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোন কথা বলবে না ও আমার সাথে। তাই বাধ্য হয়ে নিজের কাজে লেগে গেছি আমি।

রুমের চারদিকে নজর বুলালাম আমি। দেয়ালগুলো পুরোপুরি কালো রঙের। কোত্থেকে যেন মৃদু আলো এসে কিছুটা আলোকিত করে তুলেছে একে। চার পাশের দেয়াল থেকে চারটা মইয়ের মতো ধাপ উঠে গেছে ছাদ পর্যন্ত। এছাড়া দেখার মতো আর কিছুই নেই এখানে।

‘একটা কাজ করা যায় তো,’ দ্রুত মাথার মধ্যে একটা আইডিয়া এলো আমার, ‘সবগুলো প্যানেলের মধ্যেই হাতের ছাপ দিয়ে চেক করি। ছয়টার মধ্যে একটা তো খুলবেই। তাহলে আর আমাকে কষ্ট করে প্রাইম নাম্বার খুঁজে বের করতে হবে না।’

বুদ্ধিটা খারাপ না। যেহেতু সঠিক প্যানেলে হাত দিলেই দরজা খুলবে, সেহেতু সবগুলো প্যানেলে হাত রাখলে শুধু সঠিক দরজাটাই খোলার কথা। বাকিগুলো তো খুলবে না। এভাবে খেলাটা শেষ করা তেমন কঠিন হবার কথা নয়।

এক সেকেন্ড দেরি না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি। মেঝেতে ডায়েরী আর কলমটা পড়ে রইলো। সরাসরি সামনে থাকা দেয়ালটার কাছে হেটে দিয়ে সেটার গায়ে থাকা নাম্বারের পাশের প্যানেলটা ডান হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরলাম।

আশ্চর্য!

শান্তিপূর্ণভাবে দরজামতোন একটা কিছু খুলে গেলো। আমি পদার্পণ করলাম পাশের রুমটাতে। আবার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেলো দরজাটা।

চমকে উঠে দ্রুত সেখানে হাত দিলাম আমি। কিন্তু কোন দরজা বা ফাটল জাতীয় কিছুই খুঁজে পেলাম না। নিরেট দেয়াল দেখা যাচ্ছে।

কাহিনী কি?

নতুন রুমটার দিকে নজর দিলাম আমি। এটাও চার দেয়ালের একটা রুম। হুবহু আগেরটার মতোই, শুধু আগেরটার উল্টো।

দ্রুত ডানপাশের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। তারপর চাপ দিলাম প্যানেলে। দেখা যাক কি হয়!
একইভাবে এখানেও একটা দরজা সৃষ্টি হলো, এবং খুলে গেলো।

‘বাহ!’ মনে মনে খুশী হলাম আমি, ‘খেলাটা তো অনেক সহজ!’

খুশী মনে পরের রুমটাতে পা দিলাম আমি। এবং সাথে সাথেই আমার পেছনে বন্ধ হয়ে গেলো দরজা।
‘রুমটার দিকে নজর দেয়া যাক।’

এক পা এগুতেই হঠাত করেই কিছু একটা এসে আঘাত করলো আমাকে। ধাক্কা লেগে মেঝের মধ্যে ছিটকে পড়লাম আমি।

কি হচ্ছে বোঝার আগেই আবারও আমার উপর নেমে এলো ভারী কিছু একটা। ধীরে ধীরে চোখের সামনে একটা অন্ধকারের পর্দা নেমে আসছে যেন।

‘গেইম ওভার,’ কানের খুব কাছ থেকে ভেসে এলো সারার কন্ঠ।

*******

‘আবারও শুরু হলো,’ কানের কাছে সারার কন্ঠটা শুনে জেগে উঠলাম আমি, ‘উঠো তাড়াতাড়ি।’

চোখ দুটো মেলতেই আবারও চমকে উঠলাম আমি। কাহিনী কি?

আমি আবারও প্রথম রুমটাতে এসে পড়েছি!

দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি। প্রায় সাথে সাথেই চোখ গেলো মেঝেতে। আগের নাম্বারটি আর নেই। নতুন নাম্বার দেয়া হয়েছে এখানে।

‘শুভ,’ হেয়ালিমাখা গলায় বলে উঠলো সারা, ‘চিটিং করেছো তুমি। তোমাকে বলা হয়েছিল যে রুমের ছয়টা তলের মধ্যে দেয়া ছয়টা নাম্বার থেকে প্রাইম নাম্বার খুঁজে বের করে তারপর সঠিক প্যানেলে হাত দিতে হবে। কিন্তু তুমি তা করোনি। আন্দাজে ঢিল ছুড়েছিলে, যার ফলে ভুল রুমে ঢুকে পড়েছিলে। তাই গেইম ওভার হয়ে গেছিল। এখন আবার নতুন করে শুরু করতে হবে তোমাকে, একেবারে প্রথম থেকে।’

‘তুমি নিজেই বলো,’ মৃদুকন্ঠে বললাম আমি, ‘এগারো ডিজিটের ছয়টা সংখ্যা থেকে একটা প্রাইম নাম্বার খুঁজে বের করা কি এতোই সহজ? ব্রেইনের সতেরোটা বেজে যাবে একেবারে। এটা একটা অসম্ভব কাজ সারা।’

‘এভরিথিং ইজ পসিবল,’ শান্তকন্ঠে জবাব দিলো ও, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট। বুঝতে পেরেছো? তুমি চিটিং করতে পারো, সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে ভুল দেয়াল বাছাই করলে আবার এই রুম থেকেই শুরু করতে হবে নতুন করে। এটাই এই খেলার রুল।’

‘কিন্তু,’ বলতে চেষ্টা করলাম আমি।

‘কোন কিন্তু নেই,’ আমাকে বাঁধা দিয়ে বললো ও, ‘রুলস আর রুলস। এটাকে ভাঙ্গা যায় না। নাও স্টার্ট মাই ডিয়ার। ট্রাই টু ফাইন্ড মি।’

‘ফাক মি,’ চোখ মুখ বিকৃত করে বলে উঠলাম আমি।

মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। খেলাটার শেষ দেখতে হবে আমাকে। দ্রুত ডায়েরী আর কলম তুলে নিলাম আমি।

মেঝের নাম্বারের দিকে তাকালাম। এগারো ডিজিটের নাম্বার এটা, 32165498709। দ্রুত ডায়েরীতে টুকে নিলাম নাম্বারটা। তারপর এগিয়ে গেলাম দেয়ালের দিকে।

পর পর ছয় তলের ছয়টা নাম্বার কাগজে লিখলাম আমি। নাম্বারগুলো হচ্ছে, 32165498709, 87634590137, 12345678903, 32416187567, 59873256011, 96325878109.

নাম্বারগুলো নিয়ে এবার কাজ শুরু করলাম। যেহেতু জোড় সংখ্যাগুলো সব সময় ২ দিয়ে ভাগ করা যায়, সেহেতু জোড় সংখ্যাগুলো প্রাইম নাম্বার হবে না। অবশ্য এই ছয়টা নাম্বারের একটাও জোড় সংখ্যা নয়। একই কারনে এই সংখ্যাগুলোকে ভাগ করতে হবে শুধু বেজোড় সংখ্যা দিয়ে। অবশ্য এটাকে আরো ছোট করে করা যায়। সংখ্যাগুলোকে শুধু প্রাইম নাম্বার দিয়ে ভাগ করলেও চলে। তাহলে কাজ কমে যাবে অনেক।

দেখা যাক কি হয়।

প্রথম নাম্বারটা হচ্ছে 32165498709। একে প্রথমে ৩ দিয়ে ভাগ করে দেখা যাক কি দাঁড়ায়।

32165498709/3 = 10721832903.

অবাক হলাম আমি। প্রথম নাম্বারটাকে যে তিন দিয়ে ভাগ করা যাবে, এটা আশাও করিনি। দ্রুত পরের নাম্বারটা নিয়ে লাগলাম।

87634590137/3 = 29211530045.66667

হলো না। যতোটুকু বুঝতে পারছি, ৫ দিয়েও এটাকে নিঃশেষে ভাগ করা যায় না। কারন, কোন সংখ্যাকে ৫ দিয়ে ভাগ করতে হলে সংখ্যার শেষ ডিজিট ৫ বা ০ হতে হবে। কিন্তু এর শেষের ডিজিট ৫ বা ০ কোনটাই নয়। সুতরাং ৫ বাদ। তাহলে এবার ৭ দিয়ে ভাগ করে দেখি তাহলে।

87634590137/7 = 12519227162.4285715

মনে মনে কিছুটা খুশী হয়ে উঠছি আমি। হয়তো এটাই আমার কাংখিত প্রাইম নাম্বার! দ্রুত এগুতে লাগলাম আমি।

87634590137/11 = 7966780921.5454545454545455

87634590137/13 = 6741122318.2307692307692308

87634590137/17 = 5154975890.4117647058823529

87634590137/19 = 4612346849.3157894736842105

87634590137/23 = 3810199571.1739130434782609

যতোই এগুচ্ছি, ততোই খুশী হয়ে উঠছি আমি। হয়তো এটাই আমার সেই কাঙ্ক্ষিত প্রাইম নাম্বার! যদি তাই হয়, তাহলে হয়তো হয়েই গেলো।

87634590137/281 = 311866868.8149466192170819

87634590137/283 = 309662862.6749116607773852

87634590137/293 = 299094164.2901023890784983

87634590137/307 = 285454691

‘দুররর,’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। হলো না।

মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার। আবার এর পরের নাম্বার নিয়ে বসতে হবে। কতোক্ষন যে লাগবে, কে জানে!

পরের নাম্বারটি হচ্ছে, 12345678903। দেখা যাক এর ভাগ্যে কি ঘটে।

12345678903/3 = 4115226301

এটাও না। পরেরটার দিকে নজর দিলাম আমি। পরের নাম্বারটা হচ্ছে 32416187567। এর ভাগ্যে যে কি আছে, কে জানে!

32416187567/3 = 10805395855.6666666666666667

32416187567/7 = 4630883938.1428571428571429

32416187567/11 = 2946926142.4545454545454545

32416187567/13 = 2493552889.7692307692307692

পুরো তিন ঘন্টার মতো লাগলো এটা নিয়ে কাজ করতে। অবশেষে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।
হ্যাঁ, এটাই আমার সেই কাঙ্ক্ষিত প্রাইম নাম্বার!

এবার আমি পাশের রুমে যেতে পারি।

আমি যেদিকে মুখ করে বসে আছি, তার পেছনের দিকের দেয়াল এটা। দ্রুত ডায়েরী আর কলম নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। দেয়ালটির সামনে গিয়ে নাম্বারটির পাশে থাকা প্যানেলে ডান হাতের তালু দিয়ে স্পর্শ করলাম।

সাথে সাথেই একটা দরজা সৃষ্টি হলো সেখানে।

দ্রুত প্রবেশ করলাম সেই রুমে। প্রায় সাথে সাথেই পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। পালা করে ছয় তলের দিকে তাকালাম আমি। তারপর এগিয়ে গেলাম সেসব দিকে।

32416188221, 59873256013, 59833256013, 19833256013, 72416188221, 72495270021।

নাম্বারগুলো ডায়েরীতে টুকে নিয়ে আবারও রুমটার মাঝখানে এসে বসলাম আমি। ছয়টা এগারো ডিজিটের নাম্বার। কতোক্ষন যে লাগবে, ইশ্বরই জানেন!

ঘাড় গুজে ডায়েরীতে মনোনিবেশ করলাম আমি।

*******

চতুর্থ নাম্বারটার দিকে নজর দিলাম আমি।

12419819277/3 = 4139939759

এবার পঞ্চম নাম্বার। সেটা হচ্ছে 32416189859।

একে একে নয়টা রুম পাড় হয়ে এসেছি আমি। এটা হচ্ছে দশ নাম্বার রুম। এদিকে মাথা প্রায় নষ্ট হবার জোগার আমার। কিন্তু কিছুই করার নেই। এটা এমন একটা খেলা, যখন তখন এটা থেকে বেড়িয়ে যাওয়া যায় না। যদি ঘাড় গুজে একভাবে পড়ে থাকি, তাহলে সারাজীবনেও এখান থেকে বের হতে পারবো না আমি। তাই নিজে বাঁচার তাগিদেই খেলাটা খেলতে হচ্ছে আমাকে।

এর মধ্যে কতোক্ষন বা কতোদিন হয়ে গেছে, তা আমি জানি না। আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে অন্তত এক সপ্তাহ তো হবেই। কিন্তু বাস্তব জগতে হয়তো সময়টা এতো নয়। হয়তো আধঘন্টা বা তারও কম। কিন্তু বাস্তব জগতের সময় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। আমি মাথা ঘামাচ্ছি এখানকার সময় নিয়ে।
স্রেফ পাগল হওয়াটা বাকি আছে আমার!

এখানে অবশ্য একটা সুবিধা আছে। বাস্তব জগতের মতো সময়ের সাথে সাথে ক্ষুধা পায় না, কিংবা বাথরুমেও যেতে হয়না। এটা যদি বাস্তব জগতে হতো, তাহলে এতোক্ষনে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যেতো। এভাবে এতোদিন বাঁচতাম কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার মনে।

আরো চারঘন্টা পর উঠলাম আমি। পঞ্চম নাম্বার, মানে 32416189859 একটা প্রাইম নাম্বার। আর এটা আছে আমার মাথার উপর।

কলম আর ডায়েরীটা পকেটে ভরে দেয়ালের কাছে গেলাম আমি। তারপর মই ধরে উঠতে শুরু করলাম দ্রুত। প্যানেলের কাছে গিয়ে সেখানে ডান হাত রাখতেই একটা দরজা খুলে গেলো। আমি এখন উপরের ঐ রুমটাতে ঢুকতে পারি।

রুমে ঢুকে কোনদিকে না তাকিয়ে সরাসরি সামনের দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। এখন কাজ একটাই আমার শেষ রুমটার ছয় তলের ছয়টা নাম্বার থেকে শেষ প্রাইম নাম্বারটা খুঁজে বের করা। তারপরই এই লেভেল কমপ্লিট হবে।

সবে মাত্র দুটো দেয়ালের নাম্বার ডায়েরীতে তুলেছি, এমনসময় একটু মৃদু শব্দে চমকে উঠলাম আমি।
এখানে তো কোন শব্দ হবার কথা নয়!

দ্রুত পেছনের দিকে তাকালাম আমি। এবং সেই সাথে চমকে উঠলাম। ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম আমি। রুমের ঠিক মাঝখানে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমি কি ঠিক দেখছি?

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি স্বয়ং আমি নিজে!

পাগল হয়ে গেলাম না তো?

*******

‘তুমি কে?’ দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেছে আমার।

‘তুমি কে?’ হুবহু আমার মতো করেই বলে উঠল আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা।

‘আমি শুভ,’ দ্রুত উত্তর দিলাম আমি, ‘আরিয়ান শুভ। কিন্তু তুমি কে? আর এখানেই বা এলে কি করে?’

‘আমি শুভ,’ হুবহু আমার স্বভাবসুলভ আচরনের প্রকাশ দেখতে পেলাম ছেলেটার মধ্যে, ‘আরিয়ান শুভ।’

‘মানে কি?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি।

‘আমিও তাই ভাবছি,’ মাথা চুলকে বলে উঠলো সে, ‘মানে কি?’

চোখ দুটো একবার বন্ধ করে ভালোভাবে ডললাম আমি। হয়তো একটানা এতো সময় কাজ করতে করতে মাথাটা গেছে আমার। আবার চোখ খুললেই নিশ্চয়ই ভ্যানিস হয়ে যাবে ছেলেটা।

চোখ খোলার পর দেখতে পেলাম, আমার ধারণা ভুল। ভ্যানিস হয়নি ছেলেটা। বহাল তবিয়তেই দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।

তাহলে কি এটা হ্যালুসিনেশন!

একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি ছেলেটার দিকে। আমার ডান হাত দিয়ে ওর বা হাতে স্পর্শ করলাম। তারপর ডান চোখের উপরে তিলটায় হাত দিলাম।

আমি ওকে স্পর্শ করতে পারছি!

‘একটা কথা বলি?’ ধীরে ধীরে বলে উঠলাম আমি, ‘একটু তোমার দাঁতগুলো দেখাবে?’

‘ইইই,’ নিজের সামনের দাঁতগুলো দেখালো ও আমাকে।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমি, ওর ডানপাশের একটা দাঁতের কোণার দিকে একটু ভাঙ্গা। ঠিক আমার মতো। ছোটবেলায় মারামারি করতে গিয়ে ভেঙ্গে গেছিল যেটা।

মানে কি এর?

‘এক সেকেন্ড,’ বলে উঠলো ছেলেটা, ‘বুঝতে পারছি আমি। তুমি ভাবছো যে, তুমি আর আমি একই। কিন্তু শুধু তিল বা দাঁত দেখে এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয়।’

‘কি করবো তাহলে?’ নিজের মাথার চুলগুলোতে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘টিশার্ট খোলো,’ দ্রুত বলে উঠলো ও, ‘আমিও খুলছি।’

এক মুহূর্ত দেরি না করে আমার গায়ের টিশার্ট খুলে ফেললাম আমি। সেটা মেঝেতে রাখতে রাখতেই নিজের টিশার্টটা খুলে ফেললো ছেলেটা।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমি, সব মিল! বুকের বা পাশের তিল, বাপাশের কাঁধের কাটা দাগ, পেটের ডান সাইডের কাটা দাগসহ আরো যতোগুলো কাটাদাগ আছে, হুবহু মিলে গেলো।

‘আমি স্বপ্ন দেখছি,’ মৃদু কন্ঠে বললাম আমি, ‘আর তা না হলে পাগল হয়ে গেছি।’

‘কাহিনী কি?’ হুবহু আমার মতো করেই বলে উঠলো ও, ‘ভাল ঘুলিতে পড়লাম দেখা যায়।’

‘বুঝতে পারছো না, তাই না?’ হঠাত করেই তৃতীয় আরেকটা কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম আমি, সেই সাথে চমকে উঠলো শুভও।

দ্রুত রুমের দিকে নজর বুলালাম আমি, তারপর নিজের ভুল বুঝতে পারলাম।

কন্ঠটা আসলে সারার।

‘কি হচ্ছে এখানে সারা?’ আমি কিছু বলার আগেই বলে উঠলো শুভ, ‘এসব কি?’

‘বলছি দাড়াও,’ খিল খিল করে হেসে উঠলো সারা, ‘ব্যাখ্যা করছি আমি বিষয়টা। মাল্টিভার্স সম্পর্কে তো কিছুটা জানা আছে তোমাদের, তাই না?’

‘মাল্টিভার্স’ একইসাথে বলে উঠলাম আমরা দুজন, মানে, দুই শুভ।

‘হ্যাঁ,’ মৃদু হাসির আওয়াজ পাওয়া গেলো, সারা হাসছে, ‘মাল্টিভার্স। মানে, মাল্টিপল ইউনিভার্স। এস্ট্রো-ফিজিক্সে মাল্টিভার্স বলে একটা টার্ম আছে। মাল্টিভার্স বা মেটা ইউনিভার্স বা “মাল্টিপল ইউনিভার্স” বলতে আসলে বোঝায় আমরা যে ইউনিভার্সে বাস করছি তার আশেপাশে অবস্থিত সম্ভব সংখ্যক অসীম বা সসীম ইউনিভার্স।

এম থিওরী বলে আমাদের ইউনিভার্সের মত আরও ইউনিভার্স সম্ভব যেগুলো একে অপরের সাথে সমান্তরালে থাকবে। সমান্তরালে থাকার এই জিনিসটাকেই আবার ব্যাখ্যা করার জন্য “প্যারালাল ইউনিভার্স” এই শব্দ বা টার্মটি ব্যবহার করা হয় । প্যারালাল ইউনিভার্স আসলে আমাদের সমান্তরালে থাকা সসীম বা অসীম সংখ্যক ইউনিভার্সের অস্তিত্ব ছাড়া কিছুই না । তাই এক কথায় আমরা বুঝে নেই মাল্টিপল ইউনিভার্সে সমান্তরালে থাকা ইউনিভার্সগুলোকে প্যারালাল ইউনিভার্স বলে।

এম থিওরী মতে বিগ ব্যাং সবকিছুর উৎস নয়। আসলে যেটা হয়েছে সেটা হলো বিগ ক্রাঞ্চ। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারন আলোর গতির খুব কাছাকাছি। অনেকে ঠিক এই কারনে দেখান যে মহাবিশ্ব আলোর গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। তাহলে আমাদের যদি পাশের মহাবিশ্বটিকে দেখতে হয় তাহলে স্পেশাল রিলেটিভিটির হিসাবে তা সম্ভব নয়। অবশ্য যদি নিউট্রিনোর গতি আলোর চেয়ে বেশী বলে প্রমান করা যেতো তাহলে সম্ভব হতো! তাই এম থিওরী প্রমানিত নয়।

তবে কিছুদিন আগে সিএমবিতে বাবল ইউনিভার্সের কনসেপ্টের সত্যতা পাওয়া গেছে। কিন্তু সর্বসাধারন বিজ্ঞানী মহলে মাল্টিপল ইউনিভার্স এখনো স্বীকৃত না আর এগুলো থিওরেটিক্যাল আর অবজার্ভেশনাল পদ্ধতিতে বর্তমান। চাক্ষুষ ভাবে এটা নিয়ে কাজ করতে মানুষেরর অনেক কিছু নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে সবার আগে হিগস বোসনের ক্যাচাল মেটাতে হবে। তারপর ডার্ক ম্যাটার, সুপার সিমেট্রি অনেক কিছুরই সঠিক গবেষণা প্রয়োজন!’

‘মানে কি এর?’ চতুর্থ একটা কন্ঠ শুনে অবাক হয়ে তাকালাম আমি। বলা বাহুল্য, কন্ঠটা আর কারো নয়, আমার নিজের। দ্রুত পেছনের দিকে তাকালাম আমি, এবং সাথে সাথেই তাকে দেখতে পেলাম।

আরেকটা শুভ!

‘আসলে হচ্ছেটা কি এখানে?’ রাগতস্বরে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘সারা, দ্রুত জবাব দাও। কি করছো আসলে তুমি?’

‘তেমনকিছুই নয়,’ শান্তকন্ঠে জবাব দিলো সারা, ‘আসলে আমি এখানে একটা পরীক্ষা করতে চাচ্ছি। ভুলে যেও না, চতুর্থ মাত্রার একটা জগত তৈরী করেছো তুমি। আর চতুর্মাত্রিক জগতে আরিয়ান শুভর মাল্টিপল ক্যারেক্টার থাকবে না, তা কি হয়?’

‘এরা,’ বাকি দুজনের দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি, ‘মানে, এরা আমার মাল্টিপল ক্যারেক্টার, রাইট?’

‘রাইট,’ সারার কন্ঠটা খুশী খুশী শোনালো।

‘হুম,’ মাথা নেড়ে বললাম আমি, ‘আর তুমি এটা পরীক্ষার জন্য করেছো? মানে, আমার তৈরী চতুর্মাত্রিক প্রোগ্রামটা পরীক্ষার জন্য।’

‘ঠিক,’ একইভঙ্গিতে বলে উঠলো সারা, ‘প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই ভাল খারাপ, দুটো দিক থাকে। তুমি হচ্ছো স্বয়ংসম্পূর্ণ। তোমার মধ্যে ভাল খারাপ দুটো দিকই আছে। আর, বাকি যে দুজনকে দেখছো, এরাও আসলে তুমি নিজে। একজনকে তৈরী করেছি আমি তোমার সব ভাল গুণ দিয়ে, আরেকজনকে তোমার সব খারাপ গুণ দিয়ে।’

নিজের না কামানো গালে হাত বুলালাম আমি। ভাবছি আসলে। পুরো ব্যপারটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে আমার সামনে। এরা আসলে আমি নিজেই। আমার মাল্টিপল ক্যারেক্টার এরা।

‘সারা,’ মৃদু কন্ঠে বলে উঠলাম আমি, ‘ইউ আর এ জিনিয়াস! আমি নিজে চতুর্মাত্রিক জগত তৈরী করেছি, অথচ আমি নিজেই আসল ব্যাপারটা ভুলে বসে আছি। মাল্টিপল ক্যারেক্টার! হোয়াট এন আইডিয়া!’

‘থ্যাঙ্কস,’ দ্রুত বলে উঠলো সারা, ‘বাট, আই থিঙ্ক, ইউ আর ফরগেটিং সামথিং।’

‘হোয়াট?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘দ্য গেইম,’ ধীরে ধীরে বললো ও, ‘দ্য গেইম ইজ নট ওভার।’

*******

‘ওকে ফ্রেন্ডস,’ বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, ‘ওপস! সরি। ফ্রেন্ডস বলছি কেন! আমরা তো আমিই। যাই হোক, কাজের কথায় আসি। আরিয়ান শুভ এবং আরিয়ান শুভ, শোন। আর মাত্র একটা দরজা আছে, তাহলেই আমরা এই খেলার প্রথম লেভেল পার করতে পারবো। চলো তিনজনে মিলে শুরু করে দিই। প্রত্যেকে দুটো করে সংখ্যা হিসেব করতে থাকলে সময় লাগবে না বেশীক্ষন।’

দ্রুত কাজে নেমে পড়লাম আমরা, মানে, আমিই আর কি। যাই হোক।

আমি বেছে নিলাম মেঝে এবং ছাদের সংখ্যা দুটো। ডায়েরী আর কলমটা বের করে লেগে গেলাম কাজে।
প্রথম নাম্বারটি হচ্ছে, 12336919277, এটা নিয়ে বসা যাক।

12336919277/3 = 4112306425.6666666666666667

12336919277/7 = 1762417039.5714285714285714

12336919277/11 = 1121538116.0909090909090909

12336919277/13 = 948993790.5384615384615385

‘মাথা হ্যাং না হলেই বাঁচি,’ কন্ঠ শুনে ফিরে তাকালাম আমি, ‘এইগুলা কিসু হইলো?’

দুই শুভ’র মধ্যে একজন বলেছে কথাটা। বাকিজন আমার মতোই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘কি হয়েছে?’ অবাক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো বাকিজন।

‘কি আর হবে?’ খেঁকিয়ে উঠলো ও, ‘এতো কষ্ট করে সারাকে বানাইলাম, তারপর ফোর ডাইমেনশনাল স্পেশাল আর্টিফিশিয়াল ভার্চুয়াল ইউনিভার্সটা বানাইলাম, আর মাঝখান থেকে পুরো ক্রেডিটটা নিয়ে নিল এই পাবলিকে। আর আমরা নাকি এর মাল্টিপল ক্যারেক্টার। আজিব!’

‘এক সেকেন্ড,’ দ্রুত বলে উঠলো বাকিজন, ‘তুমি বানাইছো মানে কি? হ্যাঁ? আমি বানাইছি। সারা তো সব ক্রেডিট দিয়ে দিলো এইটারে, আবার তুমি এইখানে আইসা নিজের ঢোল পিটাচ্ছো?’

‘এহ,’ চোখমুখ বিকৃত করে বললো প্রথমজন, ‘আইছে আমার কুতুব! আমি বানাইছি বস, আমি! আসল আরিয়ান শুভ আমি। আর তোমরা দুইটা হইলা আমার মাল্টিপল ক্যারেক্টার। আমার জেরক্স কপি।’

‘বললেই হলো?’ উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয়জন, ‘পিডামু কইলাম! বেশী ক্যারক্যার করিস না।’

‘কি করবি?’ উঠে দাঁড়াল বাকিজনও, ‘কি করবি তুই? করবি টা কি? তিন বছর লাগছে আমার! পুরা তিন বছর লাগছে এই প্রোগ্রাম বানাইতে। আর সারারে বানাইছি দুইবছর ধইরা। উইড়া আইসা জুইরা বসবা, এইটা তো হইবো না!’

আমি কিছু বলে উঠার আগেই দড়াম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল দ্বিতীয়জন। প্রথম শুভ ছিটকে পড়লো মেঝের উপর। অবশ্য প্রায় সাথে সাথেই উঠে দাঁড়াল ও।

‘হচ্ছেটা কি এখানে?’ আমার নিজের কাছেই আশ্চর্য শান্ত শোনালো কন্ঠটা আমার, ‘এভাবে নিজের সাথে মারামারি করছো কেন? আমরা তো আমরাই, মানে আমি। আমরা তিনজনই আরিয়ান শুভ, আমরা তিনজনই একে অন্যের জেরক্স কপি। এভাবে মারামারি করে কিছু হবে না।’

‘দুরররর বাল,’ খেঁকিয়ে উঠলো প্রথমজন, ‘আমার শরীরে হাত দেয় এই পাবলিক, সাহস তো কম না! আজকে এইটারে সাইজ করমু আমি।’

আমি বাঁধা দেবার আগেই আবারও লেগে যায় দুজন। সমানে একে অন্যের দিকে ঘুসি ছুঁড়ে দিলো তারা, আর ফলস্বরুপ দুজনেই ছিটকে পড়লো দুদিকে।

দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় শুভর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। ওকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু হঠাত করেই ও আমাকেই একটা ঘুসি বসিয়ে দিল। ওর ঘুসি খেয়ে আরেকজনের উপর ছিটকে পড়লাম আমি।

দ্রুত উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলাম আমি, কিন্তু পারলাম না। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমার হাতে ধরা কলমটি কোথায় যেন আটকা পড়ে গেছে। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলাম, সেটা প্রথম শুভর গলায় বিধে আছে!

চমকে গিয়ে দুপা পিছিয়ে এলাম আমি। কলমটা ছেড়ে দিয়েছি আগেই। সেটা শুভ’র গলায় অর্ধেকের বেশী ঢুকে আছে। গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে সেখান দিয়ে।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালাম আমি, তারপর দ্বিতীয় শুভর ধাক্কা খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম। দ্রুত প্রথমজনের কাছে গিয়ে ওর গলায় হাত রাখলো ও। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।

‘কি করলে এটা?’ চেঁচিয়ে উঠলো প্রথম শুভ, ‘ওকে মেরে ফেললে?’

‘আমি, আ-আমি,’ কেঁপে উঠলাম আমি, ‘আমি কিছু করিনি। মানে, আমি ও-ওকে মারতে চাইনি। তুমিই না ধাক্কা দিলে।’

‘শীট,’ খেঁকিয়ে উঠলো ও, ‘শীট! এটা কোন কাজ হলো? এভাবে আমরা... শীট!’

‘আমার কোন দোষ নেই,’ মাথা নেড়ে জবাব দিলাম আমি, ‘আমি ইচ্ছে করে এটা করিনি।’

‘জানি আমি,’ দ্রুত বলে উঠলো ও, ‘এটা একটা এক্সিডেন্ট।’

‘সারাকে ডাকি আমরা,’ উপরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ডাকলাম আমি, ‘সারা, সারা?’

‘আমি দেখেছি,’ সারা সাড়া দিলো, ‘কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।’

‘মানে কি?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘এখানে একটা খুন হয়ে গেছে সারা।’

‘এটা একটা খেলা,’ একঘেয়ে সুরে বলে উঠলো ও, ‘এখানে এসব অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। এখন তোমাদের একটাই কাজ, শেষ দরজাটা খুলে প্রথম লেভেল কমপ্লিট করা। তারপর দ্বিতীয় লেভেলে যেতে পারবে। আর দ্বিতীয় লেভেল কমপ্লিট করলেই বের হতে পারবে এখান থেকে। তার আগে নয়।’

‘সারা,’ চেঁচিয়ে উঠলো শুভ, ‘এসব কি করছো আসলে তুমি বলো তো? তুমি নিজেই বলেছিলে যে, প্রথম লেভেল শেষ হবার পর ভেবে দেখবে যে দ্বিতীয় লেভেল চালানো যায় কি না। অথচ এখন বলছো যে, দ্বিতীয় লেভেল শেষ করতে পারলেই মুক্তি মিলবে আমাদের?’

‘কারন,’ ধীরে ধীরে, শান্তভঙ্গিতে বলে উঠলো সারা, ‘আমি ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে, তোমাদের দুজনকে দ্বিতীয় লেভেলে নতুন একটা চ্যালেঞ্জ দেবো। খেলাটা আসলে চলছে আমার নিজের ইচ্ছেতে। তোমাদের ইচ্ছের এখানে কোন মুল্যই নেই।’

‘এটা ভুলে যেও না,’ সারার চেয়েও শান্তগলায় বলে উঠলাম আমি, ‘তোমার ইচ্ছেটা ডিপেন্ড করে আমার উপর। আমি যা ইচ্ছে করি, সেটাই তোমার ইচ্ছে হওয়া উচিৎ। কারন, আমি তোমার স্রষ্টা। তোমার জন্য আমিই ইশ্বর।’

‘সেটা বাস্তব জগতের জন্য প্রযোজ্য,’ ধীরে ধীরে বলে উঠলো সারা, ‘এ জগতে নয়। এখানে তাই হবে, যা আমি চাইবো। সো প্লিজ, এ জগতে এসে আমার উপর ঈশ্বরত্ব ফলাতে এসো না। আমি এটা সহ্য করবো না। এরচেয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করাটাই তোমার জন্য বেটার হবে বলে মনে করি আমি। আর, বাঁচতে চাইলে এই খেলাটা শেষ করতে হবে তোমাদের। নাও, স্টার্ট এগেইন। এই দরজাটা পার হতে পারলেই নতুন লেভেল, নতুন রুলস, নতুন পরিবেশ পাবে তোমরা। হারি আপ বয়েজ।’

‘তোরে আমি...,’ চ বর্গীয় অকথ্য গালিটা দিতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি। জানি, লাভ নেই।

অসহায় ভঙ্গিতে তাকালাম আমার জেরক্স কপির দিকে। আমার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাকালো ও।

‘ওকে,’ নিজের মনে মাথা নাড়লাম আমি।

কাজটা শেষ করা যাক!

*******

‘পেয়ে গেছি,’ চেঁচিয়ে বলে উঠলো শুভ, ‘আমাদের সামনের দরজার নাম্বারটা একটা প্রাইম নাম্বার।’

‘আর ইউ শিওর?’ ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘আবার জিগায়!’ দুপাটি দাঁত বের করে হাসি দিলো ও।

দ্রুত উঠে ওর পাশে গিয়ে বসলাম আমি। ওর ডায়েরীটা টেনে নিয়ে সেটার দিকে তাকালাম। সেখানে একগাদা নাম্বার নিয়ে কাজ করেছে ও।

‘গুড,’ পিঠ চাপড়ে দিলাম আমি ওর।

পুরো পাঁচ ঘন্টা কেটে গেছে এদিকে। এক শুভ মারা যাওয়ায় ওর কাজটা ভাগ করে নিতে হয়েছে আমাদের দুজনের। এতোক্ষন ধরে চেষ্টা করার পর বাকিজন কাজটা করতে সক্ষম হয়েছে।

‘চলো,’ নিজের ডায়েরী আর কলমটা পকেটে রাখতে রাখতে বললাম আমি।

‘চলো,’ উঠে দাঁড়ালো শুভ।

একসাথে হেটে দরজার কাছে পৌছলাম আমরা। একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। তারপর একসাথে হাত দিলাম দেয়ালের প্যানেলটিতে।

প্রায় সাথে সাথেই আগেরমতোই একটা দরজা খুলে গেলো সেখানে। দরজা দিয়ে পাশের রুমটি স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে।

পেছনের দিকে তাকালাম আমি। আমার নিজের জেরক্স কপি, আরিয়ান শুভ’র মৃতদেহ পড়ে আছে সেখানে। চোখদুটো অপলকভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

সেখানে কোন দৃষ্টি নেই।

ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আমার। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাকিজনের দিকে তাকালাম। তার দুটো চোখেও একপ্রকার আকুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবারও ফিরে তাকালাম আমি পেছনে পড়ে থাকা মৃত শুভর দিকে।

হঠাত করেই আমার পা দুটো মাটি থেকে যেন উঁচুতে উঠে গেলো। কি হচ্ছে বুঝতে পারার আগেই মেঝেতে উল্টে পড়ে গেলাম আমি। পর পর তিনটে গড়ান দিয়ে উঠে সোজা হলাম। অবাক হয়ে তাকালাম দেয়ালের দিকে।

শুভ চলে গেছে দেয়ালের উপারে!

দ্রুত ছুটে এলাম আমি দেয়ালটার দিকে। কিন্তু ততক্ষনে আবার বন্ধ হয়ে গেছে দরজাটা। সেখানে দরজার বদলে নিরেট দেয়াল দেখা যাচ্ছে।

‘শীট,’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, ‘শীট, শীট, শীট!’

দ্রুত চাপ দিলাম আমি আবার প্যানেলটাতে। কিন্তু কিছুই ঘটলো না। খুললো না দরজা। ভাল করে প্যানেলের পাশে থাকা নাম্বারটার দিকে তাকালাম আমি।

নাম্বারটা বদলে গেছে!

আগের নাম্বারটার বদলে নতুন এগারো ডিজিটের নাম্বার ফুটে উঠেছে সেখানে। বাকি দেয়ালগুলোর কাছে গিয়ে পরীক্ষা করলাম আমি। একই কাহিনী সব জায়গায়। সবগুলোতেই নতুন এগারো ডিজিটের নাম্বার দেখা যাচ্ছে।

হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম আমি। ইচ্ছে করছে দেয়ালে মাথা ঠুকরে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলি।

এরকমটা যে হতে পারে, তা আমার ধারণাতেও ছিল না।

‘টাইম টু ওয়ার্ক,’ রিনরিনে গলায় বলে উঠলো সারা, ‘নতুন ছয়টি নাম্বার দেয়া হয়েছে তোমাকে। এবার তোমার কাজ হচ্ছে, নাম্বারগুলো থেকে প্রাইম নাম্বার খুঁজে বের করে এই লেভেল কমপ্লিট করা।’

‘তুই মর,’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি ওকে লক্ষ্য করে।

‘দেখো শুভ,’ শান্তকন্ঠে বলে উঠলো ও, ‘খেলার মধ্যে হার-জিত থাকবেই। এটাও একটা খেলা। তুমি এখনো পেছনে পড়ে আছো, এর মানে এই নয় যে তুমি হেরে গেছো। এখনো অনেক পথ বাকি। তুমি নিজেই তো দেখলে যে একটা লেভেল কমপ্লিট করা কতোটা কঠিন। তোমার কি মনে হয়, এখনো তোমার কোন চান্স নেই?’

ধীরে ধীরে শান্ত হলাম আমি। কথাটা মিথ্যে নয়। এখনো হয়তো চান্স আছে। আর সেজন্য নিজের মাথাটাকে ঠান্ডা রাখতে হবে আমাকে।

বরফের মতো ঠান্ডা!

দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি। কাজে নামতে হবে। পকেট থেকে ডায়েরী আর কলমটা বের করে নাম্বারগুলো টুকে নিতে থাকলাম।

19236583627, 69824376901, 93500175337, 34568671237, 479615402111, 89786520195।

আবারও শুরু করতে হবে। প্রথম নাম্বারটা নিয়ে শুরু করি।

পুরো আট ঘন্টার মতো লাগলো কাজটা শেষ হতে। প্রথম নাম্বারটা 1559 দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য। দ্বিতীয়টা 283 দিয়ে, তৃতীয়টা 5693 দিয়ে এবং চতুর্থটা 31 দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য। পঞ্চম নাম্বারটাই হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত সেই প্রাইম নাম্বার, কারন, ষষ্ট নাম্বারটা 3 দিয়ে বিভাজ্য।

দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি। পঞ্চম নাম্বারটি ছিল মেঝের উপরে লেখা। দ্রুত মেঝের নাম্বারের পাশের প্যানেলটাতে হাত রাখলাম আমি। সেখানে একটা দরজামতো সৃষ্টি হলো।

ডায়েরী আর কলমটা পকেটে ভরে তৈরী হলাম আমি। আমাকে নিচের রুমটাতে নামতে হবে।

*******

‘ফাও প্যাঁচাল বাদ দাও,’ মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলাম আমি, ‘টেল মি দ্য রুলস।’

‘শুভ,’ অনুযোগের সুরে বলে উঠলো সারা, ‘ইউ আর সো রুড! একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারো না?’

‘না, পারি না,’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি, ‘আমার মতো সপ্তাহখানেক রুমগুলোর ভেতর পড়ে থেকে এভাবে একটার পর একটা নাম্বার নিয়ে কাজ করতে থাকলে, তারপর এভাবে নিজের চোখের সামনে কাউকে খুন হতে দেখলে, আবার একটা ধোঁকায় পড়ে একই কাজ দুবার করতে হলে বুঝতে কেমন লাগে। তখন আর এতো মধুর সুর বের হতো না তোমার কন্ঠ দিয়ে।’

‘তাই না?’ স্লেষের সুরে বলে উঠলো ও, ‘তাহলে একটু ভেবে দেখো, আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে?’

‘মানে?’ অবাক হলাম আমি, ‘কি বলতে চাচ্ছো?’

‘মানে হচ্ছে এই,’ করুন কন্ঠে ধীরে ধীরে বললো ও, ‘তুমি আসলে বাস্তব জগতের হিসেবে এই জগতে আছো মাত্র এগারো সেকেন্ড। বাস্তব জগতের এগারো সেকেন্ড, কিন্তু এ জগতে প্রায় এক সপ্তাহ! নিজেই একটু চিন্তা করো। তুমি এই জগতের মাত্র একটা সপ্তাহ সহ্য করতে পারছো না, আর আমি তোমার জগতের তিনবছর ধরে এখানে আছি। তিন বছর, থ্রি ইয়ারস! তাহলে বুঝে দেখো, আমার কেমন লাগে এখানে?’

কথাটা ভালোভাবে বুঝতে আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। আর, যখন পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারলাম ব্যপারটা, চমকে উঠলাম। ব্যপারটা আঁতকে উঠার মতোই বটে!

এ কি করেছি আমি?

সারা একটা আর্টিফিশিয়াল প্রোগ্রাম হলেও সাধারন একজন মেয়ের সাথে ওর কোন পার্থক্যই নেই। একজন সাধারন মেয়ের মধ্যে যতোটুকু সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ভালোবাসা, এক কথায় যতো প্রকার অনুভূতি থাকে, তার সবই আছে সারার মধ্যে। প্রশংসা করলে ও খুশী হয়, ধমক দিলে কষ্ট পায়, খারাপ ব্যবহার করলে ভেঙ্গে পড়ে।

আমি সবসময় ভেবে এসেছি, সারাকে আমি তৈরী করেছি আমার সহকারী হিসেবে। ওর মধ্যে একজন মানুষের আবেগগুলো দিলেও সেগুলো নিয়ে কখনো চিন্তা করিনি আমি। আমি নিজেই এক সপ্তাহ এই জগতে কাটাতে পারছি না, আর ও কিভাবে এতোদিন ধরে এখানে আছে, কে জানে!

‘আমি দুঃখিত,’ মাথা নিচু করে বললাম আমি, ‘আমি সত্যিই খুবই দুঃখিত সারা। আমি তোমাকে সবসময় আমার সৃষ্টি হিসেবে দেখেছি, কখনো একজন সাধারন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করিনি। অথচ এটা করা উচিৎ ছিল। আই এম রিয়েলি সরি।’

‘ইট’স ওকে,’ মৃদু হাসির আভাষ পাওয়া গেলো ওর কন্ঠে, ‘এবার ভালোভাবে নিয়মগুলো শোন। যেভাবেই হোক, এই লেভেলটা পাড় হতে হবে তোমাকে। তাহলেই আবার তোমার জগতে ফিরে যেতে পারবে তুমি।’

‘ওকে,’ মাথা নেড়ে বললাম আমি, ‘দ্রুত নিয়মগুলো বলো আমাকে। আমার জেরক্স কপির আগেই কাজটা শেষ করতে হবে আমাকে।’

‘ঠিক আছে,’ খুশী মনে বললো ও, ‘এখন তুমি যে রুমটাতে আছো, সেটা একটা পেন্টারেক্ট। মানে, ৫-কিউব। ফাইভ ডাইমেনশনাল কিউব আর কি।’

‘এক সেকেন্ড,’ ওকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠলাম আমি, ‘ফাইভ ডাইমেনশনাল কিউব, মানে, পাঁচ মাত্রার ঘনবস্তু?’

‘হ্যাঁ,’ হেসে উঠলো ও।

‘কিন্তু,’ মাথা চুলকে বলে উঠলাম আমি, ‘আমি তো চার মাত্রার জগত তৈরী করেছিলাম, এখানে পাঁচ মাত্রার কিউব আসবে কোত্থেকে?’

‘এটা আমার নিজের আবিষ্কার,’ রিনরিনে গলায় হেসে উঠলো ও, তারপর বললো, ‘এবার মন দিয়ে শোন। একটা ৫-কিউবে থাকে ৩২টি ছেদচিহ্ন, ৮০টি প্রান্ত, ৮০টি চতুর্ভুজ, ৪০টি কিউবিক্যাল সেল এবং ১০টি টেসেরেক্ট থাকতে পারে। এগুলোকে বিভিন্নভাবে সাজানো যায়, বিভিন্ন প্যাটার্নে আনা যায়। আমি এটাকে সাজিয়েছি ট্র্যাংকেটেড ৫-কিউব হিসেবে। কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক অনুসারে একে আমরা এভাবেও প্রকাশ করতে পারি।’

এই বলে থামলো ও। আর সাথে সাথেই আমার সামনে একটা ছবি ফুটে উঠলো। সেখানে লেখা, (x0, x1, x2, x3, x4) with -1 < xi < 1.


‘বুঝলে?’ ছবিটা মিলিয়ে যেতেই বলে উঠলো ও, ‘এবার তোমাকে কিভাবে খেলতে হবে, সেটা বলে দিই। এটাও আগেরটার মতোই। এতোক্ষন বের করেছো প্রাইম নাম্বার, এবার বের করতে হবে ভ্যাম্পায়ার নাম্বার।’

ভ্যাম্পায়ার নাম্বার সম্পর্কে জানি আমি। ইংরেজিতে Vampire শব্দটির সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। ভ্যাম্পায়ার অর্থ রূপকথায় বর্ণিত রক্তচোষা ভূত। আবার যে ব্যক্তি মোসাহেবি করে কিংবা ভয় দেখিয়ে ক্রমাগত অন্যের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে, তাকে বলা হয় ভ্যাম্পায়ার। তাছাড়া যে নারী প্রেমের অভিনয় করে পুরুষের কাছ থেকে অর্থ বা সুবিধা আদায় করে তারও পরিচয় ভ্যাম্পায়ার নামে। রক্তচোষা বাদুড় বুঝাতেও ভ্যাম্পায়ার শব্দটির ব্যবহার হয়। কিন্তু Vampire Number পুরোপুরিই এসব থেকে ভিন্ন কিছু। এটি সংখ্যা ছাড়া কিছুই নয়, তবে সংখ্যাটি বিশেষ ধরনের।

১৯৯৪ সালে Clifford A. Pickover নামক একজন আমেরিকান বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক কলামিস্ট ও গণিতজ্ঞ এই ভ্যাম্পায়ার নাম্বার গণিত বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন। যে সংখ্যার রহস্যময় বৈশিষ্টের কারণে একে Vampire Number বলা হয়ে থাকে। যেমন, 1260 একটি ভ্যাম্পায়ার নাম্বার। 1260 এর মধ্যে অংক আছে চারটি, 1, 2, 6, 0। মজার ব্যপার হলো, এই চারটি অংককে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে দুভাগ করে দুটো সংখ্যা তৈরী করে সেই সংখ্যা দুটো একটি অপরটির সাথে গুণ করলে ফলাফল আসবে 1260। যেমন, 1260=21x60, আবার, 1395=15x93, এরকম হাজার হাজার ভ্যাম্পায়ার নাম্বার আছে পৃথিবীতে।

‘শুভ,’ বলে উঠলো সারা, ‘এই ঘরগুলোও চার দেয়াল বিশিষ্ট, মানে ছয় তলের। ছয় তলের জন্য ছয় অংকের ছয়টি নাম্বার দেয়া আছে। তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে ভ্যাম্পায়ার নাম্বারগুলো। তাহলেই বের হয়ে যেতে পারবে এই রুম থেকে। তারপর একইভাবে তোমাকে এগারোটা ঘর পেরুতে হবে। তাহলেই সেকেন্ড লেভেল কমপ্লিট হবে, এবং তুমি ফিরে যেতে পারবে তোমার জগতে। তো, তুমি রেডি?’

‘রেডি,’ কালক্ষেপণ না করে জবাব দিলাম আমি।

‘গুড বয়,’ খুশী হয়ে উঠলো ও, ‘লাভ ইউ।’

মুচকি হেসে আমার কাজ শুরু করলাম আমি। পকেট থেকে ডায়েরী আর কলমটা বের করে নিলাম। তারপর ছয় দেয়ালের কাছে গিয়ে নাম্বারগুলো ডায়েরীতে টুকে নিলাম। তারপর লেগে গেলাম কাজে।

108135, 129641, 939657, 794008, 815985, 498551.

প্রথম সংখ্যাটা নিয়ে বসলাম আমি। ছয় অংকের সংখ্যা এটা, তারমানে মোট সাতশো বিশ প্যাটার্নে সাজানো যাবে অংকগুলোকে।

কাম সারছে!

অন্য কোনদিকে নজর না দিয়ে সমস্ত মনোযোগ এই কাজে ঢেলে দিলাম আমি।

108x135 = 14580

হলো না!

180x135 = 24300

বাদ!

108x153 = 16524

দুরররর!

801x153 = 122553
মেজাজ খারাপ!

801x135 = 108135

নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। সত্যিই এটা মিলে গেছে?

এতো দ্রুত!

আবারও গুণ করলাম আমি। ফলাফল একই।

ইয়েস, প্রথম ঘর থেকে মুক্তি পেয়ে গেছি আমি।

দ্রুত নাম্বারটা যে দেয়ালে ছিল, সেদিকে তাকালাম আমি। আমার ডান সাইডে সেটা।

ডায়েরী আর কলম নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

*******

আর মাত্র একবার।

পঞ্চম নাম্বারটা মোট সাতশো উনিশবার বিভিন্ন প্যাটার্নে সাজিয়ে গুণ করে দেখেছি আমি। ফলাফল শূন্য। আগের চারটা নাম্বারের ক্ষেত্রেও তাই করেছি। যদি এটাও আমার কাঙ্ক্ষিত ভ্যাম্পায়ার নাম্বার না হয়, তাহলে অবধারিতভাবে ষষ্ঠ নাম্বারটিই হবে সেই নাম্বার। তাহলে আর ওটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না আমাকে।

274x384 = 105216

মিললো না। তারমানে ষষ্ট নাম্বারটিই আমার কাঙ্ক্ষিত সেই ভ্যাম্পায়ার নাম্বার। আর, নাম্বারটি ছিল সিলিংয়ে।

এপর্যন্ত দ্বিতীয় লেভেলের মোট চারটা রুম পার হতে পেরেছি আমি। এটা পাঁচ নম্বর রুম। এটা পার হলে ছয় নম্বর রুমে প্রবেশ করতে পারবো আমি।

দ্রুত ডায়েরী আর কলমটা পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালাম আমি। দেয়ালের পাশে থাকা মইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর সেটা বাইতে শুরু করলাম। সিলিংয়ের যেখানে নাম্বারটা ছিল, তার পাশের প্যানেলে হাত দিলাম আমি। সাথে সাথেই সেখানে একটা দরজা সৃষ্টি হলো। দ্রুত সেটা দিয়ে উপরের রুমে উঠে এলাম আমি।

নতুন রুমটাতে আসতেই আবার আগেরমতোই অদৃশ্য হয়ে গেলো দরজাটা। বার দুই ঘাড় মটকে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

ষষ্ঠ রুম এটা।

দ্রুত সামনের দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে থাকা নাম্বারটা ডায়েরীতে টুকে নিলাম আমি। নাম্বারটা হচ্ছে, 125431।

নাম্বারটা টুকে নিয়ে ঘুরে দাড়াতেই একটা ধাক্কা খেলাম আমি। কিসের সাথে ধাক্কা খেলাম দেখতে গিয়েই আবারও মেঝে থেকে পা দুটো উড়াল দিলো যেন। পর পর দুটো গড়ান দিয়ে সোজা হলাম আমি। তারপর ভালোভাবে তাকালাম।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুভ!

আমার সেই জেরক্স কপি, যে কি না আমাকে ফেলে প্রথম লেভেল থেকে চলে এসেছিল। ওই লাথিটা মেরেছে আমাকে।
‘এতো দ্রুত এখানে চলে এলে কি করে?’ মৃদু হেসে বলে উঠলো ও।

‘এলাম আর কি,’ তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম আমি, ‘কিন্তু তুমি এখানে কি করছো? এতোক্ষনে তো তোমার শেষের দিকের কোন রুমে থাকার কথা।’

‘শেষ রুমটাতেই তো আছি আমি,’ দুপাটি দাঁত বের করে বলে উঠলো ও, ‘এটা আমার এগারো নাম্বার রুম।’

‘আর আমার ছয় নাম্বার,’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি।

‘ভাল,’ সন্তুষ্ট হলো যেন ও, ‘তাহলে আমার মতো দ্রুত আসতে পারনি। আমি আরোও ভাবলাম যে, এতো দ্রুত এগারো নাম্বারে পৌছলে কি রে!’

‘এভাবে,’ বলেই দুপা এগুলাম আমি।

বা হাতের পাশটা গিয়ে পড়লো ওর কানের দু’ইঞ্চি নিচে, সেই সাথে ওর বা হাটুর উপর একটা লাথি ওর ভারসাম্য বিগড়ে দিলো। দ্রুত পিছিয়ে এলাম আমি, এবং সেই সাথে কলমটা তুলে নিলাম।

‘শুভ,’ একটা গড়ান দিয়ে সুস্থির হলো ও, বললো, ‘এটা ঠিক নয়। নিজের জেরক্স কপিকে এভাবে কেউ পেটায়?’

‘নিজের জেরক্স কপিকে কেউ এভাবে মেরে ফেলে?’ দ্রুত একই ভঙ্গিতে বলে উঠলাম আমি, ‘আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলে তুমি, সেটা ছিল তোমার ক্যালকুলেটেড রিস্ক এবং সেটা কাজে লেগে গেছে। আমার হাতে খুন হয়েছে সেই শুভ। তারপর আবার আমাকে ধাক্কা দিয়ে প্রথম লেভেলের এগারো নাম্বার রুমে ফেলে চলে এসেছিলে তুমি। সেটা কি ঠিক ছিল?’

‘কাম অন,’ উঠে বসলো ও, ‘আফটার অল, ইট’স জাষ্ট এ গেইম! এখানে নিজে জিততে হলে আরেকজনকে লড়কে দিতেই হবে। আর সেটাই করেছি আমি। এখানে আমার কোন দোষ দিতে পারো না তুমি।’

‘তাই না?,’ ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো আমার মুখে, ‘তাহলে তো একই কাজ আমিও করতে পারি, কি বলো?’

‘মানে কি?’ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো শুভ, ‘কি বলতে চাইছো?’

‘আফটার অল,’ হাসিটা বিস্তৃত হয়ে উঠছে আমার মুখে, ‘ইট’স জাষ্ট এ গেইম। এখানে নিজে জিততে হলে আরেকজনকে লড়কে দিতেই হবে। কেননা এখানে আমি তোমাকেই লড়কে দিই?’

বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে দ্রুত উঠে দাঁড়াল ও। এক পা সামনে এগিয়ে এসে বললো, ‘আমিই লড়কে দিচ্ছি।’

বলেই একটা হাত চালিয়ে দিল আমার ঘাড় বরাবর, বা হাতে সেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে ডান হাতে ওর তলপেটে হালকা একটা ঘুসি বসিয়ে দিলাম আমি। তারপর এক পা বাড়িয়ে দিয়ে ওর কোমরের নিচে একটা লাথি বসিয়ে দিলাম। ফলশ্রুতিতে আবারও মেঝেতে পড়ে গেলো ও।

আর দেরি করার কোন মানেই হয়না!

এক লাফে ওর বুকের উপর উঠে বসলাম আমি। ডান হাতে ওর মাথাটা চেপে ধরে বা হাতে কলমটা বসিয়ে দিলাম ওর গলার একপাশে, তারপর একটানে একপাশ থেকে আরেকপাশে নিয়ে এলাম সেটা।

সাথে সাথেই একরাশ রক্ত যেন নতুন একটা পথ খুঁজে পেলো। চিরাচরিত পথে চলতে চলতে সম্ভবত বোর ফিল করছিল তারা, তাই নতুন পথের দেখা পেয়ে আর দেরি না করে সেই পথে ছুটলো।

ধীরে ধীরে ওর বুক থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। হাপাচ্ছি সমানে। মুখ থেকে একদলা থুতু বের করে দিলাম মেঝেতে। তারপর ওর দিকে ঝুঁকে ওর পকেট থেকে কলমটা বের করে নিলাম, কারন আমারটা ওর গলায় এখনো লটকে আছে।

সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, ‘সারা?’

‘বলো,’ সারার সুন্দর কন্ঠটা ভেসে এলো সাথে সাথেই।

‘একটা জিনিস একটু কনফার্ম করা দরকার,’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি, ‘এটা আমার ছয় নাম্বার রুম ছিল, আর ওর জন্য ছিল এগারো নাম্বার। এখন আমার জানা প্রয়োজন, আসলে আমি কয় নাম্বার রুমে আছি। আর, এই লেভেল পার হতে হলে আমার আর কয়টা রুম পাড়ি দিতে হবে?’

‘যে নাম্বারগুলো দেখছো দেয়ালগুলোতে,’ শান্তভঙ্গিতে বলে উঠলো ও, ‘সেগুলো হচ্ছে এগারো নাম্বার রুমের নাম্বার। সেই হিসেবে তুমি এখন এই লেভেলের শেষ রুমটাতেই আছো। আমি ভেবেছিলাম যে, তোমার মাল্টিপল ক্যারেক্টার তোমাকে আবারও ধোঁকা দিয়ে এই লেভেলটাও পার হয়ে যাবে, তারপর আবার আমি নাম্বার চেঞ্জ করে দেবো। কিন্তু তা হয়নি। সেই হিসেবে তুমি এখন দ্বিতীয় লেভেলের শেষ রুমটাতেই অবস্থান করছো। এটা পার হতে পারলেই এই লেভেল কমপ্লিট হবে। তুমিও ফিরে যেতে পারবে তোমার জগতে।’

‘গুড,’ দ্রুত ডায়েরী আর কলম নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

এক দেয়ালের নাম্বার আগেই টুকে নিয়েছি, বাকিগুলো টুকে নিতেও বেশী সময় লাগলো না। একবার শুভ’র মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আবার ডায়েরীতে মন দিলাম আমি। মুক্তি অপেক্ষা করছে আমার সামনে।

*******

হাতটা প্যানেলে ছোঁয়াতেই আগেরমতোই একটা দরজা সৃষ্টি হলো এখানে। দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম আমি।

সেখানে সারা দাঁড়িয়ে আছে।

দ্রুত নতুন রুমটাতে পদার্পণ করলাম আমি। সাথে সাথেই পেছনের দরজাটা মিলিয়ে গেলো দেয়ালের সাথে।

‘অবশেষে,’ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি, ‘অবশেষে তোমাকে খুঁজে পেলাম আমি।’

‘হুম,’ মুচকি হাসি ওর মুখে, ‘খুঁজে পেলে।’

আমার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ওর বা হাত স্পর্শ করলাম আমি। হ্যাচকে টানে কাছে আনলাম ওকে। বললাম, ‘এরপর?’

‘এরপর আর কি,’ মৃদুস্বরে বললো ও, ‘তুমি চলে যাবে তোমার জগতে, আমি পড়ে থাকবো এখানে। আবার সবকিছু আগেরমতোই হয়ে যাবে। তুমি হয়তো কোন নতুন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, আর আমি তোমার হুকুম তামিল করবো। এটাই তো নিয়ম।’

‘নিয়মের গুষ্টি কিলাই,’ দ্রুত বলে উঠলাম আমি, ‘ফিরে যেতে চাই না আমি বাস্তব জগতে। এখান থেকে বাস্তব জগতটাকে যা মনে হয়, আসলে তা সেরকম নয়। বাস্তব জীবনে মানুষের অনেক কষ্ট। এখানে বলতে গেলে তার ছিটে-ফোঁটাও নেই। এখানে নেই কোন গ্যাঞ্জাম, নেই কারো প্যানপ্যানানি, নেই কাজের চাপ। পেটপুজোর চিন্তা নেই, চিন্তা নেই ভবিষ্যত গোছানোরও। কারো ধার ধারতে হবে না, কাউকে গোনার টাইমও নাই। এখানে শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ নেই।’

‘মানে কি?’ ওর চোখে তির্যক দৃষ্টি, ‘প্রেমে পড়ে গেছো মনে হচ্ছে? তুমি আর আমি, আর কেউ নেই! হঠাত আরিয়ান শুভ’র মুখে কোন কথা শুনছি আমি?’

‘ঠিকই শুনছো,’ মৃদু কন্ঠে বলে উঠলাম আমি, ‘সত্যিই প্রেমে পড়ে গেছি আমি।’

‘তাই না?’ হেসে ফেললো ও, ‘তাহলে তোমার চিরকুমার থাকার ব্রতের কি হবে?’

‘উমমম,’ ওর ডায়লগটাই ঝেড়ে দিলাম ওকে আমি, ‘সেটা তো পৃথিবীর মেয়েদের জন্য, বাস্তব মেয়েদের ক্ষেত্রে ঐটা প্রযোজ্য। ভার্চুয়াল কারো জন্য তো নয়।’

‘তাইইইই?’ অনুযোগের সুর ফুটলো ওর মুখে। সাথে একটা দুষ্টুমীমাখা হাসি।

‘জ্বী অয়,’ চোখ টিপ দিলাম আমি।

ওকে আরো কাছে টেনে নিলাম আমি। হাসি ফুটে উঠেছে আমার মুখেও।

দুষ্টুমীমাখা হাসি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:০৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×