somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রক্তমণি‬

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(খৃষ্টপূর্ব নয়শো একানব্বই অব্দ)

হাটছি আমরা। হাটছি পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর দিয়ে। আমি এবং যুবরাজ শুহাংশু, দুজন মিলে প্রায় একটা অসাধ্য সাধন করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছি।
চারদিকে শুভ্র তুষারের ছড়াছড়ি, আকাশটাও এখানে শুভ্র বর্ণ ধারন করেছে। তার মাঝ দিয়ে চলছি আমরা দুজন। মাঝে মাঝে দূর আকাশের বুকে দু'একটা পাখি চক্কর কাটছে।
দুজনের মাঝে কোন কথা হচ্ছে না। শুধু ইশারাই যথেষ্ঠ আপাতত। পিঠের বোঝাটা একটু ভারী হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে কথা বলে শক্তিক্ষয় করার কোন মানে হয় না। শক্তিটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে আমার লক্ষ্য অর্জন করা হবে না কোনদিনও।
হ্যাঁ, এগিয়ে যেতে হবে, আরো বহুদুর। যেতে হবে শুভ্র মানুষের দেশে। রক্তমণির সন্ধানে।
ক্রিতদেবের কথাগুলো কানে ভাসছে আমার, “রক্তমণি লাগবে। গাঢ় লাল রঙের জমাট বাঁধা স্ফটিক, যেটা পাবে তৈমুর পর্বতের নিঞ্চল গুহায়। দেবী প্রাচী এতোদিন ধরে যেটা পাহারা দিয়ে রেখেছেন।”
আরো দ্রুত এগুতে হবে আমাদের। আজ রাতে চন্দ্রদেবী পাহারায় আসবেন না। সূর্যদেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে আঁধারপুরীতে যাবেন। এটাই আমার সুযোগ। একমাত্র সুযোগ।
আজ রাতের মধ্যেই রক্তমণিটা হস্তগত করতে হবে আমাকে!

*******
আমাদের রাজ্যের নাম নহৃংশুদাবাদ। এই রাজ্যের রাজা শুধাংশু গৌড়। মহামান্য শুধাংশু গৌড়কে দেখে এখন কেই বা বলবে, এক সময় এই পক্বকেশ বৃদ্ধ কতোটা সাহসী আর বীর ছিলেন! অথচ এক সময় তার নাম শুনে পাশের রাজ্যগুলোর বড় বড় বীরদেরও বুকে কাঁপন উঠতো।
তারই ছেলে শুহাংশু গৌড় আমার ছোটবেলার বন্ধু। ঠিক কবে, কখন, কিভাবে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল, সেটা আজ আমার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, অনেক ছোটবেলা থেকেই আমরা একে অন্যের সাথে আছি। একই সাথে ঘোড়ায় চড়া শিখেছি, একই সাথে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করেছি, সেই সাথে নিজেদের মনের মতো করে শিকারে বেড়িয়েছি। কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন।
সেদিন হঠাত করে মহামন্ত্রী তলব করাতে আমাকে ছুটতে হয়েছিল রাজপ্রাসাদের একেবারে পেছনেরদিকে। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, হয়তো কোন দোষ খুঁজে পেয়েছেন রাজামশাই কিংবা মহামন্ত্রী, কিন্তু রাজপুত্রের বন্ধু বলে জনসমুখ্যে সেটা প্রকাশ না করে গোপনে ডেকেছেন। কিন্তু সেখানে পৌছে দেখলাম, আমার অনুমান ভুল।
সেখানে মহামন্ত্রীর সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন খোদ রাজপুত্র শুহাংশু। এ দুজন ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না। রাজপুত্রকে দেখে আমার দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। অন্তত রাজপুত্র থাকতে কোন ভয় নেই আমার।
“এসো শুভঙ্কর,” উনাদের কাছে পৌছতেই মহামন্ত্রী বলে উঠলেন, “এদিকে, এইখানটায় বসো।”
মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখালাম। তারপর উনাদের পাশে রাখা গাছের গুড়ির উপর বসলাম।
“হঠাত করে রাজপুরীর এখানে আমাকে তলব করলেন?” যথাযোগ্য সম্মানের সাথে বলে উঠলাম, “বিষয়টা কি মহামন্ত্রী?”
উত্তরটা এলো যুবরাজের পক্ষ থেকে, “সেনাপতি হতে চাও?”
“মানে?” যুবরাজের কথায় থমকে গেলাম, মুখে কথা রুচতে কিছুটা সময় লাগলো, “কি বলছেন যুবরাজ?”
“মানেটা সহজ,” এবার মহামন্ত্রী বলে উঠলেন, “রাজামশাই ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, তোমাকে তিনি সেনাপতির পদে দেখতে চান। আর কতোদিন সাধারন সৈনিক হয়ে দিন কাটাবে? তোমার বুদ্ধি আছে, সাহস আছে, সবদিক থেকেই তুমি সেনাপতি হবার যোগ্য। আর আমাদের বর্তমান সেনাপতির যোগ্যতা সম্পর্কে তো জানোই। তাই জিজ্ঞেস করছি, সেনাপতি হতে চাও?”
মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলাম। সেনাপতির দায়িত্ব মস্ত দায়িত্ব, সবাইকে দিয়ে এটা সম্ভব হয় না। আর এ দায়িত্ব হেলাফেলার জিনিসও নয়। অনেক বুদ্ধি খাটাতে হয়, অনেক কিছুই বিবেচনায় রাখতে হয়। আমি কি তার যোগ্য?
যুবরাজের দিকে তাকালাম আমি, “আপনার কি মত মহামান্য যুবরাজ?”
“আসলে,” মৃদু হাসছেন যুবরাজ, “এ কথাটা আমিই পিতার কানে প্রথম তুলি। জানোই তো, গত কয়েকটা যুদ্ধে কংনুমরাদের সাথে আমাদের সূচনীয় পরিনতি বরণ করতে হয়েছে। সেটার দায় বর্তমান সেনাপতি এড়িয়ে যেতে পারেন না। আর তাছাড়া, দিন দিন পিতার শরীরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এ রাজ্যের ভালো মন্দ আমাকেই দেখতে হবে। তুমি আমার ছোটবেলার বন্ধু, তোমার চেয়ে শুভাকাংখী আমার আর কে আছে বলো? তোমার মতো বিচক্ষন সৈনিকও খুব একটা দেখা যায় না। তাই আমি পিতার সাথে কথা বলে ঠিক করেছি, তোমাকেই সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হবে। অবশ্য এখানে মহামন্ত্রীও কিছুটা ইন্ধন যুগিয়েছেন আমাকে। তোমার কি মত?”
আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলাম আমি। যেখানে স্বয়ং এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজা আমাকে এ দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন, সেখানে আমার না করা চলে না।
“আপনাদের যা মর্জি,” মাথা ঝুঁকিয়ে আবারো সম্মান প্রদর্শন করলাম আমি।
“তাহলে এটাই ঠিক রইলো,” মহামন্ত্রী বলে উঠলেন, “কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে শুভঙ্কর।”
“কি পরীক্ষা মহামন্ত্রী?” মহামন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
“সেটা তুমি ক্রিতদেবের কাছ থেকেই জানতে পারবে বাছা,” শান্তভঙ্গীতে জবার দিলেন মহামন্ত্রী।
“ক্রিতদেব?” অবাক হলাম আমি, “কিন্তু সে তো শুনেছি বহুবছর ধরে উত্তরের পর্বতে অবস্থান করছেন। তাকে এখন পাবো কোথায়?”
“পাবে, পাবে,” মুচকি হেসে বলে উঠলেন মহামন্ত্রী, “সে এখন এই রাজ্যেই আছে। শুধু এ রাজ্যে নয়, এতোক্ষনে বোধহয় এই প্রাসাদেও পৌছে গেছে। চলো যাই।”
যে পথ ধরে রাজপ্রাসাদের পেছনে এসে পৌছেছিলাম, সেই পথেই আবার হাটতে শুরু করলাম আমরা তিনজন।

*******
“তুমিই তাহলে শুভঙ্কর!” শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো ক্রিতদেব।
গলা শুনে বোঝা যাচ্ছে না আমাকে দেখে খুশী হয়েছে না বেজার। বলতে গেলে একেবারেই নিঃস্পৃহ শোনাচ্ছে তার বলার ভঙ্গি। শুধুমাত্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে। তীক্ষ্ণ দুই চোখ মেলে নিরীক্ষা করছে আমাকে, বুঝতে পারলাম।
কৃতদেবকে দেখে অবাক হইনি আমি। মাথায় জটা, সারা শরীরে একটা মাত্র সাদা কাপড়ে ঢাকা। এক হাতে অচেনা গাছের বাঁকানো ডাল, আরেক হাতে জ্বলজ্বল করছে অচেনা পাথরের তৈরী মালা। শুভ্র দাড়িগুচ্ছ বুকের নিচ পর্যন্ত শোভা পাচ্ছে।
অনেক ছোট থাকতে ক্রিতদেবের নাম শুনেছিলাম। শুধু আমি নই, এ রাজ্যের প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ এই বৃদ্ধ সম্পর্কে জানে। এর বয়েস ঠিক কত, তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। সবাই শুধু এর নামই শুনেছে, কিন্তু দেখেছে খুব কম লোকেই।
লোকমুখে শোনা যায়, ক্রিতদেব অনেক বড় জাদুকর। সে পারে না, এমন কিছুই নেই। সে সর্বজ্ঞ। জগতের হেন বিষয় নেই, যা সম্পর্কে সে অবহিত নয়। সারাটা জীবন ধ্যান আর সাধনা করে কাটিয়ে দিয়েছে সে। দৈবাৎ তার দেখা মেলে রাজ্যে। যখন কোন বিপদের সম্মুখীন হয় রাজ্য, ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন হাজির হয় সে। গত দশ বছরের ভেতর তাকে কেউই দেখেনি।
“বসো,” সামনের একটা গুড়ি দেখিয়ে বললো সে, “কিছু গোপন কথা জানা দরকার তোমার।”
এই বলে নিজের ঝোলার ভেতর থেকে একটা পুঁথি বের করলো সে। সেখান থেকে একটা পাতা টেনে নিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললো, “এটা রাখো। এর ভেতরে দুটো স্লোক আছে, যেটার একটা তোমার রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করবে। আর, পুরো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে শোন, কিভাবে যেতে হবে।”
পুরো ব্যাপারটার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। এও সম্ভব? কিন্তু কথা বলার সাথে সাথে এমনকিছু জিনিস দেখালো ক্রিতদেব আমাকে যে বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। বিষয়টা হজম করতে বেশ কিছুক্ষণ লাগলো আমার।
পুরোটা বলার পর আমার মুখের দিকে তাকালো সে। বললো, “বুঝলে পুরোটা?”
“পরিস্কার,” রক্ষাকবজটা আস্তিনের ভেতর রেখে বললাম আমি, “আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি আছি। এই অভিযানটা ভালভাবেই শেষ হবে আশা করি। অন্তত আমার চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না।”
“সময়টা সম্পর্কে মনে থাকে যেন,” আবারো সতর্ক করে দিলো সে, “সময়ের হিসেবটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
“মনে থাকবে,” তার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
উঠে দাঁড়ালো ক্রিতদেব। তারপর হঠাত করেই দু’হাতে তালি বাজালো সে। সংকেত পেয়ে তার সামনে হাজির হলেন যুবরাজ। এতোক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি।
ক্রিতদেব এবার আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “রক্তমণি লাগবে। গাঢ় লাল রঙের জমাট বাঁধা স্ফটিক, যেটা পাবে তৈমুর পর্বতের নিঞ্চল গুহায়। দেবী প্রাচী এতোদিন ধরে যেটা পাহারা দিয়ে রেখেছেন। আমি শুভঙ্করকে সবই বলে দিয়েছি। কাল সকালে সূর্যদেব জেগে উঠার আগেই রওনা হতে হবে। আমি জানি কাজটা খুবই কঠিন। দুজনের বেশী কেউ ওখানে যেতে পারবে না একসাথে। তাই কাউকে সাথে নিতে পারবেন না এ কাজে। যা করার দুজন মিলেই করতে হবে।”
দেবী প্রাচীর কথা এখানকার সবাই অবগত। শক্তি এবং ক্ষমতার দেবী প্রাচী, তার কাছে আছে এমন এক ক্ষমতা যা কোন মানুষের হাতে পড়লে পুরো মানবজাতির ইতিহাসটাই বদলে যাবে।
“তুমি কোন চিন্তা করো না ক্রিতদেব,” আমার দিকে তাকিয়ে একবার হেসে আবার ক্রিতদেবের দিকে তাকালেন রাজপুত্র, “আমরা সফলকাম হবোই। রক্তমণি না নিয়ে ফিরছি না।”
“ঠিক,” মুচকি হেসে বললাম আমিও, “সেনাপতির দায়িত্ব পেয়েই এমন একটা রোমাঞ্চকর কাজে নামতে হবে, তা কে ভাবতে পেরেছিল! সেনাপতি হিসেবে আমার প্রথম কাজটা যেভাবেই হোক, সফল করতেই হবে। না হলে রাজপুত্র আমার কল্লা কেটে নেবেন।”
“যা বলেছো,” হেসে উঠলেন রাজপুত্র।
ক্রিতদেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম আমরা। যুবরাজের সাথে হাটতে হাটতে বের হয়ে এলাম রাজপ্রাসাদের বাইরে।
হঠাত করেই একটা চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালাম আমি। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম যুবরাজের দিকে।
“এখনকার সেনাপতির গলা এটা,” শীতলসুরে বলে উঠলেন তিনি, “কংনুমরাদের সাথে হেরে যাবার ফল ভোগ করছেন।”
আর কিছু বললাম না আমি। বুঝতে পারলাম কি হচ্ছে। এই বুঝতে পারলাম, নিজের দায়িত্বপালনে বিফল হলে আমার কপালে কি জুটবে।
পরদিন খুব সকালে রওনা দিলাম আমরা। সাথে দুটো ঘোড়া, সামান্য কিছু খাবার, আর নিজেদের পছন্দের অস্ত্রগুলো নিয়ে। তার আগে আরো একবার ক্রিতদেবের সাথে সাক্ষাৎ করলাম আমি।
পুরো আটাশ দিন লেগেছে এ পর্যন্ত আসতে। প্রথম উনিশদিন তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি, কিন্তু তারপর থেকেই শুরু হয়েছে যন্ত্রনা। বরফরাজ্যে এসেই ঘোড়া দু’টোকে রেখে আসতে হয়েছে পর্বতের পাদদেশে এক সরাইখানায়। সেখান থেকে হাটছি তো হাটছিই।
আমাদের দেশটা মূলত নাতিশীতোষ্ণ। তাই এখানে এই বরফের দেশে এসে কি ঝামেলা যে পোহাতে হচ্ছে, তা বলার বাইরে। চারদিকে যেদিকে তাকাচ্ছি, শুধু বরফ আর বরফ। হাড়কাপুনি শীতে শরীর থেমে যেতে চায় সর্বক্ষন। নিঃশ্বাস বাইরে বেড়িয়েই জমাট বাধে। কিন্তু কিছুই করার নেই আমাদের। পথ চলতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে।

*******
“এসে গেছি মনে হচ্ছে,” মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে বললেন রাজপুত্র, “এরকমই তো বলেছিল ক্রিতদেব, তাই না?”
সময়টা দুপুর। ভোরে রওনা দেয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো থামলাম আমরা।
কিছুটা পিছিয়ে এলাম আমি। রাজপুত্রের পাশে হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। রাজপুত্রের সামনে এক জোড়া পায়ের ছাপ।
“শুভ্র মানুষের পায়ের ছাপ এটা,” হাত দিয়ে ছাপগুলো স্পর্শ করলাম আমি। নিশ্চিতকন্ঠে বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ, এ রকমই বলেছিল সে। পায়ের ছয়টা আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এখানে। হয়তো বেশীক্ষন আগের নয় এটা।”
আশেপাশে তাকালাম আমি। ক্রিতদেব যা বলেছিলেন আমাদের দুজনকে, তা হুবহু মিলে যাচ্ছে। ছয় আঙ্গুলওয়ালা শুভ্র মানুষের দেশে এসে পড়েছি আমরা। এখন থেকে সবসময়ই সাবধানে থাকতে হবে। কারন, শুভ্র মানুষরা আমাদের মতো সাধারন মানুষদের সহ্য করতে পারে না।
“সরে পড়তে হবে,” দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি, “বেশীক্ষন থাকা যাবে না এখানে। শুভ্র মানুষরা দেখে ফেললে বিপদে পড়ে যাবো।”
খাপ থেকে ছুড়িটা নিয়ে পরীক্ষা করলাম আমি। তারপর তূণটা একবার দেখে নিলাম। সব ঠিকই আছে। তূণ থেকে একটা তীর নিয়ে ধনুকের ছিলার সাথে আটকে নিয়ে তরবারিটা বের করলাম আমি। যতক্ষন এই রাজ্যে আছি, সাবধান থাকতে হবে।
“তোমার কি মনে হয়?” উঠে দাড়ালেন রাজপুত্র শুহাংশু, “তৈমুর পর্বতটা কতদূরে আর?”
“বেশী দূরে নয় বলে মনে হচ্ছে,” হাত দিয়ে উত্তরদিকের একটা চুড়া দেখি বললাম আমি, “ঐ যে চুড়াটা দেখছেন, আমার মনে হয় ওটাই। ঐ রকমই বর্ণনা দিয়েছিল ক্রিতদেব। আমরা এখন যে পর্বতের গায়ে আছি, সেটার পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। সেখানে একটা তুষারের সেতু থাকার কথা। সেটা পেরোলেই ওটার শীর্ষের কাছে একটা ঢালে পৌছতে পারবো।”
“দেরি করা উচিৎ নয় আর,” উঠে দাঁড়ালেন রাজপুত্র, “চলো, যাওয়া যাক। অনেক কষ্ট করেছি রক্তমণির জন্য। এটা নিয়ে গেলেই পিতা আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
“সুস্থ হবেন, অবশ্যই সুস্থ হবেন,” ধীরে ধীরে কথাগুলো উচ্চারন করে রওনা হলাম আমি। আমার পেছনে পেছনে রাজপুত্র।
পর্বতের বাকি অংশ পাড়ি দিতে খুব বেশী সময় লাগলো না। দুই পর্বতের মাঝের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আবার উপরের দিকে উঠে যেতে হবে। এটা পার হতে পারলেই তৈমুর পর্বতের পাদদেশে পৌছতে পারবো আমরা।
পর্বতটা আর সাধারন সব পর্বতের মতোই। ঐ পর্বতের গায়েই আছে নিঞ্চল নামের একটা প্রাচীন গুহা। তার ভেতরে গেলেই পাওয়া যাবে রক্তমণি।
“আমার মনে হয়,” কাঁধের বোঝাটা বরফের মধ্যে নামিয়ে রাখলাম আমি, “বোঝাগুলো বয়ে নেওয়ার কোন মানে হয় না। শুধু রাতের খাবার আর তলোয়ারটা নিয়ে যাই। বাকি সব এখানে বরফের মাঝে গর্ত করে রেখে যাই। খামোখা কষ্ট করার কোন মানে হয় না।”
“তোমার ধনুকটাও,” আমার কাঁধের দিকে তাকিয়ে বললেন যুবরাজ, “সঙ্গে নিয়ে চলো। কাজে লাগতে পারে।”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বললাম আমি।
আমি আর যুবরাজ, বরফের মাঝে হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। গর্ত খুড়তে হবে। এখানে আমাদের বোঝাগুলোকে রেখে যাবো আমরা। তারপর আবার গর্তটা বরফ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
দ্রুত হাত লাগালাম আমরা। কোষবদ্ধ তলোয়ারের বাট দিয়ে বরফ খুড়ে পাশেই জমা রাখলাম সেগুলো। অমানষিক পরিশ্রম হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। ভাগ্য ভাল, এখানকার উপরের বরফ তেমন একটা জমাট বাঁধে না। না হলে পরিশ্রমের মাত্রা আরো বেড়ে যেতো।
“যথেষ্ট হয়েছে,” অনেকক্ষন পর মুখ খুললেন যুবরাজ, “এবার থামা উচিৎ। গর্তটা মাপ মতোই হয়েছে মনে হয়।”
বরফের উপরই শুয়ে পড়লাম আমরা দুজন, অবস্থা কাহিল। এতো শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছি একেবারে। সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হচ্ছে, ঘামগুলো বাইরে বেড়িয়েই জমাট বেঁধে যাচ্ছে। শুভ্র মানুষরা এখানে কিভাবে থাকে, কে জানে! বেটারা ঘামে না নাকি?
বেশ কিছুক্ষন একভাবে শুয়ে থাকার পর উঠে বসলাম আমি। বোঝাগুলো গর্তে রেখে বরফচাপা দিতে হবে।
দুজনে মিলে বোঝাগুলো বরফের মধ্যে ঠেসে রেখে মিহি বরফগুলো তার উপরে চেপে দিলাম আমরা। চারপাশে ভালোভাবে ছড়িয়ে দেয়া হলো বরফ কুচি, যাতে হঠাত করে শুভ্র মানুষরা এদিকে চলে এলেও কিছু ঠাহর করতে না পারে।
“এবার,” দাঁড়িয়ে বললাম আমি, “যাত্রা শুরু করতে হয়।”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন যুবরাজ।

*******
তুষারের সেতুর কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। তুষার সেতুর এপাশে বসে পড়লাম আমরা। বিশ্রাম প্রয়োজন।
“রক্তমণিটা ভালোভাবে সংগ্রহ করতে পারলে,” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যুবরাজ, “তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কৃত করবো আমি। অনেক কষ্ট করেছো তুমি একাজে।”
“এ আর এমন কি,” নিজের তলোয়ারের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, “নহৃংশুদাবাদের জন্য এমনকি আমার প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি আমি।”
“মানে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন যুবরাজ।
“মানে,” দ্রুত জবাব দিলাম আমি, “মানে আমাদের রাজ্যের জন্য। শ্রদ্ধেয় রাজা মশাইয়ের জন্য। আপনার জন্য যুবরাজ।”
খুশী হয়ে উঠলেন তিনি, “যা বলেছো। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে শুধু রাজ্যের জন্য। এখানে আমরা আমাদের রাজ্যের জন্য আসিনি শুভঙ্কর। এসেছি রক্তমণির জন্য, এসেছি আমার পিতাকে সুস্থ্য করার জন্য।”
“একই কথা যুবরাজ,” উনার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, “রাজ্যটা তো আপনার পিতারই। তিনি না থাকলে আপনি আসতেন না। এখানে তার জন্য আসা, আর রাজ্যের জন্য আসা সমান কথা।”
“ঠিক বলেছো,” মাথা নেড়ে জবাব দিলেন যুবরাজ, “তোমার মতো দেশপ্রেমিকের জন্য গর্ব হয় আমার।”
“চলুন যুবরাজ,” আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, “সময় আর বেশী বাকি নেই। সন্ধ্যা শেষে রাত ঘনিয়ে এসেছে। ক্রিতদেবের হিসেব ঠিকই ছিল। আজ রাতে চন্দ্রদেবী আসবেন না, অমাবশ্যা আজ। রাতের ভেতরই রক্তমণিটা উদ্ধার করতে হবে। না হলে আগামী অমাবস্যার আগে তা করা যাবে না।”
“চলো,” উঠ্বে দাড়ালেন যুবরাজ, “যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। এখন কিছু কাজ করা যাক। পিতার জন্য।”
“নহৃংশুদাবাদের জন্য,” বলে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
মৃদু হেসে উঠলেন যুবরাজ।
পিছল হয়ে আছে সেতুটা। কিংবা কে জানে, সবসময় এরকমই থাকে কি না। আসলে এর আগে কখনো বরফ রাজ্যের কোন তুষার সেতুর উপর দিয়ে হাটার অভিজ্ঞতা নেই, তাই জানি না এগুলো কেমন হয়। তবে আমার কাছে খুবই পিচ্ছিল লাগছে। পা হড়কে যেতে চাচ্ছে বারবার।
“এতো পিছল,” বলে উঠলেন যুবরাজ, “এর উপর হাটাই তো কষ্টকর। একবার পা হড়কে গেলে আর দেখতে হবে না।”
“কিছুই করার নেই,” মৃদুস্বরে বলে উঠলাম আমি, “এর উপর দিয়েই যেতে হবে আমাদের। অন্য কোন রাস্তা নেই নিঞ্চল গুহায় যাওয়ার।”
“হুম,” সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ চলতে লাগলেন যুবরাজ।
অনেক দীর্ঘ একটা সেতু এটা। কে জানে কতো বছর ধরে একইভাবে আছে! কতো আগে তৈরী হয়েছিল এটা?
ধীরে ধীরে সরু হয়ে এসেছে সেতু। এতোটা সরু যে, একজন মানুষ কোনমতে হেটে যেতে পারবে এর উপর দিয়ে। পাশাপাশি দুজন যাওয়া সম্ভব নয়।
“আমি আগে যাচ্ছি,” বলেই পা বাড়ালেন যুবরাজ।
“সাবধানে,” চেঁচিয়ে তাকে সতর্ক করলাম আমি।
“তা আর বলতে,” আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন যুবরাজ।
আর প্রায় সাথে সাথেই কেঁপে উঠলেন তিনি। পা হড়কে গেছে তার। বিকট একটা চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি।
পড়ে যাচ্ছেন যুবরাজ!

*******
“পার হলাম তাহলে,” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন যুবরাজ।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম আমি। বসে পড়লাম তার পাশে। বসে বসে ভাবতে লাগলাম একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা।
আরেকটু হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হতো যুবরাজের। পড়েই যাচ্ছিলেন উনি, অনেক কষ্টে তাকে সেতুর উপরে উঠাতে হয়েছে। তারপর পুরোটা সেতু অনেক সাবধানে পার হতে হয়েছে আমাদের। সবসময়ই ভয়ে ছিলাম, আবার যদি পা হড়কে যায়!
অমাবস্যা আজ। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকার কথা। কিন্তু এখানে এতোটা অন্ধকার নেই। মিহি একটা সাদা আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে। অদ্ভুত আর আশ্চর্য সুন্দর একটা আলোর বিস্তার চারদিকে। জগতটা অপার্থিব লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে নয়, বরং স্বর্গে আছি আমরা।
“কাজটা শেষ করা উচিৎ আমাদের,” যুবরাজের কথায় যেন ধ্যান ভাঙ্গলো আমার।
“হ্যাঁ,” দ্রুত জবাব দিলাম আমি।
ঝটপট উঠে দাঁড়ালাম আমরা। এখন উপরের দিকে উঠতে হবে।
পর্বতের ঢাল বেয়ে উপরে উঠছি আমরা। বারবার পা পিছলে যাচ্ছে। সাবধানে এগুতে হচ্ছে আমাদের। একবার হড়কে গেলে আর দেখতে হবে না। একেবারে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে।
ঝামেলা কেবল এই একটা নয়। টানা কয়েকদিন ধরে অনবরত উপরে উঠতে হচ্ছে আমাদের। যতোই উপরে উঠছি, শ্বাসকষ্ট ততোই বেড়ে যাচ্ছে আমাদের। কেন এটা হচ্ছে, কে জানে! তাছাড়া বাতাস এখানে এতোই ঠান্ডা যে শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যন্ত জমে যাচ্ছে। শান্তিতে ঘামাও যায় না এখানে। ঘামগুলো বের হওয়ার সাথে সাথে জমে যায়।
কতোক্ষন ধরে উপরে উঠছি কে জানে! কেবল উঠেই চলেছি আর উঠেই চলেছি। নিঞ্চল গুহার দেখা আর পাচ্ছি না। কোথায় গেলো সেটা?
“শুভঙ্কর?” যুবরাজের ডাক শুনে তার দিকে ফিরে তাকালাম আমি, “নিঞ্চল গুহা বলে আসলেই কি কিছু আছে?”
“আছে যুবরাজ,” দৃঢ়তার সাথে বললাম আমি, “ক্রিতদেব মিথ্যে বলার মানুষ নয়।”
“তা ঠিক,” ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন তিনি, “কিন্তু এখন কেমন যেন লাগছে আমার।”
“আমারও,” সংক্ষেপে জবাব দিলাম আমি। বেশী কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার।
যুবরাজ সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন আমার মনের ভাব। তাই আর কোন কথা না বলে উঠতে লাগলেন।
পর্বতের গা বেয়ে উঠার মতো পরিশ্রম আর নেই। বার বার হড়কে যেতে চায় শরীর। হাতের দশ আঙ্গুল আর দু পায়ের সাহায্যে কোনমতে ঝুলে থাকতে হয়। বেশ কষ্টসাধ্য কাজ এটা। অবশ্য আগেই বুদ্ধি করে হাতের তালুতে কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম বলে রক্ষা। না হলে এতোক্ষন আর টিকতে হতো না।
খুবই ধীরে ধীরে উঠছি আমরা। এই এলাকায় এমনিতেই কেন যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আমাদের। এখন অবস্থা আরো খারাপ। প্রচন্ড পরিশ্রমের ফলে হাঁপিয়ে গেছি ইতোমধ্যেই। হাপরের মতো উঠানামা করছে বুক। যুবরাজের অবস্থাও প্রায় একই রকম।
"একটু জিরিয়ে নিতে হবে," বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন যুবরাজ।
কোন কথা না বলে শুধুমাত্র মাথা নাড়লাম আমি। এতোটাই কষ্ট হচ্ছে যে কথা বলার শক্তিটুকুও পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে হাত দুটো কাঁধ থেকে ছুটে আসবে যেন।
অবশেষে অমানষিক পরিশ্রমের পর একটা গুহামুখ দেখা গেলো। কোনমতে শরীরটাকে টেনে গুহামুখে তুললাম আমরা, তারপর সেখানেই চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছে শরীরের শেষ শক্তিটুকুও খরচ করে ফেলেছি।
এভাবে কতোক্ষণ কেটে গেলো, বলতে পারবো না আমরা। এতোটাই ক্লান্ত হয়েছি যে কথা বলার শক্তিটাও পাচ্ছি না। এভাবে একভাবে পড়ে থাকার পর যেন ধীরে ধীরে হারানো শক্তি ফিরে পেলাম আমরা। শরীরটাও ধকল কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলো।
“এটাই কি নিঞ্চল গুহা?” অনেকক্ষণ পর কথা বললেন যুবরাজ।
“হ্যাঁ,” ধীরে ধীরে উত্তর দিলাম আমি, “ক্রিতদেবের কথা যদি ঠিক হয়, তবে এটাই হওয়া উচিৎ।”
“রাতের খাবারটা খেয়ে নিলে হয়না?”
যুবরাজের দিকে নজর দিলাম আমি। তারপর হেসে উঠলাম। বেচারা একেবারেই কাহিল হয়ে গেছে।
“চলুন খেয়ে নিই। তারপর কাজে নামা যাবে।”
আমার কথা বলার ধরন দেখে হেসে উঠলেন যুবরাজ। সেদিকে নজর না দিয়ে পিঠের ঝোলা থেকে আজ রাতের জন্য রাখা খাবারটা বের করলাম আমি। যুবরাজকে তার অংশ দিয়ে আমার অংশ নিয়ে বসলাম আমি। কোন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করলাম।
খাবার শেষ হওয়ার পর উঠলাম আমি। এবার গুহার ভেতরে প্রবেশ করতে হবে।
কোষের তরবারিটা বের করে নিলাম আমরা দুজনই। পিঠে ধনুক আর তীরের খাপটা রয়েছে, সেগুলো যে কোন সময়ই প্রয়োজন পড়তে পারে।
একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম আমরা। তারপর এগুতে লাগলাম গুহার ভেতরদিকের উদ্দেশ্যে।

*******
একে তে রাত, তারপর আজ অমাবস্যা, কিন্তু তাতে আমাদের দেখতে কোন সমস্যাই হচ্ছে না। কোন এক অপার্থিব আলোয় যেন ছেয়ে আছে গুহার ভেতর। অদ্ভুত এক নীল আলোয় উদ্ভাসিত সবকিছু, এমনকি গুহার দেয়ালের প্রত্যেকটা জিনিসই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোত্থেকে আসছে এই আলো, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ খুঁজেও আলোর উৎসের সন্ধান পেলাম না আমি।
গুহাটা শুধুমাত্র একটা গুহা নয়। মনে হচ্ছে কোন একটা গোলকধাঁধার ভেতরে প্রবেশ করেছি আমরা। বেশ কিছুক্ষণ যেতেই একটা ত্রিমুখে হাজির হলাম আমরা। এখানে রাস্তা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে রওনা হয়েছে।
“কোন পথে এগুবো?” আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন যুবরাজ।
কোন কথা না বলে নিজের আস্তিনের দিকে হাত বাড়ালাম আমি। সেখানে ক্রিতদেবের দেওয়া সেই পুথির অংশটা আছে, যেটাকে রক্ষাকবচ হিসেবে বর্ণনা করেছিল সে।
পুথির সেই অংশটা বের করে মেলে ধরলাম আমি। সেখানে একটা স্লোক লেখা।

“নিঞ্চলের আস্তানায় যাহিবারে চাও?
শুভ্র মানুষের দ্যাশে আগে যাও।
একের লগে তিন, পর্বতেরও বীণ
লগে আছে চাইর, দুনিয়ার বাইর।
হেইখানে পাবা তুষার পুল
নিচে ঠান্ডা জল করে কুল কুল।
সাবধান এ সাধু, একবার যদি হড়কাও
আসতে হইবো না নিঞ্চলে, দুনিয়া ছাড়িয়া যাও।
যদি পার করতে পারো বরফের হেই পুল
সোজা উপরে উঠো, কইরো না ভুল।
একে আর একে দুইশো হস্ত হইবো উঠন,
যদি যাও হড়কাইয়া, থামবো না পতন।
এইহানেও যদি পাও তুমি পার
গোলকধাঁধায় আটকাইবা এইবার।
তিনে তিনে নয়
গুনা এরে কয়।
পরথমে তিন বায়ে, তাহার পরে ডানে হয়
এইভাবে আগাইয়া যাও, কইরো না ভয়,
ধীরে আগাও সাধু, কহিবারে চাই
ভুল সড়ক ধরলে হইবো তোমার ক্ষয়।
যাবার পথে পড়বো মরণ ক্লদ
কেউ একজন এইখানে হইবো বধ।”

“তিনে তিনে নয়,” বলে উঠলেন যুবরাজ, “তিনটে রাস্তা দেখতে পাচ্ছি আমরা। তিনটে রাস্তাই কিছুদুর যাওয়ার পর তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে। খুব সম্ভবত এটাই বোঝানো হয়েছে।”
“প্রথম তিনটে রাস্তার মাঝে নিতে হবে বাঁয়েরটা,” তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “পরের তিনে ডানের রাস্তায় যেতে বলা হয়েছে।”
“কিন্তু মরণ ক্লদটা কি জিনিস?” আমার হাত থেকে পুঁথির অংশটা হাতে নিলেন তিনি, “আর একজনকে বলি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কাকে?”
“দেখা যাক,” মৃদু হাসলাম আমি।
পুঁথির লাইনগুলোকে অনুসরণ করে বাঁয়ের পথটায় ঢুকে পড়লাম। ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম, সাবধানে। কারণ এখনো জানি না সামনে কোন প্রকার বাঁধা বা বিপদ আছে কি না। থাকতেও পারে, বলা যায় না।
এখানকার পরিবেশ দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। বাইরে যতক্ষণ ছিলাম, কিংবা যতদিন ধরে তুষার রাজ্যে আছি প্রচন্ড শীতে জমাট বাঁধার জোগাড় হয়েছিল। অথচ এখানকার পরিবেশ একেবারেই অন্যরকম। মনে হচ্ছে আমরা আমাদের নিজেদের রাজ্যেই আছি। একেবারেই নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ এখানে।
যতোই ভেতরে যাচ্ছি, ততোই যেন পরিবেশটা আরো আরামদায়ক হচ্ছে আমাদের জন্য। প্রথম প্রথম দেয়ালগুলোতে বরফ মোড়া থাকলেও এখানে দেখা যাচ্ছে পাথর। গুহাটা সম্ভবত পাথরের তৈরী, অথবা পাথর কেটে বানানো হয়েছে। শক্ত পাথরকে কেটে এভাবে এই গুহাগুলো বা এই গোলকধাঁধা কে তৈরী করেছে কে জানে! তবে যেই তৈরী করে থাকুক না কেন, সে একজন খুবই বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিল, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরো বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর দ্বিতীয় ত্রিমুখের সন্ধান পেলাম আমরা। এখানেই রাস্তা তিনভাবে বিভক্ত হয়ে সামনে এগিয়েছে।
“এবার ডানে,” যুবরাজের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
“হুম,” সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে হাটা শুরু করলেন তিনি। আমিও তার পিছু পিছু হাটতে লাগলাম।
বেশ কিছুদূর হাটার পর ধীরে ধীরে রাস্তাটা প্রশস্ত হতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরই শেষ হয়ে গেলো সেটা, সামনে দেখা যাচ্ছে আরেকটা ছোট গুহা। গুহার অপরপ্রান্তে আরেকটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে।
“এর কথা তো বলা ছিল না পুঁথির অংশটাতে,” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যুবরাজ, “তাহলে কি ভুল রাস্তায় চলে এসেছি আমরা?”
“আমার তা মনে হয় না,” নিজের মাথা নাড়লাম, “হয়তো এর কোন বৈশিষ্ট্য নেই, তাই এর উল্লেখ নেই পুঁথিতে।”
“কিন্তু কোন বৈশিষ্ট্য যদি থাকে,” দ্বিধান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন তিনি।
অসহায় ভঙ্গিতে নিজের কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। এটা দেখে মাথা নিচু করলেন যুবরাজ। চোখ বন্ধ করে নিজের মনে ভাবতে লাগলেন।
একটু পরই মাথা তুলে তাকালেন তিনি। বললেন, “দেখা যাক সামনে কি আছে। না এগুলে বোঝা যাবে না এটা ভুল না সঠিক পথ। দেরী করো না, এসো।”
বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। আর সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠলেন।
“কি হচ্ছে এখানে?”

*******
অবাক হলাম আমি, যদিও অবাক হবার মতো তেমন কিছুই হয়নি এখানে, বরং এটাই স্বাভাবিক ছিল।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে থাকা পাথরের মেঝেটা যেন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে কাদায়। ঘন কাদা, যাকে পুঁথির ভাষায় বলা হয় ক্লদ, সেখানে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছেন যুবরাজ।
“কি হচ্ছে এখানে?” আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন যুবরাজ, “পাথর গলে গেলো নাকি?”
“মরণ ক্লদ,” ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে জবাব দিলাম আমি, “মানে মরণ কাদা। পাথর পরিণত হয়েছে কাদায়, তার ভেতর ডুবে যাচ্ছেন আপনি।”
“আমাকে ধরো,” খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি, “উঠাও আমাকে এখান থেকে।”
ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। একটা হাত পেছনে, অন্যটা সামনে যুবরাজের দিকে বাড়ানো। ধীরে ধীরে যুবরাজের একেবারে কাছে পৌছে গেলো হাতটা।
আমাকে হাত বাড়াতে দেখে নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন যুবরাজ। তারপর শক্ত করে চেপে ধরলেন কব্জির কাছে। উঠাতে চাচ্ছেন নিজেকে কাদার মাঝ থেকে। আমিও পাল্টা চেপে ধরলাম তাকে, নিজের দিকে টানতে লাগলাম। হঠাত করেই লক্ষ্য করলাম, উঠতে পারছেন না তিনি, যতোই নিজের দিকে টানছি, ততোই যেন গাঢ় কাদার ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছেন যুবরাজ।
“জোড়ে টানো আমাকে,” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন যুবরাজ। স্পষ্ট আতংক ফুটে উঠেছে তার দু’চোখে, “আমাকে বাঁচাও।”
ঠিক তখনই আমার অন্য হাতটা যেন ছোবল মারলো। হাতটা গিয়ে থামলো ঠিক যুবরাজের ঘাড়ের পেছন দিকটায়। প্রথমে খুশী হয়ে উঠলেন যুবরাজ, কিন্তু পরক্ষণেই একটা বিস্ময়ের দৃষ্টি ফুটে উঠলো তার চোখে। অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে যেন মৃদু হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটে।
অনেক কষ্টে শব্দটা উচ্চারণ করলেন যুবরাজ, “কেন?”
“নহৃংশুদাবাদের জন্য,” শীতল গলায় বলে উঠলাম আমি।
আর কোন কথা না বলে হাতটা সরালাম আমি যুবরাজের ঘাড়ের কাছ থেকে। হাতে থাকা ছুড়িটা উঁচু করে ধরলাম যুবরাজের চোখের সামনে। যুবরাজের উষ্ণ লাল রক্তে ভিজে আছে সেটার ফলা।
মুখের মৃদু হাসিটা আরো বিস্তৃত হলো আমার। যুবরাজের হাতটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম আমি। তারপর বললাম, “ আমি আগেই বলেছিলাম, নহৃংশুদাবাদের জন্য এমনকি আমার প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি আমি। অবশ্য বাস্তবে আমার নিজের প্রাণ দিতে হয়নি। বদলে নিতে হচ্ছে, আপনার প্রাণ।”

*******
“যাবার পথে পড়বো মরণ ক্লদ
কেউ একজন এইখানে হইবো বধ।”

আমি বধ হতে রাজী নই, এমনকি নহৃংশুদাবাদকেও হারাতে রাজী নই। এটা সেই নহৃংশুদাবাদ, যার জন্যে গত তিন পুরুষ ধরে যুদ্ধ করছে আমার জাতি, কংনুমরারা। কয়েকবারই বিজয় এসেছে আমাদের, কিন্তু কোনবারই পুরোপুরি দখল করতে পারিনি নহৃংশুদাবাদকে।
অনেক ছোটবেলায় গোপনে আমাকে রেখে যাওয়া হয়েছিল নহৃংশুদাবাদে। উদ্দেশ্য তেমন কিছুই নয়, আবার খুব একটা সামান্য কারণেও নয়। জানা ছিল আমার পিতার, আমার শরীরে কার রক্ত বইছে। এও জানতেন তিনি যে একটা সময় এই আমাকে দিয়েই নহৃংশুদাবাদকে নিজের করায়ত্বে আনতে পারবেন তিনি। আর সেই কাজটাই গোপনে করে চলেছি আমি।
গত আশ্বিনেই আমাদের রাজ্যে খবর পৌছায় যে ক্রিতদেব মারা গেছেন। ক্রিতদেবের সঙ্গী ধরা পড়ে কংনুমরার সীমান্তে, তখন সে নহৃংশুদাবাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে ক্রিতদেবের মৃত্যুর খবরটা পৌছে দেওয়া।
ক্রিতদেবের মৃত্যু সংবাদে একটা বিরাট বোঝা নেমে যায় পিতার কাঁধের উপর থেকে। তবুও খবরটা সত্যি কি না নিশ্চিত জন্য আমার সহোদর শৌনকে পাঠানো হয় বরফের দেশে। ক্রিতদেবের সঙ্গী ফেরার সময় তার রচিত একটা পুঁথি নিয়ে আসছিলো, সেই পুঁথিটাকে কাজে লাগানো হয় এই কাজে। আরও একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে, দেবী প্রাচীর সাক্ষাৎ লাভ করা। প্রথম দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করতে পারলেও দ্বিতীয়টি পালন করতে পারেনি শৌন। কারণ ওর ভেতর এতো সাহস ছিল না যে কাউকে ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারবে সে।
শৌনের ব্যর্থতার পর নতুন করে ছক আঁকা হয়। আর সেই ছকে নতুন করে ক্রিতদেবকে আনা হয়। কারণ নহৃংশুদাবাদের মানুষ তখনো জানতে পারেনি ক্রিতদেবের প্রয়াণের কথা। যে লোক ক্রিতদেবের মৃত্যুর খবর নিয়ে নহৃংশুদাবাদে যাচ্ছিল, তাকে মেরে ফেলা হয় এবং তারপর তার বদলে অন্য লোক পাঠানো হয় নহৃংশুদাবাদে। সে গিয়ে খবর দেয় যে ক্রিতদেব আসছেন শীঘ্রই।
এই ফাঁকে সমস্ত সৈন্য সাজিয়ে নেন পিতা এবং প্রস্তুতি নেন নহৃংশুদাবাদ দখলের। শুধাংশু গৌড় তখন বিছানায়, মৃত্যুর অপেক্ষায়। জানা ছিল আমাদের, নহৃংশুদাবাদ দখল করার পথে মাত্র দুটো বাঁধার মুখে পড়তে হবে। এক, নহৃংশুদাবাদের সেনাপতি, এবং পরেরজন রাজপুত্র শুহাংশু।
বাঁধা দুটো দূর করার জন্য মহামন্ত্রীকে গোপনে হাত করি আমরা, তাকে কথা দেওয়া হয় যে নহৃংশুদাবাদের এক-তৃতীয়াংশ তাকে দিয়ে দেওয়া হবে। মহামন্ত্রীর ইন্ধনেই আগের সেনাপতিকে পদচ্যুত করা হয় এবং মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এবং তারপর নকল ক্রিতদেবের সাহায্যে ‘রক্তমণি’ সন্ধানের নাম করে রাজপুত্রকে নিয়ে আমি বেড়িয়ে পড়ি রাজ্য থেকে। আদতে রক্তমণি নামে কোন পাথরের অস্তিত্বই নেই। সেই সুবাদে রাজা শুধাংশু গৌড়ের বাঁচারও কোন আশাই নেই। অবশ্য এখনো রাজামশাই বেঁচে আছেন কি না, তা নিয়ে আমার ভেতর ঢের সন্দেহ আছে। কারণ, আমার হিসেব যদি সত্যিই হয়, তাহলে এতোদিনে নহৃংশুদাবাদের রাজামশাইয়ের সকল ক্ষমতা ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এও আশা করা যায় যে নহৃংশুদাবাদ আমাদের হাতে চলে এসেছে।
ইচ্ছে করলে অনেক আগেই মেরে ফেলা যেতো যুবরাজকে। এমনকি তুষার সেতুর সেখানে তাকে না বাঁচিয়ে রাখলেও হতো। কিন্তু সেটা করলে কখনই আমার মূল উদ্দেশ্য সাধণ করা যেতো না। যুবরাজকে এ পর্যন্ত না আনলে চলতো না আমার। কারণটা যদিও এখনো স্পষ্ট নয় আমার কাছে।
খাবি খাচ্ছেন যুবরাজ। ছুঁড়িটা আমূল গেঁথে দিয়েছিলাম উনার ঘাড়ে, যার ফলে গল গল করে রক্ত বেরুচ্ছে উনার ঘাড় থেকে। নিজের আস্তিনের সাথে বাঁধা পাত্রটা এগিয়ে দিলাম আমি, উনার ঘাড়ের পেছনে চেপে ধরলাম। চুইয়ে চুইয়ে বেশ কিছু রক্ত সংগ্রহ করলাম, তারপর উঠে দাঁড়ালাম।
আসল ক্রিতদেবের পুঁথির সেই অংশটা এবার বের করলাম আমি। পাত্র থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ফেললাম তার উপর। ধীরে ধীরে পুঁথিতে লেখা শ্লোকটা যেন হাওয়ায় মিশে গেলো। তার বদলে ফুটে উঠলো আরেকটা শ্লোক।

“সাধু, আসিয়াছো নিঞ্চলে
ঢোকো তাইলে ভিতর অঞ্চলে
তাইর আগে বাইর করো বধ শরীরে
হৃদপিন্ড, আমারে দিবার তরে।
আমি প্রাচী, চাইয়া তোমার পথ
বইয়া রইয়াছি, কইরাছি শপথ
বধ দেহের রক্ত কইরবো পান
তাইর সাথে ভোজিবো হৃদপিন্ড,
আমার সকল ক্ষমতা কইরবো তোমারে দান।
আসো সাধু, আসো আমার তরে
আমার ক্ষমতা লইয়া ফিরা যাও ঘরে।”

মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো আমার। ধীরে ধীরে তাকালাম যুবরাজের দিকে। তাকে এ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার ফল পাওয়া যাবে কিছুক্ষণের মাঝেই। এতোক্ষণে কোমর পর্যন্ত কাদায় ডেবে আছেন তিনি, ধীরে ধীরে কাদার নিচে হারিয়ে যাচ্ছেন। প্রবল রক্তপাতের ফলে কিছুটা ঘোরের মাঝে চলে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। দুর্বল মাথাটা কোনরকমে সোজা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যদিও চেহারায় কষ্টের প্রবল ছাপ রয়েছে এখনও।
এখনও রক্তপাত হচ্ছে যুবরাজের ক্ষতস্থান থেকে। খুব ধীরে বেরুচ্ছে রক্ত। আগের পাত্রটাকে আবারও এগিয়ে দিলাম আমি, যুবরাজের রক্তে পরিপূর্ণরুপে ভরে নিলাম, তারপর ছুড়ি চালালাম তার বুকে।
বেশ কিছুক্ষণের মাঝেই যুবরাজের হৃদপিন্ড চলে এলো আমার দখলে। ততক্ষণে বুকের নিচ পর্যন্ত কাদায় ডেবে গেছেন তিনি।
ক্রুর দৃষ্টি মেলে যুবরাজের দিকে তাকিয়ে আছি। বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, যদিও চোখ দুটোতে কোন প্রাণের চিহ্ন নেই।
আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমি, যতক্ষন না পুরোপুরি যুবরাজের শরীরটাকে ক্লদ বা কাদা নিজের ভেতরে পুরোপুরি গ্রাস করে নিলো। তারপর উঠে দাঁড়ালাম।
কাজটা শেষ করা প্রয়োজন!

*******
বেশ বড় একটা বেদী, অন্তত কয়েকশো চর্বির বাতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে তার সম্মুখভাগ। একপাশে পাথরের গায়ে রয়েছে বেশ বড়সর কিছু তাক, পাথর কুঁদে তৈরী করা। অন্তত হাজারখানেক বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন রঙের পুঁথি শোভা পাচ্ছে সেখানে। অন্যপাশে রয়েছে কিছু অদ্ভুত আসবাব, বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়ানো ছিটানো রয়েছে সেগুলোর উপর। পুরো গুহাটার উপর থেকে এক নজর দৃষ্টি বুলিয়ে আবারও দৃষ্টি দিলাম বেদীর দিকে। কেন যেন এটা আমাকে আকর্ষণ করছে, সম্মোহিত হয়ে পড়ছি আমি।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি বেদীর দিকে। এখনো কোন এক অদ্ভুত কারণে চোখ দুটো আমার সেটে রয়েছে বেদীর উপর। চেষ্টা করেও দৃষ্টি সরাতে পারছি না, অমোঘ কোন শক্তি যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বেদীর দিকে। যেন নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণই নেই আমার।
বেদীর সামনে এসে থেমে গেলাম আমি, সাথে সাথেই অদ্ভুত প্রবণতাটা মাথা থেকে সরে দাঁড়ালো যেন। নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম বলে মনে হলো।
“সাধু,” রিনরিনে গলায় একেবারে আমার কানের কাছে বলে উঠলো কেউ একজন, “আসছো তুমি সাধু?”
কন্ঠটা কানে প্রবেশ করা মাত্রই যেন আবারও সম্মোহিত হয়ে পড়লাম আমি। গলা দিয়ে অদ্ভুতভাবে খসখসে শব্দ বেরোল, “এসেছি আমি। এসেছি তোমার কাছে, তোমার দাবী করা জিনিসগুলো তোমার পায়ে সমর্পণ করার জন্য আমি এসেছি দেবী প্রাচী।”
“আমি কোন দেবী না,” গম্ভীরসুরে বলে উঠলো কেউ একজন। খেয়াল করলাম আমি, কন্ঠটা এসেছে আমার পেছনদিক থেকে, “এবং আমার পায়েও কিছু সমর্পণ করার দরকার নাই।”
অবাক হলাম আমি। তবে কি আমি ভুল কোথাও চলে এসেছি? দেবী প্রাচীর সেই নিঞ্চলে গুহার খোঁজ কি আমি পাইনি? কিন্তু তা কি করে হয়? পুঁথির সেই অংশটাতে যা যা বর্ণনা করা ছিল, সবই তো মিলে গেছে। তবে?
“এ কি বলছো দেবী?” ধীরে ধীরে পেছন ঘুরলাম। আবারও চমকে যেতে হলো।
আমার সামনে এখন যে দাঁড়িয়ে আছেন, তার রুপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীর যাবতীয় উপমা দিয়ে বর্ণনা করা হলেও যেন তা কম পরে যাবে তার রুপের কাছে। বয়েস দেখে মনে হচ্ছে বড়জোর অষ্টাদশী, তবে আমি জানি চোখের দেখা আর আসল জিনিসের মাঝে তফাৎ আকাশ পাতাল।
“সত্যিই কই সাধু,” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। সুক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, “আমি কোন দেবী না। আমিও মানুষ। তোমাগো মতোই সাধারণ মানুষ। প্রাচী, প্রাচী আমার নাম।”
“তাহলে পৃথিবীর সবাই যে তোমাকে দেবী বলে পুজো করে,” ভ্রু কুঁচকে গেলো আমার।
“এইটাই তো মানুষের স্বভাব। যারে মনে করে নিজের চাইতে ক্ষমতা বেশী, তারেই দেবতার আসনে বসাইয়া দেয়। প্রতিমা বানায়, পুজা করে, আরো মেলা কিছু করে। দোয়া চায়, আর চায় ক্ষমতা। আমি কোন দেবী না সাধু। আমি মানুষ, তোমার মতোই সাধারণ মানুষ। কপালের দোষে এইখানে পইড়া রইছি।”
“তাহলে এখানে যে লেখা আছে,” পুঁথির সেই অংশটা বের করে তাকে দেখাই আমি, “‘আসো সাধু, আসো আমার তরে, আমার ক্ষমতা লইয়া ফিরা যাও ঘরে।’ তুমি যদি দেবী না হও, তাহলে কিভাবে মানুষকে ক্ষমতা দেবে?”
“ক্ষমতা কি খালি ঐশ্বরিকই হয় সাধু?” ঠোঁট বেঁকে গেলো তার, ধীরে ধীরে বেদীর দিকে এগিয়ে গেলো সে। বললো, “এছাড়া কি আর কোনভাবে ক্ষমতা পাওন যায় না? আমি তোমারে ক্ষমতা দিমু সাধু, আমার নিজের সমস্ত ক্ষমতা তোমারে দিয়া দিমু। অনন্তকাল বাঁচবা তুমি, পৃথিবীর সমস্ত বীর তোমার পায়ে লুটাইবো। কিন্তু একটা শপথ করতে হইবো তোমারে।”
“কি শপথ?” তার দিকে লক্ষ্য রেখে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। ধীরে ধীরে বেদীর উপরে গিয়ে বসলো সে।
“কমু তোমারে,” মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললো সে, “সবই কমু। তার আগে জানবা না কি কি ক্ষমতা পাইবা? জানবা না আমার সব ক্ষমতার উৎস কি?”
“বলো তুমি।”
“তার আগে আমার সামনে বসো তুমি। আর আমার যা চাওয়ার ছিল, সেইগুলা দাও।”
নির্দেশের সুরে নয়, বরং কেমন যেন একটা মিনতির সুরে ফুটে উঠলো প্রাচীর কন্ঠে। তার এহেন আচরণে বিস্ময় বাড়ছে আমার।
জিনিসগুলো তার হাতে তুলে দিলাম আমি, একটা পাত্রে যুবরাজের রক্ত এবং অন্য আরেকটা পাত্রে হৃদপিন্ড। তারপর হাটু গেঁড়ে বসলাম তার সামনে।
জিনিসগুলো নিজের সামনে তুলে ধরলো সে। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেগুলোর দিকে, তারপর পাশে নামিয়ে রাখলো। তাকালো আমার দিকে।
“জান সাধু, এই জীবন আর ভাল লাগেনা আমার। একটা সময় আছিল, যহন আমি পাগল হইয়া আছিলাম অমরত্ব পাওয়ার লাইগা। দিন রাইত সাধণা করতাম বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে, তাগো পুজা করতাম। ভাবতাম, আমার পুজায় সন্তুষ্ট হইয়া আমারে বর দিবো তারা। হা হা হা। কি বোকা আছিলাম আমি! যেইখানে কোন দেবদেবীই নাই, সেইখানে আমারে ক্ষমতা দিবো কেরা?”
“কি বলতে চাচ্ছো?” শঙ্কিত হলাম আমি, “পৃথিবীতে কোন দেবদেবীই নাই?”
“হয়তো আছে, আমরা তাগো চিনিনা!” উদাস সুরে বলে উঠলো সে, “হয়তো তারা আমাগো মূর্খতা দেইখা হাসে। মনে মনে কয়, ‘কি বোকা এই মানবজাতি!’ তয় মানুষে যাগো দেবদেবী মনে কইরা পুজা করে, তারা না। আসল দেবদেবী যদি থাইকা থাকে, তাগো হদিস এখনো পায় নাই পৃথিবীর মানুষ। কিংবা হয়তো দেবদেবীই নাই। আমি ঠিক জানি না।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সে, তারপর আবারও শুরু করলো।
“একটা কাহিনী কই সাধু। মন দিয়া শুনো। তাইলে বুঝবা আসলে আমি কি। শুনবা সাধু?”
“বলো।”

*******
“আমি আছিলাম খুবই সাধারণ এক মানুষ। তোমাগো মতোন, সেইটা তো কইছিই তোমারে। বাকিসব মানুষের মতো আমিও বিভিন্ন দেবদেবীর পুজা করতাম, ক্ষমতা চাইতাম তাগো কাছে, বর চাইতাম। ক্ষমতার উপরে আমার প্রচন্ড লোভ আছিল। কিন্তু জানো সাধু, বছরের পর বছর সাধণা করার পরেও কোন ক্ষমতাই পাইলাম না আমি। একটা সময় বুঝলাম, আমি এতোদিন গলত আছিলাম। ভুল করছি, মস্ত বড় ভুল। শুধু শুধু নিজের জীবনের দামী সময়গুলা আকামে খরচ করছি। সম্পূর্ণ নতুন কইরা চিন্তাভাবনা শুরু করলাম আমি। তহন আমার বয়েস উনত্রিশ কি ত্রিশ।
মাত্র এগারো কি বার বছর বয়েসে বিয়া দিছিল বাপে আমারে, আমাগো রাজ্যের রাজার লগে। আমার বাপে আছিল পুরোহিত, রাজামশাইয়ের খাস লোক। একবার রাজামশাই আমারে মন্দিরে দেখে, তহনই নাকি হের আমারে মনে ধরছিল। ফরমান পাঠাইছিল বাপের কাছে, আমারে সে বিয়া করবার চায়। আমার বাপেও আর কোন রাস্তা না দেইখা রাজার লগে আমারে বিয়া দিবো বইলা ঠিক করলো।
ধুমধাম কইরা বিয়া হইলো আমার। সারা রাজ্যের মানুষ খাইবার আইলো নিমন্ত্রণ। সবাই অনেক আশীর্বাদ করলো আমাগো। কিন্তু আশীর্বাদ ফললো না। বিয়ার রাইতেই রাজা মারা গেলো। বয়েস হইছিল বুইড়ার।
রাজা মরার পরে আমি পড়লাম অকুল পাথারে। রাজার প্রথম ঘরে কোন পোলা আছিল না, আছিল দ্বিতীয় ঘরে। হেই বড় পোলা। আমি আছিলাম রাজার পাঁচ নম্বর রাণী।
রাজা মরার দিন পনেরো পর দ্বিতীয় রাণীর পোলার অভিষেক হইলো। সতেরো বছর বয়েস তখন তার। সিংহাসনে বসলো সে। তখনো জানতাম না, রাজার আগে আমার উপরে তার নজর পড়ছিল।
দুই মাস ভালই গেলো, তারপর শুরু হইলো অশান্তি। কোন এক আজব কারণে মরতে শুরু করলো আমার সতীনেরা। উনিশ দিনের ভিতরে মইরা গেলো চাইর রাণী। বাকি রইলাম আমি। একদিন নতুন রাজা আমারে ফরমান পাঠাইলো, আমার সাথে সে দেখা করবার চায়। কোন কিছু না ভাইবা আমি রাজী হইলাম তার লগে দেখা করতে।
আমার প্রাসাদে আইলো সে। নিজের মনের কথা ব্যক্ত করলো আমার কাছে। কইলো আমারে সে পছন্দ করে, বিয়া করবার চায়। কিন্তু আমি তো তার বাপের পঞ্চম স্ত্রী, স্বাভাবিকভাবে আমারে বিয়া করতে পারবো না সে। বিশেষ কইরা তার মায়েরা জানবার পারলে এই জিনিসটা কখনোই হইতো না। তাই সে কৌশল কইরা এক এক কইরা চাইর রাণীরেই মাইরা ফালাইছে। যদিও কেউ বুঝবার পারেনাই যে সেই তাগো মারছে। সবাই মনে করছে যে স্বাভাবিকভাবেই মরছে তারা।
আমারে একটা আজব প্রস্তাব করলো নতুন রাজা। মরতে হইবো আমারে। পৃথিবীর মানুষের সামনে মরতে হইবো আমারে, সবার সামনে সৎকার করা হইবো আমার। তার দুই মাস পরে আবার রঙ্গমঞ্চে আসমু আমি, নতুন পরিচয়ে। তহন আর আমারে বিয়া করতে কোন সমস্যা হইবো না তার। মানুষেও আর কিছুই কইবার পারবো না। কারণ, তারা তহন জানবো যে আমি আগেই মইরা গেছি। আজব না সাধু? এবং বহুত কার্যকর উপায়।
মনে সায় পাই নাই সাধু। হঠাত কইরাই আমার রাগ উইঠা যায়, যে কারণে তার ছোঁরা দিয়া তারেই গাঁইথা দিছিলাম আমি। বেচারা টু শব্দও করতে পারেনাই।
সে মরার পর রাজ্যের হাল ধরলাম আমি। যদিও আমার স্বামীর আরো দুইটা পোলা আছিল, কিন্ত তারা নাবালক ঐ সময়। তাই বাধ্য হইয়া, আরো ভাল কইরা বলতে গেলে এক প্রকার জিদ কইরাই রাজ্যের ভার নিলাম আমি। যদিও ততোদিনে সারা রাজ্যে আমারে অপয়া কওয়া শুরু হইয়া গেছিল। তাতে আমার জিদ বাড়ল বৈ কমলো না।
ক্ষমতা অর্জনের পরে আস্তে আস্তে লোভী হইয়া উঠলাম আমি। ক্ষমতার প্রতি লোভ, আয়ুর প্রতি লোভ, রক্তের প্রতি লোভ। অল্প দিনেই বুঝতে পারছিলাম যে নাবালক রাজপুত্র দুইটা বড় হইলে কাল সাপ হইয়া দাড়াইবো। তাই সবার আগে কৌশলে ঐ দুইটারেও সরাইয়া দিলাম। এর ফলে আমার নামের পাশে ‘অপয়া’ শব্দটা এক্কেবারে জন্মের মতো লাইগা গেলো। কেউ কেউ আমারে ডাইনীও ভাবতে শুরু করছিল।
নিজের ভবিষ্যত নিশ্চিত কইরা সাধণার দিকে মন দিলাম আমি। দিন নাই রাইত নাই দেবদেবীর মূর্তির সামনে পইড়া থাকতাম। তাগো সন্তুষ্ট করতে চাইতাম, তাগো কাছে আরো বেশী ক্ষমতা ভিক্ষা চাইতাম। কিন্তু পাইলাম না আমি সাধু, কিছুই পাইলাম না। একটা সময় বুঝলাম, এইসব দেব-দেবী আমারে ক্ষমতা দিতে পারবো না। তাই অন্য রাস্তা ধরলাম আমি।
সারা রাজ্যের সমস্ত পণ্ডিতগো গোপনে এক জায়গায় জড়ো করলাম আমি। সবগুলারে বন্দী করলাম। তারপরে আদেশ দিলাম এমন কিছু বানানোর লাইগা, যা আমারে ক্ষমতা দিবো। তবে সবার আগে দরকার আয়ু। আয়ুই যদি না থাকে, তাইলে ক্ষমতা দিয়া ঘন্টা করমু আমি?
পুরা সতেরো বছর লাগলো প্রথম কাজ সমাধা হইতে। তখন আমার বয়েস ছয়-ছল্লিশ সাতচল্লিশ। আয়ু পাইলাম আমি, অনন্তকাল বাঁচার রাস্তা পাইলাম। পাইলাম নতুন কইরা যৌবন। বয়েস কইমা সতেরো-আঠারোতে নাইমা আইলো। তারপরে মনোযোগ দিলাম আরো ক্ষমতা পাইবার লাইগা। ধীরে ধীরে অর্জন করলাম আরো অনেক ক্ষমতা। ততোদিনে পণ্ডিতগো তিন পুরুষ মইরা গেছে।
লেখাপড়া জানতাম না। বাপে কিছু কিছু পুঁথিপাঠ শিখাইছিল, কিন্তু সেইটা যথেষ্ট আছিল না। পণ্ডিতগো কাছ থেইকা পড়াশোনা শিখলাম আমি, সেই সাথে তাগো কাজকারবার সম্পর্কে সবকিছুই দেখতাম আর শিখতাম। একটা সময় পণ্ডিতগো চাইতেও বেশী জ্ঞান লাভ করলাম আমি, সেই সাথে নিজে নিজে সন্ধান শুরু করলাম অনন্ত ক্ষমতা পাইবার লাইগা। ক্ষমতা অর্জন তহন আর আমার সাধারণ কোন শখ বা লোভে আটকাইয়া নাই, অভ্যাসে পরিণত হইছে।
এই ক্ষমতার লোভে একটা জিনিস খেয়াল করি নাই আমি। সারা রাজ্যে আমি অপয়া বইলা পরিচিত আছিলাম, সেই সাথে তিন পুরুষ ধইরা বাইচা থাকনে আমার প্রজারা আমারে সত্যিই সত্যিই ডায়নী ভাবতে শুরু করছিল। খুবই সঙ্গোপনে একজন একজন কইরা রাজ্য ত্যাগ করতাছিল তারা, সেই সাথে পাশের দুইটা রাজ্যের সাথে যোগাযোগ করতাছিল। একটা সময় পুরা রাজ্যের লোক আমার বিপক্ষে চইলা গেলো, বিদ্রোহ করলো। তাগো বিদ্রোহের সুযোগ লইয়া আমার রাজ্য আক্রমণ করলো পাশের দুই রাজ্যের রাজা। আমিও সুযোগ পাইলাম নিজের ক্ষমতা ঝালাই করবার লাইগা। কিন্তু ঘুর্ণাক্ষরেও টের পাইনাই যে আমি যাগো খাওয়াই পড়াই, তারাও আমার উপরে অসন্তুষ্ট হইয়া আছে।
যুদ্ধ হইলো, বুঝছো সাধু! বিশাল যুদ্ধ হইলো। আমার রাজ্য আর পাশের দুই রাজ্যের সমস্ত সৈন্যবাহিণীর সাথে যোগ দিলো আমার রাজ্যের প্রত্যেকটা লোক, এমনকি আমার সহচরীরাও, যারা এতোদিন আমার গুণগাণ গাইতো।
রাইগা গেলাম আমি। সেই সাথে নিজের ক্ষমতা দেখাইলাম। কতোটা রাইগা আছিলাম আমি, তোমারে বুঝাইতে পারমু না। কল্পনা করো সাধু, তিন রাজ্যের বিরুদ্ধে একজন মাত্র মেয়ে, একাই লইড়া যাইতেছে দুই হাতে তলোয়ার লইয়া। একের পর এক সৈন্য মারা যাইতেছে, কেউই টিকতে পারতেছে না।
একটা সময় শেষ হইলো যুদ্ধ। বেশীরভাগ মানুষ মারা গেলো, বাকিগো বেশীরভাগই পলাইয়া গেলো দূরের রাজ্যে। আর যারা তহনও আছিল তিন রাজ্যে, এক এক কইরা সবাইরেই মাইরা ফেললাম। ডাইনী না, পুরা পিশাচিণী হইয়া গেছিলাম। ক্রোধে দুই চোখে কিছুই দেখতেছিলাম না তখন।
ক্রোধ যহন কমলো, তাকাইয়া দেখলাম ধ্বংসযজ্ঞ। নিজের হাতে ধ্বংস করা তিনটা রাজ্য, হাজার হাজার মানুষের মরা দেহ দেইখা ঠিক থাকতে পারলাম না আমি। নিজের উপরেই ঘেন্না জন্মাইতে শুরু করলো আমার। চইলা আইলাম নিজের রাজ্য ছাইড়া, এইহানে আইসা বসতি বানাইলাম নিজের জন্য। অবশ্য এইহানে আসার সময় সাথে কইরা আমার যতো পুঁথি আছিল ক্ষমতা অর্জনের উপরে, সব নিয়া আইলাম। এইহানে, এই নিঞ্চলের গুহায় আইসা জীবন কাটাইতে লাগলাম আমি।”

*******
একটানা কথাগুলো বলে থামলো প্রাচী, তারপর তাকালো আমার দিকে।
“কতো বছর ধরে এখানে আছো তুমি?” অনেকক্ষণ পর প্রশ্ন করলাম আমি।
“কতো বছর হইবো, কি মনে হয় তোমার সাধু?”
“জানি না,” অসহায় ভঙ্গিতে নিজের মাথা নাড়লাম আমি।
“হাজার বছর। ঠিকঠাক হিসাব রাখিনাই আমি। ঠিকঠাক হিসাব করলে হাজার এক-দেড় শো বছর তো হইবোই। এর মধ্যেই ডাইনী রাণী প্রাচী থেইকা দেবী প্রাচীতে বদলাইয়া গেছি। মানুষ পারেও, বুঝলা? পিশাচিনীরে দেবী বানাইয়া পুজা করে!”
কৌতুক ঝড়লো তার কন্ঠে। চোখগুলো কেমন যেন জ্বল জ্বল করছে তার।
“অনেক রক্ত ঝড়িয়েছো তুমি,” নিজের মাথা নাড়লাম আমি, “কিন্তু তারপরও রক্তের প্রয়োজন পড়লো কেন তোমার?”
“খালি রক্ত না, হৃদপিন্ডও প্রয়োজন। আমার শরীর থেইকা সমস্ত ক্ষমতা তোমার শরীরে দেওয়ার লাইগা। চাইলে আমি নিজেই কেউ একজনরে মাইরা তার রক্ত আর হৃদপিন্ড জোগাড় করবার পারতাম, কিন্তু ঐটা কোন কামে আসতো না। আমার সাধণা অনুসারে, যার শরীরে আমি আমার ক্ষমতা দিমু, রক্ত আর হৃদপিন্ড তারেই সংগ্রহ করতে হইবো। আর সেই ক্ষমতার লোভ দেখাইয়াই তো তোমারে ডাইকা আনছি আমি, সাধু।”
“তুমি আমাকে ডেকে আনোনি প্রাচী,” পূর্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম আমি, “আমি নিজেই এখানে এসেছি। এবং এসেছি নিজের প্রয়োজনেই।”
“নিজের দরকারেই আসছো, কিন্তু তোমার এইখানে আসার পিছনে আমার হাত আছিল। কইবার গেলে, আমিই তোমারে টাইনা আনছি। টাইনা আনছি ক্ষমতার লোভ দেখাইয়া, অমরত্বের লোভ দেখাইয়া। আর এইসব ঐশ্বরিক ক্ষমতার লোভ যে সবচেয়ে বড় লোভ, এইটা তো মানবা?”
“তা মানছি,” দ্রুত মাথা নাড়লাম আমি, “কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আমাকে ক্ষমতা দিয়ে তোমার লাভ কি?”
“লাভ ক্ষতির হিসেব কি আর সব সময় করন যায়? অবশ্য আমার যে লাভ নাই, তাও কমু না। লাভ আছে।”
“কি লাভ?”
“মরবার চাই আমি,” বিষণ্ণ কন্ঠে বলে উঠে সে, “আর ভাল লাগেনা। বাঁইচা থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত। আর বাঁচার স্বাধ নাই আমার, বুঝলা? ঘুম দরকার আমার, জন্মের ঘুম! ক্ষমতার লোভে পড়ছিলাম, ক্ষমতা পাইছিলাম, ক্ষমতা দেখাইছিলাম, নিজের ক্ষমতার উপরে ঘেন্না ধইরা গেছিল। আর এখন? নিজের জীবনের উপরেই ঘেন্না ধইরা গেছে। মরবার চাই আমি সাধু। আর তা করবার চাইলে নিজের আয়ু আরেকজনরে দিয়া যাইতে হইবো। আমার সব ক্ষমতা আমি তোমারে দিয়া যামু। তুমিই আমার সব ক্ষমতার যোগ্য, আর তা তুমি প্রমাণও করছো। তোমারে আমার সব ক্ষমতা দিয়া চিরনিদ্রায় যাইবার চাই আমি।”
“অদ্ভুত,” স্বগোক্তি করলাম আমি, “একজন আমি, যে চায় পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা অর্জন করতে। আর একজন তুমি, যে চায় পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতাকে বিসর্জন দিতে। পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত।”
“সত্যিই কইছো সাধু,” আমার দিকে একটু ঝুঁকে আসে প্রাচী, “দুনিয়াটা বড়ই আজব!”
“তোমার কাছে কি যেন একটা শপথ করতে হবে বলেছিলে না? কি সেটা?”
“ওহ! আরেকটু হইলে ভুইলাই যাইতাম। আমার কাছে তোমার শপথ করতে হইবো, আমি যে ভুলটা করছি ক্ষমতা পাইয়া, সেইটা করবা না তুমি। ক্রোধের বসে তিন-তিনটা রাজ্য ধ্বংস কইরা ফালাইছিলাম আমি। আমি চাই না আবারও এমন কিছু ঘটুক। তুমি ক্ষমতা পাইবা, ক্ষমতার ব্যবহার কইরা নিজের উন্নতিও করতে পারবা। কিন্তু সেই ক্ষমতার খারাপ ব্যবহার ততক্ষণ পর্যন্ত করতে পারবা না, যতোক্ষণ না তোমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে। কি সাধু? শপথ করতে পারবা? রাখতে পারবা আমার কথা?”
বেশ কিছুক্ষণ ভাবলাম আমি। তারপর উত্তর দিলাম, “পারবো। অবশ্যই পারবো তোমার কথা রাখতে। আমি শপথ করছি।”
একটা গুমোট নিরবতা নেমে আসে পুরো গুহায়। একটা অদ্ভুত নিরবতা যেন গ্রাস করেছে আমাদেরকে। কোন এক ঘোরের মাঝে যেন পড়ে গেছি আমি।
বেশ কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে তাকায় প্রাচী, নিচ থেকে পাত্র দুটো তুলে নিজের কোলের উপর রাখে, তারপর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেগুলোর দিকে।
“আচ্ছা,” হঠাত করেই জিজ্ঞেস করি আমি, “তুমি তো আমাদের প্রচলিত দেবদেবীতে বিশ্বাস করো না, তাই না? ইশ্বরে বিশ্বাস করো কি?”
মায়াময় চোখে আমার দিকে তাকায় সে। এক মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেছে, তারপর মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হয় তার কন্ঠ। রিনরিনে আওয়াজে কথা বলে সে।
“ঈশ্বর আছেন সাধু। ঈশ্বর অবশ্যই আছেন। তিনিই আমাগোরে সৃষ্টি করছেন, আমাগোর জন্যে এই দুনিয়া বানাইছেন। কিন্তু সমস্যাটা কি জানো? আমরা কেউই তারে চিনি না, আর তিনিও আমাগোরে খোলা ছাইড়া দিয়া মজা দেখতেছেন। দুনিয়াটা একটা মজার জিনিস, যার মজা তিনি একাই লুটতেছেন। আর আমরা তার মজার খোরাক জোগাড় করতেছি দিন রাইত।”

*******
নির্দিষ্ট সময়েই পৌছে গেলাম সেই সরাইখানায়, যেখানে ঘোড়া দুটোকে রেখে গিয়েছিলাম আমরা। অবশ্য এখন আর সাথে যুবরাজ শুহাংশু নেই, আমি একাই। সরাইখানার পাওনা মিটিয়ে ঘোড়াগুলো ছাড়িয়ে নিলাম আমি, তারপর পথ ধরলাম নহৃংশুদাবাদের দিকে।
প্রাচী তার সমস্ত ক্ষমতা আমাকে দান করে দিয়েছে। সেই সাথে তার বাসস্থানও আমাকে ছেড়ে দিয়ে চিরনিদ্রার দেশে চলে গেছে। অবশ্য যাবার আগে কোন পুঁথিতে কি কি আছে, কিংবা কোন যন্ত্রের কি কি কাজ, সেগুলো আমাকে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। যেন পরবর্তীতে যে কোন সময় ইচ্ছে করলে তার সাধণাকে টেনে নিয়ে যেতে পারি আমি।
নহৃংশুদাবাদের সীমান্তে পৌছতেই অভাবনীয় শুভেচ্ছা পেলাম আমি। সীমান্তেই কংনুমরাদের সেনাপতি অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। প্রচন্ড খুশী দেখাচ্ছিল তাকে। তার সাথেই একত্রে যাত্রা করলাম নহৃংশুদাবাদের দিকে।
যেতে যেতে এদিকের পরিস্থিতি বর্ণনা করলো সেনাপতি। যুবরাজকে আমি সরিয়ে নেবার পর নহৃংশুদাবাদে আর কেউ ছিল না আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। মহামন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সাহায্যেই জয় সম্ভব হয়েছে। এদিকে প্রাক্তন সেনাপতির প্রাণদন্ড এবং বর্তমান সেনাপতির অনুপস্থিতিতে যুদ্ধে যায়নি নহৃংশুদাবাদের সৈন্যরা, দিশেহারা হয়ে পড়েছিল।
শান্তিপূর্ণভাবেই রাজাকে বন্দী করা হয়েছিল। বন্দী অবস্থাতেই মারা গেছেন তিনি। অবশ্য এরপর নহৃংশুদাবাদের মহামন্ত্রী নিজের অংশ নিয়ে ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। মহামন্ত্রীকে তার প্রতিশ্রুত এক তৃতীয়াংশ দেবার চিন্তাভাবনা চলছিল, এমতাবস্থায় সে দুই-তৃতীয়াংশ দাবী করে বসে। এই লোভই তার প্রাণনাশের জন্য দায়ী হয়েছে।
অবশ্য সেনাপতির কথা আমার মনে ধরলো না। নহৃংশুদাবাদের মহামন্ত্রী ধুরন্ধর ছিলো, কিন্তু নিজের বুঝ বোঝার মতো ক্ষমতা ছিল তার ভেতর। অবস্থা দেখেই ভবিষ্যৎ আঁচ করার একটা অদ্ভুত শক্তি ছিল তার ভেতর। তার পক্ষে আর যাই হোক, এই রকম পরিস্থিতিতে দুই-তৃতীয়াংশ দাবী করার বিষয়টা মানায় না। এ কারণেই নিজের অজান্তেই মনের ভেতর একটা খটকা লেগে রইলো আমার।
দু’দিনের মাথায় নহৃংশুদাবাদের রাজপ্রাসাদে পৌছলাম আমরা। সেখানে আরো বড় করে আমাকে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পিতা নিজে উপস্থিত ছিলেন সেখানে। আগেই খবর পাঠানো হয়েছিল তার কাছে। তার সাথে শৌনও উপস্থিত হলো আমাকে অভ্যর্থনা দিতে।
জমকালো উৎসব হলো পুরো রাজ্য জুড়ে। যদিও এভাবে আক্রমণ করে নহৃংশুদাবাদ জয় করার ব্যাপারটা এই রাজ্যের বেশীরভাগ জনগণই মেনে নিতে পারেনি, তবুও পিতার আদেশে উৎসবে যোগ দিলো তারা। ঠিক এক সপ্তাহ পর শৌনের হাতে নহৃংশুদাবাদের দায়িত্ব অর্পণ করে কংনুমরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম আমরা।

*******
পনেরোদিন পর
হঠাত করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো আমার। চারদিকে তাকিয়ে অবাক হলাম আমি, বুঝতে পারলাম না ঘুম ভাঙ্গার কারণ।
অবশ্য একটু পরেই একটা জোড়ালো শব্দ কানে প্রবেশ করতেই আসল কারণটা জানা গেলো। দ্রুত ঘুরে সেদিকে তাকালাম আমি। যা দেখতে পেলাম, তাতে ভ্রু কিছুটা কুঁচকে গেলো আমার।
কামরার দরজার কাছে বেশ কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে, পুরো দেহ যুদ্ধ সাজে সজ্জিত। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে শৌন। দ্রুত এগিয়ে এলো তারা আমার দিকে।
“কি হয়েছে শৌন?” দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম আমি, “হঠাত তুমি কংনুমরায় যে?”
“কংনুমরা আক্রান্ত হয়েছে যুবরাজ শুভঙ্কর,” শৌনের আগেই তার পাশ থেকে বলে উঠলো এক সৈনিক, “রাজামশাইকে হত্যা করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। একে একে রাজ প্রাসাদের প্রায় সবাইকেই খুন করা হচ্ছে।”
“মানে কি?” খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, “কে আক্রমণ করেছে?”
সহসা কোন উত্তর বেরোলো না কারো মুখ থেকে। এদিকে আমার একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে শৌন। স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি, চোখ দুটো জ্বলছে তার।
“পিতাসহ রাজপ্রাসাদের সবাইকে হত্যা করার জন্য তোমাকে আটক করা হচ্ছে শুভঙ্কর,” ক্রোড়কন্ঠে বলে উঠলো শৌন।
“কি বলছো এসব?” আগের চেয়েও জোড়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি, “কে বলেছে এসব তোমাকে? আমি কেন পিতাকে হত্যা করতে যাবো?”
“কারণ, ছোটবেলা থেকেই নহৃংশুদাবাদে বেড়ে উঠেছো তুমি। তোমার মনের এক কোণায় এখনো নহৃংশুদাবাদের জন্য ভালোবাসা কাজ করে। আর আমরা, মানে কংনুমরার বাসিন্দারা কৌশলে জিতে নিয়েছি নহৃংশুদাবাদ, সেটা সহ্য করতে পারছো না তুমি। অথবা, প্রতিযোগিতা থেকে আমাকে সরাতে চাইছো। প্রথমে পিতাকে হত্যা করেছো, তারপর আমাকেও হত্যা করতে তুমি। এবং সেই সাথে দখল করে নিতে কংনুমরা ও নহৃংশুদাবাদ। ভালই চাল চেলেছিলে শুভঙ্কর।”
একেবারেই চুপ হয়ে গেলাম আমি। পুরো ছকটাই আমার মাথায় ঢুকে গেছে। একেবারেই শীতল গলায় বলে উঠলাম, “ভালই চাল চেলেছো শৌন। আমাকে জব্বরভাবে মাত করেছো। চুপচাপ আমাকে মেরে ফেলে সব দায় আমার উপর দিলে কেউ কিচ্ছুটি বলতে পারবে না তোমাকে। সত্যিই, খুব ভাল বুদ্ধি করেছো।”
“ধন্যবাদ,” মৃদু হেসে উঠলো সে। তার হাসিতে যোগ দিলো তার সঙ্গের সব সৈন্য।
“তবে কি,” আগের চেয়েও শীতল গলায় আবারও বলে উঠলাম আমি, “তোমার সাধ কখনোই পূর্ণ হবে না। কৌশলে জেতা খুবই সহজ, কিন্তু সামনা সামনি দাঁড়িয়ে জেতাটা খুবই কঠিন। এবং তুমি এখন আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছো, বোকার মতো। যদি জানতে আমি আসলে কি, তাহলে অন্তত এই ভুলটা কখনোই করতে না।”
থমকে দাঁড়ালো শৌন, বাকি সবার মুখের হাসিও হঠাত করেই থেমে গেলো। অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখলো আমাকে ওরা। তারপর হঠাত করেই আতংক দেখা দিলো ওদের চেহারায়।
আমিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি, একটা প্রচন্ড অমানসিক ক্রোধ গলা বেয়ে উঠে আসতে চাচ্ছে আমার। সেই সাথে পরিবর্তন ঘটছে আমার ভেতর। বাহ্যিক পরিবর্তন নয়, নয় শারীরিক পরিবর্তনও। এটা অন্য ধরণের পরিবর্তন। অমানসিক পরিবর্তন।
“আমি খুবই দুঃখিত প্রাচী,” মনে মনে বলে উঠলাম, “আমার পিঠটা দেয়ালে গিয়ে ঠেকে গেছে।”

(
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×