somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্য আর্টিস্ট (ফ্ল্যাশ ফিকশন)

১৪ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অন্ধকার, কালো নিকষ অন্ধকারে ঢেকে আছে পৃথিবী। কোথাও একটুও আলোর দেখা নেই। অমাবস্যা নাকি আজকে?

ছোট্ট জানালাটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। মনের ভেতর আশা, একটুখানি আলোর দেখা পাবো। বেশী না, এই এইটুকু। খুবই সামান্য আলো প্রয়োজন। শুধুমাত্র দেয়ালের গায়ে একটু আলো প্রয়োজন, যাতে কাজটাকে শেষ করতে পারি আমি।

একটু আগেও বেশ আলো ছিল এখানে। হঠাত করেই লোডশেডিং হওয়ায় কিছুই চোখে পড়ছে না এখন। ম্যাচের কাঠিও শেষ। এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। কাজটা খুব দ্রুত শেষ করতে হবে। যতোই দেরী হবে, কাজটা অসমাপ্ত থেকে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, ঠিক আমার আগের করা সব কাজের মতোই।

হতাশায় ছেয়ে আছে মন, এদিকে শরীরের সব শক্তি যেন ধীরে ধীরে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হতাশার পরিমাণ যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে।

মনে মনে খেঁকিয়ে উঠলাম। অন্তরের ভেতর থেকে দেশের যাবতীয় রাজনীবিদদের উদ্দেশ্যে আন্তরিক খিস্তি বেড়িয়ে আসছে সমানে। শালারা একটা দেশের দায়িত্বে আছে এতো বছর ধরে, অথচ সামান্য সমস্যার সমাধানও করতে পারে না। জোচ্চোর সব কটা। বাল ফেলে নাকি বসে বসে?

কোনমতে হাতড়ে হাতড়ে বিছানার উপর গিয়ে বসলাম। গরমে অবস্থা সাইজ হয়ে গেছে, দরদর করে ঘাম বেরুচ্ছে শরীর থেকে। সামান্য বাতাসের প্রবাহও নেই কোথাও। অবশ্য বাতাসের চেয়েও এখন আমার বেশী প্রয়োজন একটু আলো। একটুখানি আলোর বড়ই প্রয়োজন আমার, এবং সেটা এখনই।

*******
আমি ধ্রুব, পেশায় একজন ছাত্র। এমবিএ করছি একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওহ, ভুল হলো। এমবিএ'তে পড়তাম। এখন আর পড়িনা। কারণ, গত দুই বছর যাবত বন্দী আছি আমি এই দশ ফুট বাই ছয় ফুট আয়তক্ষেত্রের মাপে তৈরী বন্ধীশালায়।

খুনের আসামী আমি। মোট আটত্রিশটা খুনের দায়ে এখানে পাঠানো হয়েছে আমাকে। যদিও এখনো কোনটারই রায় হয়নি, কিন্তু তবুও জজ সাহেবের বিশেষ নির্দেশে রাখা হয়েছে এই বিশেষ সেলে। জজ সাহেব, বাদী পক্ষগুলোর উকিল, সংবাদকর্মী- এক কথায় সারা দেশের মানুষের ভাষ্যমতে, "বড়ই বিপদজনক ধরণের সিরিয়াল কিলার" আমি। যদিও আমার জানামতে সামান্য কোন প্রাণীকেও খুন করিনি কখনো।

আমার জানামতে আমার দোষ ছিল একটাই, মানুষের ছবি আঁকা। খুব ভাল ছবি আঁকতে পারতাম, এটাই ছিল আমার প্যাশন। যদিও আমার পরিবার কখনোই কোন গুরুত্ব দেয়নি এই প্যাশনের প্রতি।

চারুকলায় ভর্তি হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আব্বার কথাকে অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগই হয়নি কখনো। তাঁর কথায় ভর্তি হতে হয়েছিল আমাকে বিবিএ'তে। বিবিএ শেষ করে এমবিএ। আমার আব্বার ভাষ্যমতে আমার সামনে ছিল "উজ্জ্বল ভবিষ্যত"। কিন্তু সেই তথাকথিত "উজ্জ্বল ভবিষ্যত" কখনোই আমাকে আগ্রহী করতে পারেনি। আমার ধ্যানজ্ঞান সবকিছুই ছিল আমার তৈরী করা ছবির প্রতি।

প্রতিদিন ভার্সিটি যাওয়া আসার পথে বিভিন্ন মানুষ দেখতে পেতাম আমি। খুবই মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম মানুষের হাটাচলা, শরীরের ভাবভঙ্গি। তারপর সেগুলোকে আমার স্কেচবুকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম। পরে অবশ্য ক্যানভাস ব্যবহার করতাম। একেবারেই নিখুঁত করার চেষ্টা করতাম আমি, কিন্তু কোন এক অজানা কারণে সেগুলো কখনোই নিখুঁত হতো না। কিছু না কিছু খুঁত থেকেই যেতো।

আজ পর্যন্ত কোন ছবিই শেষ করতে পারিনি আমি। আমার আঁকা প্রত্যেকটা ছবিই ছিল অসমাপ্ত। হয়তো দেখা যেতো রাস্তায় দেখা কোন একজন মানুষকে আঁকছি আমি। আঁকতে আঁকতে একটা সময় বিরক্ত হয়ে যেতাম। ফেলে রেখে দিতাম অসমাপ্ত ছবি। অথচ সেই ছবিগুলোই মানুষের কাছে কেন যেন ভাল লাগতো। অসাধারণ কিছু ছিল না সেগুলো, তবে সবাই অনেকেই পছন্দ করতো।

তখন সবেমাত্র এমবিএ'তে এডমিশন নিয়েছি আমি। এমন সময় আমাদের ভার্সিটিরই এক ম্যাম কিভাবে যেন জেনে গেলেন আমার ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁকের কথা। একদিন তার রুমে ডাকলেন, দেখতে চাইলেন আমার আঁকা ছবিগুলো। ছবিগুলো দেখে সে কি উচ্ছ্বাস তার!

"তুমি যে একটা জিনিয়াস," ছবিগুলো থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না মানসুরা ম্যাম, "তা কি তুমি জানো?"

জবাব দিতে পারিনি আমি। শুধু লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার আঁকা ছবির প্রশংসা করেছিলেন অনেকেই, কিন্তু এভাবে কেউ কখনো এতোটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি।

"তুমি কি জানো তোমার ছবিগুলো তোমাকে কতটুকু উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে?" আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবারও প্রশ্ন করেছিলেন তিনি, "তোমার নিজের ভেতর কি আছে, সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো?

"কিন্তু ম্যাম," ধীরে ধীরে, অনেক কষ্টে উচ্চারণ করেছিলাম আমি, "যে ছবিগুলো আপনাকে দিয়েছি আমি, প্রত্যেকটাই তো অসম্পূর্ণ।"

"মানে কি?" থতমত খেয়ে গেছিলেন তিনি, "এগুলো একটাও সম্পূর্ণ নয়?"

"না ম্যাম। আমি আজ পর্যন্তও কোন ছবিই শেষ করতে পারিনি। একটা সময় এসে ছবিগুলোর প্রতি বিরক্তি ধরে যায়। প্রত্যেকটা ছবিই অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছি আমি।"

"আমার কাছে তো তা মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে যে এই অসমাপ্ত ছবি আঁকাটা তোমার একটা চালাকী। তোমাকে কি কেউ কখনো বলেছে যে প্রত্যেকটা সম্পূর্ণ ছবির তুলনায় অসমাপ্ত ছবিগুলোই মানুষকে আকর্ষণ করে সবচেয়ে বেশী? তুমি বলছো তোমার প্রত্যেকটা ছবিই অসমাপ্ত, অথচ প্রত্যেকটা ছবিই আমার কাছে চমৎকার লেগেছে। অসমাপ্ত ছবিগুলোর মাঝে একটা রহস্য কাজ করে। অনেক বিখ্যাত চিত্রকরই নিজেদের ছবিগুলোকে অসম্পূর্ণ করে রেখেছেন। এতে করে তাদের অন্যান্য ছবির তুলনায় সেগুলোরই আকর্ষণ মানুষের কাছে বেশী।"

এবারও চুপ করে রইলাম আমি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও ছবিগুলোর দিকে মনোযোগ দিলেন মানসুরা ম্যাম। অনেকক্ষণ পর মুখ তুললেন।

"তুমি এক কাজ করছো না কেন? একটা এক্সিবিশনের ব্যবস্থা করো। সেখানে তোমার আঁকা ছবিগুলো সবার সামনে প্রকাশ করো। দেখবে সারা পৃথিবী তোমার কদর করবে।"

"কিন্তু ম্যাম," ঘাবড়ে গেলাম আমি, "এক্সিবিশন করতে অনেক টাকা প্রয়োজন। এছাড়া, আমার মতো নবিশের আঁকা ছবি দেখতে কেই বা আসবে?"

"সব বিখ্যাত চিত্রকরই এক সময় অপরিচিত ছিলেন," মৃদু হেসে সাহস যোগালেন তিনি, "তারাও যদি তোমার মতো চিন্তা করতেন, তাহলে আজকের পৃথিবী অনেক ট্যালেন্ট চিত্রকরকে হারাতো। আজকে পর্যন্ত যেসব ছবি দেখে আমরা অবাক হই সেগুলোর বেশীরভাগই হয়তো আমাদের নজরে আসতো না যদি সেগুলো কেউ প্রকাশ না করতো। বুঝতে পেরেছো?"

"হুম। কিন্তু এক্সিবিশন করার তো একশো একটা ঝামেলা। অনেক টাকার ব্যাপার।"

"এটা কোন সমস্যাই নয়। আমাদের ভার্সিটির একজন ছাত্রের এক্সিবিশন হবে, আর আমরা হাত-পা গুটিয়ে নেবো, তা কি হয় নাকি?"

সত্যিই, ভার্সিটির কেউই হাত পা গুটিয়ে নেননি। বরং সবাই নিজেদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে সাহায্য করেছেন। আমার আঁকা ছবিগুলোকে সবার সামনে আনার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাদের সবাইকে। এবং এই কাজে সবাইকে একত্র করা থেকে কাজটা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করা- পুরো ক্রেডিটই দিতে হয় মানসুরা ম্যামকে। তিনি না থাকলে এসব কখনোই হতো না। অবশ্য আরেকজনও প্রচুর খেটেছিল। আমার গার্লফ্রেন্ড, লুবনা।

প্রথম দফায় তেইশটা ছবি প্রকাশ করা হয়। তিন দিনের এক্সিবিশন ছিল। এক্সিবিশন শেষে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার আশেপাশের সবাই যেন কেমন করে বদলে গেছে। আমার পুরো পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেছে। এমনকি আমার আব্বাও। যিনি সারাজীবন আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তায় তটস্থ থাকতেন, তিনি পর্যন্ত গর্ব করে আমাদের সব আত্নীয়-স্বজন এবং পরিচিত সবাইকেই বলে বেড়াতে লাগলেন এক্সিবিশনের কথা।

প্রথম এক্সিবিশনের এক মাস পর আরো একটা এক্সিবিশনের ব্যবস্থা করা হয়। আগের তেইশটার সাথে যোগ হয় আমার আরো পনেরোটা ছবি। সবাই প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন। সবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ চেহারা দেখে নিজের ভেতরে কেমন একটা অদ্ভুত মনোভাব হওয়া শুরু করেছিল আমার। স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম, নিজের চারপাশের মানুষগুলোর মতো বদলে যাচ্ছি আমি নিজেও। তখনও যদি আমার পরিণতি সম্পর্কে বিন্দমাত্র আভাষ পেতাম, হয়তো এতোটা খুশী হতে পারতাম না। হয়তো আদৌ খুশী হতে পারতাম না।

দ্বিতীয় এক্সিবিশনের এক সপ্তাহ পর হঠাত করেই আমার বাসায় এসে হাজির হলো একদল পুলিশ। আমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এরেষ্ট করলো তারা। কুকুরের মতো টেনে হেঁচড়ে তুললো পুলিশ ভ্যানে, তারপর সেখান থেকে থানায়। তখনও পর্যন্ত নিজের কৃত অপরাধ সম্পর্কে অজ্ঞাত আমি।

থানায় আনার পরেও আমাকে কোনকিছু বলার বা জানার সুযোগ দিলো না তারা। প্রথমেই একটা সেলে নিয়ে পেটাতে শুরু করলো ইচ্ছেমতো। আধ ঘন্টা অমানসিকভাবে পিটিয়ে ক্ষান্ত দিলো তারা। ততোক্ষণে আমার শরীরের সকল শক্তি শুষে নেওয়া হয়েছে।

ঘন্টা দুই পর আবারও এলো তারা। তখনই প্রথমবারের মতো জানতে পারলাম আমার অপরাধ সম্পর্কে।

"আহমেদ সাহেবকে কিভাবে খুন করেছিস? কেন?"
"শাহরীন সুলতানার সাথে তোর কি কোন শত্রুতা ছিল? নাকি নেহাত নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য খুন করেছিস?"
"ব্যারিষ্টার আলম মাকসুদকে খুন করলি কেন?"
"কায়সার মাহমুদকে চিনতি কতোদিন ধরে? ম্যাগনিটিউট কোচিংয়ের টীচার কায়সার মাহমুদ- কেন খুন করেছিস তাকে?"
"এই আটত্রিশজন ছাড়াও আরো কোন খুন করেছিস?"

অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। একের পর এক প্রশ্ন করে গেলো তারা। যদিও প্রশ্নের উত্তরগুলো জানা ছিল না আমার। অবশ্য জানলেই বা কি, না জানলেই বা কি। তারা ধরেই নিয়েছিল কাজগুলো আমার নিজের করা। তাই একই প্রশ্ন বার বার করে যাচ্ছিল তারা।

কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারিনি আমি। কোনভাবেই আমার মুখ থেকে কোন কথা বের করতে না পেরে ক্ষেপে উঠেছিল তারা। আবারও শুরু হলো টর্চার। সেই ভয়াবহ টর্চার সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালাম আমি।

আমার যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন বাইরে গভীর রাত। টিমটিমে একটা হলুদ বাল্বের মৃদু আলোতে আবছা আবছাভাবে রুমটা দেখা যাচ্ছিল। অথর্বের মতো টেবিলের উপর পরে ছিলাম আমি, হাত পা বাঁধা অবস্থায়। সারা শরীরে যেন সাগরের ঢেউয়ের মতো তরঙ্গ প্রবাহ চলছিল সর্বক্ষণ, ব্যথার ঢেউ গ্রাস করে নিতে চাচ্ছিল আমার সচেতনতাকে।

তখনও পর্যন্ত জানতাম না সেলের বাইরে দাঁড়িয়েছিল আমার পুরো পরিবার। অপেক্ষা করছিল আমার জ্ঞান ফেরার।

সচেতন আর অসচেতনতার মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলাম আমি তখন। শরীরের প্রত্যেকটা কোষের ব্যাথা অনুভব করতে পারলেও পারিপার্শ্বিক বিষয় সম্পর্কে কোন সচেতনতাই ছিল না আমার। আশেপাশে কি হচ্ছে বা কে কি বলছে, সেসব কানেই ঢুকছিল না যেন।

পরের কয়েকটা দিন যে কি অসহ্যভাবে কেটেছে আমার তা বলার বাইরে। তিনদিনের মাথায় কোর্টে চালান করা হয় আমাকে। জজের সামনে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছিলাম না আমি। আমার পরিবার একজন উকিল রেখেছিল আমার জন্য, সে আমার হয়ে জামিন চেয়েছিল জজের কাছে।

অপরাধ ঘোরতর। একটা নয় দুটো নয়- মোট আটত্রিশটা খুন! জামিন নামঞ্জর করে জেলখানায় পাঠানো হয় আমাকে।

কোর্ট থেকে বেরুতেই এক ঝাঁক সাংবাদিক ঘিরে ধরে আমাকে। একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। অবশ্য সব প্রশ্নই আমার জানা, অজানা ছিল শুধু উত্তরগুলো।

যতোই সময় যেতে লাগলো, ব্যাপারটা ধীরে ধীরে বুঝে আসলো আমার। সমস্যাটা আসলে আমার আঁকা ছবিগুলোর মাঝে। আমি যেসব ছবি এঁকেছিলাম, মানে যাদের ছবি এঁকেছিলাম, তারা কেউই বেঁচে নেই। প্রত্যেকটা ছবি আঁকা শুরু করার দিনের তারিখটা ক্যানভাসের নিচে লিখে রেখেছিলাম। এবং অবাক করা বিষয় হলো, ঠিক সেই তারিখগুলোতেই মারা গেছে তারা।

বিষয়টা আমাকে চমকে দিলেও কিছুই করার ছিল না আমার। এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। কোন ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারিনি। যতোই দিন যাচ্ছিল, নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছিলাম আমি।

সবচেয়ে যে বিষয়টা চমকে দিয়েছিল আমাকে, সেটা হচ্ছে একটা ছায়া। জেলখানায় যাবার পর বেশ কয়েকবার রিমান্ডে নেওয়া হয় আমাকে। সেখানেই আমার নিজের আঁকা ছবিগুলো বার বার দেখানো হয়। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, সব ছবিতেই নিজের অজান্তেই একটা ছায়া এঁকেছিলাম। খুবই সুক্ষ্ণ, বেশ মনোযোগ না দিলে কখনোই বোঝা যাবে না এমন। ছায়াটা কার, সেটা আবিষ্কার করে থ হয়ে গেছিলাম। কারণ, ছায়াটা আর কারো নয়, আমার নিজের।

*******
হঠাত করেই একটা হলুদ আলো যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিলো আমার। বিদ্যুত এসেছে, এবং এতোক্ষণে অন্ধকারে থাকার কারণেই এই মৃদু আলোই চোখের বারোটা বাজিয়ে দিতে চাচ্ছে যেন।

কিছুক্ষণ পর আলোতে চোখটা সয়ে এলে আবারও উঠে দাঁড়ালাম। গিয়ে দাঁড়ালাম দেয়ালের সামনে। কাজটা শেষ করা প্রয়োজন।

মেঝে থেকে মোমের ছোট্ট টুকরোটা তুলে নিলাম আমি। বিভিন্ন রঙের মোম দিয়ে শুরু করেছিলাম কাজটা, সবগুলোই শেষ হয়ে গিয়েছে। শুধু এই টুকরোটাই আছে এখন অবশিষ্ট। সেটা দিয়েই দেয়ালের গায়ে আঁচড় কাটতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে একটা চেহারা। অবশ্য জানি, বেশীক্ষণ আর আঁকতে পারবো না। শরীরের শক্তি প্রায় ফুরিয়ে আসছে আমার।

চেহারাটাকে ফুটিয়ে তোলা শেষ করতেই মোমটা নিঃশেষ হয়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলাম আমি। যা ভেবেছিলাম, ফাইনাল টাচ দিতে হবে অন্য জিনিস দিয়ে। এবং সেই জিনিসটা আছে আমার কাছে। এতোক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে জমা করেছি আমি জিনিসটা।

ধীরে ধীরে মেঝের দিকে ঝুঁকে গেলাম আমি। মেঝের একটা পাশ একেবারেই ভিজে আছে। ভিজে থাকবেই না বা কেন? ছবি আঁকা শুরু করার আগেই নিজের বা'হাতের শিরাটাকে দাঁতে কেটে সুক্ষ্ণভাবে ছিড়ে ফেলেছিলাম আমি। খুবই ছোট্ট একটা ফুটো, খুবই ধীরে ধীরে পড়ছিল রক্ত। অবশ্য কিছুক্ষণ পর পরই জমাট বেঁধে যাচ্ছিল রক্ত, শিরা দিয়ে বের হতে চাচ্ছিল না। তখন আবারও দাঁত দিয়ে সুক্ষ্ণভাবে কেটে নিতে হচ্ছিল খুবই ধীরে ধীরে নিরবচ্ছিন্নভাবে রক্ত পড়ার জন্য। ডানহাতে ছবি এঁকেছি, আর বা'হাতটা মেঝের ঐ নির্দিষ্ট জায়গা বরাবর রেখেছি যাতে রক্তের ফোটাগুলো এক জায়গায় জড়ো হতে পারে।

রক্তগুলো প্রায় জমাট বেঁধে গেছে। প্রায় জমাট বাঁধা রক্তগুলো দিয়ে ডানহাতটাকে ভিজিয়ে নিলাম আমি। তারপর আবারও লেগে পড়লাম কাজে। আর বেশীক্ষণ টিকবো না জানি, তাই দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন কাজটা।

পরিশিষ্টঃ খবরটা শুনে চমকে যায় সারা দেশের মানুষ, অবশ্য চমকানোরই কথা। ধ্রুবের মৃত্যুটা সবারই কাম্য ছিল। আটত্রিশটা খুনের আসামীর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই। চমকানোর কারণটা ছিল ভিন্ন।

নিজের সেলের দেয়ালে একটা ছবি এঁকেছিল ধ্রুব। সেই ছবিটার নিচেই পাওয়া যায় তার লাশ। ছবিটা কার, সেটার খোঁজ নিতেই অবাক হয়ে গেলো সবাই।

ছবিটা ছিল ধ্রুবের গার্লফ্রেন্ড লুবনার, যে কি না প্রায় একই সময়ে খুন হয়েছিল।
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×