somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাইয়িদ রফিকুল হক
আমি মানুষ। আমি ত্বরীকতপন্থী-মুসলমান। আমি মানুষ বলে আমার ভুলত্রুটি হতেই পারে। বইপড়তে আমার ভালো লাগে। সাহিত্য ভালোবাসি। লেখালেখি আমার খুব শখের বিষয়। বাংলাদেশরাষ্ট্র ও গণমানুষের জন্য আমি লেখনিশক্তিধারণ করেছি।

গল্প: চব্বিশ-পঁচিশ বছরের কবিতা

১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গল্প:
চব্বিশ-পঁচিশ বছরের কবিতা

সাইয়িদ রফিকুল হক

কাচের দরজাটা ডানহাতে একটুখানি ঠেলে মিহির উঁকি দিয়ে ভিতরের লোকটিকে বললো, “ভাই, একটু ভিতরে আসবো?”
লোকটি এতে ভিতরে-ভিতরে খুব বিরক্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু ভিতরের সবটা তো আর বাইরে প্রকাশ করা চলে না। তাই, সে জোর করে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলো। আর ভ্রুকুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “এখন?”
“জ্বি, এখন।” মিহির খুব বলিষ্ঠভাবে কথাটা বললো।
মিহিরকে দেখে লোকটি এমন একটা ভাব করলো যেন তার হাতে কত কাজ! এইসময় সে টেবিলের কাগজপত্র হাতড়ে ব্যস্ততার ভানও করলো।
তবুও মিহির হাল ছাড়ে না। সে তাকিয়ে রইলো লোকটির দিকে।
আর সে দরজাটাকে এখনও ঠেলে অর্ধফাঁক অবস্থায় রেখে দিয়েছে। এছাড়া আজ তার কোনো গত্যন্তর নেই।
শেষমেশ লোকটি কিছুক্ষণ পরে মনভার করে বললো, “আসুন। আসুন। কিন্তু আপনাকে বেশি সময় দিতে পারবো না।”
মিহির ভিতরে ঢুকে পড়লো।
লোকটি সামান্য ভদ্রতার খাতিরে হাততুলে পিছনের দিকের একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বললো।
মিহির কোনোরকম ভনিতা না-করে বললো, “নাসির ভাই, আমার কবিতা কি ছাপা হবে না?”
নাসির আগের মতো মনভার করে বলে, “ছাপা হবে না―তাতো বলিনি। তবে আপনার লেখার চেয়ে যদি ভালো কোনো কবিতা পাই―আমরা তো সেগুলো আগে ছাপাবো। কী বলেন?”
মিহির তার কথার কোনো জবাব না-দিয়ে বললো, “আমার কবিতার ছন্দ, অলংকার, ভাবসম্পদ, বিষয়বৈচিত্র্য সবই তো ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে। আপনি তা বলেছেন। কিন্তু আমাকে তা তো দেখতে হবে। এই দৈনিক পুবের আলো পত্রিকা কি এমনি-এমনি আমাকে এখানকার সাহিত্যসম্পাদক নিযুক্ত করে রেখেছ? নাকি আমি তৈলের জোরে এখানে এসেছি?”
মিহির বললো, “না। আমি তা তো বলিনি। তবে গতসপ্তাহে আপনাদের সাহিত্যপাতায় দেখলাম, কোনো কবিতাই হয়নি―তাও খুব ঘটা করে ছেপেছেন!”
নাসির খন্দকার এবার রেগে গিয়ে বললো, “দ্যাখেন ভাই, কোনটা কবিতা হয়েছে আর না-হয়েছে তা কি আপনি দেখবেন? নাকি তা আমাকে শেখাবেন? তাইলে তো আপনি কোনো সাহিত্যসম্পাদক হয়ে যেতেন!”
শেষের কথাটি যে নাসির তাকে বিদ্রুপ করে বলেছে, তা বুঝতে মিহিরের বাকি রইলো না। তবুও সে ভদ্রতা বজায় রেখে তা হজম করলো।
মিহির বললো, “না। আমি তো এই লাইনে এতদিন চেষ্টা করিনি। আমি তো বড় একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে রয়েছি। এতে আমি সন্তুষ্ট। কোনো পত্রিকায় আমার কাজ করার ইচ্ছে নেই।”
“তবে সেখানেই থাকেন। আপনাদের মাথায় যে কেন হঠাৎ কবিতা-লেখার ভূত চেপেছে! এসব কিছুতেই বুঝতে পারি না!” কথাগুলো বলে নাসির বিজ্ঞের মতো একটু হাসার চেষ্টা করলো।
এবার মিহির সহ্য করতে না-পেরে বললো, “আরে ভাই, আপনি কবিতা ছাপালে ছাপাবেন। আর না-ছাপালে না-ছাপাবেন। তাই বলে আমার কবিতা ও কবিতা-লেখার চেষ্টাকে কেন কটাক্ষ করছেন?”
তারপর সে একটু থেমে আবার বলতে লাগলো, “এই নিয়ে আমি আপনার অফিসে মোট একত্রিশবার এসেছি। একটা গল্পও জমা দিয়েছি মাসখানেক হলো। তাও ছাপালেন না! অথচ, গতসপ্তাহে একটা মেয়ের খুব নিম্নমানের গল্পও ছাপা হয়েছে দেখলাম! আপনাদের সাহিত্যপাতার আরেকটি ছেলের গল্প পড়ে মনে হলো ফাইভ-ফোরের ছেলে লিখেছে―তাও আপনারা ছেপেছেন! কেন? আর কেন এমন করেন?”
“সে কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে আমাদের।” নাসির এবার ভিতরে-বাইরে উত্তেজিত হতে থাকে।
“না। তা দিতে হবে না। তবে আপনাদের গুণের কথা একটুখানি বলছিলাম আরকি?” মিহিরও বিদ্রুপ করতে ছাড়লো না। আর সে করবেই-বা না কেন―তার পিঠ যে দেওয়ালে ঠেকে গেছে!
তাদের উত্তেজনা আরও বাড়তে কিংবা ছড়াতে পারতো। এমন সময় কাচের দরজাটা আবার খুলে গেল! আর চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একটি যুবতী ও সুন্দরী বীরদর্পে ভিতরে ঢুকলো।
তার মুখে দুর্দান্ত হাসি! সে হাসিমুখেই বললো, “কেমন আছেন নাসির ভাই? আমার কবিতাটা ছেপেছেন বলে দেখা করতে এলাম। সঙ্গে আরও কয়েকটি কবিতা নিয়ে এসেছি।”
“খুব ভালো করেছেন। আমি তো এতক্ষণ আপনার অপেক্ষায়ই বসে ছিলাম। আপনি কী মানুষ বলুন তো! একটা ফোনও করলেন না! অথচ, আপনার কবিতা আমি ছেপে বসে আছি!” এবার নাসিরের সারামুখজুড়ে কী অপূর্ব হাসি!
তরুণীটি এবার সলজ্জভঙ্গিতে আর দারুণ হাসিতে বলতে লাগলো, “না-না। আপনার কথা আমার মনে ছিল। আসলে, একটা ঝামেলা ছিল তো! তাই, আপনাকে ফোন করিনি। এজন্য আজ সরাসরি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চলে এলাম। আজ সারাদিন আপনার অফিসে আড্ডা দিবো। আপনার কোনো সমস্যা হবে নাতো?”
“কী যে বলেন। আপনি যতক্ষণ খুশি থাকবেন। কে আপনাকে যেতে বলেছে! আর আপনাদের মতো কবি-লেখিকাদের সময় দেওয়াই তো আমার কাজ।” নাসির খুশিতে আরও গদগদ হয়ে উঠলো।
মেয়েটি আগের চেয়ে আরও সুন্দরভাবে হেসে বলে, “নাসির ভাই, আপনি যে আমার কবিতা ছেপেছেন―এজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আর মনে মনে খুব খুশি! আমার কবিতা তেমন একটা ভালো হয়নি। তবুও আপনি ছাপিয়েছেন। আমি আবারও বলছি: আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।”
নাসির হাসি-হাসি-মুখে সোল্লাসে বলে, “আরে, আপনি নিজেই তো একটা কবিতা! কবিতার মতো স্নিগ্ধ আপনার সৌন্দর্য! আপনার কবিতা এখন থেকে নিয়মিত আমাদের সাহিত্যপাতায় ছাপা হবে!”
একথা শোনামাত্র মেয়েটি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো। আর পারলে সে ছুটে গিয়ে তখনই নাসিরের পাশে গিয়ে বসে! তার মনে যেন আনন্দ আর ধরে না!
হঠাৎ তার চোখজোড়া গিয়ে পড়লো রুমের এককোণে চুপচাপ জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা মিহিরের ওপর। তারপর মেয়েটি তাকে আরও ভালোভাবে লক্ষ করতে লাগলো। সে এতক্ষণ মিহিরকে লক্ষই করেনি। এবার সে পিছনের দিকে চেয়ারটাতে বসে থাকা মিহিরকে চিনতে পেরে আর তাকে দেখে প্রায় লাফিয়ে উঠে বললো, “কেমন আছে ভাইয়া? আপনার কবিতার কিন্তু আমি খুব ভক্ত। ইসঃ, এত সুন্দর কবিতা যদি আমি লিখতে পারতাম!”
মিহির মেয়েটির মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার মাথাটা এখন ঘুরছে। সে কিছুই বলতে পারলো না।
মেয়েটি আবার বললো, “আমাকে আপনি চিনতে পারছেন না! অনুপ্রাসের সাহিত্যআড্ডায় আমাদের মাঝেমাঝে দেখা হতো তো। আমার নাম কবি মেহরীন চৌধুরী।”
মিহির এবার একটু হেসে বললো, “চিনতে পেরেছি। আপনি ভালো আছেন?”
মেহরীন এবার বিনয়ে গলে পড়ে বললো, “জ্বি। ভালো আছি।”
তারপর মেহরীন তাকে বললো, “কী জন্য এখানে এসেছেন?”
“ওই আপনি যেজন্য আসেন। কবিতা ছাপানোর জন্য।” কথাটা বলে মিহির ম্লানভাবে হাসলো।
মেহরীন চৌধুরী এবার নাসির খন্দকারকে বললো, “ভাই, উনার কবিতা ছাপাবেন না? উনি কিন্তু আমার চেয়ে অনেক ভালো কবিতা লেখেন। আমরা সবাই উনার দারুণ ভক্ত।”

নাসির খন্দকার মুখটা এবার মলিন করে। আর একটু গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলতে থাকে, “না, ছাপাবো। একটু সময় লাগবে। আমি চাচ্ছি উনার লেখা আরও ভালো হোক। উন্নত হোক। তাছাড়া, উনি যে কবিতাটা জমা দিয়েছেন―তার চিত্রকল্পগুলো খুব একটা ভালো হয়নি। মানে, উঁচুমানের হয়নি।” কথাগুলো ভারিক্কিচালে বলে সে মেহরীনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।
মিহির এতক্ষণ ওর ভণ্ডামি দেখছিল। এবার সে ঠাস করে নাসিরের গালে চড় মারার ভঙ্গিতে বললো, “আপনি আমার কবিতায় চিত্রকল্প পেলেন কোথায়! আমি আপনার কাছে যে তিনটি কবিতা জমা দিয়েছি―তার একটাতেও কোনোরকম চিত্রকল্পের ব্যবহার করিনি। এখানে, ছন্দ আছে। ভাব আছে। অলংকারও আছে। কিন্তু আপনি চিত্রকল্প কোথায় পেলেন?”
নাসিরের ফর্সা মুখটি আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল। সে এবার ভিতরে-ভিতরে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে বললো, “আপনি এবার আসুন তো। আর আপনার কবিতা ছাপা হলে পত্রিকায় দেখতে পাবেন। আমাকে অযথা আর বিরক্ত করতে আসবেন না।”
বত্রিশ বছরের মিহির আটচল্লিশ বছরের নাসিরের কাছে পরাজিত হয়ে তার অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় তার মনে হলো―সে কোনো চব্বিশ-পঁচিশ বছরের তরুণীও হতে পারবে না! তার কবিতাও সাহিত্যপাতায় ছাপা হবে না!
সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো: আর কখনো-কোনোদিন কোনো সাহিত্যসম্পাদকের অফিসের ছায়াও মাড়াবে না। এই জীবনে সে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের কবিতাও হতে পারবে না। আর তার কবিতাও ছাপা হবে না!


সাইয়িদ রফিকুল হক
০৯/০১/২০২১
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:১১
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×