(অযাচিত মন্তব্য থেকে রক্ষা পেতে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ছবি এখানে যুক্ত করা হয় নি)
ভাস্কর্য নিয়া কথা তো অনেক হইলো! ভার্চুয়ালি কন সম্মুখ যুদ্ধে কন, কোন জায়গাতেই কেউ কারো থাইকা কম না। আমার পরিচিত পাড়ায় যেমন রয়েছেন সুচিন্তক, প্রগতিশীল, বাম, নাস্তিক তেমনি রয়েছেন আলেমদের অনেকে। এ পর্যন্ত আমি বিভিন্ন জনের থেকে নেওয়া জ্ঞান থেকে যা পেলাম তা বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে নিচের লেখাটাই যুৎসই বলে মনে হয়। মুসলিমদের জন্য মনে হয় এই লেখাটাই সব জিজ্ঞাসার সমাধান; যদি আপনার হৃদয়ে থাকে তৃপ্ততা লাভের বিশ্বাস। আমার মতে, প্রগতিশীল আর এলিট মুসলিমরা আলাদা কোন মুসলিম না। তাছাড়া সত্যের সন্ধানী সে যে ধর্মেরই হোক সত্য স্বীকারে সে থাকে স্পষ্টভাষি।
চলুন, শুরু করা যাক মূল আলোচনা। বোঝার সুবিধার্থে গোটা আলোচনাকে মৌলিক দুটি শিরোনামে ভাগ করে নেয়া যায় :
১. মূর্তি ও ভাস্কর্য বিষয়ে শরীয়তের ফায়সালা।
২. ভাস্কর্য সমর্থনকারীদের যুক্তি ও তার অসারতা ।
এক. মূর্তি ও ভাস্কর্য বিষয়ে শরীয়তের ফায়সালা
প্রাণীর আকৃতি গড়া এবং এর মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার দুটোই শরীয়তে নিষিদ্ধ ও হারাম। এ প্রসঙ্গে যে হাদীসগুলো এসেছে তা অকাট্য ও মুতাওয়াতির। ইসলামের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে গোটা মুসলিম উম্মাহ্র ঐকমত্য ও ইজমা রয়েছে। এটা মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ পথ। আর কুরআন মাজীদে মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ পথ পরিহার করাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলা হয়েছে। [সূরা নিসা (৪) : ১৫]
প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণের অবৈধতা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান। এতে পূজার শর্ত নেই। এই অবৈধতার কারণ হল আল্লাহ্র সৃষ্টিগুণের সঙ্গে সাদৃশ্য গ্রহণ, যা বিভিন্ন হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
আমরা আল্লাহ্র বান্দা। আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যেই আমাদেরকে অবস্থান করতে হবে। আল্লাহ তাআলা প্রাণীর আকৃতি দানকে একমাত্র তাঁরই অধিকার সাব্যস্ত করেছেন। কেননা আকৃতির মধ্যে শুধু তিনিই প্রাণ দান করতে পারেন। যার পক্ষে প্রাণ দান সম্ভব নয়, তাকে আল্লাহ আকৃতি নির্মাণেরও অনুমতি দেন না। একে তিনি তাঁর সঙ্গে মোকাবিলা করার সমার্থক বলে মনে করেন।
তবে মানুষের স্বভাবে অঙ্কন ও নির্মাণের যে প্রেরণা রয়েছে তার জন্য আল্লাহ তাআলা জড়বস্তু বা প্রাণহীন বস্তুর চিত্র-প্রতিকৃতি প্রস্তুতের অনুমতি দিয়েছেন।
প্রাণীর চিত্র ও ভাস্কর্য সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালার কথা যেসব হাদীসে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষিত হয়েছে তার কয়েকটি এবার লক্ষ করুন-
১. হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ تَمَاثِيلُ أَوْ تَصَاوِيرُ.
ফিরিশতারা ওই ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে ‘তামাছীল’ (ভাস্কর্য) বা ছবি রয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১১২
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-
سَمِعْتُ مُحَمدًا صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ يَقُولُ: مَنْ صَورَ صُورَةً فِي الدنْيَا كُلِّفَ يَوْمَ القِيَامَةِ أَنْ يَنْفُخَ فِيهَا الروحَ، وَلَيْسَ بِنَافِخٍ.
আমি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কেউ দুনিয়াতে কোনো চিত্র-প্রতিকৃতি তৈরি করবে তাকে কিয়ামতের দিন বাধ্য করা হবে, যেন সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে, অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১১০
৩. আয়েশা রা. বলেন-
قَدِمَ رَسُولُ اللهِ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ مِنْ سَفَرٍ، وَقَدْ سَتَرْتُ بِقِرَامٍ لِي عَلَى سَهْوَةٍ لِي فِيهَا تَمَاثِيلُ، فَلَما رَآهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ هَتَكَهُ وَقَالَ: أَشَد الناسِ عَذَابًا يَوْمَ القِيَامَةِ الذِينَ يُضَاهُونَ بِخَلْقِ اللهِ، قَالَتْ : فَجَعَلْنَاهُ وِسَادَةً أَوْ وِسَادَتَيْنِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফর থেকে ফিরলেন। আমি কক্ষের দ্বারে একটি পর্দা ঝুলিয়েছিলাম, যাতে ‘তামাছীল’ (ছবি) অঙ্কিত ছিল। তিনি তা খুলে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন আযাব দেওয়া হবে, যারা আল্লাহ্র সৃষ্টি-বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। উম্মুল মুমিনীন বলেন, তখন আমরা তা কেটে ফেললাম এবং একটি বা দুইটি বালিশ বানালাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৭
৪. আলী রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন বললেন-
أَيكُمْ يَنْطَلِقُ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلا يَدَعُ بِهَا وَثَنًا إِلا كَسَرَهُ، وَلا قَبْرًا إِلا سَوَّاهُ، وَلا صُورَةً إِلا لَطخَهَا؟
তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো মূর্তি পাবে তা ভেঙ্গে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিস্মাৎ করে দেবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দিবে?
আলী রা. এই দায়িত্ব পালন করলেন। ফিরে আসার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
مَنْ عَادَ لِصَنْعَةِ شَيْءٍ مِنْ هَذَا، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمدٍ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلمَ.
যে কেউ পুনরায় ওইসব বস্তু তৈরি করবে সে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নাযিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৯
৫. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জাটির নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা ইতিপূর্বে হাবাশায় গিয়েছিলেন। তাঁরা গির্জাটির কারুকাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিসমূহের কথা আলোচনা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন-
أُولَئِكِ إِذَا مَاتَ مِنْهُمُ الرجُلُ الصالِحُ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، ثُم صَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصورَةَ، أُولَئِكِ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللهِ.
তাদের কোনো পুণ্যবান লোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহ্র সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৮
এই হাদীস থেকে জানা যাচ্ছে যে, প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ পূর্বের শরীয়তেও হারাম ছিল। তা না হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহ্র সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করতেন না।
বাইবেলে (বিকৃতির পরও) এখনও পর্যন্ত প্রাণীর চিত্র প্রতিকৃতি তৈরির অবৈধতা বিদ্যমান রয়েছে। বলা হয়েছে-
`Do not make for yourselves images of anything in heaven or on earth or in the water under the earth.’ (HOLY BIBLE (Good news Bible) p. 80, The Bible society of India)
দুই. ভাস্কর্য সমর্থনকারীদের যুক্তি ও তার অসরতা
‘উলামা’ পরিচয়ে কিছু লোক দাবি করেছেন, ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। তারা এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য তুলে ধরে বলেছেন-
“ভাস্কর্য হচ্ছে একটা শিল্প, যা নগরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। আর মূর্তি বানানো হয় ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে, উপাসনা করার জন্য।”
এটা হল ঐ ‘ভদ্রলোক’দের বিকৃতিমাত্র।
পূজার মূর্তি আর ভাস্কর্যের মাঝে পার্থক্য করে যারা প্রাণীর প্রতিকৃতি বিষয়ে ইসলামের দেয়া অকাট্য বিধানে ফাঁক বের করতে চান তাদের জানা থাকা উচিত-
ইসলামে প্রাণীর প্রতিকৃতির অবৈধতা একটি স্বতন্ত্র বিধান। পূজার উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক প্রাণীর মূর্তি তৈরি করাই অবৈধ। প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়াই অবৈধতার কারণ। এজন্য ভাস্কর্যের বিধানগত দিক বুঝতে মূর্তি ও ভাস্কর্যের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা অপরিহার্য নয়। বাইতুল্লাহ্ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে পূজার মূর্তি সরিয়েছেন তেমনি স্তম্ভ ও দেয়ালে অঙ্কিত চিত্রগুলোও মুছে দিয়েছেন এবং তিনি মূর্তিগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ এ বলে দেননি যে, এগুলোর পূজা করা হয়; বরং তিনি বলেছেন-
قَاتَلَ اللهُ قَوْمًا يُصَوِّرُونَ مَا لَا يَخْلُقُونَ.
আল্লাহ ওই গোষ্ঠীকে ধ্বংস করুন, যারা এমন প্রতিকৃতি নির্মাণ করে, যা তারা সৃষ্টি করে না। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫৯০৩
আরো বলেছেন-
لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ تَصَاوِيرُ.
ফিরিশতাগণ ওই গৃহে প্রবেশ করেন না, যাতে রয়েছে ছবি। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫৮৯৬
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর কক্ষে ঝোলানো পর্দা তিনি খুলে দেয়ার সময় এই চিত্রগুলো পূজার সামগ্রী কি সামগ্রী না- এই প্রসঙ্গ আনেননি; বরং বলেছেন-
أَشَدّ الناسِ عَذَابًا يَوْمَ القِيَامَةِ الذِينَ يُضَاهُونَ بِخَلْقِ اللهِ.
কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আযাবে ওইসব লোক পতিত হবে, যারা আল্লাহ্র সৃষ্টিবৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৭
আরো বলেছেন-
إِن أَصْحَابَ هَذِهِ الصوَرِ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، وَيُقَالُ لَهُمْ: أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ.
এই প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীদেরকে কিয়ামতের দিন আযাব দেওয়া হবে, তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা ‘সৃষ্টি’ করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৮১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৭
মোটকথা, মূর্তি এজন্যই অবৈধ যে, তা প্রাণীর প্রতিকৃতি। ওই মূর্তির পূজা করা না হলেও এবং পূজিত কোনো কিছুর মূর্তি না হলেও তা অবৈধ।
তাছাড়া উলামায়ে কেরাম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, পূজার মূর্তি দুই কারণে নিষিদ্ধ : ১. প্রাণীর প্রতিকৃতি। ২. পূজা। আর সাধারণ ভাস্কর্য প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়ার কারণে অবৈধ।
পূজা শুধু মূর্তিরই হয়নি, বিভিন্ন বস্তুরও হয়েছে। সেগুলোর ভাস্কর্য তৈরি করাও নিষিদ্ধ ও হারাম। এটা পূজার কারণে। যদিও তা প্রাণীর প্রতিকৃতি নয়।
তদ্রূপ ছবি বা মূর্তির পিছনে কখনো শুধু সৌন্দর্যই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এটা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ প্রাণীর প্রতিকৃতি। আবার কখনো স্মরণ ও সম্মানের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। এটা যেমন প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়ার কারণে হারাম তেমনি এ কারণেও যে, এভাবে কোনো প্রতিকৃতির সম্মান দেখানো এক ধরনের ইবাদত বলেই গণ্য।
ইসলামের আদর্শ ও চেতনার সঙ্গে মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিরোধ কোথায়- এটা স্পষ্ট করতে গিয়ে আরবের প্রখ্যাত আলেম ড. ইউসুফ কারযাভী বলেছেন :
“ইসলামে প্রাণীর প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ হওয়ার অন্যতম তাৎপর্য হল, মুসলমানের চিন্তা-চেতনা এবং মন-মানসকে শিরকের কলুষ থেকে পবিত্র রাখা। তাওহীদের বিষয়ে ইসলাম অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটা অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। কেননা, অতীত জাতিসমূহে মূর্তির পথেই শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।”
উপরের লাইনগুলো থেকে পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়াই ভাস্কর্যের নির্মাণ অবৈধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। পূজনীয় হওয়া শর্ত নয়। অতএব মূর্তি থেকে ভাস্কর্যকে আলাদা করার যে চেষ্টা ঐ সব ‘ভদ্রলোক’ করেছেন তা অর্থহীন।
কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা
ভাস্কর্য সমর্থনকারী ‘ভদ্রলোক’দের মধ্যে আরেকটি শ্রেণী আছে, যারা বলছেন, “মূর্তি বা ভাস্কর্য মানেই শিরকের উপকরণ নয়...। বুখারী শরীফের হাদীস : ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়্যাত (নিয়তের উপর কাজ নির্ভরশীল)। সুতরাং যেটি যে উদ্দেশ্যে বানানো হয় সেটিকে সেভাবে বিবেচনা করতে হবে...।”
এই ‘ভদ্রলোকেরা’ মূলত আগেরওয়ালাদের মতো মূর্তি ও ভাস্কর্যের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টির পথে না হেঁটে এসব নির্মাণের উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগ দেয়ার কথা বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে যে, উদ্দেশ্য যাই হোক, প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ সর্বাবস্থায় হারাম। সে হিসেবে তাদের বিষয়ে আলাদা কিছু বলার ছিল না। তবে এরা তাদের বক্তব্য প্রমাণ করতে গিয়ে একটি আয়াত এবং একটি হাদীসের শরণ নিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আল্লাহ্র কালাম এবং তাঁর রাসূলের বাণীর মর্যাদা তারা রক্ষা করতে পারেননি।
তাদের প্রমাণ উপস্থাপনের তরীকাটা দেখুন এবং লা-হাওলা পাঠ করে তাদের বক্তব্য লক্ষ করুন-
“বুখারি শরিফের শুরুতেই রয়েছে, বিখ্যাত হাদিস, ‘ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়্যাত (নিয়তের উপর কাজ নির্ভরশীল)।’ মূর্তি বা ভাস্কর্য মানেই শিরকের উপকরণ নয়। যেটি যে উদ্দেশ্যে বানানো হয়, সেটিকে সেভাবে বিবেচনা করতে হবে। হযরত মা আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) রাসুল (সা.) এর প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। তার কয়েকটি পুতুল ছিল বলে হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তার বান্ধবীদের সঙ্গে এসব পুতুল নিয়ে খেলা করতেন। কই, মহানবী (সা.) তো তাকে শিরক বলে এসব পুতুল নিয়ে খেলতে বারণ করেননি। আবার এসব পুতুল শিরকের উপকরণ এমন কথাও কখনও বলেননি। রাসুল (সা.)-এর বাসগৃহে পুতুলের অবস্থান স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে, পুতুল বা ভাস্কর্য মাত্রই শিরকের উপকরণ নয়। কট্টর ওয়াহাবিপন্থী হুজুররাও এটি জানেন, প্রাণীর ভাস্কর্য মানেই শিরক নয়। সৌদি আরবের জেদ্দার মূল কেন্দ্রে ‘দি ফিস্ট’ নামে একটি ভাস্কর্য আছে, এটি একটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের ভাস্কর্য। আরও আছে ঘোড়ার ও মাছের ভাস্কর্য; একইভাবে মুসলিম অধ্যুষিত সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও মিশরে রয়েছে ঘোড়া ও অন্যান্য জীবের ভাস্কর্য। সুতরাং বলা যায়, ভাস্কর্য জীবের হোক বা জীব দেহের কোনও অংশের হোক, তা যদি শিরক বা পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত না হয়, তবে এতে দোষের কিছু নেই।”
তারা আরো বলেছেন-
“...পবিত্র কুরআনের সূরা সাবার ১৩ নম্বর আয়াতে ভাস্কর্য নির্মাণের উল্লেখ করে বলা হয়েছে—‘উহারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্যসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করিতো। আমি বলিয়াছিলাম, হে দাউদ-পরিবার, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমরা কাজ করিতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ’।”
পাঠক! মুতাওয়াতির ও অকাট্য হাদীসের আলোকে আপনি একটু আগেই জেনেছেন, প্রাণীর প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান। এখন আপনিই বলুন, এদের এই উদ্ভট কথাবার্তার কী হাশর!
শুধু নিয়ত ভালো হওয়াই যথেষ্ট?
এখানে আমরা তাদেরকে প্রথম যে কথাটি জিজ্ঞেস করতে চাই তা হল, নিয়ত বা উদ্দেশ্য দিয়ে কাজের পরিণাম বিচারের এই শরঈ নীতি কখন এবং কোথায় প্রযোজ্য হবে- এর কোনো সীমারেখা আছে কি নেই? কেউ মদ পান করতে থাকবে আর বলবে- ‘আমি এটা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খাচ্ছি, একে নেশাজাত দ্রব্য ভেবে নয়’ তার এ কথা কি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য হবে? বা কেউ কারো সম্পদ চুরি করল- এ নিয়তে যে, ‘সে তো যাকাত দেয় না; আমি এটা নিয়ে গরীব-মিসকীনকে দিয়ে দিব।’ এই সৎ নিয়তের কারণে কি তার চুরি বৈধ হয়ে যাবে? যদি তা না হয় তাহলে প্রাণীর প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য নির্মাণকে শরীয়ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ করে দেয়ার পর একথার কী অর্থ- ‘যেটিকে যে উদ্দেশ্যে বানানো হয়, সেটিকে সেভাবে বিবেচনা করতে হবে’? শরীয়ত বলছে, সাধারণ ভাস্কর্য প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়ার কারণেই অবৈধ। এতে পূজার শর্ত নেই । আর এরা বলছেন, ‘ভাস্কর্য জীবের হোক বা জীব দেহের কোনও অংশের হোক, তা যদি শিরক বা পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত না হয়, তবে এতে দোষের কিছু নেই।’
কোনটি মানবেন- শরীয়ত নাকি এদের মতামত?
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর পুতুলখেলা এবং এদের ভাস্কর্যপ্রেম
রইল তাদের একথা যে, “হযরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে ঘোড়ার ছোট মূর্তি রাখা ছিল (সূত্র : বুখারি শরিফ-কিতাবুল আদাব)। কই, রসূল (সা.) তাকে তো নিষেধ করেননি।”
এই বিকৃতির উত্তর হল-
হাদীসটি আলোচ্য বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক। এটা এসেছে মেয়েদের খেলনা সম্পর্কে। এখান থেকে মূর্তি ও ভাস্কর্যের বৈধতা আহরণের প্রয়াস কি অপরিণত চিন্তার প্রমাণ বহন করে না?
চিন্তাশীল মানুষ আলোচ্য বিষয়ের বিধান উম্মুল মুমিনীন-এর ওই হাদীস থেকে আহরণ করবেন, যেখানে তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফর থেকে ফিরলেন। আমি দরজায় একটি ঝালরবিশিষ্ট পর্দা ঝুলিয়েছিলাম, যাতে পাখাওয়ালা ঘোড়ার ছবি অঙ্কিত ছিল। তিনি তা খুলে ফেলার আদেশ দিলেন। আমি তা খুলে ফেললাম। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১০৭
আম্মাজান যখন ছোট ছিলেন তখন পাখাওয়ালা ঘোড়ার পুতুল ছিল তার খেলার সামগ্রী। এর উপর নবীজী আপত্তি করেননি, কিন্তু যখন তিনি বড় হলেন এবং ঘোড়ার ছবিযুক্ত পর্দা ব্যবহার করলেন তখন নবীজী অসন্তুষ্ট হলেন। এমনকি তাঁর চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল এবং তা খুলে ফেলার আদেশ দিয়েছেন এবং তাকে সতর্ক করেছেন। এসম্পর্কিত কিছু হাদীস ইতিপূর্বেও আমরা দেখেছি।
সুলাইমান আলাইহিস সালামের ধর্মেও প্রাণীর চিত্র তৈরি করা নিষিদ্ধ ছিল
তারা বলেছেন, “ভাস্কর্য জীবের হোক বা জীবদেহের কোনো অংশের হোক তা যদি শিরক বা পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত না হয় তবে এতে দোষের কিছু নেই।” তারা সূরা সাবা (৩৪)-এর আয়াত ১৩ দিয়ে কুরআন থেকে প্রমাণ করতে চেয়েছেন এই ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতা। এ থেকে বৈধতা তো প্রমাণিত হয়ই না, উল্টো তা এদের জ্ঞানদৈন্য ও হঠকারিতাকেই প্রকটিত করে তোলে।
আয়াতের তরজমাটিও তারা ঠিকভাবে করতে পারেন নি। শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানীকৃত তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের বাংলা সংস্করণে এর কী তরজমা করা হয়েছে দেখুন :
“সুলায়মান যা চাইত, তারা তার জন্য তা বানিয়ে দিত- উঁচু উঁচু ইমারত, ছবি, হাউজের মত বড় বড় পাত্র এবং ভূমিতে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ...”।
আয়াতে উল্লিখিত تَمَاثِيْل ‘তামাছীল’ বা ছবি শব্দের কী উদ্দেশ্য তা স্পষ্ট করে টীকায় লিখেছেন : ‘প্রকাশ থাকে যে, এসব ছবি হত প্রাণহীন বস্তুর, যেমন গাছ-পালা, ইমারত ইত্যাদি। কেননা তাওরাত দ্বারা জানা যায়, হযরত সুলাইমান আ.-এর শরীয়তেও প্রাণীর ছবি আঁকা জায়েয ছিল না।’
দেখুন, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন (উর্দু, ইংরেজি বা বাংলা, যে কোনো সংস্করণ), সূরা সাবা (৩৪)-এর আয়াত ১৩-এর অধীন টীকা।
ভদ্রলোকদের উচিত ছিল, আয়াতের তরজমা করার আগে এবং একে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের আগে নির্ভরযোগ্য দু’একটি তাফসীর ও কুরআনুল কারীমের বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ দেখে নেয়া। তাতে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানতাবশত তারা কুরআনের আয়াতের যে অর্থ বিকৃতি করেছেন তা থেকে হয়ত বেঁচে যেতেন।
তাদের বিভ্রান্তির শুরু এ আয়াতে ব্যবহৃত আরবী تَمَاثِيل ‘তামাছীল’ শব্দ নিয়ে। এর অর্থ তারা ধরেছেন, ভাস্কর্য এবং কেবলই প্রাণীর এমন ভাস্কর্য, যার পূজা করা হয় না।
কুরআনের তাফসীর তো বটেই, স্বয়ং কুরআনও তাদের এ ব্যাখ্যা সমর্থন করে না।
কয়েক কারণে :
এক. আয়াতে উল্লিখিত تماثيل ‘তামাছীল’ শব্দের অর্থ মুফাসসিরগণ লিখেছেন- الصور অর্থাৎ সাধারণ ছবি।
দেখুন : তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ইবনে কাসীর (মৃত্যু : ৭৭৪), ৩/৮৪১, দারুল ফিকর থেকে প্রকাশিত, দ্বিতীয় সংস্করণ।
আল্লামা ইবনে হাইয়ান আন্দালুসী (মৃত্যু : ৭৪৫ হি.) তার তাফসীর আলবাহরুল মুহীত-এ জোর দিয়ে লিখেছেন-
التَّمَاثِيلُ: الصُّوَرُ، وَكَانَتْ لِغَيْرِ الْحَيَوَانِ.
অর্থাৎ এসব ‘তামাছীল’ ছিল প্রাণহীন বস্তুর ছবি।
দেখুন, আলবাহরুল মুহীত ৭/৩৫৩, দারু ইহইয়াইত তুরাছ, প্রথম সংস্করণ।
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী রাহ. (মৃত্যু : ৬০৬ হি.) তাঁর তাফসীরে কাবীরে লিখেছেন-
وَالتَّمَاثِيلُ مَا يَكُونُ فِيهَا (المَحارِيب) مِنَ النُّقُوشِ.
অর্থাৎ এই ‘তামাছীল’ ছিল, প্রাসাদে অঙ্কিত বিভিন্ন নকশা ও কারুকার্য।
দেখুন, আততাফসীরুল কাবীর ২৫/১৯৮, দারু ইহইয়াইত তুরাছ, চতুর্থ সংস্করণ।
আরো দেখুন, জামিউল বায়ান আন তাবীলি আয়িল কুরআন, মুহাম্মাদ ইবনে জারীর আততবারী (মৃত্যু ৩১০ হি.) ১৯/২৩১, দারু আলামিল কুতুব, প্রথম সংস্করণ এবং তাফসীরু ফী যিলালিল কুরআন, সায়্যেদ কুতুব শহীদ (মৃত্যু ১৩৮৬ হি.=১৯৬৬ ঈ.) ৫/২৮৯৯, দারুশ শুরূক।
দুই. পূর্ববর্তী ধর্মসমূহে যে প্রাণীর চিত্র তৈরি করা হারাম ছিল, একথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকেও সুস্পষ্ট। এ নিবন্ধেই ইতিপূর্বে আপনারা পাঠ করেছেন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أُولَئِكِ إِذَا مَاتَ مِنْهُمُ الرجُلُ الصالِحُ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، ثُم صَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصورَةَ، أُولَئِكِ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللهِ.
তাদের কোনো পুণ্যবান লোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহ্র সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৮
এই হাদীস থেকে জানা যাচ্ছে যে, প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করা পূর্বের শরীয়তেও হারাম ছিল। তা না হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে একাজের কারণে আল্লাহ্র সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করতেন না।
তিন. এমনকি বর্তমান বাইবেলেও পরিষ্কারভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে প্রাণীর কোনো ছবি, ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মাণ। পড়–ন -
`Do not make for yourselves images of anything in heaven or on earth or in the water under the earth.’ (HOLY BIBLE (Good news Bible) p. 80, The Bible society of India)
চার. তারা যে বলেছেন, تماثيل ‘তামাছীল’ অর্থ প্রাণীর ভাস্কর্য এবং একমাত্র ঐ ভাস্কর্য যার উপাসনা করা হয় না এ কথাটিও কুরআন-বিরোধী। কুরাআনে কারীমে সূরা আম্বিয়া ( ২১)-এর ৫২ নং আয়াতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ইরশাদ হয়েছে-
اِذْ قَالَ لِاَبِیْهِ وَ قَوْمِهٖ مَا هٰذِهِ التَّمَاثِیْلُ الَّتِیْۤ اَنْتُمْ لَهَا عٰكِفُوْنَ
(স্মরণ কর ঐ সময়কে, যখন সে তার পিতা ও আপন সম্প্রদায়কে বলল, এই ভাস্কর্যগুলো কী, তোমরা যার উপাসনা করছ!)
এ আয়াতেও تماثيل ‘তামাছীল’ (ভাস্কর্য) শব্দ রয়েছে। এখান থেকে জানা যাচ্ছে যে, হযরত ইবরাহীম আ.-এর সম্প্রদায় তামাছীল (ভাস্কর্য)-এর পূজা করছিল এবং তিনি তাদেরকে এজন্য ভৎর্সনা করেছিলেন। অতএব তারা যে বলতে চাচ্ছেন, ‘তামাছীল’ মানে প্রাণীর এমন ভাস্কর্য, যার পূজা করা হয় না- একথা টিকল না।
পাঁচ. হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে রয়েছে-
لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ تَمَاثِيلُ أَوْ تَصَاوِيرُ.
ফিরিশতারা ওই ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে ‘তামাছীল’ (ভাস্কর্য) বা ছবি রয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১১২
এখানেও تماثيل ‘তামাছীল’ শব্দ রয়েছে। এখানে তো নবীজী এ ভাগ করেননি যে, তা পূজার উপকরণ কি উপকরণ নয়!?
তাদের বিভ্রান্তির গোড়ার কথা
আসলে পূজার উপকরণ আর পূজার উপকরণ নয়- এই দুই ভাগে ভাস্কর্যকে ভাগ করতে গিয়েই তারা বিপত্তিতে পড়েছেন এবং বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। তারা যদি এক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশিত ভাগটি মনে রাখতেন, তাহলে সহজেই সব সমস্যা উতরে যেতে পারতেন।
হাদীসের ভাষা থেকে পরিষ্কার যে, প্রাণীর ছবি মাত্রই তা নিষিদ্ধ। সেটা কাগজে, কাপড়ে, মাটিতে বা দেয়ালে অঙ্কিত হোক কিংবা কাঠ, পাথর বা ইট-বালু-সিমেন্ট বা এজাতীয় অন্য পদার্থ দিয়ে স্বতন্ত্র দেহ-কাঠামো গড়ে হোক। প্রাণীর ছবি ও প্রতিকৃতি হওয়ায় সর্বাবস্থায় তা হারাম। সেটা পূজার উপকরণ হোক বা না হোক। পূজা-অর্চনা যোগ হলে তাতে নিষিদ্ধ হবার বাড়তি কারণ পাওয়া গেল। বিধায় তা চরমভাবে ঘৃণিত। আর পূজার সামগ্রী না হলে শুধু এক কারণে নিষিদ্ধ; সেটা হল প্রাণীর ছবি বা ভাস্কর্য হওয়া।
অন্যদিকে ছবি যদি প্রাণহীন জড়বস্তুর বা উদ্ভিদ ও প্রাকৃতিক অন্যান্য জিনিসের হয় তাহলে তার অঙ্কনে দোষের কিছু নেই। সে ছবি কাগজে, কাপড়ে, মাটিতে বা দেয়ালে আকাঁ হোক কিংবা কাঠ, পাথর, লোহা বা এজাতীয় পদার্থ দিয়ে স্বতন্ত্র কাঠামো তৈরি করে হোক। তবে যদি এই প্রাণহীন চিত্র ও বস্তুও পূজার উপকরণ হিসেবে তৈরি করা হয় তাহলে সেটাও নিষিদ্ধ। সেটা ছবি বা প্রতিকৃতি হওয়ার কারণে নয়; বরং পূজার কারণে।
এই শরঈ মানদ-ে বিচার করলে কোনো সংশয় বা বিভ্রান্তি থাকে না। বন্ধুগণ গোটা বিষয়টা কেন এইভাবে ভেবে দেখছেন না সেটাই বিস্ময়।
দলীল হল শরীয়ত, কোনো দেশ নয়
তারা আরেকটি কথা বলেছেন- সৌদি আরব ও মিশরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ভাস্কর্যের উপস্থিতি প্রসঙ্গে। এর উত্তর এই যে, শরীয়তের বিষয়ে শরীয়তের দলীল দিয়ে কথা বলতে হবে। কোন্ দেশ কী করেছে সেটা ধর্তব্য নয়।
(নিবন্ধের অধিকাংশটুকু আমার এক প্রিয়জন জনাব আব্দুল মালেক ভাইয়ের থেকে সংগৃহীত।)
দয়া করে, নিবন্ধটি না পড়ে কেউ মন্তব্য করবেন না।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪৫