তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি পেলেন দুর্নীতির দায়ে আট বছর সাসপেন্ডে থাকা এবং একাধীক বার স্টান্ড রিলিজ হওয়া মহাব্যবস্থাপক ম. মাহফুজুর রহমান। তিনি এন্টি মানি লন্ডারিং বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রায় দুই ডজন দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সদ্যবিদায়ী এন্টি মানি লন্ডারিং বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেমও তার বিরুদ্ধে তিন পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র গভর্নরের নিকট জমা দিয়ে গেছেন। এদিকে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গির আলমকেও নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ পদোন্নতির বিষয়েও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বদলি নীতিমালা অনুযায়ী ২৪ মাসের আগে বদলি হবার নিয়ম না থাকলেও ১৪ মাসেই সিলেট থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় তাকে। গতকাল ওই দুই মহাব্যবস্থাপককে নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিনিয়র তিন মহাব্যবস্থাপককে ডিঙ্গিয়ে ওই দুজনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। সিনিয়র তিন কর্মকর্তা হলেন খুলনা অফিসের মহাব্যবস্থাপক আব্দুস সাত্তার, বরিশাল অফিসের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম ফজলুর রহমান এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক স্ট্রেনদেনিং প্রোজেক্ট সেলের মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল হক।
ম. মাহফুজুর রহমান ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি নানা রকম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরেন। এসব দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার চাকুরি চলে যায়। দীর্ঘ ৮ বছর সাসপেন্ড অবস্থায় থাকার পর বিভিন্ন লবিংয়ের মাধ্যমে তিনি আবার চাকুরিতে যোগ দেন। এর পরও তিনি অনেক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে একবার তিনি স্টান্ড রিলিজ হন।
মাহফুজুর রহমানের নানা দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে একটি চিঠি ইস্যু করা হয় ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর। এই সময়ে তিনি খুলনা শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসিবে কর্মরত ছিলেন। চিঠিটি ইস্যু করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অফিসার লুৎফর রহমান। এই চিঠিটি বর্তমানে মাহফুজুর রহমানের ব্যক্তিগত গোপনীয় প্রতিবেদনের ৫৪০ এবং ৫৪১ পৃষ্ঠায় রেকর্ড আছে। চিঠিটির পাঠানো হয়েছে খুলনার দুর্নীতি দমন ব্যুরোর বাংলাদেশ ব্যাংক শাখার পরিদর্শকের কাছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মাহফুজুর রহমান ১৯৮১ সালে এ ডি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন। তখন তিনি অগ্রণী ব্যাংকের অফিসার ছিলেন। এ তথ্য গোপন করে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন এবং একই সঙ্গে কয়েক মাস উভয় ব্যাংক থেকে বেতন নেন।
১৯৯২ সালে অবৈধভাবে এনসিএল থেকে লাখ লাখ টাকা নিজ নামে ও তার মালিকানাধীন অফসেট প্রেসের নামে ঋণ গ্রহণ করেন। শেয়ার মার্কেটের কনসালটেন্ট এস সি এল নামক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হন। এইভাবে বেআইনিভাবে ঋণ গ্রহণ ও খেলাপি হবার ফলে চাকুরিচ্যুত হন। এখনও এনসিসি ব্যাংকে তার নামে লাখ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আছে যা মামলাধীন আছে।
২০০০ সালে সাবেক সরকারের স্পিকার আ. হামিদের তদবিরে সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনকে খুশি করে চাকরিতে পুনঃনিয়োগ পান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে তদবিরে পোস্টিং নিয়ে বহু দুর্নীতির আশ্রয় নেন। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে আবার বহু ব্যবসা খোলেন। এই ঘটনা জানাজানি হলে ওই বিভাগ থেকে তাকে রংপুর বদলি করে স্টান্ড রিলিজ করা হয়।
রিলিজ হবার পূর্বেই তিনি বহু ব্যবসার মালিক হন। বর্তমানে তিনি মধুমিতা সিনেমা হলের দোতলায় অবস্থিত শেয়ার বাজারের কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান এসসিএল, কিশোরগঞ্জে একটি কোল্ড স্টোরেজ, হাসপাতাল (কিনিক) ও একটি ঔষধ তৈরী ফ্যাক্টরির মালিক। স্ত্রীর নাম দেখিয়ে তিনি নিজেই সাইন করে এসব চালাচ্ছেন বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০০১ সালে খুলনায় বদলি হয়ে তদবিরের জোড়ে ভুয়া একটি কাজের অসিলা দেখিয়ে ঢাকায় ডেপুটেশনে আসেন। এই সুযোগে তিনি তার শেয়ার ব্যবসার কাজ করেছেন ও প্রেসের ব্যবসা চালাচ্ছেন বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ১৯৮১ সালে। দীর্ঘ ২১ বছর পর (এসএসসি পাশের ৩১ বছর পর) তিনি তার জন্ম তারিখ জালিয়াতি করে ব্যাংকের নিকট আবেদন পাঠিয়েছেন। সব জায়গায় জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৫৬ ছিল। তিনি টাকার বিনিময়ে সেটা ১ নভেম্বর ১৯৫৬ করতে চাচ্ছেন। এই সুবিধা পেলে তিনি বিপুল অঙ্কের টাকা রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পাবেন। এটা নৈতিকতা ও ব্যাংকিং আইনের পরিপন্থি কাজ যা গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, দীর্ঘ ৩১ বছর পর তার জন্ম তারিখ সংশোধনের কি রহস্য তা তদন্ত করে দেখা দরকার। টাকা দিয়ে চাকরির আবেদন পত্রে তার জন্ম তারিখ ইতোমধ্যে ঠিক করেছেন। তবে সব রেকর্ড কাটাতে পারেন নি। একজনকে বড় অঙ্কে ঘুষ দিয়ে একটি ডুপ্লিকেট সনদ সংগ্রহ করেছেন। অন্য সব রেকর্ড আগের মতোই আছে। অগ্রণী ব্যাংকের চাকরিতে ১ জানুয়ারি ১৯৫৬ আছে। তার এইচ এস সি পরীক্ষার (১৯৭৩) সার্টিফিকেটও জাল হয়েছে বলে জানা গেছে যা ঢাকা বোর্ডে যাচাই করা দরকার।
চিঠিতে বলা হয়েছে, মাহফুজ খুলনা শাখার প্রশাসনে পোস্টিং নেয়ার পর ক্ষমতার জোরে ঢাকার মিরপুরে ৪ বছর আগে নির্মিত বাড়ির একটি ফাটের নামে এককালীন ২৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা গৃহনির্মাণ ঋণ নেন যা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ ওই পুরো বাড়িটিই এইচবিএফসিতে মর্টগেজ করা। তিনি আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে অনিয়মিতভাবে ঋণ নিয়েছেন। তবে এটার মর্টগেজ করান নাই। কারণ একই ফাট দুই অফিসে মর্টগেজ দেয়া সম্ভব নয়। মর্টগেজ না থাকায় বর্তমানে তাকে দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ২৭ লাখ টাকা অরক্ষিত (জামানতবিহীন) অবস্থায় আছে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।
এদিকে ২০০৩ সালের ১০ মার্চ মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির অভিযোগ সম্বলিত একটি চিঠি তৎকালিন গভর্নরের কাছে পাঠিয়েছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরোর ব্যাংক শাখা। এই চিঠিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের প্রশাসন বিভাগের ৪৩৯ নম্বর ডায়রি হিসেবে নথিভুক্ত আছে। আর মাহফুজুর রহমানের ব্যক্তিগত রেকর্ডের ৫৩৯ নম্বর পৃষ্ঠা হিসেবে নথিভুক্ত আছে। চিঠিটি গ্রহণ করেছিলেন তখনকার ডেপুটি গভর্নর-২ নজরুল হুদা। এই চিঠিতেও উপরের অভিযোগগুলো উল্লেখ ছিল।
গতবছরের জুনে বদলি করে সিলেট পাঠানো হয় মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গির আলকমে। গত আগস্ট মাসে তাকে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাকে বিআরপি বিভাগের মহাব্যাবস্থাপক করা হয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বদলি নীতি অনুযায়ী ২০১১ সালের জুনের পূর্বে তিনি বদলি হতে পারেন না। কারণ এতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, কোন কর্মকর্তা এক অফিসে ২৪ মাস সক্রিয়ভাবে চাকরি না করা পর্যন্ত বদলি হতে পারবেন না। ###
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



