নেহা আমার প্রাইভেট টিউটর জীবনের তৃতীয় ছাত্রী- বুয়েটের ক্যাম্পাসের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হয় স্টুডেন্ট। নতুন টিউশনী শুরু করার খবর পেলে বন্ধুবান্ধবরা এখানে গলা নামিয়ে জিঞ্জাসা করে, বন্ধু, ছাত্র না স্টুডেন্ট? উত্তর ‘স্টুডেন্ট’ হলে প্রশ্ন কর্তা সব বুঝে ফেলা মার্কা বিমল আনন্দের হাসি দেয়।
নেহার আম্মার মতো খাটাশ মহিলা আমি আমার এই জীবনে আর একটি দেখেছি বলে মনে পড়ে না, ভবিষ্যতে কখনো দেখবো এরকম সম্ভাবনাও ক্ষীণ। মহিলার সামনে বসে উনার ছোট ছোট চোখের দিকে তাকালে প্রথমেই যেটা মনে হয় তা হল, আমাকে কয় হাটে বিক্রি করে কয় হাটে কেনা হবে ইতিমধ্যে মোটামুটি ঠিকঠাক হয়ে গেছে , লাভের অঙ্ক নিয়ে উনার মনে সামান্য সন্দেহ আছে বিধায় এখনো বেচা কেনার আনন্দদায়ক প্রক্রিয়া ধুমধাম করে আরম্ভ করা যাচ্ছে না।
যে কোন টিউশনী শুরু করার প্রথম দিনেই আমি ঠিক করি যে, এই টিউশনী করবো না, এটা চিন্তা করলে মনে শান্তি পাওয়া যায়,তারপর শান্ত সমাহিত মন নিয়ে গার্জিয়ানের কাছে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যায়।
নেহাদের কলাবাগানের বাড়িটা পাচতলা, কেবল দ্বিতীয় তলা বাদে বাকি প্রত্যেকটি তলা খুব সম্ভব ভাড়া দেয়া, এ্যাটলিস্ট বিনা পয়সায় যে এই খাটাশ মহিলা কাউকে থাকতে দেয় না, এইটা নিশ্চিত।
ভদ্রমহিলা দেখতে সুন্দর। একটা অন্ধকার অন্ধকার বিকেলে পুরনো ভারী আসবাব দিয়ে সাজানো ড্রইংরুমে তিনি আমার ইন্টারভিউ নিলেন। খুবই সন্দেহভরে উল্টে পাল্টে আমার আইডি কার্ড দেখা
হল, টাকা পয়সা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আমরা মুলামুলি করলাম। হাসি হাসি মুখে বেশ দৃঢ়ভাবে নিজের মতামত উপস্থাপন করার মতো খুব ‘হ্যান্ডি’ একটি গুণ আমি কবে আয়ত্ত করেছি চিন্তা করতে করতে আমি মহিলার সঙ্গে বিরক্তিকর আলোচনা চালিয়ে গেলাম।
শেষ মেশ ঠিক হল যে সপ্তাহে চারদিন পড়াতে হবে, টাকার অঙ্কটা এমন কিছু আহামরি নয়, আমার নিজের হাতে তখন এর চাইতে বেশি দামের দুইটা টিউশনী। আমার ‘স্টুডেন্ট’ এর সাথে সেইদিন দেখা হল না, ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বের হবার সময় আমি খেয়াল করলাম যে বাসার সদর দড়জার পাশের দেয়ালে ফ্রেম করা বিশাল সাইজের দুইটা ফটোগ্রাফিক পোট্রেট টাঙানো, তারমধ্যে একটা এই খাটাশ মার্কা মহিলার বিয়ের সময়কার , অন্যটাতে আমার দৃষ্টি আটকে গেল, ষোল সতের বছর বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ে, কি মাত্রা ছাড়া অতিরিক্ত রকমের স্নিগ্ধ আর সুন্দর সেই মুখ, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
.........................................................
নেহাকে প্রথম পড়াতে গেলাম আমার থ্রি টু-র টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার শেষ দিন। আগের দিন রাত্রি চারটা পর্যন্ত পড়ে, সকাল সাতটায় ওঠার কারণে যতটুকু ঘুম পাওয়া উচিত ছিল, তার পুরোটুকুই পরীক্ষার হলে পেয়েছে বলে পরীক্ষার পর আমি নিজেকে বেশ তরতাজা আবিষ্কার করলাম। তরতাজা বা ফুরফুরে যাই বলি না কেন, তার পিছনে আরো একটা ফ্যাক্টর দায়ী, তা হল পরীক্ষার পরে নতুন করে অনুধাবন করা সেই পুরনো ফিলসফি।“আরে পরীক্ষা টরীক্ষা কোন ব্যাপার হলো? পরীক্ষা ভালো হয় নাই তো কি হইসে, চেষ্টা তো করসিলাম।” আর মহাবিশ্ব কতো বড়, তার মধ্যে একেবারে ছোট একটা গ্যালাক্সির ছোট্ট একটা নক্ষত্র হল সূর্য, তারও ম্যালাগুলা গ্রহের ভিতরে ছোটখাট একটা গ্রহ হল পৃথিবী, এই পৃথিবী ভর্তি বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ, সেই মানুষদের একজনের পরীক্ষা ভালো হল, নাকি খারাপ হল এইটা আসলে হাস্যকর রকমের আনইম্পরটেন্ট একটা বিষয়। আর এই কোটি কোটি বছর বয়সের মহাবিশ্বে একটা মানুষ কয়দিন আর বাচে, এই ক্ষুদ্র জীবনের ম্যাক্সিমাম সময় পরীক্ষা পরীক্ষা করে নষ্ট করার কোন মানে হয়? উত্তর হল, ‘হয় না’। কাজেই আমি আমার ফুরফুরে মেজাজের কোন দোষ দেখলাম না।
যাইহোক, ছাত্রী পড়াতে যাওয়ার আগে ফিটফাট হয়ে যাওয়া নিয়ম। সম্ভব হলে, শার্ট/ টি শার্ট যাই পড়া হোক না কেন ,পর্যাপ্ত ইস্ত্রী সমেত পড়া উচিত। হলের ক্লোরিণযুক্ত পানির কারণে কেউ যদি চুল পড়তে পড়তে টেকো হবার দ্বারপ্রান্তে উপনীত না হয়, তাহলে ‘সেট ওয়েট’ জেল ব্যবহারে হালকা কেশবিন্যাস করলে জনসাধারণ তাতে আপত্তি করে না। টুকটাক বডি স্প্র্রে তো সবাই ইউজ করে, স্টুডেন্ট পড়াতে যাবার আগে এক দুইবার বেশি স্প্রে করলে যে বডি স্প্রে ফুরায়ে যায় না, সেটাও ঠিক।
আমার সেইদিনের ড্যামকেয়ার ভাবের কারণে আমি এসবের কোনটাই করলাম না।উপরন্তু পলাশীতে দাড়ায়ে একটা বেনসন ধরায়ে ফেললাম। যাইহোক আমি যখন নিজেকে নেহাদের লোহার ভারী গেট ওয়ালা বাসার সামনে আবিষ্কার করলাম, তখন একটু আধটু ফিটফাট হয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা বোধ হচ্ছিলো।যা থাকে কপালে, খাটাশ মহিলার মেয়ে তো ছোট খাট একটা খাটাশই হবে, তার চেহারা যতই পরীদের মতো হয়ে থাকুক না কেন- ভেবে আমি দোতলায় উঠে কলিংবেল বাজালাম।
সেই শুরু, এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে চারদিন নেহাদের বাসার বিশাল কাপভর্তি ঢ্যালঢ্যালে বিস্বাদ চা খেয়ে আমার সন্ধাটা মাটি হয়। রাস্তায় একটা অপরিচিত মেয়ে হিসেবে নেহার সঙ্গে দেখা হলে আমি নির্ঘাত ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকায়ে থাকতাম, ইংরেজীতে যাকে মনে হয় বলে ‘ওগল অ্যাট’, কিন্তু মেয়েটা যখন ছোট ছোট পায়ে এসে চশমাটা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে প্রায় চোখের সাথে লাগায়ে মাথা নিচু করে চুপ চাপ আমার সামনে বসে, তখন একটা অসম্ভব সুন্দর মুখের দিকে ইচ্ছামতো তাকিয়ে খাকা না হোক মাঝে মধ্যেই তাকানোর লাইসেন্স পাওয়া এই আমার ভিতর থেকে কেমন একটা প্রতিরোধ কাজ করে। মনে হয় বাচ্চা একটা মেয়ে- সারাদিন বাপমায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী এই কোচিং, সেই কোচিং, নাচের ক্লাস, গানের ক্লাসে দৌড়াতে দৌড়াতে টায়ার্ড; তাকে আরও একটু টর্চার করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে। তার নিজের মতো করে পাওয়া সময়ে এসে আমি ভাগ বসাচ্ছি। এই যে চারপাশে কোন পাহারা নাই (খাটাশ মহিলা যত খাটাশই হোক না কেন, পড়ানোর সময় পাহারার ব্যবস্থা করতে কেন জানি ভুলে গেছে-ছাত্রী পড়ানোর সময় পাহারা থাকার অভিঞ্জতা আমার আছে), সেটা আমার জন্য একটা বার্ডেন বলে মনে হয়, মনে হয় এই মেয়েটার সাথে একলা না খেকে আরও কেউ থাকলে মনে হয় ভালো হতো।
পড়ানোর সময় অবশ্য আমার তেমন কিছু মনে হয় না। নেহার ব্রেন মোটামুটি, তাড়াতাড়ি না বুঝলেও একটা ব্যাপার ভালো যে, সে না বুঝে বলে না ‘আমি বুচ্ছি’। না বুঝলে হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকায়, ওর ভাব দেখে আমি বুঝি যে বোঝানো ঠিকমতো হয় নাই।
নেহাকে পড়াতে পড়াতে একঘন্টার জায়গায় দেড় ঘন্টা হয়ে যায়, হলের ডাইনিং মিস হওয়াটা একটা অনিবার্য ব্যাপার হয়ে দাড়ায়, অথচ আবার পরের পরের দিন নেহাকে গিয়ে পড়াতে হবে ভাবলেই আমার গায়ে জ্বর আসে।
একটা সুন্দরী মেয়েকে পড়ানোর ব্যাপারটা আমাকে টানে, আবার একই সঙ্গে মেয়েটাকে মেয়ে হিসেবে দেখার জন্য, কেবল স্টুডেন্ট হিসেবে দেখতে না পারার এই স্মার্টনেসের অভাব আমাকে পীড়া দেয়।
প্রতিদিন পড়ানো শেষ করে বের হবার সময় সদর দড়জার পাশে নেহার ছবিটা দেখে আমার রাগ হয়, কী দরকার ছিলো ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকায়ে এতো মোহনীয় ভঙ্গিতে হাসার,- কই আমার দিকে তাকায়ে তো কেউ এতো সুন্দর করে হাসে না।
নেহার সঙ্গে একদিন গাউসিয়ায় দেখা, বাচ্চাদের কাপড়জামা দাম করছে। আমি অবাক হয়ে জিঞ্জাসা করলাম,-‘আরে তুমি এইখানে কি করো? আজকে না তোমার এক্সাম?’ ও অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো, বললো, ‘এই তো, একটু কাজ ছিলো। এক্সাম ভালো হয়েছে’। দেখা গেল নেহা যত সুন্দরীই হোক না কেন, ঢাকার অন্যান্য মেয়েদের মতো সে দরদাম করতে পারে না। কেনা কাটার পর আমি ওকে ঞ্জান দান করার চেষ্টা করলাম,-‘শোন, গাউসিয়ায় কোন জিনিস কিনে রাম ঠকা খেতে না চাইলে যা দাম চাইবে তার অর্ধেকের চাইতে বেশ কিছুটা কম দাম দিয়ে দরাদরি শুরু করবে, এতে দেখবে অর্ধেকের কাছাকাছি দাম দিয়ে জিনিসটা পেয়ে যাচ্ছো’। নেহাকে অনেক চাপাচাপির পর বাচ্চাদের জামাকাপড়ের ব্যাপারে যা জানা গেল, তা হল –পলাশীর দিকে সে গাড়ি নিয়ে এসেছিলো কোয়েশ্চেন পেপার দেখানোর জন্য(যেহেতু পরীক্ষার কারণে আমি একমাস আসবোনা বলে দিয়েছি), পথে পলাশীর মোড়ে রাস্তার পাশের ফুটপাথ এ বস্তির এক মহিলা তার তিন চার বছরের বাচ্চাকে গোসল করাচ্ছিলো দেখে গাড়ি থেকে নামে, উদ্দেশ্য ছিলো মোবাইলে ছবি তুলবে, সেখানে কথায় কথায় মহিলার কাছে জানতে পারে যে বাচ্চাটার কেবল একটাই পাতলা জামা, শুধু তাই না বস্তির ঐ পরিবারটির কোন বাচ্চারই শীতের কোন কাপড় নেই।
-‘ভাবতে পারেন’ চোখ মুছতে মুছতে বললো নেহা ‘শীতের মধ্যে পাতলা শার্ট গায়ে বাচ্চাটাকে সামনে শুইয়ে নিয়ে ঐ মহিলা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিক্ষা করে?’
আমি হাসলাম।
-‘এ্তো টাকা দিয়ে এসব কিনলে, আন্টি বকবে না তো আবার?’
-‘বাহ্, আম্মার টাকা নিবো কেন, সব আমার পকেট মানির টাকায় কেনা’।
ওর ঠোটের কোণে হাসি চিক মিক করছে-‘ চিন্তা করেন, ওরা আজকে কতো খুশি হবে এই কমদামী কয়েকটা কাপড় পেয়ে’।
এই ছোট্ট মেয়েটা তার দুর্বল দুটা হাতে শীতার্ত একটা পৃথিবীতে একটু ওম নিয়ে আসার প্রানান্তকর যে চেষ্টা করছে, তা আমার ভিতরে এক ধরণের হীনমন্যতা তৈরি করলো। এর চেয়ে সবল দুটা হাত দুলিয়ে দুলিয়ে আমি রোজ ঘুরে বেরাই, পান কিমবা চায়ের দোকানের মতো বস্তির মানুষেরা দু:খের দোকান খুলে রাস্তার পাশে বসে থাকবে, এটা কখনো আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় নি।
সেই থেকে নেহার জন্য আমার মধ্যে গাঢ় একটা মমতা তৈরি হলো, পড়াতে বসে অপেক্ষাকৃত কম বকাঝকা করি, বিস্বাদ চায়ে চুমুক দিয়ে মাঝেমধ্যে ওর সাথে হালকা গল্প গুজব করা হয়।
আস্তে আস্তে অপূর্ব্ব সুন্দর একট মুখে প্লেস করা ততোধিক সুন্দর দুটা চোখে আমার জন্য ঘোর তৈরি হয়, আমার মধ্যে সদাজাগ্রত প্রতিক্রিয়াশীল তামজীদটা সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করে।
................................................
এরপর বহুদিন পার হয়ে গিয়েছে, বুয়েটের মেধাবী ছাত্রদের প্রাণ রক্ষার জন্য লক্ষ লক্ষ ব্রয়লার মুরগী তাদের জীবন বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে। নামের আগে ‘ইন্জি:’ উপসর্গ যোগ করার মহান অধিকার পেয়েও আমি সেই ব্যাপারে নিজের মধ্যে খুব একটা উৎসাহ টের পাই না। নিয়ম করে অফিস করাটা ধাতে না সওয়ায় হাফ ডজন চাকরী বদলের পর আমি কিছুদিন হল ঢাকার বাসায় স্থিতু হয়ে বিশ্রাম করছি আর ভাগিনাদের সময় দিচ্ছি। এরকম সময়ে নেহার সঙ্গে একদিন আমার দেখা হল বসুন্ধরা সিটিতে। স্মারটেক্স থেকে ঝ্যালঝ্যালে একটা পান্জাবী অবিশ্বাস্য দামে কেনার পর নিজেকে মনে মনে গালা গালি করতে করতে পিচ্ছল মেঝের উপর দিয়ে সাবধানে হাটছি, সেইসময় আমি নেহা কে দেখলাম।আগের চেয়ে সাস্থ্য কিছুটা ভালো হয়েছে, কিন্তু সুন্দরও হয়েছে অনেক, ওর এক হাত শক্ত করে ধরে জীবন্ত জাপানী পুতুলের মতো হাটছে ছোট্ট একটা মেয়ে। আমাকে দেখে নেহা থমকে দাড়ালো, তার মুখের তেমন কোন ভাবান্তর হলো না, ভ্রূ কুচকে বললো, ‘আপনি স্যার না, ‘এ’ লেভেলে থাকতে আমাকে পড়াতেন, মনে আছে?’ আমি মাথা নেড়ে হাসলাম, অ্যাটলিস্ট হাসার চেষ্টা করলাম। নেহা মনে হল খুব সতর্ক চোখে আমাকে খানিক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর শক্ত শক্ত গলায় বললো, ‘রুনি, বেবি, ইনি একসময় আমার প্রাইভেট টিউটর ছিলেন, খুব ভালো পড়াতেন, আমি উনার অনেক ফ্যান ছিলাম। কই, উনাকে হ্যালো বল’। আমি মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে ওর চুলগুলো নেড়ে দিলাম।নেহাই বললো ‘এতদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হল, চলুন বসি কোথাও’।
অত:পর বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের টপফ্লোরের কোন একটা খাবারের দোকানে আমরা বসি, নেহা মেন্যুটা খানিক্ষণ অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করে দুটা কফি আর একটা ভ্যানিলা আইসক্রীম অর্ডার দেয়। আমি রুনির সঙ্গে টুক টাক কথা বলতে বলতে নেহাকে ভালো করে দেখছিলাম। ওর চেহারা থেকে সবসময় কেমন একটা দ্যুতি বের হতো, কই সেটা? খুব প্রিয়, খুব চঞ্চল, খুব মায়া ভরা দুটা চোখ কেমন শান্ত আর কঠোর হয়ে গিয়েছে।
আমার চিরকালের অধরা নারীকে যে ধরতে পেরেছে, তার বংশধরের সামনে নিজের পুরনো প্রেমের সঙ্গে কেমন করে কথাবার্তা আদান প্রদান করতে হয়, আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের কোন কোর্সে আমাদের সেটা শেখানো হয় নি।সুতরাং আমি নিতান্ত আনস্মার্টের মতো চুপ করে থাকি।
‘আমি আম্মা দুজন ই ভেবেছিলাম আপনি বাইরে চলে গেছেন’।
‘হুম’
‘কি করছেন এখন?’
‘এই তেমন কিছু না।
আমার কথা বাদ দাও তোমার কথা বল, কেমন যাচ্ছে দিনকাল, ভালো কথা- বিয়ে হলো কবে?’
‘হয়েছে’ নেহার ছাড়াছাড়া উত্তর ‘আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইনি, আম্মা জোর করলো, আর আব্বাও হঠাৎ স্ট্রোক করায় ফ্যামিলির একজন গার্জিয়ানের দরকার ছিলো।‘
‘হু, তা ঠিক’
‘আপনাকেও দাওয়াত দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু, সীম পাল্টে ফেলেছেন বোধহয়’ , একটু হেসে যোগ করলো নেহা ‘আমিই অবশ্য আপনার আগে পাল্টেছি’
আমি একটু অবাক হয়ে নেহার দিকে তাকালাম। তার দৃষ্টি পরিষ্কার। চাহনি এবং ভাব ভঙ্গিতে ফুটে বেরোচ্ছে তৃপ্তি আর কেমন একটা অচেনা ধরণের আত্ম অহংকার। আমার বুঝতে সময় লাগলো যে, আমাকে ধরে বসানোটা অনেকটা বাক্স পরিস্কার করতে গিয়ে পেয়ে যাওয়া পুরনো প্রিয় কোন খেলনাকে মানুষের নেড়ে চেড়ে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছার মতো। আমাকে আদ্যপান্ত পর্যবেক্ষণ করে সে যে খুশি হয়েছে, তা বোঝা গেল, যা হয়েছে এককালে তা ভালই হয়েছে- নেহার চোখ বল্ল।
সবধরণের হালকা আবেগ আর ঘোর থেকে মুক্ত হওয়া একটি মেয়েকে গর্বভরে ,খুব প্রাণবন্তভাবে নিজের সংসারজীবন নিয়ে গল্প করতে দেখতে হয়তো ভালই লাগার কথা, কিন্তু আমি তো সেই চোখ দুটাকে ভালোবাসতাম যা প্রচন্ড একটা ঘোর নিয়ে আমার দিকে তাকাতো। এই মেটামর্ফসিস হয়ে যাওয়া মেয়েটির ভিতরের সেই পরীটাকে ভালোবাসতাম, বিশ্ব সংসারের দু;খে যার চোখে পানি টলটল করতো, দৈনন্দিন জীবনে অন্তরালে বয়ে চলা আনন্দের এক টিউন শুনতে পেয়ে যার ঠোটের কোনায় হাসি চিকমিক করতো।
টিনএজ বয়সে শরীরে কি একটা হরমোন চলে আসে বলে মানুষের শরীর মন নাকি অন্যরকম হয়ে যায়, বাচ্চা বয়সের বেহিসেবী মেয়েরা পৃথিবীর সবটুকু আবেগ নি:শেষ করে হয়তো নিতান্তই অনুপযুক্ত গাধা ধরণের কাউকে ভালোবাসে।
সেই হরমোন জিনিসটার অ্যাটমিক স্ট্রাকচার আমার খুলে খুলে দেখতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর সব অল্প বয়েসী মেয়ের মধ্যে যেটা এক পরীকে বেধে রাখে।
তারপর আস্তে আস্তে ছোট মানুষ বড় হয়, হরমোনের কারসাজিতে বেহিসেবী মেয়েরা হিসেবী হতে শেখে, জীবনসঙ্গী বেছে নেবার আগে নিজের সঙ্গে নিজেই অনেক দর কষাকষি করে।নিজের বেহিসেবী বয়সের আবেগকে ছুড়ে ফেলে, আর তাদের মনেও থাকেনা ছোটখাট বহু পাগলামির ইতিহাস।
আমি একটা ছোট্ট নি:শ্বাস ফেলে বললাম, ‘নেহা ,আজ উঠি?’
ও জিঞ্জাসু চোখে আমার দিকে তাকালো।
আমি এককালের প্রিয় মুখটার দিকে তাকিয়ে কোমল কিছু বলতে চাইলাম, আমার মায়াই লাগলো নেহার জন্যে, ও কি জানে যে, ওর ভেতরের পরীটা উড়ে গেছে?
বিশেষ দ্রস্টব্য ১: ‘পরী উড়ে গেছে’ একটা খুব হালকা থীমের উপর লেখা গল্প, এর বিষয়বস্তুকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কিছু নেই। পরী উড়ে যাওয়াটা খারাপ , সেটা দেখানোও আমার উদ্দেশ্য ছিলোনা, আমাদের মায়েরা হিসেবী বিচক্ষণ না হলে আমাদের সবার কপালে দু:খ ছিলো সেটাও একশতভাগ খাঁটি সত্য কথা।
বিশেষ দ্রস্টব্য ২: লেখাটাকে এডিট করে আবার পোস্ট করলাম, কারন আগের বারে মূল স্টারটিং এর আগে একটা শ্যাডো স্টারটিং ছিলো, যার কারণে দুঃখজনকভাবে কম মানুষ লেখাটি পড়েছে।
আশা করি ব্লগ সমাজ ব্যাপারটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




