somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টুকিটাকি দেশপ্রেম...

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আর্মিদের স্কুল হওয়ায় আমাদের স্কুলের নিয়মকানুন ছিলো খুব কড়া(হয়তো এখনো আছে, বহুদিন স্কুলে যাওয়া হয় না)। ক্লাসের আগে প্রতিদিন পিটি হতো, অর্থহীন হাত পা ছোড়া ছুড়ির শেষে হতো জাতীয় সংগীত।
পরের সাতটা পিরিয়ডের কয়টার পড়া করা হয় নি, কয়টার বাড়ির কাজ ক্লাসেবসে লিখতে হবে সেই টেনশন, তার ওপর কড়া রোদ- সব মিলিয়ে পিটি ভালোলাগার কোন কারণ থাকতে পারে না।কেবল মাত্র জাতীয় সংগীতের সময়টা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হতো, আমি আড়চোখে সামনে টানানো জাতীয় পতাকাটার দিকে তাকাতাম। কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার মনে হতো, জাতীয় সংগীত গাইলে পতাকাটা বোধহয় খুণি হয়। নইলে কেন ভ্যাপসা গরমের সকালে কেবল জাতীয় সংগীতের সময়ই কোথা থেকে একঝলক বাতাস উড়ে আসবে, আর সেই বাতাসে গর্বিত ভঙ্গিতে পতাকাটা কয়েকবার উড়বে। ব্যাক গ্রাউন্ডে কিছু অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ের গলায় গাওয়া জাতীয় সংগীত, শতশত ছেলে মেয়ে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে, পতাকা উড়ছে, উপরে নীল পরিষ্কার আকাশ, আমি প্রচন্ড একটা মমতা নিয়ে আমাদের স্কুলের সেই পতাকার দিকে তাকিয়ে আছি, এটাই আমার ছোটবেলার দেশপ্রেমের স্মৃতি।
আরো ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, তখন আমার ধারণা ছিলো, প্রত্যেকটা বিশেষ দিনকে পালন করা একটা অবশ্য কর্তব্য জাতীয় ব্যাপার। বিজয় দিবসে আমি যে কারণেই হোক পতাকা বানানোর একটা প্রজেক্ট হাতে নিতাম( এখনকার মতো তখনও ঢিলা ছিলাম, তাই প্রজেক্ট শুরু হতো দুপুরের দিকে)। একটা আয়তাকার সাদা কাগজের দুইপাশে কম্পাস দিয়ে বৃত্ত আকা হতো, খুজেপেতে ছোট হয়ে যাওয়া দুটা রং পেন্সিল দিয়ে পতাকা আকার কাজ শুরু করতাম, ছোটবেলার বিজয় দিবস মানে আমার কা্ছে আফসোসে ভরা বিকাল।সূর্যের আলো সোনালী থেকে কমলা তারপর একসময় ফিকে হয়ে আসতো, আমার জাতীয় পতাকার একপাশ তখনো রং করা বাকি। চোখে পানি, প্রাণপণে সূর্যের আলো থাকতে খাকতে পতাকা শেষ করার জন্য একটা ছোট হয়ে যাওয়া সবুজ রঙের পেন্সিল কাগজের মধ্যে এলোমেলো ভাবে কেবল ঘষছি আর ঘষছি, এটাকে বলা যেতে পারে আমার শিশু বয়সের দেশপ্রেমের স্মৃতি।
আমি আমার ভোতা অনুভূতি দিয়ে যতটুকু বুঝতে পারি ,তা হল দেশপ্রেম খুব মিষ্টি একটা বিষয়। দেশকে খুব ভালোবাসলে তখন দেশটাকে একটা মানুষের মতো মনে হয়, বিশাল একটা মমতাময় মানুষ, আমি যেমন সেই মানুষটাকে ভালোবাসি, সেই মানুষটাও আমাকে একইরকম ভালোবাসে। আমি দাবি করি না আমি বিশাল দেশপ্রেমিক, দেশের জন্য এখনো পর্যন্ত কতটুকু করতে পেরেছি? দেশ থেকে নিতে নিতে হয়রান,দেয়ার হিসাব করতে না যাওয়াই ভালো। তবু হাস্যকর হলেএ সত্যি আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি হ্যালুসিনেশনের মতো দেশটাকে ফিলকরি। একবার এ্যালিফ্যান্ট রোডে, বাটা সিগনালের মোড়ে পপকর্ন বিক্রি করে এরকম একটা ছয় সাত বছরের বাচ্চা ছেলেকে খুব মন খারাপ করে গা্লে হাত দিয়ে আইল্যান্ডের উপর বসে থাকতে দেখেছিলাম। ব্যস্তভাবে রাস্তা পার হবার আগমুহুর্তে দৃশ্যটা দেখে আমি দাড়িয়ে গেলাম, আমার মনে হলো এই বাচ্চাটার মতো গোটা বাংলাদেশটারই খুব মন খারাপ, চারপাশে এতো মানুষ, সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, কারো কোন গরজ নেই দেশটার মন ভালো করার, কেউ দেশকে নিয়ে ভাববে না, সবাই নিজের নিজের ধান্দায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছুটবে, দরকার হলে মারামারি করবে ; কোন কারণছাড়াই বেকুবের মতো আমার চোখে পানি আসলো। মনে মনে বললাম,’রাসকেল তুই মর, দেশের জন্য কিছুইকরতে পারিসনা, তোর মরাই উচিত’।
অন্যান্য জায়গার কথা বলতে পারবোনা, তবে আমার নিজের আর সহ বুয়েটিয়ানদের মারাত্মক আত্মকেন্দ্রীক গন্ডীবদ্ধ জীবনের কথা আমি জানি। দেশটাকে গড়তে হলে আগে নিজেকে গড়ার প্রয়োজন আছে, এটা সত্যি; কিন্তু নিজেকে গড়ার ,বড় হওয়ার কঠিন পথ পাড়ি দিতে দিতে কয়জনের একদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে মনে হয়, অনেক হয়েছে, এবার আমি আমার ছোট্ট আর দু:খী দেশের জন্যে কিছু করবো?
ছোটবেলায় দেশটার জন্য কতকিছু করার কথাই না আমি ভাবতাম , আমার ভুল ছিলো- আমি জানতাম না যে বাস্তবের ধুলো কাদা ভর্তি রাস্তাটা কখনো স্বপ্নের সোনালী রাস্তাটার সামনে যেয়ে শেষ হয় না, বরং স্বপ্নের সোনালী রাস্তাটায় ধুলো জমতে জমতে সেটাই একসময় বাস্তবের রাস্তা হয়ে যায় । ছোটবেলায় ভাবতাম দেশের সব সমস্যা আমি বড় হয়ে ঠিক করে ফেলবো। তারপরে যত বড় হয়েছি নিজেকে তত ছোট আবিষ্কার করেছি। এখন আমি জানি দেশটা যদি একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলের রূপ ধরে আমার চলার পথের একপাশে মন খারাপ করে বসে থাকে তাহলে তার মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দেবার সামর্থ্য টুকুও আমার নেই।
তবুও ভাবতে ভালো লাগে হয়তো একদিন বিজয় দিবসের তাৎপর্য জাতীয় পতাকার খুচরা আর পাইকারী বাজার চাহিদা বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, একদিন বিজয় দিবসে তরুণ তরুণীদের দেশপ্রেমের দৌড় কনট্রাস্ট রংএর কাপড় পড়ে জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেরানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ খাকবে না, একদিন এমন বিজয় দিবস আসবে যে দিন সারাদিনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রধান বা তার চ্যালা চামুন্ডাদেরকে তেল মারার জন্য অপ্রয়োজনীয় মিীছল বের হবে না, একদিন এমন বিজয় দিবস আসবে যেদিন দেশের অধিকাংশ মানুষ বলতে পারবে যে, হ্যা আমরা দেশের জন্য সত্যিকারের কিছু একটা করেছি।
একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করি। পলাশীর বাজারে মামার দোকানে দাড়িয়ে বিকালের নাস্তা খাই, সেদিনও প্লেটে টোস্ট তুলে নিয়ে একটু সরে এসেছি, কয়েকটা বাচ্চা (যারা পলাশীর আশেপাশেই বস্তিতে থাকে) খুব বিরক্ত করা শুরু করলো, টাকা বের করার অবস্থা নাই,বললাম,-’পরে’; দোকানের মামা তার কাস্টমাররকে বিরক্ত করতে দেখে সময়ের প্রয়োজনে বিশাল ধোমক দিয়ে বাচ্চা গুলাকে বিদায় করে দিলো, তারা চলে যাওয়ার পর আমার একটু একটু খারাপ লাগাতে শুরু করলো, খাওয়া শেষ করে বিল মিটায়ে পকেট থেকে টাকা বের করে বাচ্চাগুলাকে খুজতে শুরু করলাম, আমার বেশ খানিকটা সময় লাগলো তাদেরকে খুজে পেতে, সবগুলা বাচ্চা গোল হয়ে মাটিতে বসে আছে,মধ্যে বড়সড় এক প্লেট ভর্তি ন্যুডুল্স। বাচ্চাগুলাকে আমি আদর করে কিছু কিনে দিতে পারি নি ঠিক, কিন্তু তাই বলে অদৃশ্য সেই মহান করুণাধারার বর্ষণ থেমে নেই, এই ভীড়ের চারপাশের সাধারণ মানুষ গুলোরই কারো না কারো ভেতর দিয়ে তা প্রবাহিত হচ্ছে।
তাই আমার মনে হয়,দেশের জন্য কিছু একটা করতে আমরা হাত লাগাই আর না লাগাই, কেউ না কেউ ঠিক উঠে দাড়াবেই; আমাদেরকে খালি ঠিক করতে হবে আমরা একটা আলোকিত মিছিলের অংশ হব,না কি অন্ধকারে এক কোণে অপরাধীর মতো চুপ করে দাড়িয়ে থাকবো। সবাইকে বাসি বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×