somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নুরুন্নবীর বউ

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পৃথিবী ভর্তি এতো মানুষের মধ্যে ঘুরেফিরে নুরুন্নবীর বউ হওয়া নিয়ে তার বউয়ের মনে বিশেষ একটা দু:খ টু:খ নাই।নুরুন্নবী এমন কিছু কেউকেটা টাইপের লোক নয়।বউটার বাপের বাড়ির গ্রামের লোকেরা তার স্বামীর কাজের কথা জিঞ্জেস করলে সে গর্বের সংগে নুরুন্নবীর ইউনিভার্সিটির চাকরির কথাটা বলে দেয়।বেতনের প্রসঙ্গ আসলে বারিয়ে টারিয়ে এমন একটা অঙ্ক বলা হয়, যত টাকা বেতন নুরুন্নবী পেলে তাদের আর কোন চিন্তাই থাকতো না।
আসল কথাটা হল নুরুন্নবী শহরের ভার্সিটিতে চাকরী করে ঠিকই, কিন্তু সেটা আসলে ঠিক ভার্সিটিরই মধ্যে না। সে ছাত্রদের ক্লাস নেয় না, কিম্বা ক্লাসের আশে পাশেও বিশেষ যায় না।কিন্তু ক্লাস ছাড়া অন্য জায়গাতেও তো ছাত্ররা যেতে পারে , না-কি? নুরুন্নবী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বারো ঘন্টা বসে ওই অন্য জায়গাটাই পাহারা দেয়।আর সেটা হল ছাত্রদের হোস্টেল। নুরুন্নবী কোন ছাত্রেরই মামা হয় না, তবু নতুন ভর্তি হওয়া কচি বাচ্চাটা থেকে শুরু করে ভারিক্কি চেহারার সিনিয়র ছাত্রটা পর্যন্ত কেউই তাকে মামা ছাড়া কথা বলে না।তাহলে কথাটা কি দাড়াচ্ছে?- হ্যা নুরুন্নবী ছাত্র হোস্টেলের দারোয়ান।
নুরুন্নবী দারোয়ান হলেও তার বসার জন্যে গর্জন কাঠের চেয়ার টেবিল, যখন তখন বাতাস খাওয়ার জন্যে ফ্যান এসব দেখে ভাবাটা অস্বাভাবিক না যে হলের কর্তৃপক্ষ তাকে বেদম খাতির যত্ন করে। হতে পারে বেচারার আলাদা রুম নাই, আচ্ছা সবার ওই ভার্সিটির স্যরদের মতো দম আটকানো রুম লাগবে এটা কে বললো? এর চাইতে স্বামীর বসার জন্য হোস্টেল গেটের নির্ঘাত খোলামেলা ‘বলতে গেলে অফিস’ জায়গাটা নুরুন্নবীর বউয়ের ভালোই লাগে।
একসময়ের তরুণ যুবা পুরুষ নুরুন্নবী, ছাত্রহলের গেটে বসে থেকে থেকে আস্তে আস্তে থলথলে ভুড়িওয়ালা নুরুন্নবী হয়ে গেল, ব্যাপারটা আসলেই যথেষ্ট আজব এবং দু:খের। ইদানিং নুরুন্নবীর বউ মাঝেমধ্যেই স্বামীকে ঠাট্টা করে ‘মামা’ সম্বোধন করে, নুরুন্নবী তাতে বিশেষ একটা আলোড়িত হয় না, কেবল পান খাওয়া লাল দাত বের করে হালকা একটু হাসে ।মোনালিসার মতো নুরুন্নবীর হাসি নিয়ে তেমন কোন গবেষণা হয় নাই, তারপরেও স্বামীর হাসিটা যথেষ্টই সুন্দর বলে নুরুন্নবীর বউয়ের মনে হয়।
এইযে তাদের তিরিশ বছরের সংসারে বাচ্চা কাচ্চা তো কিছু হয়ই নাই, বরং মাঝখান খেকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নুরুন্নবী আরো বেশি থলথলে আর ভুড়িওয়ালা হয়ে উঠেছে, এতে কিন্তু তাদের ভালোবাসার মধ্যে বিশেষ একটা পরিবর্তন টরিবর্তন আসে নাই।
শুকনা বাছা চালে নুরুন্নবীর বউ যখন পানি ঢেলে সকাল বেলায় ভাত বসায়, তখন তার কাছে মনে হয় ভালোবাসা ব্যাপারটা আসলে ভাত রান্নার মতোনই।একটা অভ্যাস, আবার সেই সাথে একটা প্রয়োজনও।
নুরুন্নবী বাজার থেকে যে সাবান তাকে এনে দেয়, তার কাছে মনে হয় না সাবান ভর্তি থাকে সংসার চালানোর কর্তব্যবোধ, আজগুবি হলেও সত্যি সে সাবানে ভালোবাসার গন্ধ পায়। সকাল-দুপুর-রাতের ভাত রান্নাটাও কি খালি প্রয়োজন? ভাত রান্না আর তরকারী কোটার মধ্যে কি আর সঙ্গের মানুষটার জন্য ভালোবাসা মিশে থাকে না? হুম এটাই হলো ভালোবাসা,তার মনে হয়, এটা থাওয়াও যায় আর গায়েও মাখা যায়। অতএব, নুরুন্নবীর বউ সকালে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি ভাতের মতো দেখতে ভালোবাসা দিয়ে দেয় নুরুন্নবীর খাওয়ার জন্য, তা সেটা নুরুন্নবী বুঝুক আর না বুঝুক।
.....................
পিঠের উপর একটা টিংটিংয়ে হাতের থাবা খেয়ে নুরুন্নবীর দুপুরের ঘুমটা ভেঙে যায়।
-ও নুরুন্নবী বাই, অতো চিন্তা করো ক্যান?
নুরুন্নবী চোখ ডলতে ডলতে হলের ঝাড়ুদার প্লাস ভার্সিটির চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ফিরোজ মিয়ার দিকে তাকায়। কাচা ঘুম ভাঙা মগজে ঠিক কি নিয়ে তার চিন্তিত থাকার কথা সেটা চট করে মনে পড়তে চায় না।
শীতকালের দুপুরের রোদে ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছু ব্যাপার আছে কি-না, চিন্তা করতে করতে নুরুন্নবী টেবিল থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে, পান খাওয়া লাল দাত বের করে হেসে সহৃদয় থাবার বিলম্বিত প্রতিদান দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তখনই চট করে স্ত্রীর কঠিন অসুখটার কথা মনে পড়ে যায় বেচারার। বউয়ের পাংশু মুখ আর দিনদিন জ্যান্ত কংকালে পরিণত হতে থাকার বাস্তবতা আচমকা এসে তাকে জাপটে ধরে।
‘জরায়ু’ নামটা নুরুন্নবী আগে কখনো শোনে নাই। এতোদিন ঘর করার পর যখন সে জানতে পারলো যে তার স্ত্রীর পেটে এই অদ্ভুত নামের একটা জিনিস আছে,ততোদিনে জিনিসটা থেকে অসুখের কোষ শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে।
তারপরেও ভার্সিটির ছাত্রহলের দারোয়ান নুরুন্নবী স্ত্রীকে বাচিয়ে তোলার জন্যে তার থলথলে শরীর নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে নাই।গ্রামে গিয়ে ভাইদের সঙ্গে কাজিয়া করে বিষয় সম্পত্তির ভাগে পাওয়া ছোট্ট জমিটা বলতে গেলে পানিরও কম দামে বিক্রি করে এসেছে, ম্যালা কাগজপত্র চালাচালি করে প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় পুরো টাকাটা তু্লে ফেলেছে।এতেও কি হয়? কি দৌড়ঝাপটাই না গেছে কয়েকদিন। শেষের দিকে বাধ্য হয়ে অসহায় নুরুন্নবী সহকর্মী আর হলের ছাত্রদের কাছে হাত পেতেছে।
ফলাফল কি হলো শেষমেষ? কিছুই না। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরাজিত নুরুন্নবী ছাত্র হলের গেটে বসে সারাদিন পান চিবায়।অধিকাংশ সময় দুপুরের ভাতের টিফিন ক্যারিয়ারটা অযত্নে অবহেলায় পাশে পড়ে থাকে।
..................
নুরুন্নবী মনের মধ্যে প্রায়ই সেই দিনটার জাবর কাটে, যেদিন তার বউ আর থেরাপী নিবে না ঘোষণা দিল,
-‘শোনেন মামা, বাচ্চা গুলা বাসা থেকে দূরে থাকে, কষ্ট করে লেখাপড়া করে,সারা মাস কি খায় না খায়, ওদের ফিস্টের টাকা দিয়ে আমি আর থেরাপী নিব না’
পরে বেশি কঠিন করে বলা হয়ে গেছে ভেবে যোগ করে,-‘আপনার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু, ততটুকু তো আপনি করসেনই- দ্যাখেন দেখি আমার মতো একটা বয়স্ক মানুষের বেচে খাকা না আর না থাকায় কি আসে যায়- ছাত্র গুলা ভালো খাওয়া দাওয়া করে পড়ে শুনে একদিন কতো বড় হবে, মানুষ হবে-ওদেরকে আমি ক্যান কষ্ট দিব?’
নুরুন্নবীর কোন আপত্তিই আর ধোপে টিকে না- সেদিন খেকে সব ট্রিটমেন্ট বন্ধ করে বউকে হোমিওপ্যাথি খা্ওয়াতে আরম্ভ করে সে।
ছাত্রহলের নি:সন্তান দারোয়ান নুরুন্নবী তার স্ত্রীর মনের গোপন নরম অংশটার খবর জানে না, এমন নয়। নুরুন্নবীর বউ যখন মাঝেমধ্যে তার কর্মস্থলে বেড়াতে আসে, ছাত্রগুলার দিকে উজ্জল, কিন্তু কেমন একটা ক্ষুধার চোখে তাকায়,তখন বউটা তার না হওয়া কোন এক সন্তানকেই যে এই ছেলে গুলার ভীড়ে হেটে চলে বেড়াতে দেখে, তা-কি আর নুরুন্নবী বোঝেনা?
তবু নুরুন্নবী হল গিয়ে বাস্তবের গেটে বসে থাকা মানুষ, পর পর কয়েক মাসের ফিস্টের টাকা নুরুন্নবীকে দিয়ে দেয়ায় ছাত্রদের মধ্যে তৈরি হওয়া অসন্তোষের বাষ্প সে ঠিকই একদিন ডায়নিং রুম এর গেটে পোস্টার আকারে দেখতে পায়, সহকর্মীরাও তাকে যেন বেশি সুবিধা পাওয়া মানুষ হিসেবে অপছন্দ করতে আরম্ভ করে- বৃথা চেষ্টা করে অহেতুক পয়সা নষ্ট না করার উপদেশও সে বিস্তর শোনে।
নুরুন্নবী বউকে এসব কথার কিছুই জানায় না। একাই ছাত্রহলের গেটে বসে মানুষদের ঘৃণা, করুণা আর বিরক্তি ভরা চোখ দেখে যায়। অসহায় পরাজিত নুরুন্নবী পানখাওয়া লাল দাত বের করে সহৃদয় হেসে ভাগ্যের বিদঘুটে নির্মম আচরণের নির্বাক প্রতিবাদ করে যায়।
..............
অবশেষে কোনও এক রোদ মরে আসা পড়ন্ত বিকেলে ভার্সিটির এক ছাত্র অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখে হলের গেটের সামনে থমকে দাড়ায়। সে দেখতে পায়, নুরুন্নবী আর একজন কংকালসার রুগ্ন মহিলা হাতধরা ধরি করে হলের বাগানে হেটে বেড়াচ্ছে। মহিলার মুখে খেলা করা অপার্থিব কোনও এক আনন্দের ধারক, হাসির রেখাটি অনেকদিন পর্যন্ত তার মাথার মধ্যে ঢুকে থাকে।



.................................
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক,তা বোধহয় বলা যাবে না।তবে গল্প তো গল্পই।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×