somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজকে যাদের মন খারাপ...

০৭ ই মে, ২০১২ রাত ৮:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অবশেষে এক রোদ মরে আসা কমলা বিকেলবেলায় আমি আমার খদ্দরের ফতুয়াটা গায়ে চাপালাম।বারান্দার কোণা খেকে টেনে হিচড়ে বের করে আনলাম ধুলো পড়া নীল রঙের হারকিউলিস এম টি বি সাইকেলটাকে।তারপর সেটাতে সওয়ার হয়ে রওয়ানা হলাম, অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম বলতে পারলে ভালো লাগতো, কিন্তু আসলে সেদিনটা ছিলো আমার এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন।দুরু দুরু বুকে, ঘেমে যাওয়া হাত আর টলতে থাকা পা নিয়ে যে ছেলেটা সেদিন কোনমতে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে রেজাল্ট আনতে যাচ্ছিলো, সে জানতো না তার সামনে কী অপেক্ষা করছে।

গ্রেডিং সিস্টেম নতুন নতুন চালু হবার পর যে জিনিসটা বুঝতে আমার অনেকদিন লেগে গেলো, তা হল রেজাল্টের দিনটাতে আসলে রেজাল্টটা পাওয়া যায় না, যেটা পাওয়া যায় আক্ষরিক অর্থে সেটা হল রেজাল্ট কোন রেন্জের মধ্যে আছে তার একটা ধারণা। অধিকাংশ মানুষই মূল রেজাল্টটা জানে পরেরদিন, যখন কম্পিউটারে গ্রেডশীট চলে আসে।বাচ্চাগুলাকে এতো যন্ত্রণা না দিয়ে কেন গ্রেডশীটসহ পুরো রেজাল্টটা একদিন পরে পাব্লিশ করে না, কে জানে?যেমন কেউ একজন এ প্লাস পেয়ে গোল্ডেনের চিন্তায় বিভোর হয়ে হালকা বাতাসে টানা প্রায় চব্বিশ ঘন্টা ভেসে বেড়ানোর পর যখন জানতে পারে যে সে কানের গোড়া দিয়ে এ প্লাস পেয়েছে, তখন বেচারার ভাল কলেজে ভর্তি হবার স্বপ্ন খান খান হয়ে ভেঙে গেলে তার দায়িত্ব কে নেবে?

স্বপ্নভঙ্গের দু:খটা আমি মনে হয় খানিকটা বুঝি। এসএসসির ইংরেজীতে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এ মাইনাসের মূল্য দিতে গিয়ে আমাকে ভর্তি হতে হলো চট্টগ্রাম শহরের পেছনের সারির একটা কলেজে। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই নটরডেমের অবারিত ক্যাম্পাস, প্রশ্বস্ত সিড়ি, আমার ঠিক আগেই ভাইভা দিতে যাওয়া কলেজিয়েটের ফর্সা সুন্দর ছেলেটার মুখ চোখে ভাসে, পত্রিকায় রেজাল্ট পাব্লিশ হবার সুবাদে আমি ততদিনে জানি সে এখন আমার স্বপ্নের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চোখ খুললেই আবার দেখতে পাই আমার বাস্তবের ময়লা , ছোট্ট ক্যাম্পাস, পাশের টয়লেট থেকে ভেসে আসা অ্যামোনিয়ার গন্ধযুক্ত ক্লাস রুম। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক দলের বড় ভাইরা এসে মিছিল করার জন্য ধরে নিয়ে যায়, কোনকিছু করতে না পারার অন্ধ আক্রোশে হাটার গতি শ্লথ হয়ে গেলে, পিঠে গুতা দিয়ে কোন একটা কন্ঠ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তাড়াতাড়ি হাটেন’।

যাক সেসব কথা, এরপরে এইচএসসির রেজাল্ট। কেউ আমাকে কেমিস্ট্রি সেকেন্ড পেপার পরীক্ষার আগের বন্ধের দিনগুলোতে হ্যারিপটার পড়ার জন্য বেদম চাপাচাপি করে নি।আমি নিজের বুদ্ধিতে জেনে শুনে পড়েছি। কাজেই এ প্লাস ছুটে যাওয়ায় কাউকে দোষ দেয়ার নাই।ফিজিক্স এর অংক সবগুলা আমি রিভিশন দিয়ে গেলেই পারতাম, কেন কয়েকটা চ্যাপ্টার ঝুলায়ে রেখে গেলাম, সেটা আজও আমার কাছে রহস্যের মতো লাগে। বাংলায় যে আমাকে এ প্লাস দেয় নাই তাকে আমি দোষ দেই না, নিজের লেখা মাঝে মধ্যে আমি নিজেই বুঝতে পারি না, সে বেচারা কষ্ট করে পড়ে নাম্বার দিয়েছে, না হয় একটু কম দিয়েছে, তাতে কি? আমি আমার নিজের আর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর গ্রেডশীট সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে একসাখে ডাউনলোড করি, ওর গোল্ডেন পাওয়া গ্রেডশীটের দিকে তাকিয়ে পাশে নিজের কানের গোড়া দিয়ে এ প্লাস পাওয়া গ্র্রেডশীটটাকে কেমন দীন- হীন মনে হয়, দুইবছর ধরে প্রায় একইরকম খাটাখাটনির পর ভাগ্যের নির্মম ঘুষিটা হজম করতে এমনকি আমারও কিছুটা সময় লাগে।

ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে থানার মধ্যে ফার্স্ট প্লেস আর ক্লাস এইটের বৃত্তিতে ফোর্থপ্লেস করা যে ছেলেটার ভিতরে ভালোছাত্র সুলভ আত্মবিশ্বাসের একটা ঝরঝরে ভাব ছিলো, ততদিনে সেটা কেমন মিইয়ে গেছে। তার জায়গা দখল করেছে কেমন একটা মার খাওয়া বাচ্চা ছেলের অন্ধ জিদ । এরপর এখন পর্যন্ত প্রায় সব রেজাল্টেই আমি নিরাশ হয়েছি, বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট, বুয়েটের একেকটা টার্ম ফাইনালের রেজাল্ট, কোনটাতেই স্বপ্নকে ছুতে পারি নি,আসলে যখন স্বপ্ন দেখি তখন পায়ে কোন শেকল থাকে না, কিন্তু বাস্তবে অসংখ্য অক্ষমতার শিকল আমাকে শক্ত করে বেধে রাখতে চায়, এক পা আগাতে হলেও আমাকে গায়ের জোরে আগাতে হয়।

তবে আমি আমার এতোদিনের জীবন থেকে কিছু একটা শিখেছি। আজকে ২০১২ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে।আজকে যাদের মন খারাপ তাদের সেটা কাজে লাগবে ভেবেই এতোকিছু বলা। আমার মনে হয় কে কত উচু লাফ দিয়ে একটা বাধা পার করলো, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সব মিলিয়ে কতগুলো বাধা অতিক্রম করা হল সেই ব্যাপারটা। সোজা কথায় জীবন আর ক্যারিয়ারটাকে একটা অবস্টাকল রেস কল্পনা করলে, কোন একটা নির্দিষ্ট বাধায় কম উচ্চতা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। পরের বাধায় তুমি অন্যদের চেয়ে ভালো করে দেখিয়ে দাও।কিমবা নিতান্তই পড়ে গেলে বাধাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যাও। জীবন নিয়ে যে আশাবাদী,জীবন তার জন্য কখনোই সুযোগের দড়জা বন্ধ করে না আমার বিশ্বাস।

হলে খাকার কারণে খবর দেখতে পারছি না।ভিকারুন্নেসার, হলিক্রসের এ প্লাস পাওয়া মেয়েদের সম্মিলিত লাফালাফির ছবি গত কয়েক বছর ধরে আগ্রহ করে টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখায়। সাফল্যকে অবশ্যই উৎসাহিত করতে হবে, সেই সাথে এটাও ভাবতে হবে যে ছেলেটা বা মেয়েটা খুব খারাপ রেজাল্ট করে লজ্জায় মরে যাচ্ছে, ঘরের দড়জা বন্ধ করে কাদছে, হয়তো মনে মনে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছে (এবং তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়)এদের বাবা মা আপনজনরাও কেউকেউ টিভি দেখছে, এই সাফল্যের প্রকটতা দিয়ে তাদের তাদের বুকের হাহাকারটা আরো বাড়িয়ে দেবার সত্যিই কি কোন প্রয়োজন আছে?

যে কোন পাব্লিক পরীক্ষার রেজাল্টের সময় অহেতুক আমাদের আশেপাশে যে সাজ সাজ রব ফেলে বাচ্চাগুলোকে ভয় পাইয়ে দেয়া হয় তার কোন দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না।এর ফলে খারাপ রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েদের পরিবার সামাজিক অসম্মানের মধ্যে পড়ে যায়, তাদের দু:খের দিনগুলো আরেকটু কঠিন হয়ে ওঠে।

আসলে কথাটা হল আমাদের বিশাল জীবনটার তুলনায় ছোটখাট একেকটা পরীক্ষার ফলাফল হাস্যকর রকমের গুরুত্বহীন, আজকে যাদের মন খারাপ- তাদেরকে বলছি, তোমার জীবনে তুমি নিজেকে যে জায়গাটাতে খুব বেশি রকমভাবে দেখতে চাও, তুমি বিশ্বাস না করতে চাইলে নাই, কিন্তু আজকের এই ফলাফলে সেই জায়গার কিচ্ছু যাবে আসবে না, তোমার ইচ্ছাশক্তি একদিন তোমাকে সেই জায়গায় ঠিক পৌছে দেবেই, তোমাকে খালি মুষড়ে পড়া থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখতে হবে, নিজের শক্তিতে নিজেকে তুলে ধরতে হবে।

পরিশেষে, আমি আমার ছোট্ট ভাইবোনগুলার জীবনের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি।

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১২ রাত ৯:৪০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×