.................................
কাঁচা বাজার জায়গাটাকে আমি হয়তো ততটা অপছন্দ করতাম না, কিন্তু এর মুরগীরঅংশ টাকে মন থেকে পছন্দ করা আসলেই খানিকটা কঠিন। নিজেদের বিষ্ঠার উপর চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে থাকা একদল নিরীহ সদানন্দ জীব কেবল মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে- মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে কোন মুরগীর চোখে চোখ রাখা তো দূরের ব্যাপার , নিজের চোখের পানি ধরে রাখাই মুশকিল। অবশ্য এখন অব্দি ঐ পরিমাণ মানবিক(কিম্বা মুরগিক) হয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতায় প্রায়ঃশই তাদের বিষ্ঠার দুর্গন্ধ আমার নাকে বড় হয়ে ওঠে।
নিতান্তই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের একজন হওয়ায় আমাকে নিয়ম করে অপছন্দের কাজ গুলো যত্ন সহকারে করতে হয়। যেমন কালকেই সন্ধ্যায় আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম গোপীবাগ রেলগেটের কাঁচাবাজারে, গোটা দশেক ফার্মের মুরগীর খাঁচার সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় । তো দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ খেয়াল হল দোকানদারের হেল্পার ছোকরাটা, বয়স পনের ষোলর বেশি হবে না, তেল দিয়ে পাট করে আঁচড়ানো চুল, সস্তা জ্যাকেট গায়ে, খুবই নোংরা একটা কাজ করছে। সে দুটা ইটের উপর কন্ডেন্স মিল্ক এর কৌটা রেখে তার নিচে কাগজ পুরিয়ে সেই জিনিশ গরম করার চেষ্টা করছে। নাড়ানি হিসেবে যেটা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই চিকন মাথা ছুরিটা একটু পর পর নেয়া হচ্ছে মুরগীর বিষ্ঠা জমে থাকা মেঝের উপর থেকে। স্পষ্টতই এই কন্ডেন্স মিল্ক এর চা আমি নিজে থেকে কখনও আগ বাড়িয়ে খেতে চাইতাম না।
খেয়াল করলাম কাগজের ধোয়ায় আমি একা না, আশে পাশের দোকানদারেরাও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিরক্ত হচ্ছে। আঠালো তরলের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে নিতান্ত ঠ্যাঁটার মতো মুখ গুঁজে বসে থাকে। এক দুই ঘা সেই বেত্তমিজ এর পাওনা হয়েছে কি হয় নাই, এরকম মুখরোচক আলোচনায় জল ঢালতে তার কয়েক বন্ধু এসে উপস্থিত হয়। উদ্ধার হয় কন্ডেন্স মিল্ক এর মতো দেখতে আঠালো তরলের ‘পানি মেশানো আটা’ পরিচয়। যা কিনা আঠা হিসেবে ব্যবহারের অপেক্ষায় কন্ডেন্স মিল্ক এর কৌটায় ততক্ষনে ঢেউ তুলেছে।
‘আঠা, আঠা দিয়ে আবার কি হবে?’
- ছেলে গুলার পকেট থেকে বেশ কয়েক বান্ডিল কাগজের জাতীয় পতাকা বের হয়। আশে পাশের প্রৌঢ় এবং জ্ঞানী দোকানদারদের উচ্চকিত হাসি শোনা যায়।
আঠালো সেই তরলের মতো জিনিশটা আসলে খানিকটা বিশুদ্ধ দেশ প্রেম কিনা, আসুন সেইসব উচ্চ মার্গের বিতর্কে আমরা না যাই। শুধু মনে রাখি, সারাদিন নোংরা ঘেঁটে, রাতের বেলায় আরশোলাদের পাশে শুয়ে যে কিশোর বড় হচ্ছে, এই দেশটা তারও।
হয়ত সেই দিন কখনো আসবে না, কিন্তু যদি এমন হয়, সেই কিশোর খুব বড় একটা জায়গায় পৌঁছালো, সে না হলেও তার মতো কেউ, আমার মনে হয় তারা আজকের মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতিদের মতো দেশের সাথে গাদ্দারি করবে না, নিজের প্রয়োজনে দেশকে বলাৎকার করবে না। দেশ প্রেমের মতো এক আঠালো তরল যার হৃদয়ে আছে সে কি পারে নিজেকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবতে?
বিজয় দিবসের বিকেলে ঘুরতে বের হয়ে আমার আড়াই আর সারে ছয় বছর বয়স এর ভাগিনা দ্বয় তাদের গালে জাতীয় পতাকা একে বাসায় ফিরেছে। তারা আলাদা আলাদা ভাবে দাবি করল, তাদের গালে আঁকা জিনিসটা হল বাংলাদেশ। আমাকে তাদের বাংলাদেশে চুমু খেয়ে দিতে হল- আমার আচমকা মনে হল এই বাংলাদেশের ভেতরে এই সব নতুন মানুষদের দিয়ে নতুন আরেকটা বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে । সেই বাংলাদেশ খুব ,খুব আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে বুকের ভেতর আঠালো তরল সমৃদ্ধ মানুষদের। যাদের হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে একদিন স্বপ্নের কোমল উদ্যান থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেবে।
সবাইকে বাসি বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




