somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহজাদা শাহ সুজার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

০৮ ই জুন, ২০২০ দুপুর ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আওরঙ্গজেব সিংহাসন দখল করে বড় ভাই দারা শিকো ও ছোট ভাই মুরাদ বাকশতে হত্যা করেন, বাবা শাহজাহানকে করেন গৃহবন্ধী। এরপর মেঝ ভাই শাহ সুজাকে বাংলা থেকে ধরে আনার জন্য পাঠান সেনাপতি মীর জুমলাকে। শাহ সুজার রনকৌশল মীর জুমলার কাছে নস্যি। শাহ সুজা বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যান। ঠিক করেন আশ্রয় নেবেন আরাকান রাজ্যে।

আরাকান রাজ্যের রাজধানী তখন ম্রোহং, মতান্তরে ম্রাউক-উ। রাজা ছিলেন চন্দ্রসুধর্ম্মা, মতান্তরে চন্দ্র সুধর্ম, আরাকান উচ্চারনে যা সান্দা থুডাম্মা। মোঘল সংস্কৃতিবান শিল্পানুরাগী শাহজাদার সামনে আরাকান রাজা প্রায় জংলী, বারবারিক। কিন্তু শাহ সুজার উপায় নেই। তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আরাকান রাজা শর্ত দেন শুধু পরিবার ও সৈন্যদের এক অংশ আসতে পারবে। সৈয়দ আলী আহসান ‘পদ্মাবতী’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন শাহ সুজা বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যাবার সময় সঙ্গে ১৫০০ অশ্বারোহী সৈন্য ছিল। স্ত্রী, তিন কন্যা এবং এক পুত্র, ৪০ জন অনুচর ও দু’শজন দেহরক্ষী সহ শাহ সুজা আরাকান ঢুকেন। সাথে ১২টি উট বোঝাই ধনরত্ন। সেনাবাহিনীর বড় অংশ চট্টগ্রামে থেকে যায়।

আবদুল করিম নামে এক হিস্টোরিয়ান তার ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ লিখেছেন শাহ সুজার দল রাজা চন্দ্র সুধর্মের পাঠানো নৌবহরে নাফ নদী পার হয়ে আরাকানে ঢুকেন। শাহ সুজা ইচ্ছা পোষণ করেন বর্ষা মৌসুম শেষ হলে নৌপথে মক্কা, পারস্য বা তুরস্কে চলে যাবেন। গবেষক নিকোলাও মানুচির 'স্টোরিয়া ডো মোগর' ও চার্লস স্টুয়ার্টের 'হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল' বইয়ে এসব উল্লেখ আছে। কিন্তু এরপর শাহ সুজার কি হয় তা উল্লেখ নেই।

যদুনাথ সরকার হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব নামে এক বই লেখেন। অ্যালবার্ট ফিচ বার্মা - পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট নামে লেখেন এক বই। তাদের বইয়ে আরাকানে শাহ সুজার পরিণতি সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানা যায়। যদুনাথ সরকার ও অ্যালবার্ট ফিচের তথ্যের উৎস ছিল ওলন্দাজ বণিকরা যারা সেসময় আরাকানে ব্যাবসা করতো এবং ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের। এই দুই বইয়ে উঠে আসে যে রাজা চন্দ্র সুধর্ম আশ্রয় দেবার বিনিময়ে শাহ সুজার বড় মেয়ে গুলরোখকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। অন্য কিছু সুত্রে উঠে আসে রাজা চন্দ্র সুধর্মের সেই ১২টি উট বোঝাই ধনরত্নের দিকেও চোখ যায়।

শাহ সুজা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং সিদ্ধান্ত নেন রাজা চন্দ্র সুধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন, সিংহাসনচ্যুত করবেন। বেশ উচ্চাভিলাসী ও বোকা সিদ্ধান্ত। চন্দ্র সুধর্মের অনুচর, গুপ্তচর ছিল শাহ সুজার আসে পাশে। বিদ্রোহের গোপনীয়তা রক্ষা হয় না। বাধে সংঘাত। শাহ সুজা আবার হারেন সেই যুদ্ধ। পালিয়ে যেতে থাকেন জঙ্গলে। কিছুদিন জঙ্গলেই পালিয়ে থাকেন। রাজা চন্দ্র সুধর্মের দেহরক্ষীরা তাকে ও পলায়নরত অনুচরদের একসময় ধরে ফেলে, জঙ্গলেই তাদের কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। মেয়েদেরকে ধরে আনা হয়। চন্দ্র সুধর্মে গুলরোখকে বিয়ে করেন অথবা তার হেরেমে রাখেন। গুলরোখ একসময় গর্ভবতী হন। কিছুমাস পরে গুলরোখের কোন এক কাজে ক্ষিপ্ত হয়ে গর্ভবতী অবস্থাতেই হত্যা করা হয়। তার দুই বোনদের অন্ধকার খুপরিতে রেখে মারা হয়। গুলরোখের অপরাধ সম্ভবত ছিল চন্দ্র সুধর্মকে হত্যার চেষ্টা।

আরাকানের জঙ্গলে ফালা ফালা হয়ে পরে থাকেন শাহজাহান পুত্র, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভাই শাহ সুজা। নাকি তিনি পালিয়ে যান ত্রিপুরার দিকে? নাকি চট্টগ্রামের দিকে? অনুমানের ডালপালা ও গুজব ছড়াতে থাকে।

দিল্লীর দরবারে খবর আসতে থাকে যে শাহ সুজাকে দেখা গেছে মক্কায় এবং তুরুস্কে। আওরঙ্গজেব এরকম এক খবর পেয়ে মক্কায় লোকও পাঠান। কিন্তু পাওয়া যায় না শাহ সুজাকে।

কোন কোন সুত্র বলে শাহ সুজা ত্রিপুরা হয়ে মণিপুরের হাইগনাঙ-এ আশ্রয় নেন। তাকে আশ্রয় দেয় পাঙ্গাল জনগোষ্ঠীর লোকেরা। অন্য সুত্র বলে তিনি এক সময় চট্টগ্রামে এসে পৌঁছান এবং পীর সন্ন্যাসী হয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে দেন। আবার একটি সুত্র বলে পাকিস্তানের সারগোদায় তার কবর পাওয়া গেছে। কবরের ফলকে খোদাই করা আছে তার নাম, বাবা শাহজাহানের নাম। মৃত্যু সাল দেয়া আছে ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ। তবে এসবই অনুমান এবং কিছু ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত। খুব সম্ভবত আরাকানের জঙ্গলেই বিশ্বস্ত অনুচরদের সাথে মারা যান শাহ সুজা।

শাহ সুজা ও তাঁর পরিবারের পরিণতির কাহিনী ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকের মাধমে আগ্রাতে ও দিল্লীতে এসে পৌঁছায় কিছুকাল পর। এক ওলন্দাজ বণিক আরাকানে বসবাসকারী তাঁর সহকর্মীর একটি চিঠি পেশ করেন আওরঙ্গজেবের দরবারে। ফার্সি ভাষায় সেই চিঠি অনুবাদ করা হলে জানা যায় শাহ সুজা ও তাঁর পরিবারের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির কথা।

আওরঙ্গজেব সেই সময় নাকি দুই হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে বলেছিলেন, 'তোমার দরবারে অহংকারীর পতন আর নিরহংকারীর পুরস্কার সর্বদা সুনিশ্চিত।'

বাবা শাহজাহান তখনো জীবিত, কিন্তু আওরঙ্গজেবের কাছে বন্দী। ঈশ্বরের কাছে মৃত ছেলের আত্মার মাগফেরাত করা ছাড়া কিছু করার ক্ষমতা নেই তখন তার।




**ব্যক্তিগত ব্লগেও প্রকাশিত

তথ্য সুত্র

JN Sarkar, ed, History of Bengal, vol. II, Dacca University, Dhaka, 1948


JN Sarkar, History of Aurangzib, vol. II, Orient Langman Reprint, New Delhi, 1972-74


Abdul Karim, History of Bengal, Mughal Period, vol. II, Rajshahi University, Institute of Bangladesh Studies, Rajshahi, 1995

Khan, Inayat; Begley, Wayne Edison. The Shah Jahan name of 'Inayat Khan: an abridged history of the Mughal Emperor Shah Jahan, 1990


Shujauddin, Mohammad; Shujauddin, Razia. The Life and Times of Noor Jahan. Caravan Book House, 1967
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২০ দুপুর ২:৪৮
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×