আমাদের লোকালয়ের কাছেই ছিল একটি নদী। সেই নদীর তীর বড়ই কান্তিময়, মনোরম। প্রায় ইচ্ছে করতো নদীতে নেমে শরীরটাকে এক অজানা অচেনা মোহনার গন্তব্যে ছেড়ে দিতে। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পড়ন্ত এক বিকেলে নদীতে নামার অজুহাত খুঁজছি। হঠাৎ দেখি অদূরে দুটি মেয়ে বসা। একজনকে আমি চিনি। আমাদের ক্লাসেরই। নদীতে নামার পরিকল্পনা আপাতত বাদ রেখে আমি তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে বললাম, তোমার পাশের জনকে তো চিনতে পারলাম না। তাদের চমকে দেবার আমার উদ্দেশ্য আংশিক সফল হল। আমার ক্লাসের মেয়েটি কিছুমাত্র বিচলিত না হলেও তার পাশের জন ভয়াবহ চমকে গেল। চমক আর কৌতূহল মেশানো কি অদ্ভুত এক দৃষ্টি! আমি নিজেই উল্টো ভয় পেয়ে গেলাম।
কেন আমি করলাম এ কাজ? জীবনে প্রথম বার মনে হয় কোন কাজের জন্য আফসোস হল। মেয়েটি এত আগ্রহ নিয়ে দিগন্তটা দেখছিল বলেই কি? যে দিগন্ত কি যেন এক অপার ঐশ্বর্যের লোভ দেখিয়ে নদী ও সূর্যকে একটু একটু করে তার কাছে টানে। কিন্তু তাতে আমার কি আসে যায়?
কচুপাতায় শিশির বিন্দু একটি অসাধারণ দৃশ্য। টোকা দিলে সেই অসাধারণ দৃশ্যটা মিলিয়ে যায়। তারপরও আমরা টোকা দেই। কেন দেই? অসাধারণ কিছু ছুঁয়ে দেখতে চাওয়ার সর্বনাশা লোভে ? নাকি সুন্দর কিছুকে ধ্বংস করার এক অর্থহীন অসুস্থ ইচ্ছা থেকে ?
তার উদাস তাকানোর মধ্যেও কি যেন এক দুর্বিনীত আগ্রহ ছিল ! সেই আগ্রহের দুর্বোধ্যতায় এক অসহ্য সৌন্দর্য কোথাও জেগে উঠেছিল। আমি অমীমাংসিত কোন এক অভিপ্রায়ে সেইটা লন্ডভন্ড করলাম। শিশির বিন্দুহীন কচুপাতা ছেড়ে মানুষ চলে আসে। আমিও চলে এলাম। মনটা আমার খারাপ হল। এই অজুহাতে কাউকে আর কিছু না বলে নদীতে ঝাপ দিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনাটা হল ভয়াবহ। স্কুল কলেজে সীমিত গন্ডির কাছে এ তো রীতিমত রাজ্য! এলাহী যার কারবার। তার মধ্যে হঠাৎ করেই স্মার্ট হয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েদের মাপা চলাফেরা। নিভৃত মফস্বলে ফেলে আসা সেকেলে ভালবাসার মানুষটাকে ধরে রাখতে আবার খাবি খাচ্ছিল কজন। কারো কারো এখান থেকেই ভালবাসার জাল বোনা শুরু। তাদের বোনা কারেন্ট জালে বাদ পড়েনা কেউই। এর মাঝেই চলে হিসেব করে পড়াশোনা। একটা আলগা যত্নের ছাপ সর্বত্র। আমি হাপিয়ে উঠি। তার উপর এল মোবাইল। এই বিস্ময় বাক্সটা জীবনটাকে যেন অসম্ভব সহজ করার পণ করে নেমেছে। বিস্ময় আমাকেও গ্রাস করে। সেই বিস্ময়ভাব থাকতে থাকতে আমিও কিনলাম একটা মোবাইল। কিন্তু বিস্ময়ের হাত ধরে আসে আপদ। মোবাইল পুষতে খাবি খাওয়ার দশা। পারতপক্ষে তাই মোবাইল ধরি না।
তবে মাঝে মাঝেই হেলায় পড়ে থাকা মোবাইলটাকে বড় মায়া হয়। হাতে তুলে তখন নেড়েচেড়ে দেখি। এখনকার মত তখন ঘন ঘন মোবাইল বেজে উঠতো না। যারটা বাজতো সে গর্বিত মুখে রিসিভ করতো। নায়কের মত গলায় ভারিক্কি ভাব এনে বলতো, হ্যালো। কিন্তু যে কল করে সে এক মিনিট হতে না হতেই চোখ কপালে তুলে বলে, রাখো, রাখো, রাখো। নানা কায়দায় মিসকল ধরা তো ছিলই। নিমিষে ৭টাকা হারানোর বেদনায় কাতর এক অদেখা মুখ কল্পনা করে অসুস্থ এক আনন্দ হয়। এরকমই এক পরিকল্পনা নিয়ে স্পীকারের পাশে মোবাইল রেখে বসে আছি একদিন। যথারীতি মোবাইলে কল আসার আগেই ধরে ফেললাম। কিন্তু ওপাশ থেকে কল কাটা হয় না। আমি অবাক হয়ে ফোনটা কানে নিয়ে হ্যালো বলি। ওপাশ থেকে বলতে শুনি, আমার মনটা অনেক
খারাপ। আপনি কি পারবেন আমার মনটা ভালো করতে?
না দেখতে পেলেও টের পাচ্ছি অনেকে এ পর্যায়ে আমার অতিরিক্ত মেলোড্রামা দেখানোয় এক গাল হেসে নিচ্ছেন। গল্প লেখার জায়গা পাওনা বলে সিরিয়াস কিছু পাঠক পিন্ডি চটকাচ্ছেন। তবে বাস্তবের রাস্তাটা মাঝে মাঝেই আশ্চর্য সরল। সামনের গাড়ির হেডলাইটের আলো সেই সরল রাস্তায় আমাদের বিভ্রান্ত করে।
আমিও বিভ্রান্ত হলাম। বিভ্রান্ত হয়েই ভ্রমের আগুনের দিকে হাত বাড়ালাম। ( to be continued)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০০৮ রাত ৩:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



