একটা ব্যাং কে যদি কখনো কোন নর্দমা কিংবা অগভীর নোংরা ডোবা থেকে তুলে এনে সাগরের পরিষ্কার লবণাক্ত জলে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে সেটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে এদিক-ওদিক লাফাতে থাকে! সাগরের অথৈ জল পেয়ে সেটি ভুলে যায় এই লবনাক্ত পানি তার বেঁচে থাকার জন্য কতটা প্রতিকূল। খুব অল্প সময়েই লবণাক্ত পানিতে তার ক্ষুদ্র জীবন বিষিয়ে উঠে। ফলাফল অতি অবশ্যাম্ভাবি! গভীর থেকে আরও গভীরে সেটি নিস্তেজ ও নিঃশেষ হয়ে যায়!
এইবার মুল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ২ টা ঘটনা শেয়ার করার খুব ইচ্ছা ছিল। একটা আমার বাবার জীবনের আরেকটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত জীবনের। একান্ত ব্যাক্তিগত বলেই নিজের অভিজ্ঞতার জায়গাটা আর শেয়ার করলাম না। কিন্তু প্রতি মুহুর্তেই ভাবি, মানুষের চোখ ঝলসানোর অভ্যাসের পরিনতিটা কত ভয়াবহ হতে পারে।
দৃশ্য-০১
সালটা ঠিক মনে নেই। আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম। বাবা আর্মির সাধারন একজন সিপাহী। বেশ তাগড়া জোয়ান হওয়ায় প্রায়ই উনার ইউনিটের (অফিস) মেইন গেটে গার্ড পড়ত। তো যথারীতি একদিন গেটে দাড়িয়ে কর্তব্যরত আমার বাবা। সাথে গার্ডে ছিল আমার পরিচিত আরেক আঙ্কেল(বাবার কলিগঃ নাম প্রকাশ করলাম না)। এমনই এক গ্রীষ্মের বিকেল বেলা, সব নিস্তব্দ। সৈনিকেরা ডিউটি শেষে যে যার মত শিডিউল অনুযায়ী খেলাধুলায় ব্যাস্ত। এমন সময় মেইন গেটে বেশ বয়স্ক একজন বৃদ্ধের আগমন। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া জীর্ণশীর্ণ শরীরে অগনিত তালি মারা একটা পুরাতন দাগ পড়া ছেড়া পাঞ্জাবি আর পরনে একখানা পুরাতন লুঙ্গি। বৃদ্ধের হাতে একটা প্রায় অর্ধছেড়া কাগজ। কাঁধে গামছায় ঝুলানো কিছু তেলের পিঠা,গুড়,নারকেল,মুড়ি-মুড়কি!
বেশ পরিশ্রান্ত বৃদ্ধের গাঁয়ের চুইয়ে পড়া ঘামে হাতের কাগজটাও প্রায় ভিজে গেছে। আমার বাবার কাছে গিয়ে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “বাবা আমি অনেক দূর থেকে পায়ে হাইটা আইছি। সেই সকাল থেইকা এইহানে অইহানে আমার ছাওয়ালটারে (ছেলেটাকে) খুজতেছি। আমার ছাওয়ালটা ও তোমার মত মিলিটারি বাবা।” বাবা সালাম দিয়ে কাগজটা হাতে নিতেই দেখল লিখা আছে, “সিপাহী ..............., ৪০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, চিটাগাং ক্যান্টনমেন্ট।” বাবার চোখ ছল ছল করে উঠল। আরে, উনিতো দেখি আমার কলিগ ............... এর বাবা।
বাবা তাড়াতাড়ি করে গার্ড রুমে উনাকে বসিয়ে টুকটাক খাতির যত্ন করতে থাকলো। তখন সৈনিকদের বিকালের হাল্কা স্ন্যাকের মধ্যে ছিল আটার গুলটির সাথে এক মগ চা। আমার বাবা আগন্তুক বৃদ্ধের দিকে নাস্তার প্লেটটা এগিয়ে দিতেই উনি বলে উঠল, “বাবারে, আমার ছাওয়ালডা কই? ও খাইছে বাবা? একটু জলদি অরে ডাইকা দাও। কতদিন ছাওয়ালডারে দেহিনা!”
দৃশ্য-০২
গার্ডরুমের আশেপাশে বেশ হট্টগোল। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। বৃদ্ধের হাউমাউ কান্নাকাটি আর সৈনিকদের চিল্লাচিল্লিতে বেশ এক ঝটলা গার্ড রুমের সামনে। এমন সময় সি.ইউ. কর্নেল .............. এর গাড়ি হাজির।
“কি ব্যাপার, এখানে এত হট্টগোল কেন? উনি কে? কি হয়েছে? উনি কাঁদছেন কেন? গেটের গার্ডরা কই?” বাবা চোখের পানি মুছে দৌড়ে এসে স্যালুট দিয়ে বলল, “স্যার, উনি গ্রাম থেকে এসেছেন। আমাদের সিপাহি ........... নাকি উনার ছেলে। কিন্তু সিপাহি ......... বলল, সে নাকি এই লোককে চিনেনা, জীবনে কোনদিন দেখেওনি। আর তার বাবা নাকি গ্রামের চেয়ারম্যান। সে দূর থেকে উনাকে একবার দেখে ফিরে যেতে যেতে বলল, তার বাবা কেন এই ভিখারির বেশে আসবে।”
ততক্ষনে কর্নেল সাবের আর কিছু বুঝতে বাকি রইলনা। মাটিতে ঘাসের উপর বসে থাকা মাথায় হাত দিয়ে বিলাপরত বৃদ্ধ লোকটিকে উঠিয়ে পা ছুয়ে সালাম করলেন কর্ণেল সাব। চোখের পানি মুছে বুকে জড়িয়ে কোলে নিয়ে আমার বাবাকে অর্ডার দিলেন, “সিরাজ, সিপাহী ....... এখন কই? ওকে ডেকে নিয়ে আসো এক্ষুনি।” (আমার বাবার নাম সিরাজ।)
বেশ ভিত চোখ নিয়ে সিপাহী ........... আসলো। কর্নেল সাব ও বেশ শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “ উনি কি তোমার বাবা?” সিপাহী কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে দাম্ভিকতার সাথে বলে উঠল, “স্যার, আমি উনাকে চিনিনা। জীবনে দেখিও নাই।” এইবার আর বৃদ্ধ লোকটি নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। সারাদিনের না খাওয়া পরিশ্রান্ত-ক্লান্ত শরীরটি কর্নেল সাহেবের পায়ে লুটিয়ে দিয়ে বললেন, “বাবা, আমারই ভুল হইছে, আমার কোন ছাওয়াল নাই, বাবা আমারে একটু কষ্ট করে ইসটিশনে দিয়া আসবা? আমি চইলা যামু। আমার কোন ছাওয়াল নাই।”
এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যে উপস্থিত প্রায় সকলের চোখের কোন ভিজে গেল। কর্নেল সাব কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, “এটেনশন, উনি আসলে আমার বাবা। আজ থেকে উনি আমার বাসায় থাকবেন। সিপাহী সিরাজ। উনাকে আমার গাড়িতে উঠিয়ে দাও। উনি আমার বাসায় যতদিন চায় থাকবেন। উনি আমার বাবা। আর সিপাহী ............., তুমি তোমার কৃতকর্মের ফলের জন্য প্রস্তুত থাকো।”
দৃশ্য-০৩
কর্নেল সাবের বাসা। বেশ আলিশান। এসি, টিভি, ফ্রিজ কি নেই তাতে। ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার দেওয়া। সব আয়োজন কর্নেল সাবের কথিত বৃদ্ধ বাবার জন্য। সকালে কর্নেল সাব নিজ হাতে বাজার করেছে। ম্যাডাম নিজ হাতে রান্নাবান্না করেছে। ২১ বছরের নিঃসন্তান দম্পতির পুরো বাড়িতে একটা পোষা কুকুর ছাড়া কেউই নেই। কাল সারারাত কিচ্ছু খায়নি বৃদ্ধ লোকটা। সারারাত গাঁয়ের ভাষায় কেঁদে কেঁদে প্রলাপ বকেছে লোকটা। কর্নেল সাব ও রাতে ঘুমায় নাই। কতক্ষন পর পর উঠে খেয়াল রাখে লোকটার কিছু লাগবে কিনা। এর ফাকে ফাকে জিজ্ঞাসা করে উনার ছেলে সিপাহী ........... এর কথা। বৃদ্ধ লোকটি মাঝে মাঝে উত্তর দেয়। মাঝে মাঝে প্রলাপ বকতে বকতে বলে, “আমার তো কোন ছাওয়াল নাইরে বাপ।” :'(
আসলে সিপাহী ....... ই তার একমাত্র ছেলে। মা মরেছে বহুকাল আগেই। আর কোন ছেলেমেয়ে নাই। বৃদ্ধ লোকটা ঠেলাগাড়ি চালিয়ে, পরের জমিতে কামলা খেটে বড় কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ(?) করেছে। শেষবার আর্মিতে জয়েন করার পর একবারও বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেয়নি তার বৃদ্ধ বাবা কি বেঁচে আছে না মরে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে বৃদ্ধ বাবাই ঠিকানা জোগাড় করে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
প্রায় তিন দিন কর্নেল সাবের বাসায় একটানা অনাহারে থেকে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পরে বৃদ্ধ লোকটি। তাড়াতাড়ি সি.এম.এইচ এর এম্বুলেন্সে করে সেখানেই কর্নেল সাবের বাবা পরিচয়ে ভর্তি করানো হয়। শেষ বিকালের দিকে প্রলাপ বকতে বকতেই নিঃসঙ্গ, অভাগা আর চিরদুঃখী এক নিঃসন্তান বাবা চিরনিদ্রায় শায়িত হয়। তৎকালীন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান, সি.এম.এইচ এর কর্তব্যরত উচ্চপদ মর্যাদার ডাক্তার, স্টুডেন্ট, নার্স সহ মান্যগন্য আরও অনেক নাম না জানা ব্যাক্তিকে উনার লাশের পাশে দাড়িয়ে অঝরে কাঁদতে দেখা যায়।
দৃশ্য-০৪
রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। শেষ রাতে সব একেবারেই নিস্তব্দ। ইউনিট সহ পুরো ক্যান্টনমেন্ট যেন এক ভুতুড়ে নগরী। মাঝে মাঝে দুই একটা টহলরত জিপ অফিসের ভেতরে যায় আর বের হয়। ২ দিন পরেই ১৬ ই ডিসেম্বর। অফিসের বড় খানা। সি.ইউ. সাব সহ কয়েকজনের চোখে ঘুম নাই। জিপে করে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে অফিসে ঢুকবে। মেইন গেটের সামনে এসে কয়েকবার হর্ন দেওয়া হল! একি গার্ডরা সব গেল কই? কিছুক্ষণ বাদে কর্নেল সাব বিরক্ত হয়ে জিপ থেকে বের হয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “ ব্লাডি @৳&%*#!, হয়ার আর ইউ অল?, ওপেন দ্য গেট!”
এমন সময় গেটের উপরে থাকা বিশালাকার জাম গাছের ঢালের উপর থেকে কেউ একজন উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠল, “হাহাহাহাহাহাহা..... হোহোহোহো...... সালাম স্যার, আমি এখানে, গার্ড দিচ্ছি স্যার!”
ততক্ষনে আরও ২/৩ জন সিপাহী হট্টগোল শুনে কাঁটাতার টপকে বের হয়ে এল। কারণ মেইন গেটে তালা মারা।
“একি সিপাহী............, তুমি ওখানে গাছের উপর ডিউটি রেখে ইউনিফর্ম পরে কি করছ?, তোমার আর্মস কোথায়? আর তোমার সাথের অন্য গার্ড কোথায়?” সি.ইউ. সাব বললেন।
“স্যার, আমি এখানে গার্ড দিচ্ছি। আমি নামতে পারবোনা। আপনি কাঁটাতার টপকে ভিতরে যান। চাবি আমার কাছে। আমি আরেকজন গার্ডকে আর্মস সহ গার্ডরুমের টয়লেটে আটকে রেখেছি। হাহাহাহাহাহাহা..... হোহোহোহো.....” বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরে সিপাহী ........।
সি.ইউর আর বুঝতে বাকি রইলনা যে সিপাহী ........ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে! এরপর বেশ কিছুক্ষণ এভাবে পাল্টাপাল্টি কথা-বার্তা চলল। বহুত বুঝানো হল সিপাহিকে নিচে নেমে আসার জন্য। শেষে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করে আরও ২/৩ জন সৈনিককে গাছে উঠিয়ে তাকে নামিয়ে আনা হল।
এর পরের ঘটনা পুরাটাই ইতিহাস। ৭ দিনের মাথায় সিপাহী ......... মানসিক ভারসাম্য হারানোয় চাকরিচ্যুত হল! মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সে পাগলপ্রায়!
এদিকে বছর না ঘুরতেই সম্পুর্ন কাকতালীয় ভাবে কর্নেলের ঘরে এল ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান! শুধু ৪০ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট না, পুরো ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার সবাই এই ঘটনায় হতবাক, বাকরুদ্ধ! ক্যান্টনমেন্টের এমন কোন বাসা নেই যেখানে কর্নেল সাব মিষ্টি বিলায়নি! তবে কি কর্নেল সাবের সেই কথিত বাবা গাঁয়ের ভাষায় প্রলাপ বকার সাথে সাথে কর্নেল সাবের জন্য মন ভরে দুয়াও করে গেছেন???
(ঘটনাটি আমার বাবার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা। প্রথম যেদিন ঘটনাটি বাবার মুখে শুনেছিলাম সারারাত ঘুমাতে পারিনাই। আমি হয়তো সম্পুর্ন আবেগ দিয়ে পুরো ঘটনাটি সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে ধরতে পারলাম না। তবুও বহুদিনের ইচ্ছা ছিল ঘটনাটি সবার সাথে শেয়ার করা। আমার বাবার মুখ থেকে শুনতে পারলে হয়তো আরও ভালো লাগবে। আমার বাবা অনেক মিশুক মানুষ। চাইলে যে কেউ ইনবক্সে আমার বাবার ফোন নাম্বার নিতে পারেন। আসলে বাস্তব জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত এরকম ঘটনার সাক্ষী। এগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া অবশ্যাম্ভাবি। নয়তো ধ্বংস অনিবার্য।)
পরিশিষ্টঃ
১. অহঙ্কার পতনের মুল।
সূরা বনী ইসরাঈল (মক্কায় অবতীর্ণ)
(১৭:৩৭) এর অর্থ- পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।
২. দুনিয়ার চাকচিক্য থেকে কেউ উপভোগ্য সংগ্রহ করলে তাকে এর দুর্যোগের দুর্দশাও মোকাবেলা করতে হয়।
৩. প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে!
(আমার জীবনের সবচেয়ে বড় থিওরি। “দ্যা থিওরি অব এভেরিথিং” অব মাই লাইফ!)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




