somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবরাহা’র হস্তী রোড এবং দর্পচূর্ণের কাহিনী- শেষ পর্ব (আরব ডায়েরি-১১০)

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ম পর্ব
২য় পর্ব

রাস্তাটি দেখে কোন সন্দেহই রইল না। পাহাড়ের পাদদেশে বামপাশে একটি পিলার। কোনকালে একটি ফলক ছিল হয়তো, কিন্তু কেউ উঠিয়ে নিয়েছে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। নীচের দিকটা অনেক ভঙ্গুর, তবে ১০ ফিটের মত একটি রাস্তার প্রকৃতি সহজেই বুঝা যাচ্ছে। আমি ও আবু সাঈদ ভাই উপরে উঠতে থাকলাম।





আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ইসলামিক ও প্রাক ইসলামিক আরবের ইতিহাস আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে। আমার বাড়ীর পাশে এমন একটি ঐতিহাসিক নিদর্শণ দেখার জন্য ৩টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, সময় ও সুযোগ হয়ে উঠেনি। আমি অস্থিরচিত্তে আবু সাঈদ ভাইকে অনুসরণ করছি।


ব্যবহৃত পাথর

কিছুটা উপর উঠার পর রাস্তার অবিকৃত কিছু অংশ চোখে পড়ল। অন্যকোথাও হতে পাথর এনে পাহাড়ের উপর রাস্তা বানানো হয়েছে। পাথরের উপরের অংশ এতটাই মসৃণ যে ১৪০০ বছর আগের মেধা ও তাদের টেকনোলজি’র কথা চিন্তা করে অবাক হলাম। সেসময় এ রাস্তা নিশ্চিতভাবেই বর্তমানকালের পিচঢালা রাস্তার চেয়েও ভালো ছিল। এমন মসৃণ রাস্তা করার একটাই কারণ ছিল- হাতী যাতে কোনপ্রকার সমস্যা ছাড়া মক্কা অব্ধি পৌছাতে পারে।




এখনো মসৃণ পথ

আবু সাঈদ ভাই ফোনে শাহরিয়ার ভাইকে রাস্তাটি খুঁজে পাবার কথা জানালেন। শাহরিয়ার ভাই ২ বাচ্চা ও ভাবীকে নিয়েই রওনা দিলেন। ১৫ মিনিটের রাস্তা তাদেরকে একা আসতে হবে, সাহসী সিদ্ধান্ত বটে।

আমার ধারণা ছিল আব্রাহার রাস্তাটির কিছু অংশ হয়তো অবশিষ্ট আছে। ১৪০০ বছরে আর কিবা বাকী আছে? কিন্তু রাস্তার ধরে পাহাড়ের যত উপরে উঠছি রাস্তা ততই এগিয়ে চলেছে, রাস্তার অবস্থা নীচ হতে আরো ভালো হচ্ছে। এক জায়গায় আরেকটি পিলার পেলাম। আমি কিছু ভিডিও করলাম। সেখান হতে উপরে আরেকটি পিলার দেখতে পেলাম। টার্গেট নিলাম সেখানে গিয়ে থামব, এ রাস্তার যেন শেষ নেই। আব্রাহা ইয়েমেনের সানা হতে এখান দিয়ে আল-বাহা হয়ে, তায়েফ দিয়ে মক্কায় মিনা/মুযদালিফা’র একটি ওয়াদিতে পৌছেছিল। স্বভাবতই আমরা আজ যে রাস্তাটিতে দাঁড়িয়ে আছি এর ধ্বংসাবশেষ ইয়েমেনের সানা পর্যন্ত পৌছেছে।


আমাদের পাহাড় হতে পথটি পাশের পাহাড়ে চলে গেছে

আমরা আমাদের পাহাড়ের চূড়ায় চলে আসলাম। নীচে শাহরিয়ার ভাইকে দেখতে পেলাম, আমাদের দিকে আসছে। আবু সাঈদ ভাই একটু এগিয়ে জানালেন-এই পাহাড় হতে পথটি পাশের পাহাড় দিয়ে আরো সামনে চলে গেছে এবং রাস্তা অনেক ভালো আছে। তাড়াহুড়া করে আসায় আমাদের সাথে পানি নিয়ে আসিনি, রোদের তেজ বাড়ছে। তাই আমরা এখানেই আমাদের হস্তী রোডের ইতি টানলাম।
নীচে নামার সময় একটি পাহাড়ি গাছ চোখে পড়ল। এলিয়েন টাইপ বিচিত্র কিছু গাছ ইয়েমেনের সুকুত্রা দ্বীপে দেখা যায়। গাছটি দেখে সেই দ্বীপের কথা মনে পড়ে গেল। শাহরিয়ার ভাইকে নিয়ে আবারো পাহাড়ের কিছুটা পথ সঙ্গী হলাম। আবার যদি ফিরে আসার সুযোগ হয় সে প্রত্যয় নিয়ে আমরা নাজরানের দিকে ছুটে চললাম।



তবে একটা বিষয় আমার মনে খচখচ করছিল। বাসায় ফিরে যখন গুগুল ম্যাপে রাস্তাটি খুজে বের করলাম-অবাক হলাম। পাহাড়ের উপর দিয়ে তৈরি রাস্তাটি এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু খচখচানির বিষয়টি ছিল- আব্রাহা কেন রেড সি’র পাশ দিয়ে যায়নি? কেন সে এত কষ্ট করে পাহাড়ের উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দূর্গম পথ ধরে মক্কা গিয়েছিল? রেড সি’র পাশের সমুদ্র সমতল দিয়ে সে খুব সহজেই মক্কা পৌছাতে পারত। ম্যাপ দেখলে রেড সি’র পাশ দিয়ে যাওয়াটাই অনুমেয় মনে হয়। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আযম ভাই, শাহরিয়ার ভাই সবার মতামত জানতে চাইলাম- কিন্তু উত্তর পেলাম না।


গুগুল ম্যাপে রাস্তাটির একাংশ

এরই মাঝে খুঁজতে খুঁজতে ২ বছর আগের একটি পত্রিকার রিপোর্ট পেলাম। ইতিহাস উৎসাহী একদল সৌদি আব্রাহা’র পথটি ধরে অনুসন্ধান করেছিল। তারা পাহাড়ে অংকিত বিভিন্ন লেখা ও চিত্রাবলী খুঁজে পেয়েছিল। পাশাপাশি তারা আমাদের আসির প্রদেশের পূর্ব দিকে “হাফায়ের” নামক স্থানে পুরনো কুয়া খুঁজে পায় যা আব্রাহা’র বাহিনী ব্যবহার করেছিল বলে ধারণা করা হয়।


আব্রাহা’র বাহিনীর ব্যবহৃত কুয়া

কুয়া’র বিষয়টি জানার পরই- আমি উত্তরটি পেয়ে যাইঃ সুপেয় পানি ও আবহাওয়া। আব্রাহা’র একাধিক হাতী ও প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যবাহিনীর জন্য প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে মিষ্টি পানি’র প্রয়োজন ছিল। তাই আব্রাহা মক্কা অভিযানের জন্য লোকালয়ের পথ বেছে নেন। তখন পাহাড়ের উপর মানুষের বসতি ছিল। অবস্থানগত কারনে পাহাড়ের উপরটা ছিল ঠান্ডা, পাদদেশের সমুদ্র নিকটবর্তী অঞ্চল ছিল অত্যধিক গরম। এখনো আমাদের আবহা, আল-বাহা ও তায়েফ সৌদি আরবের ঠান্ডা এলাকা। গ্রীষ্মকালে আরবের বিভিন্ন দিক হতে টুরিস্টরা এখানে বেড়াতে আসে।

লোকালয় মানেই পানির ব্যবস্থা, পাশাপাশি পাহাড়ের মধ্যবর্তী ওয়াদিগুলোতে পানি জমে থাকত। আর সানা-নাজরান-আসির-আল বাহা-তায়েফ পথটি ব্যবহার করে আব্রাহা মরুভূমি’র রুক্ষতাকে পাশকাটাতে পেরেছিল। এ পথে তার বাহিনী মরুভূমির দেখা পায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। সুতরাং আব্রাহা ভেবেচিন্তেই পাহাড়ী পথটি বেছে নিয়েছিল।

আযম ভাইকে পানির কথা জানাতেই উনি একটি ঘটনার কথা বললেন- এক জায়গায় একটি গোত্র আব্রাহা’র সাথে যুদ্ধ করেছিল যাতে তার বাহিনীকে পানি দিতে না হয়। অর্থাৎ পানির ব্যাপারটি ফেলে দেয়া যায় না, এবং উনি আমার মতামতকে সমর্থন জানালেন। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি-তখন আব্রাহার পথটি নিয়ে চিন্তা করতেই আবহাওয়া/মরুভূমি’র বিষয়টি মাথায় এল। হয়তো পাহাড়ী পথ ব্যবহারের কারণ আরো অনেকেই জানেন অথবা অন্যান্য কারণ থাকতে পারে কিন্তু আমার নজরে আসেনি।

আব্রাহা সফলভাবে মক্কার মিনা ও মুজদালিফা’র মধ্যবর্তী ওয়াদি মুহাসসার পর্যন্ত পৌছে যায়। সেখানেই তার বাহিনী ধ্বংস হয়।


(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:৪২
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×