somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোহাম্মদ (সাঃ) এর কবরস্থান এবং কিছু ঘটনা / এক্সোডাস কোথায় হয়েছিল?-৮ (আরব ডায়েরি-১২০)

০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব

আসসালাম গেটের প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ধীর পদক্ষেপ। আমার হাতের বামপাশে রিয়াদুল জান্নাহ এবং ডানপাশে মসজিদের বর্তমান মিহরাব। মিহরাবটি সাদা কালো টাইলস দিয়েই ডিজাইন করা- ঠিক পুরনোটির মতো। তৃতীয় খলিফা ওসমান (রাঃ) বর্তমান স্থানে মিহরাবটি স্থাপন করেন। মিহরাবের দেয়ালটি কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ক্যালিগ্রাফিতে পূর্ণ। এছাড়া মসজিদে তৃতীয় আরেকটি মিহরাব আছে যেটি ‘সোলায়মান মিহরাব’ নামে পরিচিত।





আমাদের আশেপাশের সবাই মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি দুরুদ পড়ছে ও সালাম দেয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে।

গ্রিন ডোমের নীচের স্থানটিতে পৌছে গেলাম। এখানেই মোহাম্মদ (সাঃ), আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) শায়িত আছেন। অনেকগুলো বেষ্টনির আড়ালে তাঁদের অতি সাধারণ কবরগুলো আছে। অনলাইনে আমরা যে ছবি দেখে থাকি তার সবকটিই ভূয়া। আমাদের সামনের দৃশ্যমান বেষ্টনিটি সোনালী রংয়ের। তার সামনে একজন সৌদি পুলিশ ও একজন শাইখ দাঁড়িয়ে আছেন- কেউ যাতে কবরের গ্রিলটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে না পারে। প্রথম কবরটি মোহাম্মদ (সাঃ) এর যা গ্রিলটিতে একটি বড় গোলক দিয়ে চিহ্নিত, পরের দুটি ছোট গোলক যথাক্রমে আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) এর কবরকে নির্দেশ করছে। প্রতিটি গোলকের সাথেই নাম লেখা আছে। গোলক ৩টি মূলত দেয়ালগুলোর ওপাশে শায়িত মোহাম্মদ (সাঃ), আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) এর মাথার অবস্থান নির্দেশ করে।





এই গ্রিল বা গোলকগুলোর ভেতর দিয়ে মানুষ অনেক আগ্রহ ভরে দেখার চেষ্টা করে। খুব চেষ্টা করে হয়তো সবুজ একটি পর্দা দেখতে পাবে।



ওমর বিন আব্দুল আযীয ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের ৮ম খলিফা। তিনি ৯৯-১০১ হিজরি পর্যন্ত ৩০ মাস শাসন করেন। ওমর বিন আব্দুল আযীয ইসলামের ৩য় খলিফা ওমর বিন খাত্তাবের নাতনি ফাতিমার সন্তান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার এই সংক্ষিপ্ত শাসনামল ছিল স্বর্ণালী সময়। অনেকে তাকে ভালোবেসে ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসাবে অভিহিত করে থাকে।

খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক তৎকালীন মদীনার গভর্ণর ওমর বিন আব্দুল আযীযকে মসজিদে নববী প্রশস্ত করার জন্য এর আশেপাশের জায়গা কিনে ফেলতে বলেন। যখন হুজরার (পরবর্তীতে যা কবরস্থান) দেয়াল সরনো হয় তখন কবর ৩টি প্রকাশিত হয়। কবর ৩টি মাটির প্রায় সমউচ্চতায় ছিল।

আয়েশা (রাঃ) এর ভাতিজা আল কাসিম বলেন, "কবরগুলো জমিনের উপর খুব উঁচুতে ছিল না, আবার তা একেবারে জমিন সমানও ছিল না। আমি কবরগুলোকে লালচে মাটিতে আবৃত দেখেছি।"



চেম্বারটিতে আরো ২টি কবরের স্থান ফাঁকা আছে। যাদের একটিতে ঈসা (আঃ)কে কবরস্থ করা হবে বলে বহুল প্রচারিত যদিও এর সঠিক কোন রেফারেন্স ইসলামে পাওয়া যায়নি।



আমাদের পাশের গোলক এবং গ্রিল হতে কবরগুলোর দূরত্ব প্রায় ১০ ফিট। এর মাঝে রয়েছে ৩টি দেয়াল। প্রথম আবস্থায় কবরের চারপাশের দেয়াল ইট বা পাথরের ছিল না। চেম্বারের চারপাশের আয়তকার দেয়ালটি খলিফা ওমর (রাঃ) ইট/পাথর দিয়ে তৈরি করেন, কিন্তু দেয়ালটি বেশী উঁচু ছিল না। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) দেয়ালটিকে উঁচু করে দেন।



৯১ হিজরিতে ওমর বিন আব্দুল আযীয আয়তকার দেয়ালটির বাহিরে পঞ্চভূজ আকৃতির দ্বিতীয় আরেকটি কালো পাথরের দেয়াল তৈরি করেন যাতে কেউ পবিত্র চেম্বারের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। ৬৫৪ হিজরিতে মসজিদে নববীতে আগুন লাগে যাতে সবকিছু পুড়ে যায়। আগুনের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে চেম্বারের কিছু দেয়াল ধ্বসে পড়ে। আর এতে করে ৬০০ বছরের মাঝে প্রথমবারের মতো কবরগুলো প্রকাশ্যে আসে।



৬৭৮ হিজরিতে (১২৭৯ ইং) মিশরের মামলুক সুলতান আল মানসুর কালাউন কবরের উপর (ভেতরের চেম্বার) একটি কাঠের গম্বুজ তৈরি করেন। ৮৮৬ হিজরিতে (১৪৮১ ইং) মসজিদে বজ্রপাতে দ্বিতীয়বারের মতো আগুন লাগে। মামলুক সুলতান আল আশরাফ কাইতাবাই সবসহ তৃতীয় দেয়ালটি তৈরি করেন এবং গম্বুজটি নতুন করে সাদা ও কাল পাথর দিয়ে নির্মাণ করেন।

পরবর্তীতে সুলতান মাহমুদ (২য়) ১৮১৭ সালে প্রথম গম্বুজের উপর দ্বিতীয় আরেকটি গম্বুজ তৈরি করেন যাতে ১৮৩৭ সালে সবুজ রঙ দেয়া হয়। বর্তমানে এই সবুজ গম্বুজটিই আমরা বাহির হতে দেখে থাকি। এর আগে গম্বুজটি বিভিন্ন সময় সাদা, নীল/বেগুনী রঙের ছিল। সুলতান আল আশরাফ কাইতাবাইয়ের সর্বশেষ দেয়ালটিতে সবুজ কাপড় ঝোলানো আছে যা বাহিরের গ্রিল দিয়ে তাকালে দেখতে পাওয়া যায়।





প্রতিটি দেয়াল ছাদ পর্যন্ত উঁচু এবং দেয়ালগুলো চেম্বারটিকে সম্পূর্ণভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে। দেয়ালে কোন দড়জা না থাকায় কারো পক্ষে আর সেখানে প্রবেশ করা স্বম্ভব নয়। তবে দু’টি গম্বুজেই ১টি করে ছোট জানালা রাখা আছে।

ইসলামে কবরের উপর কোন ধরণের স্থাপনা ও গম্বুজ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। মামলুক ও তুর্কি সুলতানরা যে দুটি গম্বুজ নির্মাণ করেছে, তা ইসলাম সম্মত ছিল না। বাকী কবরস্থানে কবরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙ্গা হলেও বৃহত্তর ফেতনার আশংকায় মোহাম্মদ (সাঃ) এর কবরের উপরের এ ধরণের স্থাপনা ভাঙ্গা হয়নি। তবে এ নিয়ে পূনরায় বাড়াবাড়ি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।


এছাড়াও আরেকটি আন্ডারগ্রাউন্ড দেয়াল রয়েছে-

ইতিহাস হতে জানা যায় মোহাম্মদ (সাঃ) এর দেহাবশেষ চুরির জন্য অন্তত পাঁচবার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ১১৬২ ইং সালে (৫৫৭ হিঃ) দু’জন খ্রিস্টান ক্রুসেডার মদীনায় সুরঙ্গ খুড়ে প্রায় চেম্বারের কাছাকাছি চলে যায়। তারা মোহাম্মদ (সাঃ) দেহাবশেষ চুরি করতে চেয়েছিল। তারা আইবেরিয়া’র (বর্তমান পূর্ব জর্জিয়া) রাজার নির্দেশে এ কাজ করতে এসেছিল। সুলতান নুর আদদীন জঙ্গি স্বপ্ন মারফত তা জেনে তাদেরকে ধরে ফেলেন। এরপর সুলতান নুর আদদীন জঙ্গি চেম্বারের চারপাশে গরম সিসা ঢেলে গভীর দেয়াল তৈরি করেন যাতে আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়েও চেম্বারটি সুরক্ষিত থাকে।

খলিফা ওমর (রাঃ) আক্রান্ত হবার পর এই চেম্বারে সমাহিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আয়েশা (রাঃ) নিজের জন্য স্বামী মোহাম্মদ (সাঃ) এবং পিতা আবু বকর (রাঃ) এর পাশের জায়গাটি ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু আয়েশা (রাঃ) ওমর (রাঃ) ইচ্ছার কথা শুনে তাঁর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন। ওমর (রাঃ) সমাহিত হবার পর আয়েশা (রাঃ) তার ঘরের বাকী অংশ এবং চেম্বারের মাঝে একটি দেয়াল তুলে দেন। কেননা ওমর (রাঃ) হতে আয়েশা (রাঃ) পর্দা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন যেহেতু ওমর (রাঃ) তার মাহরাম ছিলেন না।



আমরা সবাই রাসুল্লাহ (সাঃ) এর কবর চিহ্নিত জায়গায় পৌছে সালাম নিবেদন করলাম-
“আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুল্লাহ ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বরকাতুহু”

একটু আগ বাড়িয়ে আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) কে একইভাবে সালাম নিবেদন করলাম। যে স্থানটিতে কবর ৩টি অবস্থিত তা মূলত উম্মুল মোমেনিন আয়েশা (রাঃ) এর বাসা ছিল। আর প্যাসেজের যে অংশে দাঁড়িয়ে আমারা সালাম নিবেদন করি সে স্থানটি নবী (সাঃ) এর আরেক স্ত্রী হাফসা (রাঃ) এর বাসস্থান ছিল। হাফসা (রাঃ) এর বাড়ীর কিছু অংশ চেম্বারের ভেতরেও পড়েছে। প্যাসেজের শেষ মাথায় ‘বাকী দড়জা’। কবর জিয়ারত শেষে বাকী দড়জা দিয়ে বের হয়ে এলাম।





(চলবে)


সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১২:৪৪
১২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×