মাসুকের এতদিন ধারনা ছিল সে একজন কবি। তার বাল্যবন্ধু নয়ন উপপাদ্যের মত প্রমান করে দিল সে কোন কবিটবি কিছু না। সে যা লেখে তা কোন কবিতার পর্যায়েই পরে না।
মাসুক নির্বিকারভাবে বলল, এগুলা কবিতা না, তাইলে কি?
‘এগুলোকে কবিতা না বলে টবিতা বলতে পারিস।’
ক্ষুধায় মাসুকের পেট চোঁচোঁ করছে। এতবড় অপমানের পরে ক্ষুধা অনুভব করার কথা না। কবিতা লিখতে লিখতে বহুদিন মাসুক গোসল করতে ভুলে গেছে, খেতে ভুলে গেছে । কবিতা মাথায় এলে মাসুক আর মাসুক থাকে না, অন্য কেউ হয়ে যায়। তখন কিসের ক্ষুধা, কিসের কি?
‘খাবার দাবার কিছু আছে?’
‘সাতটার দিকে ভাত খাইয়া ফেলছি। জামার পকেটে একটা সিগারেট আছে, ধরা।’
খুব আনন্দের কোন কিছু হলে মাসুকের মনে হয় একটা সিগারেট হলে ভাল হতো। যখন খুব মন খারাপ করার মত কিছু হয় তখন মনে হয় একটা সিগারেট হলে ভাল হত। এতবড় অপমানের পরও মনে হচ্ছে একটা সিগারেট হলে খারাপ হত না। নয়ন বিছানায় শুয়ে কি যেন একটা কবিতা পড়ছে। নয়ন অনেক বড় বড় কবির কবিতা পড়ে। দেশী কবির কবিতা, বিদেশী কবির কবিতা। অনেক কঠিন কঠিন কবিতা। সেসব কবিদের নামও মাসুক জানেনা। মাসুক অনেক সহজ কবিতার অর্থই উদ্ধার করতে পারেনা। অথচ নয়ন কবিতাগুলো অনায়াসে ব্যবচ্ছেদ করে ফেলে । কবিতা আবৃতি করতে করতে নয়ন যখন জিজ্ঞেস করে , মানেটা বুঝেছিস তো? মাসুক শুধু মাথা নাড়ে। নয়ন তবু কবিতা তর্জমা করতে থাকে। আসলে নয়ন না বুঝালে কবিতাটা শুধু কবিতাই থেকে যেত অর্থটা জানা হতো না কখনো। কবিতা লেখার জন্য কত কিছু যে জানতে হয়। হরেক রকম ছন্দ, হরেক রকম অলংকার। কিছুই জানা হল না। তবু মাসুক কবিতা লেখে। কবিতা আসার উপরে তার নিজের কোন হাত নেই। মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন কবিতা আসতে থাকে, সে শুধু কাগজের উপর কলম চালায়।
মাসুক সিগারেট ধরিয়ে নিবিষ্টভাবে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। অপমানটা পোড়া নিকোটিনের ধোঁয়ায় দ্রবীভুত হয়ে একটু একটু করে উড়ে গেলে ভাল হত। মাসুকের মনে হচ্ছে অপমানটা বোধ হয় উড়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু গলার কাছাকাছি এসে আটকে যাচ্ছে। একটা গিঁট্টুর মত দলা পাঁকিয়ে গেছে। ঢোঁক গিলতে কি রকম যেন কষ্ট হচ্ছে।
নয়ন কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে। বুকের উপর কবিতার বই । সব্যসাচী লেখক বুদ্ধদেব বসুর ,বন্দীর বন্দনা। কি আছে বন্দীর বন্দনায়? কারাগারে কোন বন্দীর মুক্তির প্রত্যাশা? নাকি পৃথিবীটাই একটা কারাগার, মানুষ ঈশ্বরের কৃপা প্রত্যাশায় নিরন্তর বন্দেগী করে যাচ্ছে সেসব কথা। মাসুকের এসব ভেবেই বা লাভ কি, সে তো কবি নয়। সে হচ্ছে টবি। যিনি কবিতা লেখেন, তিনি হচ্ছেন কবি। যিনি টবিতা লেখেন, তিনি টবি। মাসুক নয়নের মেস থেকে বের হয়ে এল।
নয়নের মেসটা কাঁঠালবাগানে। রাত মাত্র পৌনে দশটা। মাসুকের হলে ফেরা দরকার। সাড়ে দশটার মধ্যে হলে না ফিরলে ডাইনিং ধরা যাবে না। ডাইনিংয়ের শেষ সময়, সাড়ে দশটা। রাস্তায় লোকজন কম। রাস্তারপাশের বড়বড় দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছোট পান বিড়ির দোকান খোলা। মাসুকের বুকের ভিতরটা হুহু করছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ক্ষুধা দারিদ্র্যের এ দেশে কবিতা লেখা হল না বলে চিৎকার করে কান্না চরম বিলাসিতা। মাসুক তবু কাঁদছে। নিশব্দে কাঁদছে, চোখের পানি গড়াচ্ছে। নোনতা নোনতা পানি।
মানুষের মন অত্যন্ত বিচিত্র উপাদান। চরম দুঃখের মধ্যেও অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসে। মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন ঢুকেছে। প্রশ্নটা হচ্ছে, চোখের পানি যে গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়, সেই গ্রন্থির নাম কি? উত্তরটাও মাসুকের জানা, তবু মনে আসছে না।
মাসুক অনেক চেষ্টা করছে। তবু গ্রন্থিটার নাম মনে করতে পারছে না। গত সপ্তাহেই নাফিসাকে মাসুক গ্রন্থিটার নাম বলেছে। নাফিসার মেমরী অত্যন্ত ভাল, কোন জিনিস মাথায় একবার ঢুকিয়ে দিলে মাথার মধ্যেই থেকে যায়।
(চলবে)
বিশ্বাস
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১১ সকাল ১১:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




