ছেলেবেলায় আমি লেখাপড়াতে খুব ভাল ছিলাম। সে জন্য তৃতীয় শ্রেণীতে আমাকে ভর্তি করানো হলো শহরের নামকরা স্কুলে। ওখানে পড়তে এসেই প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম 'বইমেলা' শব্দটির সঙ্গে। আমি টিফিনের টাকা, স্কুল যাতায়াতের টাকা যথাসাধ্য বাঁচিয়ে রাখতাম এবং সেই টাকা দিয়ে বই কিনতাম। ইচ্ছানুযায়ী সব বই সবসময় কিনতে পারতাম না। অনেক ভাইবোনকে একসঙ্গে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে আমাদের পারিবারিক স্বচ্ছলতাও খুব ভাল ছিল না। তাই মাঝে মাঝে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেও বই পড়তাম। শহরে যেসব লাইব্রেরিতে বই ভাড়া পাওয়া যেত সেখান থেকে বই সংগ্রহ করতাম, স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বই তুলে বই পড়তাম। এভাবে এক সময় বই পড়ার এমন অভ্যাস হয়ে গেল যে, ক্লাসের লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুধু গল্পের বই-ই পড়তাম। ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছেন আর আমি বেঞ্চের নীচে বই রেখে পড়ছি এমন ঘটনাও বহুদিন ঘটেছে।
আমি তখন কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের বাংলা পড়াতেন শ.ম. শওকত আলী স্যার। তো স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন আর আমি রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর সিরিজের বই পড়ছি। সবাই ক্লাসে মনোযোগী শধু আমি ছাড়া। এক সময় স্যারের চোখে ধরা পড়লাম। স্যার বললেন, এতক্ষণ যা পড়ালাম তা সংক্ষিপ্ত করে বল। আমি বলতে পারলাম না। ঐদিন স্যার আমাকে প্রচণ্ড মেরেছিলেন। আমি সেদিন বলতে পারিনি বই পড়ার কথা। আমার শ্রদ্ধেয় স্যার আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। অথচ এই স্যারও আমাকে বই পড়ার জন্য অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। এখনো যেকোন বই পড়তে গেলে স্যারের সেই স্নেহমাখা আদেশগুলো চোখের সামনে ভেসে আসে।
স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমাদের কুষ্টিয়া শহরে বইমেলা হচ্ছে। কয়েকদিন আগে থেকেই শুনছি কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন আসবেন বইমেলাতে। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। উনি যেদিন আসলেন সেদিন সকাল থেকে কয়েকজন বন্ধু মিলে বইমেলাতে সারাদিন বসে ছিলাম। দিনশেষে বহুকষ্টে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর অটোগ্রাফ নিতে পেরেছিলাম। সেদিন তার আপাদমস্তক খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলাম। সেদিনই সন্ধ্যার পর প্রশ্নোত্তর পর্বের আরেকটি অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করতে পেরে ধন্য হয়েছিলাম। অনেকদিন যেটা ভেবে পুলকিত হতাম। আজ ঢাকা শহরে বসবাস এবং কর্মজীবনের সুবাদে দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের সাথে মেশার সুযোগ হয়, অনেক বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের খুব কাছে থেকে দেখারও সুযোগ পাই। অথচ একদিন একজন বিখ্যাত লেখককে একনজর দেখার জন্য কত অপেক্ষায়ই না করেছিলাম! তবু দেখতে পেরেছিলাম বইমেলার জন্যই। যা ঐ কিশোর বয়সে বই পড়তে অনেকখানি অনুপ্রাণিত করেছিল।
এখন আমি প্রতি বছর বাংলা একাডেমীর বইমেলাতে যাই। সেখানে বই কিনতে যাই। গল্প, আড্ডা দিতে যাই। এখন আর বইমেলাকে শুধু বইমেলা ভাবি না। সেখানে নতুন প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাই। মনে হয় সেখানে গেলে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় ভরে ওঠে মন। বইমেলার নতুন বইয়ের গন্ধ আমার হৃদয়ের মাঝে নতুন নতুন বাংলা শব্দ শেখার প্রেরণা যোগায়। তাই সেখানে ছুটে যাই সারা মাস ধরে। সেখানে গিয়ে আমার অনেক প্রিয় বইয়ের প্রিয় চরিত্রের নির্মাতাদের খুব কাছে থেকে দেখে এখনো পুলকিত হই। সেখানে গিয়ে আমি ৫২-ও ভাষা আন্দোলন, ৬৯-র গণআন্দোলন, ৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-র গণঅভ্যুত্থানের অংশ বলে ভেবে শান্তি পাই। আমার বাবাও এবছর আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন মৃত্যুপুরীর অনন্তবাসে। তারপরও আমি বইমেলাতে যাবো আমার কৃষক বাবার বই হাতে তুলে দেবার স্বার্থকতা খুঁজে পেতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০০৯ দুপুর ২:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



