somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব-এ বই, ব-এ বাবা

১৪ ই মে, ২০০৯ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

টিনশেডের দুইটি ঘর, সামনের আঙ্গিনায় ফুল বাগান, শিউলি ফুটেছে, শরতের সকালবেলা বাগানের পাশে রোদ এসে পড়েছে। সেই রোদে আমি আর আমার ছোট বোন বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। পড়াচ্ছেন আমার বাবা। ছোটবেলায় প্রথম কবে পড়া শিখলাম এমন দৃশ্য কল্পনা করলে আমার স্মৃতিতে বার বার ওই দৃশ্যটাই ভেসে ওঠে। সম্ভবত এভাবেই প্রথম আমার বাবার কাছে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল। আমি আমার বয়স্ক বাবার সন্তান। তবু যেন তার কোনো ক্লান্তি নেই আমাকে যত্ন সহকারে পড়ানোর। অক্লান্ত এই বাবা খুব অল্প লেখাপড়া জানা একজন গ্রামের কৃষক। এই মানুষটি তার সাতটি সন্তানকেই লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করেছেন। তিনিই আমার হাতে প্রথম গ্রামের হাট থেকে প্রথম বই তুলে দিয়েছিলেন। এজন্য আজো আমি বই নিয়ে কিছু ভাবতে গেলে বার বার বাবার কথা মনে পড়ে। আমার বাবা কৃষিকাজ করেই আমাদের লেখাপড়া করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও গ্রামের হাট থেকে গল্পের বই কিনে আমাকে পড়তে দিতেন। আমি তা পড়তাম এবং বাবাকে পড়ে শোনাতাম। সেই থেকেই আমার বই পড়া শুরু।

ছেলেবেলায় আমি লেখাপড়াতে খুব ভাল ছিলাম। সে জন্য তৃতীয় শ্রেণীতে আমাকে ভর্তি করানো হলো শহরের নামকরা স্কুলে। ওখানে পড়তে এসেই প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম 'বইমেলা' শব্দটির সঙ্গে। আমি টিফিনের টাকা, স্কুল যাতায়াতের টাকা যথাসাধ্য বাঁচিয়ে রাখতাম এবং সেই টাকা দিয়ে বই কিনতাম। ইচ্ছানুযায়ী সব বই সবসময় কিনতে পারতাম না। অনেক ভাইবোনকে একসঙ্গে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে আমাদের পারিবারিক স্বচ্ছলতাও খুব ভাল ছিল না। তাই মাঝে মাঝে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেও বই পড়তাম। শহরে যেসব লাইব্রেরিতে বই ভাড়া পাওয়া যেত সেখান থেকে বই সংগ্রহ করতাম, স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বই তুলে বই পড়তাম। এভাবে এক সময় বই পড়ার এমন অভ্যাস হয়ে গেল যে, ক্লাসের লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুধু গল্পের বই-ই পড়তাম। ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছেন আর আমি বেঞ্চের নীচে বই রেখে পড়ছি এমন ঘটনাও বহুদিন ঘটেছে।
আমি তখন কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের বাংলা পড়াতেন শ.ম. শওকত আলী স্যার। তো স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন আর আমি রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর সিরিজের বই পড়ছি। সবাই ক্লাসে মনোযোগী শধু আমি ছাড়া। এক সময় স্যারের চোখে ধরা পড়লাম। স্যার বললেন, এতক্ষণ যা পড়ালাম তা সংক্ষিপ্ত করে বল। আমি বলতে পারলাম না। ঐদিন স্যার আমাকে প্রচণ্ড মেরেছিলেন। আমি সেদিন বলতে পারিনি বই পড়ার কথা। আমার শ্রদ্ধেয় স্যার আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। অথচ এই স্যারও আমাকে বই পড়ার জন্য অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। এখনো যেকোন বই পড়তে গেলে স্যারের সেই স্নেহমাখা আদেশগুলো চোখের সামনে ভেসে আসে।

স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমাদের কুষ্টিয়া শহরে বইমেলা হচ্ছে। কয়েকদিন আগে থেকেই শুনছি কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন আসবেন বইমেলাতে। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। উনি যেদিন আসলেন সেদিন সকাল থেকে কয়েকজন বন্ধু মিলে বইমেলাতে সারাদিন বসে ছিলাম। দিনশেষে বহুকষ্টে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর অটোগ্রাফ নিতে পেরেছিলাম। সেদিন তার আপাদমস্তক খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলাম। সেদিনই সন্ধ্যার পর প্রশ্নোত্তর পর্বের আরেকটি অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করতে পেরে ধন্য হয়েছিলাম। অনেকদিন যেটা ভেবে পুলকিত হতাম। আজ ঢাকা শহরে বসবাস এবং কর্মজীবনের সুবাদে দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের সাথে মেশার সুযোগ হয়, অনেক বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের খুব কাছে থেকে দেখারও সুযোগ পাই। অথচ একদিন একজন বিখ্যাত লেখককে একনজর দেখার জন্য কত অপেক্ষায়ই না করেছিলাম! তবু দেখতে পেরেছিলাম বইমেলার জন্যই। যা ঐ কিশোর বয়সে বই পড়তে অনেকখানি অনুপ্রাণিত করেছিল।

এখন আমি প্রতি বছর বাংলা একাডেমীর বইমেলাতে যাই। সেখানে বই কিনতে যাই। গল্প, আড্ডা দিতে যাই। এখন আর বইমেলাকে শুধু বইমেলা ভাবি না। সেখানে নতুন প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাই। মনে হয় সেখানে গেলে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় ভরে ওঠে মন। বইমেলার নতুন বইয়ের গন্ধ আমার হৃদয়ের মাঝে নতুন নতুন বাংলা শব্দ শেখার প্রেরণা যোগায়। তাই সেখানে ছুটে যাই সারা মাস ধরে। সেখানে গিয়ে আমার অনেক প্রিয় বইয়ের প্রিয় চরিত্রের নির্মাতাদের খুব কাছে থেকে দেখে এখনো পুলকিত হই। সেখানে গিয়ে আমি ৫২-ও ভাষা আন্দোলন, ৬৯-র গণআন্দোলন, ৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-র গণঅভ্যুত্থানের অংশ বলে ভেবে শান্তি পাই। আমার বাবাও এবছর আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন মৃত্যুপুরীর অনন্তবাসে। তারপরও আমি বইমেলাতে যাবো আমার কৃষক বাবার বই হাতে তুলে দেবার স্বার্থকতা খুঁজে পেতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০০৯ দুপুর ২:৩৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×