বুয়েট অডিটরিয়াম। দর্শক সারিতে লোকের সমাগম খুব বেশি না। বেশির ভাগ জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। কারণ যে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা কোন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নয়। বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনির ৭ম মৃত্যু বার্ষিকী। আজ থেকে সাত বছর আগে ঘাতকের ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছিল। এ ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়, যে কারণে সচেতন ছাত্র সমাজে এই শোক পালনের এত কৃপণতা। তারপরও যে কয়জন উপস্থিত তারা নিঃসন্দেহে অকৃপণ বন্ধুবৎসল এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে বুয়েটের ভিসি, সাবেক ভিসি, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান, সনির বাবা-মা ও আরো কয়েকজন বুয়েট শিক্ষক।
অতিথিবৃন্দ একে একে স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখছেন। এক পর্যায়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান আসলেন বক্তব্য রাখতে। দিন বদলে দেয়ার বর্তমান নায়ক, দেশের অন্যতম বুদ্ধিজীবী, সর্বোপরী গোছানো ও চমৎকার বক্তা হিসেবে খ্যাত জনাব মতিউর রহমান। ছাত্র রাজনীতির ভালমন্দ দিক আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, `তবুও ন্যূনতম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত ছাত্র লীগের সাংগঠনিক পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এটা একটা ভাল দিক।' বাধ সাধলো কতিপয় মেধাবী ছাত্র। পেছন থেকে শ্লোগান দিয়ে উঠল, 'প্রধানমন্ত্রী একটা সরকারি সম্মানিত পদ তার আগে মাননীয় শব্দ যোগ করুন, আপনার মত বুদ্ধিজীবীর মুখে এটা মানায় না, আপনি বদলাতে বলেন মানুষকে অথচ আপনার মুখে অসম্পন্ন ভাষা, এটা ত্যাগ করুন'। স্বভাবতই একটু থমকে গেলেন দিন বদলের নায়ক। অতিবুদ্ধি সম্পন্ন সম্পাদক বিষয়টার একটা চালাকি ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, 'প্রধানমন্ত্রী শব্দটা বার বার ব্যবহার করছি এজন্য বার বারই মাননীয় শব্দটি ব্যবহার করা না করার দ্বিমত থাকতে পারে। আপনারও দ্বিমত আছে'।
পরবর্তিতে ভাষণ দিলেন জনাব মাহফুজ আনাম। তার বক্তব্যটি ছিল অত্যন্ত গোছানো এবং গঠনমূলক। তিনি বক্তব্য শেষে অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত হওয়ার আগেই যখন অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করছিলেন তখন ওই কতিপয় ছাত্রের সাথে আমিও উৎসুখ হয়ে জনাব মাহফুজ আনামের কাছে ছুটে যায়। ওই ছাত্ররা জনাব মাহফুজ আনামকে ধরে খুব উদ্বিগ্ন এবং সোচ্চার কণ্ঠে বলছে, 'স্যার আমরাও চাই দেশের পরিবর্তন। আজকে যারা দেশ বদলের শ্লোগান নিয়ে দৌড়ায়ে বেড়াচ্ছে তাদের কথার সাথে কাজের কোন মিল নেই। আমরা চাইনি আপনাদের বিব্রত করতে। প্রথম আলোর সম্পাদকের কাছে আমরা ছাত্ররা শিখতে চাই। তিনি কেন আমাদেরকে ভুল শেখাবেন? তিনি কেন দেশের নির্বাহী প্রধান পদ প্রধানমন্ত্রী শব্দটি উচ্চারণের আগে মাননীয় বলবেন না?' এরপর তারা একটা ডক্যুমেন্ট বের করল যেখানে একটা সংবাদ আছে জনৈক ব্যক্তি প্রথম আলোর বদলে যাওয়ার অঙ্গিকারে নিজেকে বদলানোর শপথ নিয়েছেন। শপথের কথা ছবিসহ বড় বড় অক্ষরে লিখে প্রথম আলোতে ছাপানোও হয়েছে। সেই তিনিই কয়েকদিন আগে নিজের গাড়ির গ্যাস ভরতে গিয়ে পেছনে দাঁড়ানো শত শত সাধারণ মানুষকে নিজের ক্ষমতা এক হাত দেখিয়ে সবার আগে নিজের গাড়িতে গ্যাস ভরতে বাধ্য করেছেন গ্যাস স্টেশনের মালিককে। এই হল বদলে যাওয়া অঙ্গিকারের বাস্তবতা। জনাব মাহফুজ আনাম তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সান্ত্বনা দিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।
আমিও চলে এলাম। আমার কানে ভাসতে থাকল কতিপয় বুয়েটের মেধাবী ছাত্রদের বুকের মধ্যে লালিত ক্ষোভের চিত্র। দেশের 'বদলে যাও বদলে দাও' শ্লোগানের অধিনায়কেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমরা সত্যিই বদলে যাচ্ছি? নাকি সবই আমাদের নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার এক একটা কৌশল মাত্র? আর সেইসব কৌশলের বলিদান হয়ে আমরা ছা-পোষা মানুষগুলো নতুন স্বপ্ন বিভোরে পার করছি বছরের বছর। তবুও এই স্বপ্নটুকুই একদিকে যেমন আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে অপরদিকে এই দ্রষ্টাদের বানিয়ে দেয় ক্রোড়পতি। এই সত্য আমরা মানলেও মানতে চায় না তরুণ প্রজন্মের মেধাবী ছাত্ররা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



