প্রিয় xxxxx ভাই,
বিভিন্ন ধরণের ব্যস্ততার কারণে সময়মত আপনার ই-মেইলের উত্তর দিতে পারিনি। আশা করি খোদার কৃপায় ছেলে, নাতি, সংসার আর ধর্মীয় বিষয়-বস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া, পরিশেষে একটি ধর্মীয় ওয়েবসাইট নির্মাণ নিয়ে সন্তোসসময় গুজরান করছেন। ধর্মীয় নিয়মাচার (ritual) এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে গোঁড়ামি নিয়ে আপনার সঙ্গে তফাৎ রয়েছে জেনেও ওয়েব সাইটের ব্যাপারে আমার পরামর্শ চেয়েছেন জেনে খুশি হলাম।
অনেকের মত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং সাথে বেশুমার সুন্নত আর নফল আদায় করা আমার দ্বারা হয়ে উঠেনা। মানবতা, মনুষ্যত্ব, নিজের নিকট দায়বদ্ধতার স্বচ্ছতাই একজনকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এবং ধর্ম এক্ষেত্রে বড় ধরণের সহায়ক শক্তি নিশ্চয়। সহায়ক শক্তি যখন মূল শক্তি বলে বিবেচিতহয়, তখনি বিভ্রাট ঘঠে। আজ সমগ্র পৃথিবীতে যে হানাহানি, তার পেছনে মূলতঃ সম্পদ/ক্ষমতা লিপ্সুতা আর তাকে কুক্ষিগত করতে বা রাখতে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে অনৈতিক, অযৌক্তিক ভাবে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার রূপে। ইসরাইলসহ মধ্যপ্রাচ্যের, বাংলা-ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোতে এই হাতিয়ারটি দিয়েই দেশ-দশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আবেদ খানের একটি লেখায় পড়েছিলাম, সাদ্দাম আমলে ইরাক সফরে গিয়ে ইরাকের একটি কারাগারে বন্দী এক ইরানি যুবকের নিকট জানতে চাইলেন, ইরাকের মত একটি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ করছে। যুবকটি দ্বিধাহীন চিত্তে জানলো ইরাকিরা মুসলিম নয়, অমুসলিম হত্যা করে সে গাজী হবে নতুবা যুদ্ধে শহীদ হয়ে বেহেস্তে যাবে আর বেহেস্তে তার জন্য নির্ধারিত কক্ষের দরজার চাবিটিও যুদ্ধে যোগ দেয়ার পুর্বেই তাকে দেয়া হয়েছে, এই বলে সে তার আস্তিনের নীচ থেকে খোমেনীর স্বাক্ষর করা প্রায় এক হাত লম্বা চাবিটি আবেদ খান এবং দোভাষীকে দেখালো। মানসিকতার এই স্কেল আমরা অধিকাংশই অতি যত্নে লালন করে চলেছি। আমরা এখনও ভাষ্কর্য আর মুর্তিকে এক কাতারে চিন্তা করি। মুর্তির মধ্যে একটি বিশেষ সনাতনী আদল আর ধর্মীয় আবেশ থাকে, অন্যদিকে ভাষ্কর্যে থাকে চলমান কালকে শিল্পীর সৃষ্ঠিশীলতায় যুগোত্তীর্ণ করার আবেদন। উজবেকিস্তানের একজন প্রখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ (দেশের ধর্মমন্ত্রীও ছিলেন) স্পষ্ঠভাবে বলেছিলেন, ইসলামীর আবির্ভাবের সময় ছবি, চিত্র নাযায়েজ করার সঙ্গত কারণ ছিল, কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই নাযায়েজের গ্রহনযোগ্যতা এখন আর নেই। ঐ সময়ে অনেকে ধর্মান্তরিত হলেও এতকালের বিশ্বাস-সংষ্কার থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি, গোপনে মুর্তির পরিবর্তে মুর্তির ছবিকে পূজা করত।পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকা বিমান বন্দরের সামনে স্থাপিত ভাষ্কর্যটি মাদ্রাসার ছাত্রদের দড়ি টানাটানির প্রেক্ষিতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। একদল দড়ি দিয়ে টেনে নামায়, আর অন্যদল এর প্রতিবাদে মৌন মিছিল করে। মাদ্রাসায় মৌন মিছিলের সবক অপাংক্তেয়, তারা সরাসরি আঘাতে বিশ্বাসী। আমাদের মননে সন্ত্রাসী চেতনা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, আমরা অবলীলায় মেনে নিচ্ছি। বলতে পারেন, টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে একজনকেও কি ইসলামে আনতে পেরেছি এবং এভাবে দূর ভবিষ্যতেও পারবনা। একাত্তরে অনেক হিন্দু প্রাণের তাগিদে নামাজ-কোরান শিখে মুসলমান হয়েছিল, পরবর্তীতে এদের একজনও কি ইসলামে থেকেছে ? শিল্পী রথীন্দ্রনাথের কোরান তেলোয়াত আর হাদিসজ্ঞান অনেক মোল্লাকেও হার মানায়। সন্ত্রাস আর কুপমুণ্ডকতা দিয়ে মানুষের মনের গভীরে কখনও পৌঁছানো যায়না। যদি যেত, এশিয়ার সাথে সাথে ইউরোপেও ইসলামের পতাকা উড্ডীন থাকতো। এশিয়াতে ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন ওলি-দরবেশগণ আর ইউরোপের স্পেন পর্যন্ত ইসলাম পৌঁছেছিল তলোয়ারসহ। ভাবী সাহেবা আমেরিকায় মাদ্রাসা খুলবেন, মানব কল্যাণে আমরা মুসলমানরা আর কিছু করতে না পারলেও একটি মসজিদ বা একটি মাদ্রাসা তৈরী করতে পারলেই ধরে নিই পরকালের অকল্পনীয় শান্তি কেনা হয়ে গেল। আমাদের দেশের মাদ্রাসা গুলোর দিকে তাকালে কি মনে হয়না, দেশের একটি বিরাট অংশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। পশ্চিম বঙ্গের মাদ্রাসা তথা ভারতের মাদ্রাসা সম্পর্কে আপনার ধারণা আমার চাইতে ভালো। ওরা সমকালীন চিন্তা, বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়েই পাঠ্যসুচী নির্বাচন করে। ওদের মাদ্রাসার বেশ-অর্ধেক ছাত্র-শিক্ষক হিন্দু সম্প্রদায়ের, বিপরীতে আমাদের অবস্থাটা চিন্তা করুন।
(২)
ইসলাম কোন অঞ্চলনির্ভর ধর্ম নয়। যে কোন অঞ্চলের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ইসলাম সহজেই আত্মস্থ করে নেয়। ইরানী-ইরাকীরা তাদের কোন কিছু বর্জন না করে, ইসলামের মর্মবাণীকে অবিকৃত রেখে মুসলিম হয়েছে। মিসর, তুরষ্ক (তুরষ্কের ব্যপারে অনেকে আবার জিহাদী হয়ে উঠেন) থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সর্বত্র ইসলামের আত্বস্থ করার প্রবনতা দেখতে পাই, ব্যতিক্রম আমাদের এই দেশে। আল্লাহ, মুহাম্মদ,বকর, আলী,ওসমান শব্দগুলো বা নামগুলো আরবী ভাষায় পূর্বেও ছিল এবং এই নামধারীগণ মুর্তি পূজক থেকে মুসলিম হয়ে নামের কোন পরিবর্তন করেননি, সুযোগও ছিলনা এবং নেইও। ইসলাম আবির্ভাবের পর আরবী ভাষায় ইসলামিক শব্দের সৃষ্ঠি হয়নি যে তাঁরা ইসলামিক নাম রাখবেন। আরবী নামকে ইসলামী নাম আর আরবী সংস্কৃতিকে ইসলামি সংস্কৃতি ভাবার কুপমুণ্ডকতা আর কতকাল জিইয়ে রাখব, বলতে পারেন। আহম্মদ সুকর্ণ, মোহাম্মদ মহাথীর, গামাল নাসের, তান শ্রী দাতো সেরি আলী (মালয়েশীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর), আহম্মদ সরস্বতী (মালয়েশীয় ব্যবসায়ী) তথা উপমহাদেশের বাইরে সব মুসলমানের নাম দিয়ে জাত-ধর্ম বিশেষ করে জাতীয়তা চেনার একটা সুযোগ থাকছে, আমাদের নেই। এখানে আমার এক মিসরীয় সহকর্মীর নাম সোনিয়া মনসুর, যিনি জন্মগতভাবেই খ্রীষ্ঠান। সাদ্দামের খ্রীষ্ঠান পররাষ্ট্র মন্ত্রী তারিক আজিজকে আপনি কি ইসলামিক নামধারী খ্রীষ্ঠান বলবেন। আমার ছেলেদের নাম অনিরুদ্ধ আহমেদ জয়, অনুপম আহমেদ হৃদয়, আদিত্য আহমেদ নিলয় রাখায় কেউ কেউ অগোচরে সমালোচনা করেন, সামনে কিছু বলতে সাহস করেননা। আসলে আমরা যারা নিজেদেরকে শিক্ষিত বলে ভাবি, সেই আমরাই সব ধরণের গোঁড়ামিকে নিত্য নতুন উপায়ে গ্রহনযোগ্যতা দানে সচেষ্ট। ভুল বুঝবেন না। আমরা কি পারিনা মৌলানা মোহাম্মদ আলী, মৌলানা শওকত আলী, শহীদ তিতুমীর, সৈয়দ আমির আলী, মওদুদীদের ইসলাম থেকে বের হয়ে পীর-দরবেশগণ যে ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন; মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, কাজী আব্দুল ওদুদ প্রমুখগণ যে ইসলাম নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন সেই ইসলামে প্রত্যাবর্তন করতে? আপনার ওয়েবসাইটে এই আঙ্গিকে কোন বার্তা থাকলে খুশী হব।
সামনে কোরবানির ঈদ আসছে। ১৩০ ফরজের আওতায় বছরে অনুন্য ১২,০০০ ফরজ ঠিকমত পালিত হচ্ছে কিনা, তার দিকে খেয়াল নেই, অথচ একটি ওয়াজেব পালনের জন্য দেশব্যাপী মার-মার, কাট-কাট। মন সায় না দিলেও সামাজিকতার মুখ্যতা অনেককে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে।
(৩)
জাতীয়তা নিয়ে আবার আপনার এলার্জি আছে। স্মরণ করতে পারেন, আইয়ুব আমলে হঠাৎ এক ফরমান বলে আমাদের ত্রিপুরা জেলাকে কুমিল্লা করে দেয়া হল আর এর পর পরই ভারত আমাদের ত্রিপুরা সংলগ্ন পার্বত্য ত্রিপুরা জেলাটিকে ত্রিপুরা নাম দিয়ে ফেলল। পশ্চিম বঙ্গ আর বাংলাদেশ যদি উত্তর কোরিয়া আর দক্ষিণ কোরিয়ার মত একই ভাষা, সংস্কৃতির দুটি দেশ হতো, আমাদের বাংলাদেশী পরিচয়টি গ্রহণ করার সাথে সাথে পশ্চিম বঙ্গ নিজেদেরকে বাঙ্গালি বলে ঘোষণা করতো। ভাগ্য ভালো, ওরা যেহেতু একটি স্বাধীন দেশ নয়, সে সুযোগ তাদের নেই। এছাড়া আপনি কি জানেন, ওরা নিজেদেরকে ভারতীয় ভাবতেই স্বচ্ছন্দবোধ করে, এমনকি ভারতীয় বাঙ্গালি ভাবতেও একটা হীনমন্যতাবোধ করে। নিউ ইয়র্কে যে কয়জন পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালিকে জানি, তারা কখনও বাঙ্গালি এমনকি ভারতীয় বাঙ্গালি বলে পরিচয় দিতে চায়না। অথচ আমরা তাদেরকে জোর করে বাঙ্গালি বানাতে চাচ্ছি। বাঙ্গালির মধ্যে আবহমান কালের একটা জাতি গোষ্টিকে খুঁজে পাওয়া যায়, বাংলাদেশীর মধ্যে মানুষ, গরু, ঘোড়া, চেয়ার, টেবিল সবই এসে যায়। আনসার ভাই, আপনি’ত একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধকালীন আপনার আহবান আর বর্তমানের আহবানের মধ্যে আপনি কি কোন স্ববিরোধিতা দেখেননা ? ইনকিলাব আপনার প্রিয় পত্রিকা, হয়ত সংগ্রামও। এই ঘোর থেকে বের হয়ে দেশ,কৃষ্টির ধারক এমন পত্রিকায় মাঝে মাঝে চোখ বুলাতে পারেন। সাদেক খান, শফিক রেহমান, বদরুদ্দিন উমর, ফরহাদ মাজহার এর বাইরে ওয়াহিদুল হক (প্রয়াত), মুনতাসির মামুন, গাফফার চৌধুরী, বোরহান কবীর (ইদানীং ভাল লেখছে), আব্দুল মান্নান, মোনায়েম সরকার এদের লেখাগুলিতেও চোখ বুলাতে পারেন। আবার কোলকাতায় গেলে এম,জে,আকবর, হোসেনুর রহমানের কোন বই পেলে আমার জন্য নিয়ে আসবেন, আগাম বলে রাখলাম। হোসেনুর রহমানের “এখনও গেলোনা আঁধার” কোথায়ও পেলে আমার জন্য এক কপি কিনে নেবেন। কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরে এক সময়ে কিনতে পাওয়া যেত। আপনি হাসান মাহমুদের “ইসলাম ও শারিয়া” (লেখকের একটি ওয়েবসাইট রয়েছে) , সা’দউল্লাহ্’র “ইসলামে ধর্মীয়-রাজনৈতিক গোষ্টী” পড়ে দেখতে পারেন। নিউ মার্কেটে পাবেন।
(৪)
নির্মিয়মান ওয়েবসাইটে Comparative Religion নামে একটি ভাগ রাখা হয়েছে। তুলনামুলক ধর্ম পৃথিবীর তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হয়ে থাকে এবং লুপ্ত, অলুপ্ত ধর্ম সমূহের মূল বাণী, দর্শন নিয়ে আলোচিত হয়। আপনার ওয়েবসাইটে সেভাবে থাকলে জ্ঞান পিপাসুরা উপকৃত হবে। কিন্তু যদি ‘কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ এবং ইসলামই অনাদি কালের সর্বশ্রষ্ঠ ধর্ম’ এধরণের আক্রমণাত্মক বা প্রতিযোগিতামূলক বক্তব্য থাকলে প্রতিহিংসার জন্ম নেবে। বিষয়টি একবার ভেবে দেখবেন।
(৫)
আপনার ওয়েবসাইটের মত শতাধিক ওয়েবসাইট ইন্টারনেটে চালু আাছে। এগুলো এবং ঐগুলোর বাইরে, যেমন Notion of Islam ( যেটি কতিপয় ইসলাম ত্যাগকারী দ্বারা পরিচালিত), Scientology (যারা কোন ধর্মমতে বিশ্বাসী নয়, নতুন একটি দর্শন দাঁড় করাতে চায়), বাহাই (যেটি সম্পর্কে আপনি বেশ পড়ালেখা করেছেন) মাঝে মাঝে দেখতে পারেন।
দোয়া করবেন, ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। ভাবী দূঃখ পেতে পারে বলে মনে হলে ভাবী সম্পর্কিত বাক্যটি ভাবীকে দেখাবেননা। ই-মাইলটির বিষদ উত্তর না পাঠালে খুশি হব। যুক্তি দিয়ে মত,দর্শন পাল্টানোর বয়স এখন আমাদের নয়। এটা উপলব্ধি,অনুভবের সময়।
আপনার বিশ্বস্থ
জহির॥
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০০৮ সকাল ১০:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



