ছেলের বাপ সবুর করতে পারত কিন্ত ছেলের মা সবুর করতে চাইল না। দেখতে ক্লাসের অন্যান্যদের চেয়ে একটু বেশি লম্বা দেখায় বলে ছেলের মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল তার ৫ বছর বয়সের ছেলেটাকে এবার ক্লাসে ওয়ানে ভর্তি করাবে। যদিও সে এবার নার্সারী থেকে কেজি ওয়ানে উঠবে, ছেলেটা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে অথচ ক্লাস ওয়ানেই উঠতে পারছে না, এখনও নাকি কেজি ওয়ানে আরও এক বছর পড়তে হবে, তারপর স্টান্ডার্ড ওয়ান। এত দেরী কি সহ্য করা যায়? সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ঢাকার কোন সরকারী স্কুলের ভর্তি ফরম যোগাড় করার এবং বাচ্চাকে প্রস্তুতি মূলক পড়াশোনা করানোর।
শহরের মনগড়া শীতের কোন এক সন্ধ্যায় বাবা তার ৫ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে হাজির হলো পাড়ার এক বইয়ের দোকানে। "ক্লাস ওয়ানের ভর্তির গাইড বই আছে?" প্রশ্নটা করার সময় গলাটা কেমন কেঁপে উঠল বাবার। ক্লাস ওয়ানের ভর্তি! তাও আবার গাইড বই!! যাহোক দোকানী আশ্বস্ত করলো যে আছে। বেশ কতগুলি গাইড বই মেলে ধরল দোকানী। বলল বিগত দশ বছরের সেরা স্কুল গুলোর প্রশ্নপত্রের মডেল দেয়া আছে। যথারীতি বই উন্মোচন করে বাবা বিস্ময়ে থ' বনে গেল। একি ! এ যে বিসিএস পরীক্ষাকেও হার মানানোর মতো অবস্থা। পরীক্ষা হবে বাংলা, ইংরেজী, অংক এবং সাধারণ জ্ঞান বিষয়ক। এখানে বাংলা প্রশ্ন পত্রের একটা নমূনা দেয়া হলোঃ
১. এলোমেলো অক্ষর সাজিয়ে লিখঃ
লপাতাসহা, তালকমীল, কিনাজো কাপোকা, রন্দনসুর, নত্রমাচি
২. ছন্দ মিলিয়ে শব্দ বসাওঃ
নরম, মেলা, খাঁচা, বই, গান
৩. অমিল শব্দটি কেটে দাওঃ
টেবিল/চেয়ার/ হাত/পেন্সিল, কবুতর/বাদুর/কোকিল/কাক, গরু/গাঁধা/সিংহ/ঘোড়া, গ্রীস্ম/র্বষা/শ্রাবণ/বসন্ত, নানী/খালা/মা/ফুপু
৪. খালি ঘরে যথার্থ শব্দ বসিয়ে শূণ্যস্থান পূরণ করঃ
ক.................. মরুভূমির জাহাজ
খ. বাইরে শনশন ...............বইছে
গ. বাংলাদেশের দক্ষিনে ................... সাগর
ঘ. গর্ব করা ভালো...........
ঙ. সব ফুলের ............নেই
৫. চার অক্ষরের দুটি পাখি, দুটি ফল, দুটি ফুলের নাম লিখ
৬. শিং বিহীন ৫টি পশুর নাম লিখ
৭. ৫টি দেশের নাম লিখ
৮. ৫টি খেলার নাম লিখ
৯. যেগুলো চলাফেরা করতে পারে সেগুলো দাগ দাওঃ
বই, পাখি, নদী, বটগাছ, মানুষ, নীল তিমি, হায়েনা, কচ্ছপ, শাপলা
১০. বই শব্দটি দিয়ে ৫টি বাক্য লিখ
১১. মাত্রাহীন সাতটি স্বরবর্ণ লিখ
১২. মাত্রাহীন ৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ লিখ
১৩. যুক্ত ক্ষ-য়ের সংক্ষিপ্ত রূপ লিখ
১৪. ২০০৬ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছে কোন ব্যক্তি?
১৫. তিনজন বিখ্যাত কবির নাম লিখ
১৬. বাক্য রচনা করঃ
আযান, আকাশ, সূর্য ইত্যাদি
১৭. কোন নদীতে মাছ নেই?
১৮. পৃথিবীর কোন দেশে সাপ নেই?
১৯. টেলিভিশন কে আবিস্কার করেন? কত সালে?
২০. পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কি?
২১. মানবদেহের কয়টি হাড় আছে?
২২. কোন প্রাণী জিহবা দিয়ে শুনে?
এটা গেল শুধু বাংলা প্রশ্নপত্রের নমূনা। ইংরেজী, অংকের কথা না হয় আর না-ই বললাম । এখন আপনারা ভাবতে পারেন যে এটা তো খুবই ভালো যে, ক্লাস ওয়ানে ভর্তির আগেই আমাদের বাচ্চারা অনেক কিছু শিখছে। আহা! সত্যিই কি চমৎকার, দেশ তাহলে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেখা যাক ক্লাস ওয়ানের বইয়ে কি আছে?
১. আমাদের কথা
২. আমি ও আমার সহপাঠিরা
৩. হাট্টিমাটিম টিম, আয়রে আয় টিয়ে (ছড়া)
৪. ছবিতে গল্প-সিংহ ও ইদুর
৫. দেখে দেখে আঁকি
৬. ছবি দেখি ও বলি (স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ)
৭. আয় আয় চাঁদ মামা, ছোটন ঘুমায়, ঝুমকো জবা, নোটন নোটন পায়রা, কানাবগীর ছা, হনহন পনপন (ছড়া)
৮. বাংলা বর্ণমালা
৯. -কার চিহ্ন জেনে শব্দ তৈরী
১০. শব্দ মিলের খেলাঃ
বিল, লতা, আঁকা, হাসি
১১. প্রভাতি (কবিতা)
১২. সাত দিনের নাম লিখ
১৩. টিকটিকির গল্প
১৪. যুক্ত অক্ষর পরিচিতি
১৫. মামার বাড়ি (কবিতা)
১৬. ছয় ঋতু
১৭. রং নিয়ে ছবি ও কথা
১৮. সংখ্যা নিয়ে ছড়া
১৯. মহানবীর ভালবাসা গল্প
২০. ছুটি (কবিতা)
২১. বীরশ্রেষ্ঠ মহিউর রহমান গল্প
২২. আমাদের দেশ
এখন প্রশ্ন হলো ক্লাস ওয়ানের ভর্তি যুদ্ধে যে প্রশ্ন করা হয় সেটা জানতে হলে জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী আপনার সন্তানকে কোন পর্যায় পর্যন্ত অগ্রিম পড়াশোনা করাতে হচ্ছে? এবং সত্যিকার অর্থেই কি তারা সেসব ধারণ করতে পারছে? মায়ের কোল থেকে অ-আ বুলি শিখে খেলার ছলে সংখ্যা গণণা করে বাচ্চাকে আমরা অভ্যস্ত হতে শেখাই এবং পড়াশুনার প্রতি একটা আগ্রহ তৈরীর প্রাণান্তকর চেষ্টার পর অনেক ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাচ্চাকে আমরা স্কুলে পাঠাই। আর সেখানে ভর্তির আগেই যদি বিসিএস ক্যাডারদের মতো এসব জটিল বিষয় শিখতে হয়, যা জোর করে গলধঃকরণ করালেও তাদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয় যে তারা কি পড়ছে। তবে কি আমরা শুরুতেই কচি মনের শিশুদের পড়াশুনার প্রতি একটা ভীতি তৈরী করে দিচ্ছি না? আর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হওয়ার আগেই যদি কোন শিশু এসব বলতে বা লিখতে পারে তাহলে কেনই বা সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হতে যাবে। কারন এত পন্ডিত হওয়ার পরও তাকে এক বছর হাট্টিমাটিম টিম করে কাটাতে হবে। নিশ্চয়ই তার সেটা ভালো লাগবে না।
বাবার ধারণা ছিল তার ছেলে প্লে-নার্সারী কমপ্লিট করেই অনেক বেশি কিছু শিখে ফেলেছে যা ক্লাস ওয়ানের (জাতীয় পাঠ্যক্রম) বইগুলোর প্রায় ৯০% কাভার করে। আর তাছাড়া স্কুলের পাশাপাশি সে অতিরিক্ত অনেক কিছুই শিখে ফেলেছে। যেমন-সাতের ঘর পর্যন্ত নামতা বলতে পারা, ডাবল ডিজিটের যোগ-বিয়োগ (হাতে রেখে), বানান করে গল্পের বই পড়া (যদিও যুক্ত অক্ষর নিয়ে হিমশিম খেতে হয়)। বইয়ের দোকানটাতে সে কিছুক্ষণ স্থানুর মতো দাড়িয়ে রইল। "বাবা আমার চিপস কখন কিনবে?" ছেলের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল বাবা। এতক্ষণ সে আসমুদ্রহিমাচলে দুলছিল। এখন সে কি করবে? তার ছেলেতো প্রশ্নপত্রই ঠিক মতো পড়তে পারবে না। যদি পারেও, সবটুকু বুঝবে না। আর যদি পন্ডিতের মতো বুঝেও ফেলে, লিখতে পারবে কি?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



