somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চল্লিশ বনাম এক: একজন গোর্খা কর্পোরালের বীরত্বগাথা

১৭ ই মার্চ, ২০২১ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সেপ্টেম্বর, ২০১০ এর মধ্যরাত। ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে উত্তর প্রদেশগামী মাউরিয়া এক্সপ্রেস, পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল ভেদ করে এগিয়ে চলেছে। ট্রেন ভর্তি যাত্রীদের অনেকেই তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। যাত্রীবাহী ট্রেনটি আসানসোল চিত্তরঞ্জন শহরতলীর ঘন জঙ্গলে প্রবেশের খানিক পরেই গতি কমাতে বাধ্য হয়। ততক্ষণে মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙ্গে আনুমানিক চল্লিশজন সশস্ত্র ডাকাত চারদিক থেকে ট্রেনটিতে ছুটে আসছে। প্রতেক্যের হাতে ধারালো অস্ত্র, লাঠি অথবা পিস্তল। ডাকাতদের হইচইয়ে ঘুম ভেঙে যায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত একজন চৌকস গোর্খা সৈনিকের। দৈবক্রমে যিনি সেদিন নেপাল যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাউরিয়া এক্সপ্রেসে ভ্রমণ করছিলেন।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিয়তিকে মেনে নিয়ে ডাকাতদের হাতে সর্বস্ব তুলে দিতে থাকেন ট্রেনের যাত্রীরা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অষ্টম গোর্খা রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরালটিও সিদ্ধান্ত নিলেন আত্নসমর্পনের। কারণ মধ্যরাতে ডাকাত আক্রান্ত একটি থেমে থাকা ট্রেনে একাকী বিদ্রোহ করার ভয়াবহ পরিণতি তিনি জানেন। এখানে কেউ তাকে চেনে না। তার হুঙ্কারে নিরীহ যাত্রীদের কেউই ডাকাতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না। তাছাড়া, ডাকাতরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ গুম করে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাই নির্বিবাদে তিনি তার সাথে থাকা টাকা পয়সা ডাকাতদের দিয়ে দিলেন। নেপালি চেহারার একজন সুঠামদেহী মানুষের ব্যাগে যে কুকরির মতো একটা ভয়াবহ ছুরি থাকতে পারে সেটা হয়তো ডাকাতরা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।

অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরাল সাহেবের পাশের সিটেই স্বপরিবারে সহযাত্রী হয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সী একজন নারী। ডাকাতদের একজন নারীটিকে গণধর্ষনের অভিপ্রায়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনার এই পর্যায়ে প্রতিটি গোর্খাকে শিক্ষা দেয়া নীতিবাক্য মনে পড়ে যায় ৩৫ বছর বয়সী কর্পোরালের। ''Kaphar hunnu bhanda marnu ramro'' অর্থাৎ ''কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়''। কর্পোরালের ব্যাগ থেকে তড়িৎগতিতে বের হয়ে যায় প্রতিটি গোর্খার সার্বক্ষণিক বন্ধু; কুকরি। শুরু হয় চল্লিশ বনাম একের মরণযুদ্ধ।

নারীটির গায়ে হাত দেয়া ডাকাতটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারাত্নক ভাবে আহত হয়ে পড়ে। তাকে ঢালের মতো ব্যবহার করে মাত্র একটি কুকরিকে সম্বল করে চলতে থাকে কর্পোরালের হাতাহাতি যুদ্ধ। কিন্তু গোর্খাদের সাথে হাতাহাতির পরিণাম কি হয় সেটা দুই বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসেই লেখা আছে। যাত্রীভর্তি ট্রেনের মধ্যে কর্পোরালকে নিশানা করে ছোড়া একটি গুলিটি মিস হয়। ডাকাতেরা কর্পোরালকে খুন করতে বেপোরোয়া হয়ে গেছে, কেননা এর মধ্যেই তিন জন ডাকাতকে হত্যা এবং আটজনকে গুরুতর আহত করে ফেলেছেন কর্পোরাল। এই ভয়াবহ ঘটনার এক পর্যায়ে ডাকাতদের আঘাতে কর্পোরালের হাত থেকে কুকরিটি মেঝেতে পড়ে যায়। ডাকাতেরা সেই কুকরিটি দিয়েই কর্পোরালের বাম হাতে গুরুতর জখম করে ফেলে। তবে ততক্ষণে কর্পোরালের সাহসিকতায় ট্রেনে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ যাত্রীদের পাল্টা আক্রমণে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় বাকি ডাকাতেরা। পরের স্টেশনে থেমেই আহত কর্পোরালকে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটস্থ হাসপাতালে। পরবর্তীতে ভারতীয় পুলিশ, ট্রেন ডাকাতদের চক্রটিকে গ্রেফতার করে বিপুল অর্থ এবং স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করে।





এই বীরত্বপূর্ণ ঘটনাটি ২০১০ সালে উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা। সেসময় সারা পৃথিবীতে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় সিক্ত হন এই গোর্খা বীর, কর্পোরাল বিষ্ণু শ্রেষ্ঠা। বীরত্বের প্রতিদানস্বরূপ ভারতীয় সেনাবাহিনীর "সেনা মেডেল" এবং ভারত সরকারের "উত্তম জীবন রক্ষা পদক" মেডেলে ভূষিত হন অবসরপ্রাপ্ত এই কর্পোরাল।

কর্পোরাল বিষ্ণু শ্রেষ্ঠাকে সেই মেয়েটির জীবন বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মেয়েটির পরিবার মোটা অংকের অর্থ উপহার দিতে চেয়েছিলো। তিনি সেই উপহার আন্তরিকতার সাথে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,"সৈনিক হিসেবে আমার কর্তব্য ছিলো রণাঙ্গনে শত্রুদের সাথে লড়াই করা, আর মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য ছিলো ডাকাতদের সাথে লড়াই করা"




ছবি: স্টারস আনফোলডেড.কম, ইন্ডিয়া টাইমস
রেফারেন্স ১: wiki
রেফারেন্স ২: India Times

আমার অন্যান্য লেখা:
রেডিয়াম গার্লদের বেদনাদায়ক ইতিবৃত্ত
সেসিলিয়া প্যেন: বিজ্ঞানের নক্ষত্র, নক্ষত্রের বিজ্ঞান
বেতারের আটলান্টিক ভ্রমণ


আমার ফেসবুক পেজ
আমার ইউটিউব চ্যানেল
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২১ বিকাল ৫:০০
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×