somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটা সাধারণ দিনের গল্প

২০ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘুম থেকে উঠে দেখি এগারটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। সাথে সাথে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। এগারটার সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছিল। করতে পারলাম না। সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা- কী যে হবে?
আমি বিছানা ছাড়লাম না। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আজ কী করা যায়। আমার অভিজ্ঞতা বলে যে-সব খারাপ কিছুর মধ্যেও একটা না একটা ভাল লুকিয়ে থাকে। এবং আমি বরাবরই সেই ভালটা খুঁজে নিতে অভ্যস্থ। এছাড়া আমার আর কী বা করার আছে? বুঝতে শেখার পর থেকে চারপাশে শুধু খারাপ ঘটনাই ঘটতে দেখলাম। ভাল ঘটনা যে ঘটে নাই তা না কিন্তু খারাপাটা ভাল মনে থাকে। খারাপ স্মৃতি অনেকদিন পর্যন্ত টাটকা থাকে।
ভালই হল- আজ সারাটা দিন ফাঁকা পাওয়া গেল। আজ আবার রবিবার। তার মানে বিকালে টিউশনিও নাই। জোশ। শনি-সোম-বুধ বিকালে টিউশনি থাকে বলে সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ থাকে। আজ সারাদিন ছুটি, পুরপুরি ছুটি।
আরও আধ-ঘন্টা গড়াগড়ি করে সয়া এগারটায় বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি দাড়িগুলো বেশ লম্বা হয়েছে। আমার জন্য দিনের প্রথম কাজ হিসেবে দাড়ি কাটা খুবই শুভ। আমি দাড়ি কাটতে কাটতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছু অটোসাজেশন দিলাম। এই যেমন আজ আমি অনেক কম সিগারেট খাব, পরিচিত অপরিচিত যে মেয়েই ফোন করুক না কেন আমি তার সাথে দেখা করতে যাব না, রাতের বেলায় কেউ বিনা পয়সায় খাওয়াইতে চাইলেও আমি মদ খাব না ইত্যাদি। আমাকে এই উপদেশগুলো আমাকেই দিতে হয় দুটো কারনে- প্রথম কারন হল আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রন খুব কম। আর দ্বিতীয় কারন, আমাকে এই উপদেশগুলো দেয়ার মত বর্তমানে আর কেউ নেই।
দাড়ি কাটা শেষ হতে না হতেই পাশের বাসায় আমার পছন্দের এ্যালবামটা বাজতে শুনলাম। বি- পিঠ অবশ্য । কী আর করা? নিজের যখন নাই তখন অন্যরা যা বাজাবে তাই তো শুনতে হবে। এই এ্যলবামটা খুব মজার। এ- পিঠ এ গান আর বি- পিঠ এ সংলাপ। বিষযটা পরিষ্কার হল না। খুলেই বলি। পাশের বাড়ির আমাদের ঘরের সোজাসুজি ফ্ল্যাটটাতে থাকেন প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের একজন সংবাদ উপস্থাপক। সাথে তার স্ত্রী এবং আট দশ বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটি গান শেখে এবং তার গানের গলা সত্যি চমৎকার। মেয়েটি রোজ সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা রেওয়াজ করে। এটাই এ- পিঠ। আর ওই সংবাদ উপস্থাপক প্রতিদিন দু’বেলা, অফিসে যাওয়ার সময় আর অফিস থেকে ফিরেই, তার বউ এর সাথে তুমুল ঝগড়া শুরু করে। চিৎকার করে গালি দিতে পারে লোকটা। বউটাও কম যায় না। মনে হয় টিভিতে তীব্র রাজনৈতিক কোন বিষয়ে টক-শো হচ্ছে। ওটাই বি-পিঠ।
ক্যাসেট বাজতে থাকল। দাড়ি কাটা শেষে আমি একটা সিগারেট নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। এমন সময় শুনলাম আমার ফোনটা বাজছে। আমার ক্ষেত্রে সবসময় এই রকম কেন হয়? সারাদিন ফোনটা সাথেই থাকে, কল আসে না। যেই একটু বাথরুমে যাই অথবা ফোন রেখে বাইরে যাই এসে দেখি আঠারটা মিসড কল। আমার কপালটাই এইরকম। কোনদিন ইউনিভার্সিটির বাসে যেতে পারিনি। অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে আমি যখন অন্য বাসে উঠি ঠিক তখনই ওটা আসে। নিজের উপর রাগে তখন আমার গা জ্বলে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি চারটা মিসড কল। সবগুলই সিমির। ও আমার ফার্মগেটের বন্ধু। আমরা ইউ সি সি কোচিং এর ফার্মগেট শাখায় এক সাথে কোচিং করতাম। বেশির ভাগ দিনই আমরা কোচিং এ ক্লাস বাদ দিয়ে ওর পরামর্শ মত ফার্মগেটের বিভিন্ন রেস্টুডেন্টে বসে চা খেয়ে আর গল্প করে বাসায় ফিরে যেতাম। এজন্য আমি ওকে আমার ফার্মগেটের বন্ধু বলি। এটা শুনলে ও সেই রকম রাগে। সিমি ঢাকার মেয়ে। আর আমি এসেছিলাম গ্রাম থেকে। আমার চোখে ও তখন ভীষণ স্মার্ট। যা বলত তাই করতাম। ওর দেখাদেখি সিগারেট খেতে খেতে আমার নেশা হয়ে গেল অথচ ওই হামামজাদী নাকি এখন আর সিগারেট খায় না। পরিচয়ের দিনই আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে বলতে পারিনি। জানতাম ও এটা শুনলে কি করবে। খিলখিল করে হাসতে হাসতে দুইটা ঢাকাইয়া গালি দিয়ে ছেড়ে দেবে। অথচ আমার চোখের সামনে ওকে পাঁচ পাঁচবার প্রেমিক বদল করতে দেখেছি। স্ট্যাম্পের মত ওর নাকি বয়ফ্রেণ্ড জমানোর শখ। অথচ আমি কোনদিন বলতে পারিনি, ‘‘আমকেও রাখনা তোর প্রেমিকদের নামের খাতায়।”
একদিন আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। ওইদিন নানা ভাবে ওকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে আমিও তাকে ভালবাসি, পছন্দ করি। আমি সব কিছু মেনে নিতে রাজী। ও না বোঝার ভান করেছিল। আমার আর ধৈর্য্য ছিল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করেছলাম ‘আমি কম কীসে?
উত্তরে ও যা বলেছিল তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ আচ্ছা তোর কি কারও সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনের অভিজ্ঞতা আছে?’
আমি বললাম, “না, তবে আমার ইচ্ছে আছে।”
ও বলল, “ঠিক আছে, যদি তুই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাস তবে তুই আর আমি একদিন.........।”
ও জানে না ওইদিন নিজের অজান্তেই ও আমার কত বড় একট উপকার করেছে। আমি ভাল একটা সাবজেক্টে চান্স পেলাম শুধুই সেই দিনটির লোভে। থ্যাংক ইউ সিমি।
যদিও আমার অনার্স শেষ হতে গেল কিন্তু সেই দিনটি এখনও আসেনি। নানান ওজুহাতে ও বিষয়টি এড়িয়ে যায়। সরাসরি না বলে না কখনো। আমিও তাই আশা ছাড়িনি।
আবার ফোন বাজলো।
-হাই ডার্লিং, কেমন আছ?
-ভাল, তোর কি খবর?
-আমি সুপার। হঠাৎ কি মনে করে?
-না তেমন কিছু না। অনেক দিন কথা হয় না তাই। আজকে বিকেলে কি তুই ফ্রি?
-তোর জন্য অনন্তকাল ফ্রি। কী কাজ বল?
-কাজ নাই কোন। ভাবছিলাম বিকেলে তোদের ক্যাম্পাসের দিকে যাব।
-আবশ্যই। কটা বাজে আসবি?
-এই ধর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা।
-আজ হবে?
-কী?
-ওইটা।
-কোনটা?
-ওই যে, তুই আর আমি......
-যাহ....ফুট। সাড়ে পাঁচটা বাজে টি এস সি তে। ওকে? বাই।
-ওকে। বাই।
ফোন রেখে আমি নাশতা খেতে বসলাম। সকালে নাশতা খাওয়া ভয়াবহ বিরক্তিকর। আমাদের এই মেসে প্রতিদিন সকালে একই মেনু। রুটি আর আলু ভাজি। গলা দিয়ে নামতেই চায়না। ব্রেকফার্স্ট ইজ দ্য মোস্ট ডিজঘাস্টিং মিল অব দ্য ডে।শুধু খালি পেটে বেশি সিগারেট খাওয়া যায় না বলেই কষ্ট করে হলেও দুই পিস রুটি পেটে চালান করে দিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বসলাম আজকের পত্রিকা নিয়ে। খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়া করার জন্য সরকার দেখি উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু এক মাস ধরে ইন্ডিয়ায় কী ইলেকশন হচ্ছে আল্লাহ মালুম। আমাদের এক দিনের ইলেকশনে তাই নেতা-নেত্রীদের ত্বর সয় না। ভারতীয় হলে এরা কী করত কে জানে। ওয়ারিদ এর অফারগুলো তো বেশ, নেব নাকি একটা সিম? নম্বর চেঞ্জ করলে আবার সবাইকে নম্বর দাও- ভেজাল। এমনিতে কয়েক দিন আগে গ্রামীন বদলে বাংলালিঙ্ক নিছি।
পত্রিকা রেখে আমার দুপুর আর রাতের মিল অফ করে দিয়ে আমি বাসা থেকে বের হলাম। গলির মাথায় সাজু ভাই এর দোকানের সামনে রনির সাথে দেখা। রনি আমাদের এই মেসে থাকত। এখন পাশের একটা মেসে থাকে। ও হচ্ছে আমার দেখা দুনিয়ার সব থেকে ধান্ধাবাজ ছেলে। ও ওর এক বন্ধুকে দিয়ে ওর নিজের বউ এর কাছে ইমিটিশনের গয়না খাটি সোনার বলে বিক্রি করিয়েছে। তারপর সেই টাকা দিয়ে দুই বন্ধু মদ খেয়েছে। এমনিতে ছেলে খুব ভদ্র। বয়সে আমার দুই বছরের মত বড় হবে কিন্তু আপনি আপনি করে কথা বলে সবসময়।
- স্লামালেকুম আশিক ভাই। কেমন আছেন?
- আরে রনি ভাই যে। আপনার তো দেখাই পাওয়া যায় না। ব্যস্ত নাকি খুব?
- আরে না। বাড়িতে গেছিলাম। আপনার ভাবী আবার এক মাসের বেশি আমারে না দেখে থকতে পারে না। তাই মাঝে মধ্যে বাড়ি যেতে হয়। আপনাদের রুমে কি নতুন কেউ উঠছে না ফাঁকাই আছে।
- এখনও ফাঁকা আছে। ভাবতেছি আর কাউকে নেব না। ভাড়া একটু বেশি গেলে যাক। নতুন লোক মানেই নতুন ভেজাল।
- ঠিক বলছেন ভাই। ভালো লোক পাওয়া খুবই মুশকিল। ভাই একটু এই দিক আসেন তো, কথা আছে।
- বলেন।
- ভাই রাতে একটু কষ্ট করে আমার বাসায় আইসেন তো। বহুৎ ঝামেলা করে একটা বোতল ম্যানেজ করছি। আমার দুইটা বন্ধুকেও আসতে বলছি। আর তাছাড়া আমার নতুন বাসায় তো আসলেন না- কত করে বললাম।
- ঠিক আছে। রাতে আসব।
- ভাই রাতের খাবারটা আমার বাসায় খান-
- না,না। আমি খেয়ে আসব।
- ঠিক আছে। ভাই থাকেন তাইলে। আমি একটু সামনে যাচ্ছি।
- আচ্ছা যান। রাতে দেখা হবে।


সাজু ভাইএর দোকানে এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। মনে মনে দিনের বাকি সময়টার একটা প্লান করে ফেললাম। এখন ক্যাম্পাসে যাব। লাইব্রেরির সামনে লাঞ্চ করে মধুতে বসে আড্ডা দিতে দিতে সিমির জন্য অপেক্ষা করব। এরপরের সবকিছু নির্ভর করছে সিমির উপর। ওর ব্যাপারে আগে থেকে প্লান করে রাখা মুশকিল। শী ইজ ভেরি আনপ্রেডিক্টেবল। বছর দু’এক আগে একদিন ক্যাম্পাসে এসে বলল, ‘এই আশিক, শুনলাম পাবলিক লাইব্রেরি নাকি এখন সারারাত খোলা থাকে, রাতে মেয়েরা থাকতে পারে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, না পারার কী আছে?’ ও বলল, ‘কাল সারারাত আমি আর তুই লাইব্রেরিতে থাকব।’ আমি তো অবাক, ‘বলিস কী, বাসায় কী বলবি, আর তাছাড়া তুই তো বাইরের বই তেমন পড়িস না।’ ও রেগে বলল, ‘বাসা আমি ম্যানেজ করব, আর আমি আবশ্যই বই পড়ার জন্য থাকব না, আমি থাকব গভীর রাতে ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে কেমন লাগে দেখার জন্য। তুই থাকবি কিনা বল।’ ওকে না বলার সাহস আমার তখনো ছিল না, এখনো নেই। ওইদিন ও চলে যাওয়ার পরই নানা রকম দুশ্চিন্তা আমকে ঘিরে ফেলল। মাঝ রাতে একটা যুবতী মেয়ের সাথে রাস্তায় হাঁটব- যদি ছিনতাইকারি ধরে, যদি পুলিশে ধরে, যদি অন্য কেউ কিছু বলে............। পাশাপাশি আবার এটাও মনে হচ্ছিল যে কাল হয়ত ও আমকে দেয়া ওর সেই কথাটি রাখতে চায়। তুমুল উত্তেজনায় ওই দিন রাতে ঘুমাতে পারিনি এতটুকু।


হাঁটতে হাঁটতে যখন নিলক্ষেত পৌঁছে গেলাম তখন দুপুর দুটো। জৈষ্ঠ্য মাসের কাঠাঁল পাকা রোদ আর তীব্র গরম। ঢাকা শহরটাকে মনে হচ্ছে কে এফ সির চিকেন ফ্রাই। আমি ফুটপাতের পুরনো বই এর দোকানগুলোতে চোখ রেখে হাঁটছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ বইটা।
-মামা এইটা কত পড়বে?
-একশ ত্রিশ টাকা।
-পঞ্চাশ দেই।
-ওই দামে মার্কেজের বই পাবেন না মামা।
-কেন, উনার বই কি খুব ভাল?
-ক্যান জানেন না, হে বই লিখে নবেল পুরষ্কার পাইছে।
-ও এই কারন এ।
পাশেই দেখি রবি ঠাকুরের ‘সোনার তরী’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা এইটা কত?’ বলল, ‘ত্রিশ টাকা করে বেঁচি, আপনে দশ টাকা কম দিয়েন’।

আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম ক্যাম্পাসের দিকে। বেশি দেরি হলে আবার আলামিনের দোকানে লাঞ্চ পাওয়া যায় না। ওটাই ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সস্তা খাবারের দোকান। স্বাভাবিক ভাবেই ওখানে ভীড় বেশি হবে। দাম কমলে চাহিদা বাড়ে- অর্থনীতির এ এক ভীষণ মৌলিক ধারনা।

আলামিনের দোকানে লাঞ্চ সেরে আমি মধুতে গেলাম। পরিচিত কেউ না কেউ থাকেই। কিন্তু আজ কাউকেই পেলাম না। আমি এক গ্লাস রং চা আর একটা সিগারেট নিয়ে কোনার দিকের একটা চেয়ারে বসলাম। এরকম একা বসে থাকার সুযোগ পেলেই আমি আমার দুর্ভাগ্যের কথা ভাবি। মা মারা গেলেন খুব ছোটোবেলায়। বাবা আবার বিয়ে করলেন। তারপর আমি কলেজে পড়ার সময় বাবাও মারা গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবার পর থেকে টিউশনির টাকায় চলি। বাবার সম্পত্তি যা ছিল চাচারা সব লুটেপুটে খেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিলাম। এই ইলেকশনের পর ছাত্রলীগ আমকে হল থেকে বের করে দিল। কারন হলে ওঠার সময় ছাত্রদলের এক নেতা আমকে সামান্য সহযোগীতা করেছিলেন। উঠলাম কাঠাঁলবাগানের একটা টিনশেড মেসে।

আমি যথারীতি এতসব খারাপের মধ্যেও ভাল একটা দিকের সন্ধান পেয়েছি। সেটা হল আমি পুরপুরি স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারছি। আমাকে নিয়ে কেউ ঘাটাঘাটি করে না। আমিও কাউকে ঘাটি না। বুঝতে শেখার পর থেকে আমি এমনটাই চেয়েছি।

এত কিছুর পরও আমি বেশ ভাল আছি। দুইটা টিউশনি করলে ভালই চলে যায়। তিনটে করতে পারলে কিছু জমানোও যায়। আমার অবশ্য সঞ্চয় প্রবনতা একেবারই নেই। জমানো টাকা খরচ করার আগেই আমি মানুষকে মরে যেতে দেখেছি। মাসের প্রথম ক’টা দিন ভীষন বেহিসেবী ভাবে চলি। যে কারনে বিশ তারিখের পরই ধার করতে হয় বন্ধুদের কাছ থেকে আর বাকিতে সিগারেট নিতে হয় মোড়ের দোকান থেকে। টিউশনির বেতন পেলে প্রথমেই ওদের ধার শোধ করে দেই বলে ওরাও বেশি ঝামেলা করে না। সবাই বলে, আমার লেনদেন খুব ভাল।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি চারটে বাজতে পনের মিনিট বাকি। আমার অবাক লাগল। মনে হল আমার দুর্ভাগ্য তার মানে খুব বেশি না। ভাবতে এক ঘণ্টা সময়ও লাগে না।

আমি আবার লাইব্রেরির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একদিনও বই পড়ার উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে যাইনি। কয়েকবার গেছি শুধু ছোটো কাজ সারতে। পরিচিত বন্ধু বান্ধবরাও কেউ বই পড়ার জন্য ওখানে যায় না। কেউ ওখানে বসে টিউশনি করে আর কেউ প্রেম করে। আজ আমি গেলাম শুধুই বই পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। ঢোকার পর মনে হল আমার কাছে তো লাইব্রেরি কার্ড নেই। কী আর করা! গেলাম পত্রিকা সেকশনে। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে চার পাঁচটা দৈনিকের লীড নিউজ দেখলাম। একই নিউজ – শুধু ল্যাংগুয়েজ আলাদা। বিরক্ত লাগল। ওখান থেকে বের হয়ে গেলাম আলামিনের দোকানে। চা’র অর্ডার দেব এমন সময় দেখি সজীব ভাই।
- আরে সজীব ভাই না? কী খবর? কবে আসলেন ওখান থেকে?
- ভাল। গত পরশু এসছি।
- কাজ হইছে কোন?
- হ্যাঁ, একদম সাইজ করে দিছে, সব্জীর গন্ধে এখন বমি আসে ।
- বাহ, ভালই তো।পত্রিকায় জয়েন করেছেন?
- না। এখনো করিনি। এডিটর স্যার কয়েক বার ফোন করেছেন। আমি ভাবতেছি করব না। ফ্রি ল্যান্সার থাকার একটা আলাদা মজা আছে, প্রচুর স্বাধীনতা থাকে।
- ইয়প। ভাই আপনি একটু দাঁড়ান। আমি চা নিয়ে আসি।
চা খেতে খেতে আমি সজীব ভাইয়ের রিহ্যাবের গল্প শুনলাম।জায়গাটা নাকি তার খুব পছন্দ হয়েছে। সজীব ভাই জিনিয়াস,আনডাউটেডলি। জানেন প্রচুর, কথা বলেন কম, লেখেন ভাল। খুব কম বয়সে একটা দৈনিক পত্রিকার ফিচার এডিটর হয়েছিলেন। মিনটাইম গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন ভীষণভাবে। তারপর নিজ উদ্যোগে গেলেন একটা রিহ্যাব সেন্টারে। তাও প্রায় বছর খানেক আগে। তারপর আজ দেখা। দ্রুত গল্প জমে উঠল।
কখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে টেরই পাইনি। আমাদের সামনে একটা ছাই রঙের নিশান ব্লু-বার্ড এসে থামল। সিমি নামল ওটা থেকে। সাথে একটা ছেলে। বেশ হ্যান্সাম। বুঝে গেলাম এটা সিমির কালেকশনের নতুন ডাকটিকিট। কাছে এসেই সিমি ওর স্বভাবসুলভ দ্রুত গতিতে বকবক করা শুরু করল- জানতাম তুই এখানে থাকবি। তাই এই পথ দিয়েই টি এস সি যাচ্ছিলাম। ঠিকই তাই। পরিচিত হ, আমার কাজিন, হিমেল। হিমেল, আশিক।
পরিচয় পর্ব শেষে আমরা তিনজন সজীব ভাইএর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ওরা নাকি লং ড্রইভে যাবে। আমকে কেন সাথে নিচ্ছে বুঝলাম না। গাড়িতে উঠে আমি সিমিকে জিজ্ঞেস করলাম, সিমি, হিমেল কি তোর নতুন কাজিন। উত্তরে ও বলল, এই বেয়াদব, কাজিন আবার নতুন পুরান কি রে? একদম ফাজলামি করবি না কিন্তু। আমি বললাম, আগে কখনও দেখিনি, নামও শুনিনি তোর মুখে এজন্য জিজ্ঞেস করলা্ম।
গাড়ি বিজয় সরণি পার হওয়ার সাথে সাথে ওরা ভুলে গেল যে গাড়িতে ওরা ছাড়া আরও দুটো মানুষ আছে। রক্ত- মাংস-যৌনতা সমৃদ্ধ মানুষ।
আমরা আশুলিয়া গেলাম। বলা ভাল ওরা আশুলিয়া গেল, আমি সাথে ছিলাম। ওরা এদিক ওদিক ঘুরতে গেল। আমি আর ড্রাইভার ওখানকার একটা চা’র দোকানে বসে চা- সিগারেট খেলাম। আটটার দিকে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। উত্তরায় একটা রেস্টুরেণ্টে আমরা ডিনার করলাম। যাওয়া আসার পথে সিমির সাথে আমার খুবই কম কথা হল। কিন্তু আমি কিছুই মনে করিনি। সিমির কোন কিছুই আমার কেন যেন খারাপ লাগে না। আমকে কারওয়ান বাজার নামিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল। হিমেল বারবার করে ধন্যবাদ দিল। বুঝলাম সিকিউরিটি হিসেবে আমি ভাল সার্ভিস দিয়েছি।
গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম আকাশে বেশ মেঘ করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসও আসছে। ঝুম বৃষ্টি হবে মনে হল। আমি দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলাম রনির বাসার উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যেতে না যেতেই টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হল। আমি থামলাম না। আর মিনিট দুই হাঁটলেই রনির বাসা। এমন সময় আমার মনে পড়ল সকালে নিজেকে দেয়া আমার উপদেশগুলোর কথা।

Kalabagan, Lake Circus, Dhaka
Saturday, 23 May 2009
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×