এটিএন বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি আর তার স্বামী মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে নিজেদের শোবার ঘরে নৃশংসভাবে খুন হন। পরদিন সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন শূন্য ভাণ্ডের মতো বিকট আওয়াজ করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে নির্দেশ দিলেন (তার নিজের কথায় ‘নির্দেশ প্রদান’ করলেন)। তার প্রদত্ত নির্দেশও শূন্য ভাণ্ডের মতোই অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হলো।
কেউ কেউ তখনো বলেছিলেন, প্রকৃত অপরাধীরা খুব সম্ভবত ধরা পড়বে না, কেননা বর্তমান বাংলাদেশে জঘন্যতম দুষ্কৃতগুলো ঘটাচ্ছে আওয়ামী লীগের লোকেরা, আর সরকারের নিজের লোকেদের গায়ে হাত দেয়ার সাহস বাংলাদেশের দলীয়কৃত বর্তমান পুলিশ বাহিনীর নেই। বাস্তবেও তেমনটাই ঘটল। পুলিশের দিক থেকে ঘন ঘন পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা শোনা গেল। প্রায় সবাই সাব্যস্ত করলেন, ধূম্রজাল সৃষ্টি করে প্রকৃত অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রণে ভঙ্গ দিলেন। তিনি বললেন, রুনি-সাগর হত্যার সুরাহা করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে নিয়েছেন।
তাতে কেউ আশ্বস্তবোধ করেনি। কার্যক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। খুনিদের গ্রেফতারের নাম-নিশানা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলে দিলেন, ‘কারো বেডরুম পাহারা’ দেয়া পুলিশের কাজ নয়। যেকোনো চিন্তাশীল মানুষ উপলব্ধি করবেন, ‘বেডরুম’ কথাটা ব্যবহারের মধ্যে একটা কদর্যতা নিহিত আছে। কোনো রকম পরকীয়ার লক্ষণ দেখা গেলে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি প্রাসঙ্গিক হতে পারত। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ইঙ্গিত নেই। নিজেদের শোবার ঘরে স্বামী-স্ত্রী একসাথে খুন হয়েছেন। কুৎসিত রাজনীতি বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর রসনাকেও কেমন প্রভাবিত করেছে প্রধানমন্ত্রীর উক্তিতে তারই প্রমাণ পাওয়া গেল।
কারো শোবার ঘরে পুলিশি পাহারা কাম্য কিংবা শালীন কোনোটাই নয়। সে প্রস্তাব কেউ প্রধানমন্ত্রীকে দেয়নি। কিন্তু শোবার ঘরে কেউ খুন হলে খুনিকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া সরকারের দায়িত্ব। স্পষ্টতই তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সরকার সে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। জাতি শুধু তার কাছ থেকে জানতে চায় আরো অজস্র হত্যার মতো এ হত্যারও সুরাহা কবে হবে, খুনিরা কবে সাজা পাবে।
এ দিকে সম্পাদকেরা সম্পাদকীয় লিখছেন, কলামিস্টরা কলাম লিখছেন, সাংবাদিকেরা ঐক্যবদ্ধ দাবি জানাচ্ছেন, কর্মবিরতি করছেন। সবাই এ জঘন্য হত্যার সুরাহা চান, খুনিদের বিচার চান। একটা ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটে গেছে। বর্তমান সরকার দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে আদালতগুলো কেমন ভর্তি করেছেন কারো অজানা নেই। অনেকেই সরকারের ইচ্ছা পূরণের রায় দিতে কেমন পারদর্শিতা দেখাচ্ছে সেটাও সবাই জানেন। বর্তমান ক্ষেত্রে হাইকোর্ট সরকারের কর্মকর্তাদের ওপর রুল জারি করেছেন, জানতে চেয়েছেন ‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ণয় এবং খুনিদের আইনের আওতায় আনতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না?’
একটা জোর গুজব এখন সর্বসাধারণের মুখে মুখে ঘুরছে। সরকার ও প্রধানমন্ত্রী আপাতদৃষ্টিতে এযাবৎ রুনি ও সাগরের খুনিদের পাকড়াও করতে ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু খুনিরা ধরা না পড়লে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া গুজবের কলঙ্ক প্রধানমন্ত্রীর গায়েও লাগবে। গুজবটা এই যে, সাংবাদিক দম্পতি কিছু তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আত্মীয়দের একটা পারিবারিক শিল্প গ্রুপ টেন্ডারবিহীন সরকারি কন্ট্রাক্টে বহু বহু কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। সর্বসাধারণের ধারণা, এই পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি মিডিয়ায় প্রচার বন্ধ করতেই রুনি-সাগরকে হত্যা করা হয়েছে। গুজবের আরো বহু শাখা-প্রশাখা আছে। একটা হচ্ছে, প্রকৃত দু’জন খুনিকে ইতোমধ্যেই দেশের বাইরে চলে যেতে দেয়া হয়েছে। আরেকটা শাখা এই যে, মন্ত্রিসভার সামপ্রতিক রদবদলের পর থেকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের খুব কাছের ৪৩২ একর জমি ওই শিল্প গ্রুপকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
গুজবের সত্য-মিথ্যাঃ
স্বীকার করছি গুজব সব সময় সত্যি হয় না। কিন্তু বিনা আগুনে ধোঁয়া হয় না, প্রায় ক্ষেত্রেই গুজবে কিছু সত্যতা থাকে। তার চেয়েও বড় কথা রাজনীতিতে ভুয়া অভিযোগ ও গুজবও সবিশেষ ক্ষতি করতে পারে। বর্তমান শাসক দলের সেটা ভালো করেই জানা আছে, আছে বলেই তারা বিরোধী দলগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে অবিরাম মিথ্যা অভিযোগ ও মামলা করে চলেছে। কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রচলিত গুজব সাধারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার বহু কারণ আছে।
এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শাসক দল এবং সে দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর ক্যাডাররা বহু হত্যা করেছে কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই খুনিরা শাস্তি পায়নি। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সরকারের আমলে অনেকগুলো রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব রাজনৈতিক হত্যাকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্য বিবৃতিতে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খুনের পথ বেছে নিতে তম্ভি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘আপনারা কি শাড়ি পরেন? একটার বদলে দশটা লাশ ফেলতে পারেন না?’ সংবাদ সম্মেলনে লক্ষ্মীপুরের আবু তাহের, ফেনীর জয়নাল হাজারী, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান প্রমুখ গডফাদারের খুন, অত্যাচার ও নির্যাতনের সমালোচনা করায় শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের ভর্ৎসনা করেছিলেন।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে সংঘটিত কতগুলো হত্যার বিচার হয়েছিল, অপরাধীদের কাউকে কাউকে প্রাণদণ্ডও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর তার সরকার শুধু যে তার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাত হাজারেরও বেশি দুর্নীতির মামলা তুলে নিয়েছে তাই নয়, রাজনৈতিক ঘাতকদের অনেকের দণ্ড রাষ্ট্রপতির দ্বারা মার্জনা করে নেয়া হয়েছে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ড. এইচ বি ইকবালের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা রাজধানীতে বিএনপির মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল।
বর্তমান সরকার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা তুলে নিয়েছে। নাটোরের কুখ্যাত গামা হত্যার দায়ে দণ্ডিতদের ফাঁসির দণ্ড মার্জনা করা হয়েছে, লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের হত্যা দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আবু তাহেরপুত্র বিপ্লবসহ অন্যান্য খুনির দণ্ডও মার্জনা করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ওই বিপ্লব ও সহ-দুষ্কৃতকারীর আরো কিছু দণ্ড গত কয়েক দিনে মার্জনা করা হয়েছে।
হত্যা যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিঃ
যে চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে সেটা এই যে, আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের হত্যাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে। সরকার ও শাসক দলের স্বার্থের প্রতি কেউ হুমকি দেখালে তার খুন হয়ে যাওয়া এখন স্বাভাবিক। এ ধারণা এখন সৃষ্টি হয়েছে যে শুধু ৩৭ বছর আগের মুজিব হত্যা ছাড়া আর কোনো হত্যা দণ্ডনীয় নয়। কিন' এ কথা তারা ভুলে যাচ্ছে যে দণ্ডদানের মালিক-মোখতার এ দেশে আরো আছে, তারা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের ভোটদাতা।
রুনি-সাগরের খুনিদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থতার জন্য শাসক দলে যেন কারো মাথাব্যথা নেই। বরং এ দলের নেতাদের কারো কারো উক্তিতে সাধারণ মানুষের পায়ের তলাও জ্বালা করে। একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ। তিনি বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে বিদ্রূপ করেছেন। বলেছেন, খুনিদের সম্বন্ধে খোঁজখবর পুলিশকে দিতে। হানিফ আরো বলেছেন, খালেদা জিয়া মূল আসামিদের আড়াল করতে চাইছেন।
এই ব্যক্তিটি তার নেত্রীর কাছ থেকে অশোভন কথাবার্তা রপ্ত করেছেন? নাকি স্কুলজীবন থেকে? স্কুলে কেউ কেউ বদ ছেলেদের কাছ থেকে ফাজলামি আর ইতরামি শেখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে সেসব বদ অভ্যাস কেটে যায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার ঊর্ধ্বে ওঠেন। মনে হচ্ছে, সরকারদলীয় কেউ কেউ ফাজলামি আর ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না।
খালেদা জিয়া কি পুলিশের ‘ইনফরমার’ অথবা ‘সোর্স’? এবং তিনি এখন দেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব বহন করছেন না। তার কাছে রুনি-সাগরের খুনিদের গ্রেফতারে সাহায্য চেয়ে হানিফ স্বীকার করে নিলেন যে, আর সব বিষয়ের মতো আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারেও এ সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। দেশের মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়ার সাধ্যি যে সরকারের নেই তাদের গদি দখল করে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এ সরকার এখন রক্ষক এবং আশ্রয়দাতার পরিবর্তে আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ আপদ যত তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততই মঙ্গল।
সূত্রঃ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


