somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন: একটি ‘মিডিয়াজেনিক’ ইস্যুর জন্ম-মৃত্যু উপাখ্যান

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মিডিয়া ও সামাজিক আন্দোলন


সামাজিক আন্দোলনের সাথে গণমাধ্যমের সম্পর্ক এতই নিবিড় যে তাদের বলা যেতে পারে ‘দোহে দু’জনার’। ২০১৮তে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই সত্য অলঙ্ঘনীয়।

আন্দোলনের বিস্তার, আন্দোলনের দাবিগুলোর প্রতি জনসমর্থন আদায় এবং আন্দোলনের দাবিনামার যৌক্তিকতা ও যথার্থতা প্রমাণের জন্য প্রচারমাধ্যম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্র বা অস্ত্র বা মাধ্যম বা হাতিয়ার।

অর্থাৎ আন্দোলনের মোবিলাইজেশান বা মানুষের মধ্যে এটিকে ছড়িয়ে দিতে; আন্দোলনের ভেলিডেশান বা জনতার কাছে আন্দোলের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে একে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এবং আন্দোলনের স্কোপ এনলার্জমেন্ট বা আন্দোলনের পরিসরকে আরো বিস্তৃত করার জন্য মিডিয়া বা প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কোন আন্দোলন ‘জনবিরোধী’, কোন আন্দোলন ‘গণমুখী’ এইসব ‘তথ্য’ বা ‘ব্যাখ্যা’ বা ‘ফ্রেমিং’ বা ‘লেবেল’ বা ‘ট্যাগ’ বা ‘বিশ্লেষণ’ আপামর মানুষ প্রচার-মাধ্যম মারফৎ জানতে পায়। প্রচার-মাধ্যম বা গণমাধ্যম বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে রেডিও, টিভি, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ইত্যকার ট্রেডিশনাল প্রচার মাধ্যম।

অধুনা যুগের নয়া-যোগাযোগীয় মাধ্যমগুলো ‘গণমাধ্যম’ বা ‘ম্যাস-মিডিয়া’ হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা এই নিয়ে বিশ্বব্যাপী বহু তর্ক-বিতর্কের পর বাস্তবতা এই মর্মে উপনীত হয়েছে যে, নিউ-মিডিয়া বা নয়া যোগাযোগীয় মাধ্যমও গণমাধ্যমের মতই শক্তিশালী প্রচার-মাধ্যম বটে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার থেকে শুরু করে ইউটিউব ও ব্লগের শক্তি য এই নয়া জামানায় ট্রেডিশনাল প্রচার-মাধ্যমের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং কিছু অংশে বেশি সেই সত্য ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত।

‘এরাব স্প্রিং’ বা ‘আরব বসন্ত’ খ্যাত মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলন নিউ মিডিয়ার শক্তির অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। এছাড়া ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট’ মুভমেন্ট-ও এখানে স্মরণ করা যেতে পারে।

আমাদের দেশেও ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ খ্যাত ‘শাহবাগ মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গড়ে উঠা আন্দোলনের সূত্রপাতের ক্ষেত্রে সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিউ মিডিয়া যে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে সেটি আপনারাই চাক্ষুষ করেছেন বলে ধারণা করি।


‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’

বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক আন্দোলনে রূপ নেয়। তবে, সব বিক্ষোভ বা প্রতিবাদের সেই সক্ষমতা থাকে না। কিন্তু ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান তুলে নিরাপদ সড়কের দাবীতে যে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল তা আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল।

সামাজিক আন্দোলনগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রে ‘আনজাস্ট’ বা অন্যায্যতার বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়ায়। প্রতিবাদ জানায়। আন্দোলনের ভেতর দিয়ে অনেকক্ষেত্রেই আন্দোলনকারীরা একটা না একটা লক্ষ্যে উপনীত হতে চায়। অর্থাৎ তাদের একটা লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। যেমন- নয়া-নীতি বা আইনের প্রবর্তন বা পুরনো আইন বা রিপ্রেসিভ নীতির বদল ইত্যাদি।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনও অন্যায্যতার বিরুদ্ধে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার দাবী উঠিয়েছিল বলেই প্রতীয়মান। এই আন্দোলনের ট্যাগ-লাইন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া স্লোগান ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। অর্থাৎ ‘আমরা ন্যায়-বিচার চাই’। কারণ বিক্ষোভকারীদের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, তাদের সহপাঠীর ‘অন্যায় মৃত্যুর ন্যায্য বিচার তারা পাবে না’।


আন্দোলনের জীবনচক্র


বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি সামাজিক আন্দোলনেরও একটি জীবনচক্র থাকে। সামাজিক আন্দোলনের জীবন চক্রের ক্ষেত্রে সাধারণত চারটি ধাপের কথা উল্লেখ করা হয়। যেমন: আন্দোলনের উৎপত্তি, বিকাশ, অর্জন ও পরিসমাপ্তি। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের টাইমলাইনের দিকে তাকালে খুব স্পষ্টভাবেই এই চারটি ধাপ পাওয়া যায়।

ঘটনার সূত্রপাত: একটি হাসি

জুলাইয়ের ২৯ তারিখে বাসের নিচে চাপা পড়ে স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাঁধে। সেই বিক্ষোভের অনলে ঘৃত ঢেলে দেয় একজন মন্ত্রীর ‘অসংবেদনশীল’ মন্তব্য এবং তার হাসিমাখা মুখ।

একদিকে, সামাজিক মানসপটে আছে ‘খুন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এমন করুণ মৃত্যু’ বা সড়ক দুর্ঘটনা। অন্যদিকে, দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ‘কুছ পরোয়া নেহি হ্যায়’ ধরণের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’। এই দু’য়ে মিলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দাবানলের মতন রটে যায়। সতস্ফুর্তভাবে স্কুল পড়ুয়ারা নেমে আসে রাস্তায়।

এই থেকেই শুরু। অর্থাৎ স্কুল পড়ুয়া টিন-এজ বয়সী একদল ছেলে-মেয়ের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের সূত্র ধরে আন্দোলনের জন্ম।


আন্দোলনের বিস্তার


সামাজিক আন্দোলনের পরবর্তী ধাপে আসে আন্দোলনের বিকাশ বা সমাজের মানুষের মাঝে আন্দোলনের বিস্তারের প্রসঙ্গ।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের বিকাশের ডিনামিক্সটি বুঝতে হলে এই ক্ষেত্রে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে বাংলাদেশে বিদ্যমান সড়কে ‘দূর্ঘটনায়’ মৃত্যুর পরিসংখ্যান এবং এইসব ‘দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু’র প্রতি সমাজের মানুষের মনোভঙ্গির দিকে।

২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর জনকণ্ঠ পত্রিকার অনলাইন সংবাদে প্রকাশিত তথ্য মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রতিবছর ২১ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে, যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে এই সংখ্যা বছরে সাড়ে আট হাজার। আর সরকারী হিসেবে সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৬ জন।

২০১৫ সালের ২০শে অক্টোবর প্রথম আলোর সংবাদে বলা হয়, এক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২১ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ৩২ শতাংশ পথচারী। এই অনুমিত হিসাব ২০১২ সালের। বিশ্ব নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

সড়কে এই বিপুল মৃত্যুর জন্য তিনটি প্রধান কারণকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা। কারণগুলো হচ্ছে অতিরিক্ত গতি, চালকের বেপরোয়া মনোভাব এবং গাড়ীর ত্রুটি ও পরিবেশ।

এই গবেষণাকে উল্লেখ করে ২০১৮ সালের ৪ঠা অগাস্টে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে গাড়ির অতিরিক্ত গতির কারণে, ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং আর ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।

এই প্রতিবেদনেই প্রথম আলো আরো জানাচ্ছে, সড়কে এতো মৃত্যুর কারনে যে ক্ষতি হচ্ছে বছরে তার আর্থিক পরিমান দাঁড়াচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা।

অতএব, এই পরিসংখ্যান থেকে এটি অনুমেয় যে, সড়ক দূর্ঘটনা এদেশে নৈমিত্তিক ঘটনা। তাছাড়া, সড়ক দূর্ঘটনাকে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় নিছক দূর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয় না। বরং গত ২০১১ সাল থেকে এই পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সড়ক দূর্ঘটনা সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংবাদ ও সম্পাদকীয় থেকে এটি প্রতীয়মান যে, সড়ক দূর্ঘটনাকে এদেশে অনেকক্ষেত্রেই ‘হত্যাকাণ্ড’, ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ এবং বেপরোয়া মনোভাবজনিত আচরণের কারনে ঘটে যাওয়া প্রাণ-নাশের ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পাশাপাশি, সংবাদ ও সম্পাদকীয় থেকে এই আভাস-ও মিলে যে, সড়কে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া অবহেলাজনিত এসব মৃত্যুর কোনো আইনি বিচার আদতে এখানে হয় না।

এই বাস্তবতায়, সড়কে ঘটে চলা মৃত্যুর মিছিলের বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষের মনে বহু বছর ধরে অনেক ক্ষোভ জমা ছিল। তবে এই ক্ষোভগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন।

কিন্তু দুই বাসের চালকের প্রতিযোগিতার জেরে বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে নিহত দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাটির সাথে প্রভাবশালী মন্ত্রীর হাসির ঘটনার মিথস্ক্রিয়ায় বারুদ জ্বলে ওঠে। একাকী মানুষের পূঞ্জিভূত বিচ্ছিন্ন রাগগুলো পরস্পরের সাথে একসাথে মিলে-মিশে ছড়িয়ে যায় দিকে-দিকে।

ফলে, স্কুল শিক্ষার্থীরা রাস্থায় নেমে এলে তাদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন বয়সী শ্রেণী-পেশার মানুষ। মানুষের এই সমর্থনের প্রমাণ মেলে সেই সময়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস, টিভি টক শো, আর পত্রিকার কলাম ও সম্পাদকীয়গুলোতে।

৩০ জুলাই থেকে অগাস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান সব কয়টি দৈনিকের পাতাতেই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের দাবির প্রতি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন স্পষ্ট।

আন্দোলনে জনসমর্থন একটা সময়ে এতই জোরালো হয়ে উঠে যে এটি আর ‘স্থানীয় আন্দোলন’ বা কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। খুব দ্রুতই এটি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে এবং এটি হয়ে উঠে জাতীয় আন্দোলন।

রাজপথে যান-বাহন আটকে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা, গাড়ির কাগজ-পত্রের বৈধতা নিরীক্ষণ করার কাজে স্ব-উদ্যোগে নেমে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের এই কাজেও দেখা গেছে অকুন্ঠ জনসমর্থন।

এভাবেই সামাজিক আন্দোলনের বিকাশের দ্বিতীয় ধাপটিও সফলভাবে উৎরে যায় নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন।


আন্দোলনের অর্জন


সামাজিক আন্দোলনের তৃতীয় ধাপটি বিউরুক্রেটাইজেশান নামে পরিচিত। এই ধাপে এসে সমাজের আরো বিভিন্ন অংশ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ এর সাথে জড়িত হয়ে যায়। এই ধাপেই আন্দোলনে কিছু সাফল্য দেখা যায়, কিছু দাবী আংশিক বা পুরো অর্জিত হয়।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিষয়টি মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।

ব্যাপক জনসমর্থনের প্রেক্ষিতে লোকাল বা স্থানীয় সীমানা ছেড়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন যখন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয় তখন নীতি নির্ধারকেরা নড়ে-চড়ে বসেন।

এই আন্দোলন নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও তখন আগ্রহী হয়ে ওঠে।

দেশ তখন কার্যত প্রায় স্থবির। আন্দোলন তখন ফুলে-ফেপে আরো বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের কিছু দাবী মেনে নেয়া হয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কিছু সিদ্ধান্ত আসে। ‘অসংবেদনশীল আচরণকারী’ ব্যক্তির কাছ থেকে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ আসে। সব মিলিয়ে আন্দোলনের একটি সাফল্য দেখা দেয়।


আন্দোলনের পরিণতি


আন্দোলন অন্ততকাল ধরে চলে না। কিছু আন্দোলন উদ্দেশ্য অর্জিত হলে আপনিই থেমে যায়। কিছু আন্দোলনকে বলপূর্বক থামিয়ে দেয়া হয়। কিছু আন্দোলন দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। কিছু আন্দোলন নানাবিধ কারনে আর লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারে না।

এখানে বলে রাখা দরকার, সামাজিক আন্দোলন কয়েক প্রকারের হয়। যেমন রিফর্মেটিভ, রেভুলিউশনারি, রিডেম্পটিভ এবং অলটারনেটিভ সোশাল মুভমেন্ট।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে বিপ্লবীধারার বা রেভুলিউশনারী ধারা কিংবা রিডেম্পটিভ আন্দোলন ভাবার সুযোগ নেই। হয়তো রিফর্মেটিভ বলে ভাবার চেষ্টা নেয়া যেতে পারে। কারণ এক ধরণের সংস্কার প্রচেস্টা এখানে ছিল। কিন্তু শেষ বিচারে এটিকে আসলে অলটারনেটিভ সোশাল মুভমেন্ট বলাই শ্রেয়। কারণ একটি বিশেষ গোষ্ঠী— মূলত সড়কে যান চালানো চালক শ্রেনীর আচরনগত পরিবর্তন এবং তাদেরকে আইন ও বিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে এবং সড়ক-পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই ছিল এই আন্দোলন।

কিন্তু বিপ্লবীধারার না হয়েও এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি সুখকর হলো না কেন?

আন্দোলনের পরিসমাপ্তি যেভাবে হয় তার মধ্যে কয়েকটি তরিকা আছে। যেমন রিপ্রেশান বা নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়া। আবার নানান বিকল্প পন্থায় নেতৃস্থানীয়দের সাথে গোপন সমঝোতায় গিয়ে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে বইয়ে দিয়ে বা আন্দোলনের নেতাকেই এমপি, মন্ত্রী, নেতা বা বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান গোছের কিছু বানিয়ে তাকেই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব গছিয়ে দিয়েও আন্দোলনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া যায়।

কোনো-কোনো আন্দোলন আবার কাঙ্ক্ষিত লক্ষার্জনের পর আর চালিয়ে যাবার যৌক্তিকতা থাকে না। এভাবেও, সাফল্যের সাথেও, শেষ হয় কোনো-কোনো আন্দোলন। এছাড়া ব্যর্থ হয়েও কোনো-কোনো আন্দোলন পরিসমাপ্তির দিকে যায়। ব্যর্থতার পেছনে খুঁজে পাওয়া যায় নানান কারণ।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের অবসানের ক্ষেত্রে দমন-নীতি অন্যতম তরিকা হিসেবে কাজ করেছে বলে জনমনে প্রতীয়মান। পত্রপত্রিকার সংবাদ ভাষ্যেও তেমনি প্রমাণ।

এছাড়া আন্দোলনের অন্যতম দূর্বলতা ছিল এর কোনো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকা। আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে চালাতে হলে যে লক্ষ্য ও নেতৃত্ব প্রয়োজন হয় সেই লক্ষ্য ও নেতৃত্বের ঘাটতি প্রতীয়মান হচ্ছিলো।

ফলে, পত্রপত্রিকার সংবাদভাষ্য থেকে এই উপলব্ধি হয় যে, প্রারম্ভে তুমুল নিনাদে জনপদ প্রকম্পিত করলেও প্রকৃতার্থে খুব বড় কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম না হয়েই আন্দোলনের যবনিকা পতন হয়।

তবে, এই আন্দোলনকে ব্যর্থ হিসেবে আখ্যা দেয়া যাবে না বলেই বোধ করি। এর অর্জন ও সাফল্য আছে। আন্দোলনের ফলে, বিশেষ ট্র্যাফিক সপ্তাহ পালন; সড়ক দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে আইন পাশ হওয়া, জনমনে সচেতনতা তৈরি হওয়া সহ বেশ কিছু সাফল্য স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও অভিঘাত তৈরিকারী এই আন্দোলনের রয়েছে।


নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে মিডিয়ার ভূমিকা


নিজের স্বার্থেই প্রচার-মাধ্যমগুলো ঘটনার পিছু ধাওয়া করে। আর যেই ঘটনা নিজেই অনেক বিরাট, অনেক অভিঘাত তৈরিকারী, যেই ঘটনা সমাজে অভিনব, যেই ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই ঘটনার পেছনে মিডিয়া তো ছুটবেই।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনটি মিডিয়ার জন্য ছিল আকর্ষনীয় ও আবেদনময়।

প্রচার মাধ্যমগুলো কখন একটি ইস্যুকে লুফে নেয়? এই লুফে নেবার পেছনে ডব্লিউ-ইউ-এন-সি বলে একটা ফমূর্লাকে চিহ্নিত করা যায়। ইংরেজি এই চারটি বর্ণ হচ্ছে চারটি শব্দের আদ্যাক্ষর। যেমন ডব্লিউতে ওর্দি, ইউ-তে ইউনিটি, এন দিয়ে নাম্বার আর সি-দিয়ে কমিটমেন্ট।

মিডিয়া যখন দেখে ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং এটির খবর প্রচার না করলে প্রচার মাধ্যম হিসেবে সে নিজেই পিছিয়ে পড়বে তখন মিডিয়া ইস্যুর পিছু দৌঁড়ায়।

আবার যখন ইস্যু বা আন্দোলনের সাথে জড়িতদের ইউনিটি বা একতা বা ঐক্য খুব জোড়ালো হয় সেটিও যেমন খবরের উপাদান তেমনি একতায় ফাটল ধরলে সেটিও বেশ মুখরোচক ও আকর্ষণীয় খবর।

এছাড়া কোনো আন্দোলনে যদি অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা খুব বিরাট হয় তাহলে সেটিকে আগ্রাহ্য করা যায় না। যত ব্যাপকতা তত গুরুত্ব। বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের পিছু না ছুটে মিডিয়ার উপায় নেই। এই তিনটির বাইরে আরেকটি উপাদান হলো কমিটমেন্ট। অর্থাৎ ইস্যুর প্রতি আন্দোলনকারীদের নিবেদন ও অঙ্গিকার।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে এটিরও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যা মিডিয়ার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও ‘মিডিয়াজেনিক’।

এই আন্দোলনের প্রথম অভিনবত্ব হলো এটি স্কুল-পড়ুয়াদের আন্দোলন। এরা সবাই টিন-এজ বয়সী। জাতিসংঘ সনদ অনুযায় ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তি শিশু বলে গণ্য হবে। আর বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৮ অনযায়ী, ১৮ বছরের নিচে যে কোনো ব্যক্তি শিশু হিসেবে বিবেচিত।

তাই সব বিবেচনাতেই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ছিল মূল শিশু-বয়সীদের আন্দোলন। কেননা, এই বিক্ষোভের শুরুটা যারা করেছিল তারা ছিল স্কুল পড়ুয়া। শিশু-কিশোরদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত এমন তুমুল আন্দোলন বাংলাদেশে তো বটেই ইতিহাসেই বিরল। তাই, ঘটনার অভিনবত্বের কারণেই প্রচার-মাধ্যম এই মিডিয়াজেনিক ইস্যুর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

এছাড়া এই আন্দোলন ছিল এমন একটি দাবীতে যেখানে আন্দোলনকারীদের মূল স্লোগানে উঠে এসেছে ন্যায্যাতা প্রতিষ্ঠার দাবী। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানের ভেতর দিয়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে, বহু যুগ ধরে সড়কে বা পরিবহন খাতে অন্যায় ও অন্যায্যতা ঘটে চলেছে। তাই, এটি ছিল অন্যায্যতার অবসান চেয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

এই দাবিটিও আপামর মানুষের প্রাণের দাবি বলেই প্রতীয়মান। সড়ক দূর্ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের যে প্রকৃতার্থে এদেশে বিচারের আওতায় আনা হয় না তার প্রমাণ পত্রিকায় ছাপা হওয়া মৃত্যুর ঘটনা ও বিচার না হওয়া মামলার পরিসংখ্যান।

তাই, সড়কে নিরাপত্তা জোরদার করার দাবিটি ‘গণদাবি’ হয়ে উঠার কারণেও এই আন্দোলন ছিল মিডিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার দিকে তাকালে দেখা যায়, সংখ্যাটিও ব্যাপক। সংখ্যাটি এতই বিপুল যে, ব্যাপক গণসম্পৃক্ততার কারণেও ইস্যুটির গুরুত্ব অপরিসীম।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের আরেকটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ন দিক ছিল অহিংসা ও শৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খল রাজধানীতে সারিবদ্ধভাবে যান চলাচলের ব্যবস্থা করা, রোগী বহনকারী এম্বুলেন্সের জন্য আলাদা লেন তৈরি করে আগে-ভাগে যাবার সুযোগ করে দেয়ার মতন অভিনব ঘটনা এই আন্দোলনে ঘটেছে।

তাছাড়া, বাংলাদেশের অন্যান্য বিক্ষোভ বা প্রতিবাদে যেমন জ্বালাও-পোড়াও বা ভাংচুরের পন্থা অবলম্বন করা হয় তেমনি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে হয়নি। শান্তিপূর্ণ উপায়ে, ভাংচুর ও সংঘর্ষ ছাড়াই এই আন্দোলনকারীরা জনমনে তাদের দাবির যৌক্তিতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

আন্দোলনের এইসব অভিনবত্বের কারনে ইস্যুটি আপনা থেকেই হয়ে উঠে আকর্ষণীয়; হয়ে উঠে মিডিয়াজেনিক।


সামাজিক আন্দোলনে মিডিয়া কাভারেজের প্রভাব



হিথার ম্যাকলয়েড বলেছেন, মানুষজন একটি বিক্ষোভের ঘটনাকে কোন চোখ দেখবে সেটি অনেকাংশে নির্ভর করে বিক্ষোভটিকে গণমাধ্যম কিভাবে কাভার করছে তার উপর।(হাউ প্রটেস্ট ইজ কাভার্ড এফেক্টস হাউ পিপল পারসিভ প্রটেস্ট)।

যেকোনো আন্দোলনকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হলে প্রচার-মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই, পৃথিবীর সকল সামাজিক আন্দোলনে গণমাধ্যমকে বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। গণমাধ্যমে খবরটি যদি ‘ইতিবাচক’ ‘ফ্রেমিং’ দিয়ে প্রচার করা হয় তাহলে আন্দোলনে জনসমর্থন বাড়ে এবং আন্দোলনের দাবির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা পায়।

অর্থাৎ আন্দোলনকে মবিলাইজ করার জন্য, সোশাল ভেলিডেশানের জন্য এবং এর স্কোপ এনলার্জমেন্টের জন্য প্রচার-মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও মিডিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ভূমিকা পালন করেছে।

আন্দোলনের দাবীর যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে খবর, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন প্রচারের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে মবিলাইজ করতে ভূমিকা রেখেছে মিডিয়া। আন্দোলনের প্রতি মানুষের মনোভাব ইতিবাচক রাখতেও মিডিয়ার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গত শতকের ষাটের দশক থেকে পৃথিবীর সব সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই মিডিয়ার এই ভূমিকা লক্ষণীয়।


মিডিয় যখন দূতিয়ালির ভূমিকায়


সামাজিক আন্দোলনে প্রচার মাধ্যমগুলো দূতিয়ালের ভূমিকা পালন করে থাকে। কীভাবে?

প্রথমত, আন্দোলনরত পক্ষের বক্তব্য ও দাবিনামার খবর তুলে ধরে গণমাধ্যম। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ মারফত আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ও দাবি-দাওয়া সম্পর্কে জানতে পারে সরকার ও নীতি-নির্ধারনী পক্ষ। তৃতীয়ত, আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ও দাবিনামা দেখে নীতি-নির্ধারকেরা কী ভাবছেন এবং তাদের প্রতিক্রিয়া কী— সেই বিষয়ের আবার সংবাদ প্রকাশ করে প্রচারমাধ্যমগুলো। চতুর্থত, আন্দোলন সম্পর্কে নীতি-নির্ধারকেরা বা সরকার বা অপর পক্ষের মতামত, মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে আন্দোলনরত পক্ষ আবার জানতে পারে মিডিয়া মারফত।

অর্থাৎ এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি একটি চক্রের মতন কাজ করছে। ঘুরে-ঘুরে একই চক্রের আবর্তন ঘটে।

আর এই পক্রিয়ায় সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করে প্রচার মাধ্যম। বিবদমান পক্ষগুলো নিজেরা মুখোমুখি হয়ে সরাসরি পরস্পরের বক্তব্য, মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া জানার ক্ষেত্রে এদের সুযোগ ঘটে খুবই কম। তাই, দুই পক্ষের কাছে বার্তাবাহকের ভূমিকায় থাকে প্রচার-মাধ্যম।

যুযুধান দুই পক্ষের বক্তব্য সাংবাদিকেরা তুলে আনে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার স্বার্থেই। সাংবাদিকদের জন্য কালেমা তৈয়্যেবা হচ্ছে ‘ব্রিং অল দি সাইডস’। অর্থাৎ সংবাদের সাথে সম্পৃক্ত সকল পক্ষকে বলার সুযোগ দিতে হবে। নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা সাংবাদিকের ঈমানী দায়িত্ব। সাংবাদিকতার এই কার্ডিনাল ল’র পথ ধরেই বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ঘটে যায় দূতিয়ালির ঘটনা।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের প্রচার-মাধ্যমগুলো দূতিয়ালের ভূমিকা পালন করেছে।

প্রাথমিক বিক্ষোভ যে পরবর্তীতে তীব্র আন্দোলনে রূপ নিয়েছে সেখানে প্রচার-মাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকারের উপায় নেই। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুর খবরটি মন্ত্রীকে জানিয়ে সাংবাদিকেরাই মন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চেয়েছে। মন্ত্রীর হাসির খবর ও ছবিও প্রচার মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে। আর তা দেখেই বিক্ষোভকারীরা রাগে ফেটে পড়েছে। আবার বিক্ষোভকারীরা যে হাসি দেখে রাগে ফেটে পড়েছে সেই খবরও গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত খবর মারফৎই জানা গেছে।


যা নাই মিডিয়ায়, তা নাই দুনিয়ায়

মহাভারতের ব্যাপকতা বোঝাতে বাংলাভাষায় একটি প্রবাদ আছে। প্রবাদটি এরকম: যা নাই ভারতে, তা নাই ভারতে। অর্থাৎ ভূ-ভারতে হেন বস্তু নেই যার উল্লেখ মহাভারতে নেই। মহাভারতে কোনো বস্তুর উল্লেখ নেই মানে হচ্ছে, সেই বস্তু আদতে ভূ-ভারতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।

এই প্রবাদটিকেই আমি একটু ভিন্ন ভাষায় এভাবে বলি: “যা নাই মিডিয়ায়, তা নাই দুনিয়ায়”। অর্থাৎ আজকের এই প্রচার-মাধ্যমের জামানায় মিডিয়ায় যে বস্তুর উল্লেখ নেই সেই বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে লোকে সন্দিহান হয়ে পড়তে পারে। সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই আপ্তবাক্য প্রযোজ্য।

আন্দোলনের এক্সিসটেন্স বা অস্তিত্ব যে বিরাজমান সেটি মিডিয়ায় প্রচার না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এই সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানার সুযোগ পায় না। নিউ মিডিয়া হোক বা ট্রেডিশনাল মিডিয়া হোক, কোনো না কোনো ফর্মে আন্দোলনের খবরকে মিডিয়ায় তার অস্তিত্ব জানান দিতে হবে।

যদি তা না হয়, তাহলে আন্দোলন বাস্তবে বিরাজ করলেও মিডিয়ায় এক্সিস্ট না করার কারণে সেটি সম্পর্কে মানুষের জানার সুযোগ কম ঘটবে বা ঘটবে না। যেহেতু মানুষের জানার সুযোগ কম ঘটবে বা ঘটবে না তাই মানুষ এই আন্দোলন নিয়ে আগ্রহ দেখানোর সুযোগ কম থাকবে। যেহেতু আন্দোলন নিয়ে আগ্রহ কম থাকবে তাই আন্দোলনের দাবি ও যৌক্তিকতা যতই প্রখর হোক না কেন এতে সমাজে বিশেষ ঘাত তৈরি হবে না। তাই, মাঠে আন্দোলনের এক্সিসটেন্স যতখানি গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমে এক্সিস্ট করাও সমানই গুরুত্বপূর্ণ প্রায়।

এই ক্ষেত্রে মিশরের রেভুলিউশানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে শত-শত বিক্ষোভকারী তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাদের খবর মূলধারার কোনো সংবাদ-মাধ্যম বা মিডিয়া কাভার করছিল না বা প্রচার করতে পারছিল না। ফলে, দিন-রাত অবস্থান করে আন্দোলন চালানো হলেও সেই আন্দোলনের খবর বিশেষ জানতো না বৃহত্তর জনগোষ্ঠী।

এমতাবস্থায়, তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের খবরকে বৃহত্তর মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আন্দোলনকারীরা গেরিলা কায়দায় নিউ মিডিয়াকে ব্যাবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা দিয়ে ছোটো ছোটো ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন ব্লগে ও ইউটিউবে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবেই মূলধারার প্রচারমাধ্যমের বিপরীতে বিকল্প প্রচার-মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়ে মিশরের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠে নিউ মিডিয়া।

মিশরের ঘটনায় নিউ মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে চমৎকার তথ্যচিত্র ‘দি স্কয়ার’ নির্মাণ করে দুনিয়ায় খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন জেহান নওজেইম।

বিভিন্ন ব্লগ ও ইউটিউবে প্রকাশিত ভিডিও থেকেই সারা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমগুলো তাহরির স্কয়ারের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠে এবং একটি পর্যায়ে তাহরির স্কয়ারই হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

তাই, আন্দোলনে সাফল্য পেতে বাস্তবে বা মাঠে অস্তিত্ব জারি রাখা যতটা প্রয়োজন, গণমাধ্যমের এই যুগে আন্দোলনের স্বার্থেই মিডিয়াতে হাজির থাকাটাও ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ বলা চলে।


নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে মিডিয়া কাভারেজের তিন পর্ব


নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনটিকে মিডিয়া কাভারেজের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। যথা-
১. স্বাভাবিক কাভারেজ পর্ব
২. হেভি কাভারেজ পর্ব
৩. ফেইড-আউড পর্ব।

স্বাভাবিক কাভারেজ পর্ব: জুলাইয়ের ২৯ তারিখে ঘটনা ঘটার পর থেকে ১লা অগাস্ট পর্যন্ত, প্রথম তিন দিনের কাভারেজকে ধরে নেয়া যায় এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত।

এই লেখাটি প্রস্তুত করার আগে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইনে থাকা ই-সংবাদপত্রগুলো আমি খতিয়ে দেখেছি। কাগজগুলোর মধ্য থেকে নমুনা হিসেবে বাংলা কাগজ সমকাল এবং ইংরেজী কাগজ ডেইলি স্টারের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের খবরটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে ৩০ জুলাই থেকে ১ অগাস্ট পর্যন্ত পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশ করেছে উল্লিখিত এই দু’টো পত্রিকাই।

৩০ তারিখে ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় প্রধান সংবাদ হিসেবে সবচে বেশি জায়গা দিয়ে দুর্ঘটনায় মৃ্ত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়েছে। আর শিরোনামেই বলা হয়েছে ‘রেকলেস ড্রাইভিং টেকস টু ইয়াং লাইভ্স’। অর্থাৎ বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালনার প্রসঙ্গটিকে গুরুত্বের সাথে সামনে এনে খবরটি পরিবেশন করা হয়।

সমকালেও খবরটি গুরুত্ব দিয়ে এইদিন প্রথম পাতায় প্রকাশ করা হয়। তবে এটি ছিল দ্বিতীয় সংবাদ শিরোনাম।

৩১ তারিখের সমকালেও এই বিষয়টি দ্বিতীয় সংবাদ শিরোনাম হিসেবে এসেছে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট বা খবরের পরিবেশনটি করা হয়েছে এমনভাবে যে বিক্ষোভের সংবাদের দিকেই নজর যায় সবার আগে।

আর ডেইলি স্টারে ৩১ তারিখে সংবাদটি এসেছে তৃতীয় প্রধান সংবাদ শিরোনাম হিসেবে। তবে, এটিকে জায়গা দেয়া হয়েছে মোটে ১ কলাম।

১লা অগাস্টের ডেইলি স্টারে বিক্ষোভ এসেছে প্রধান সংবাদ হয়ে। ছবি এবং আনুষাঙ্গিক অন্যান্য খবর মিলিয়ে এই সংবাদের পরিবেশনে অনেক স্পেস ও গুরুত্ব দিয়েছে ডেইলি স্টার। তবে, এটিই একমাত্র খবর হিসেবে গুরুত্ব পায়নি। বিক্ষোভের খবরের পাশাপাশি অন্য আরো দু’একটি খবর এসেছে প্রথম পাতায়। কিন্তু ২ তারিখ থেকে কাভারেজ আমূল পাল্টে গেছে।

সমকালেও একই চিত্র। ১লা অগাস্টে সমকালের প্রথম পাতায় ৮টি সংবাদ প্রকাশ হয়। এর মধ্যে ৬টিই বিভিন্ন বিষয়ে। আর দু’টো সংবাদ বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের খবর। তবে, এটিই প্রধান শিরোনাম এবং প্রধান খবর হিসেবে অন্যান্য সংবাদের চেয়ে এই খবরের পরিবেশন ও স্পেসের দিকে দেয়া হয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।


হেভি কাভারেজ পর্ব
: ২রা অগাস্ট থেকে পত্রিকার প্রথম পাতায় একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে বিক্ষোভের খবর; ঢাকা অচল হয়ে যাবার খবর।

সমকালের প্রথম পাতায় সেদিন ৪টি সংবাদ এবং চার কলাম জুড়ে একটি বড় ছবি প্রকাশ করা হয়। এই চারটি সংবাদের প্রত্যেকটিই নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন এঙ্গেলের খবর। ছবিটিও আন্দোলনরত স্কুল পড়ুয়াদের স্লোগানরত ভঙ্গিমার ছবি।

এর বাইরে এই দিন সমকালের প্রথম পাতায় আর কোনো খবর প্রকাশ হয়নি।

একই দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করেছে মোট ৫টি ছবি। ৫টিই ছবিই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। আর খবর প্রকাশিত হয়েছে ৫টি। এর মধ্যে ৪টিই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। আর পত্রিকার প্রথম পাতার নিচের দিকে বাম পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে প্রকাশিত হয়েছে সিটি নির্বাচন সম্পৃক্ত অন্য আরেকটি সংবাদ।

ডেইলি স্টারে ৩ তারিখের প্রথম পাতায় আন্দোলনের খবর ছাড়া আর কোনো খবরই নেই। ৪ তারিখেও ডেইলি স্টারে একই দৃশ্য। প্রথম পাতার পুরোটা জুড়ে কেবল আন্দোলনের ছবি ও খবর।

এই খবরের বাইরে ডান দিকে এক কলামে মাত্র ইঞ্চি তিনেকের বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি খবর দেয়া হয়েছে।

আমি নিজে একসময় পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করি, খেলার এই এক কলামের খবরটি হয়তো পত্রিকার পৃষ্ঠা সজ্জার কারণেই সেদিন প্রথম পাতায় ঠাঁই পেয়েছিল।

৫ই অগাস্টের ডেইলি স্টারেও একই চিত্র। চারটি খবর ও দুইটি ছবি সেদিন উঠে এসেছে পত্রিকার প্রথম পাতায়। এই সবগুলোর সবই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন সংক্রান্ত। এর বাইরে আর কোনো খবর নেই।

৬ তারিখের ডেইলি স্টারে ছাপা হয়েছে মোট ৬টি খবর ও দুইটি বড় ছবি। এর সবগুলোই আন্দোলন সংক্রান্ত। এই খবরের বাইরে এইদিনেও পত্রিকার প্রথম পাতায় আর কোনো প্রসঙ্গ বা সংবাদ নেই।

৭ তারিখের ডেইলি স্টারে আছে মোট ৭টি খবর। এর মধ্যে ৫টি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ঘটনা আর দুটো ভিন্ন খবর।

৮ই অগাস্টের ডেইলি স্টারের প্রথম পাতাতেও কেবলি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সাথে ধর-পাকড় ও এই জাতীয় অন্যান্য খবর। এর বাইরে প্রথম পাতায় আর কোনো প্রসঙ্গের উল্লেখ নেই।

ডেইলি স্টারের মতন সমকালেও একই রকম চিত্র।

২ তারিখের আন্দোলন সংক্রান্ত ছবি ও খবর দিয়েই সাজানো হয়েছে সমকালের প্রথম পাতা। এর বাইরে প্রথম পাতায় আর কোনো খবর, মতামত, মন্তব্য বা বিশ্লেষণ নেই।

৩ তারিখের সমকালের প্রথম পাতায় আছে ৭টি খবর ও তিনটি ছবি। সবগুলোই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত খবর।

৪ তারিখের সমকালে ৫টি খবর ও দুইটি বড় ছবি। সবই আন্দোলন সংক্রান্ত। এর বাইরে আর কোনো খবর নেই।

৫ তারিখে আছে মোট ৬টি খবর। এর মধ্যে ৫টি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন সংক্রান্ত। আর অন্য একটি সংবাদ আছে ভিন্ন প্রসঙ্গে।

৬ তারিখের ছাপা হয়েছে ৮টি খবর। এর মধ্যে ৬টিই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, আন্দোলনে হামলা এবং এই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। আর অন্য দু’টো খবর ভিন্ন প্রসঙ্গে।

৭ তারিখের সমকালে প্রকাশিত হয়েছে মোট ৮টি সংবাদ। এর মধ্যে ৬টিই কোনো না কোনোভাবে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। আর বাকি দু’টো ভিন্ন বিষয়ে।

৮ তারিখ থেকে সমকালে আন্দোলনের খবর পরিবেশনে দেওয়া গুরুত্বের পরিমাণ কমেছে। এই দিনের পত্রিকায় তারা মোট ৭টি খবর প্রকাশ করেছে। যেগুলোর মধ্যে তিনটি বিভিন্ন বিষয় আর চারটি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত খবর।

এই ক্ষেত্রে অবশ্য সমকালের ট্রিটমেন্টে কিছুটা পার্থক্য দেখা দিয়েছে। ২ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত আন্দোলনের খবরই পেয়েছে একছত্র গুরুত্ব। কিন্তু ৮ তারিখের পত্রিকায় ট্রিটমেন্টের দিক থেকে অন্য খবরকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।


ফেইড আউট বা অন্তর্ধান পর্ব


৯ তারিখের ডেইলি স্টার ও সমকালের প্রথম পাতায় আন্দোলন, ধর-পাকড়, মামলাসহ আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খবর প্রকাশ হয়েছে। তবে, খবরের ট্রিটমেন্ট বা পরিবেশনার দিকে থেকে এই বিষয়কে একছত্র গুরুত্ব বা আধিপত্য দেয়া হয়নি। বরং অন্যান্য খবরকেও তুলে আনা হয়েছে গুরুত্ব দিয়ে।

১০ তারিখের ডেইলি স্টারের নিরাপদ সড়কের সাথে সম্পৃক্ত তিনটি বিষয়ের খবর প্রকাশিত হয়েছে বটে। কিন্তু সমকালে এই দিনে এই সংক্রান্ত কোনো খবরই প্রকাশিত হয়নি।

১১ তারিখে ডেইলি স্টার ও সমকালের প্রথম পাতাতে নিরাপদ সড়কের সাথে পরোক্ষে সম্পৃক্ত দুই একটি করে প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু ট্রিটমেন্টের দিক থেকে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন সংক্রান্ত খবর আরো আগে থেকেই কম গুরুত্ব পাচ্ছে।

১২ তারিখের সমকালে আর নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত আর কোনো খবরের কোনো উল্লেখ করা হয়নি। তবে, এইদিনে ডেইলি স্টার একটি খবর প্রকাশ করে বাইকারদেরকে নিয়ে। যেই খবরের মূল বক্তব্য হচ্ছে, সড়কে নিয়ম-কানুনের বালাই না মানাদের মধ্যে সবচে’ এগিয়ে আছে মোটরসাইকেল আরোহীরা।

এভাবেই পত্রিকার পাতা থেকে ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যায় আন্দোলনের খবর।


তিনপর্বের জীবনচক্র

তিনপর্বের এই মিডিয়া কাভারেজের মধ্যেই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পুরো জীবনী বা ইতিহাসকে খুঁজে পাওয়া যায়। কাভারেজের প্রথম পর্বটিতে বিক্ষোভ ক্রমশ দানা বেঁধে জোরালো হয়ে ছড়িয়ে পড়ার চিত্র পাওয়া যায়। বিক্ষোভে অকুণ্ঠ জনসমর্থনের চিত্র তুলে আনে এই পর্বের খবরগুলো।

দ্বিতীয় পর্বের কাভারেজে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ রূপ নেয় জাতীয় আন্দোলনে। সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী, পক্ষ এই আন্দোলনের সাথে নানান দিক থেকে সম্পৃক্ত ও আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে। সরকার ও নীতি নির্ধারনী পক্ষ আন্দোলন নিয়ে বিশেষ সতর্ক হয়ে ওঠে। আন্দোলনের কিছু দাবি মেনে নেয়া হয়। আন্দোলনে কিছু সাফল্য আসে।

কিন্তু এই পর্বের কাভারেজের শেষ দিকেই পাওয়া যায় আন্দোলনে ‘স্যাবোটেজ’ এবং আন্দোলনকারীদেরকে ঘরে ফিরে যাবার তাগিদ দেওয়ার চিত্র। এছাড়া, হামলা, গ্রেফতার, আটক, সংঘর্ষ, অনলাইনে গুজব ও হেলমেট বাহিনীর খবরা-খবরও মিলে এই পর্বের কাভারেজে।

তৃতীয় পর্বের কাভারেজে আছে আন্দোলন দমনের চিত্র। আটক-গ্রেফতার-আতঙ্ক, পুলিশের হাতে শিক্ষার্থীরা আটক, কেন আটক, কীভাবে আটককৃতদের মুক্তি মিলবে, ছাত্রলীগ বা হেলমেট বাহিনী বিতর্ক ইত্যকার বিষয়ের উল্লেখ এই পর্বে পাওয়া যায়।

তবে, এই পর্বে এসে ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যায় নিরাপদ সড়ক চাই ইস্যু এবং একটি পর্যায়ে পত্রিকার পাতায় এবিষয়ক আর কোনো খবরই চোখে পড়ে না।


কায়া দেখলেই মায়া বাড়ে


বাংলায় একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে, ‘কায়া দেখলে মায়া বাড়ে’। অর্থাৎ চোখের সামনে যাকে নিতি-নিতি দেখা যায় তার বিষয়ে একটা আগ্রহ, একটা উৎকণ্ঠা, তার ভালো-মন্দ বিষয়ে জানার একটা টান তৈরি হয়।

সোশ্যাল মুভমেন্ট বা সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। মিডিয়াতে কোনো আন্দোলন বিষয়ক যত বেশি খবরা-খবর প্রচার করা হবে, ততই এই বিষয়ে জানার জন্য দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের আগ্রহ তৈরি হবে। মানুষের মধ্যে এক ধরণের ‘হাইপ’ তৈরি হবে। এই হাইপ কতটা ‘মিডিয়া-নির্মিত’ আর কতটা প্রকৃত ঘটনার রেশ তা নিয়ে বির্তকের হয়তো অবকাশ থাকবে। কিন্তু এটি সত্য যে, ‘কায়া দেখলেই মায়া বাড়ে’ প্রবাদের মতই মিডিয়ায় অস্ত্বিত্ব জারী রাখতে পারলে আন্দোলনের প্রতি জন-আগ্রহও বাড়বে বৈ কমবে না।

তাই, আন্দোলনকে স্তিমিত করতে হলে বা যে কোনো বিষয় সম্পর্কে জন-আগ্রহ ঘুরিয়ে দিতে চাইলে প্রচার মাধ্যমের পাদ-প্রদীপের আলো হতে সেই বিষয়টি আড়ালে নিয়ে যেতে হবে। পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের সংবাদ-টকশো এবং রেডিওর খবর-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন থেকে যদি কোনো বিষয়কে ফেইড-আউট করে মুছে দেয়া যায় তাহলে মানুষের মনোজগত থেকেও ক্রমে সেই ইস্যু চলে যাবে দূরে, আড়ালে। এভাবেই চোখের আড়ালে যেতে-যেতেই মনের আড়ালে চলে যাবে আন্দোলন।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও সেটিই হয়েছে। মিডিয়ায় আন্দোলনের ‘কায়া’ লুপ্ত হয়েছে। কায়া লুপ্ত হওয়ায় জনমনে আন্দোলন নিয়ে ‘মায়া’ বা আগ্রহেও ধীরে-ধীরে ভাটা পড়েছে।

এভাবেই মিডিয়ার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকায় একটি বিক্ষোভ হয়ে উঠে ‘মিডিয়াজেনিক’। হয়ে ওঠে আন্দোলন। আবার সেটি হারিয়েও যায়। তাই, এই যুগের ভাবকে ফুটিয়ে তুলতে কবির থেকে ভাষা ধার করে বলা যায়, সবার উপরে মিডিয়া সত্য তাহার উপরে নাই।


রেফারেন্স:


• Four stages of social movement (n.d). Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• Satell, Greg and Popovic, Srdja (2017, January 27 ). How Protests Become Successful Social Movements. Harvard Business Review. Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• Social Movements and Social Change (n.d). Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• TheLipTV (2013, January 29). The Square, Egypt's Revolution Doc with Sundance Winner Dir. Jehane Noujaim. Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম ॥ সমন্বয়ের অভাবে বেশিরভাগ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নেই (2016, October 23). Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• সড়কে ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু (2018, August 4). Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নয় লাখ ভুয়া চালক (2018, August 3). Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে নাগরিক মন্তব্য (2018, August 03). Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• ২০১৮-র নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন. In Wikipedia. Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• Social movement (n.d). In Wikipedia. Retrieved November 5, 2018, from https://en.wikipedia.org/wiki/Social_movement

• Vliegenthart, Rens and Walgrave, Stefaan (2012, January). The Interdependency of Mass Media and Social Movements. Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• Uysal, Ahmet (n.d). The language of inclusion and exclusion: media and social movements in turkey. Retrieved November 5, 2018, from Click This Link

• The role of social media in the 2011 Egyptian revolution (n.d). Retrieved November 5, 2018, Click This Link

• Reed, Nicole (2016). The influence of social media in Egypt during the Arab Spring. Retrieved November 5, 2018, Click This Link

• Clarke, Killian and Kocak, Korhan (n.d). Launching Revolution: Social Media and the Egyptian Uprising’s First Movers. Retrieved November 5, 2018, Click This Link

________

৫ই নভেম্বর ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৩৫
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×