somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ তিন (খ)

১৫ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্বের লিংকঃ
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ এক (ক)
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ এক (খ)
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ দুই (ক)
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ দুই (খ)
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ তিন (ক)

পর্বঃ তিন (খ)

১৮৯২ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌজা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। যেখানে ৩৩টি তালুককে ১.৫ থেকে ২০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে মৌজায় বিভক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিতে (হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল) তিনজন রাজার ৩টি সার্কেলকে মৌজায় বিভক্ত করার পুনঃবিধান করা হয় এবং প্রত্যেক মৌজায় ১ জন করে মৌজা হেডম্যান নিয়োগের বিধান রাখা হয়। এই বিধি মতে, সার্কেল চীফের (রাজা) সাথে পরামর্শ করে ডেপুটি কমিশনার মৌজা হেডম্যান নিয়োগ করেন। সার্কেল চীফ তথা রাজার মত হেডম্যান নামক এই পদটি বংশানুক্রমিক নয় তবে হেডম্যানের উপযুক্ত পুত্র হেডম্যান পদে নিয়োগ লাভের বেলায় অগ্রাধিকারের দাবী রাখেন। উক্ত বিধি অনুযায়ী একজন হেডম্যান তাঁর মৌজায় নিম্নোক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেনঃ ১। জুমিয়া জমির মালিকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়, ২। ডেপুটি কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সার্কেল চীফের আদেশ মেনে চলা, ৩। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ৪। মৌজায় চাষাবাদের আওতাধীন এলাকার (আয়তনের) কোনো পরিবর্তন ঘটলে তৎসম্পর্কে ডেপুটি কমিশনারকে অবহিত করা, ৫। জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ করা, ৬। জুম তৌজি তথা জুমিয়ার তালিকা প্রস্তুত করা, ৭। জুম খাজনা প্রদান থেকে রেহাই পাবার জন্য অন্যত্র পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়া প্রজার সম্পত্তি আটক, ৮। মৌজার প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষন, ৯। সরকারী ভূমি বন্দোবস্ত, হস্তান্তর, ভাগ-বন্টন এবং পুনঃ ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রদান

উক্ত দায়িত্ব ছাড়াও উক্ত বিধি হেডম্যানকে কিছু বিচারিক ক্ষমতাও প্রদান করে এবং একটা বিচারকার্যে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন ও দোষী ব্যাক্তিকে ৫০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন। এছাড়া জেলা প্রশাসকের আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত দোষী ব্যক্তিকে আটক রাখবার আদেশ দিতে পারবেন। একজন হেডম্যানের বর্নিত বিচারিক ক্ষমতা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে, হেডম্যান গন বিচার কার্য নামক বিষয়টিকে এড়িয়েই চলেন। বরং এই কাজ গুলা তথা বিচার, মিমাংসা, সালিশ, গোত্র/পাড়া পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন ইত্যাদি কারবারীদের হাতে ন্যাস্ত হয়ে গেছে। গঠিত হয়েছে কারবারী আদালত।

মারমা সম্প্রদায়ে কারবারী বলতে মূলত গ্রাম প্রধান তথা মারমাদের স্থানীয় চিফকে বোঝায়। ফ্রান্সিস বুকানন তার ভ্রমণ ডাইরীতে এই কারবারীকে, রুয়া-সা (জঁধ-ংধ) তথা মারমাদের স্থানীয় চীফ, যার বর্মী নাম য়্য-সা, আরাকানী নাম য়্যন্সা এবং বাংলায় বিকৃত শব্দ রোয়াজা বলে উল্লেখ করেন। কারবারী নামক এই গ্রাম প্রধানের অস্তিত্বের কথা সর্ব প্রথম উঠে আসে নতুন সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সুপারিনটেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন জে.এম. গ্রাহামের ১৮ই নভেম্বর, ১৮৬২ তারিখের এক পত্রে। আবার ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লুইনের ১৮৬৭ সালের অন্য আরেকটি প্রতিবেদনেও এই কারবারী নামটি উঠে আসে। অর্থ্যাত আমরা যদি মারমা সমাজে এই কারবারী নামক প্রপঞ্চটির ইতিহাসের দিকে তাকাতে যাই তবে কারবারী নামক এই সম্প্রয়দায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি হেডম্যানের মত করে নতুন হঠ্যাৎ তৈরি হয়ে যাওয়া কোন স্বত্ত্বা নয় বরং এর ইতিহাস অনেক সুদূর প্রসারী। সুদূর অতীতে পাড়া গুলোতে রাজারা, এই রোয়াজা তথা কারবারী নিয়োগ দিতেন এবং সে সময় এই রোয়াজারাই ছিলেন গ্রাম প্রধান। তিনি রাজার হয়ে, প্রজাদের নিকট হতে রাজস্ব আদায় করতেন। প্রজাদের সকল ধরনের বিচার-আচার, ভাল-মন্দ, দুঃখ-দুর্দশা, শাস্তি-বিধান, আইন-কানুন, ধর্ম-আচার সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত ছিল তার হাতে। কিন্তু কালের আবর্তে রাজাদের সাথে সাথে, এই কারবারীদের ক্ষমতাও কমে যেতে শুরু করে।

১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিতে কারবারী নিয়োগ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোনো বিধান না থাকলেও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৬৬(১) ধারাতে কারবারী পদের স্বীকৃতি রয়েছে। পার্বত্য জেলাসমূহের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সামাজিক সমস্যা, নারীঘটিত কোনো সামাজিক মোকদ্দমার উদ্ভব হলে তা নিষ্পত্তির প্রাথমিক দায়িত্ব কার্বারীর উপর বর্তায়। প্রথম দিকে অর্থ্যাত ব্রিটিশ আমলে কারবারীরা সরকার হতে কোন ধরনের ভাতা না পেলেও বর্তমানে তারা সরকার হতে ভাতা পান। যদিও কারবারী নিয়োগের নিয়ম হল, পাড়া গুলোতে রাজা অথবা হেডম্যান এই কারবারী নিয়োগ দেবেন কিন্তু সমসাময়িক সময়ে এই পদটি হয়ে উঠেছে বংশানুক্রমিক। অর্থ্যাৎ কারবারীর বড় ছেলেই হয়ে উঠেন কারবারী। কারবারী তার গ্রাম তথা পাড়ার দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করেন তার কারবারী আদালতে। এছাড়াও পাড়ার পূজা-অর্চনা, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহন, আদেশ- পরামর্শ প্রদান ও তিনি করে থাকেন। কারবারী আদালতে বিচার প্রক্রিয়া হয় মূলত শালিসী বোর্ড গঠনের মাধ্যমে। যেই বোর্ডে অন্য দুই/ তিন পাড়ার কারবারীরা উপস্থিত থাকেন, মাঝে মাঝে হেডম্যান অথবা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার উপস্থিত থাকেন এবং গ্রামের কিছু গন্যমান্য পুরুষ, মহিলা এবং যুবক, যুবতী অংশগ্রহন করেন। বাদী এবং বিবাদী উভয়ই উপস্থিত থাকেন। বাদী-বিবাদী উভয়ের কথা শোনা হয়, স্বাক্ষ্য গ্রহন করা হয়। রায় ঘোষনার ক্ষেত্রে বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্য যে রায় দেন তাই ঘোষনা করেন কারবারী, একা একা কোন রায় দেন না। কারবারী আদালতে বিচার/শালিস/ মিমাংসা শুরুর আগে একটা সাদা কাগজে বাদী, বিবাদী/অভিযুক্তের এই মর্মে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়া হয় এই মর্মে যে, বিচারে যেই রায় ই ঘোষনা করা হোক না কেন তা তারা সকলেই মেনে নিতে বাধ্য থাকিবেন। পরবর্তীতে আবার এই কাগজেই বিচারের ফলাফল লেখা হয়। প্রমান হিসেবে কারবারী এই কাগজটি তার নিকট সংরক্ষন করেন। বিচার-শালিসের ইস্যু যদি খুব বেশি জটিল হয় অথবা পাড়ার কেউ যদি কারবারী আদালতের সিদ্ধান্তকে মেনে না নিতে চায় তবে সে ইউনিয়ন পরিষদের স্মরনাপন্ন হতে পারে।

ওয়াজ্ঞা ইউনিয়নটিতে একটিই মৌজা, ১০০ নং মৌজা! সেই মৌজার হেডম্যান হলেন দীনু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। তঞ্চঙ্গ্যা গোত্রের হলেও বংশানুক্রমে তিনিই যেহেতু ১০০ নং মৌজার হেডম্যান সেহেতু শুধু মারমা পাড়া তথা ছিংমং পাড়া নয় বরং একই সাথে আরও বাইশটি পাড়ারও হেডম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দীনু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা এবং তার সাথে করে ছিংমং পাড়ার কারবারী সাজাই মারমা একটা সিএনজি নিয়ে দুজনেই এসেছেন জুলকারনাইনকে নিয়ে যেতে। গতদিন তারা দুইজনই উপস্থিত ছিলেন ডিসি সাহেবের কক্ষে। মারমা পাড়ায় সিরিয়াল কিলিং রহস্য উন্মোচনে জুলকারনাইনের রাজী হয়ে যাওয়ায় উপস্থিত সকলের চোখ খুশিতে চকচক করলেও সাজাই মারমা বেশ দ্বিধা দ্বন্দ্বে যে ভুগছিলেন তা জুলকারনাইনের দৃষ্টি এড়ায়নি। জুলকারনাইন নিশ্চিত কারবারিকে কিছুটা জোর করেই ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল ডিসি সাহেবের কক্ষে সেই ছোট্ট মিটিংটায়। সত্তরোর্ধ বয়সী কারবারী খুব সম্ভবত এটা ঠাহর করতে পারছিলেন না, দেব-দেবীর অভিশাপ সংক্রান্ত বিষয়ে ভিন্ন ধর্মের এই মানুষটা কিভাবে সহায়তা করতে পারবে? ডিসি সাহেবও খুব সম্ভবত বিষয়টা ধরতে পেরেছিলেন বিধায় মিটিং শেষে তারা যখন বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখন তো তিনি কারবারীকে উদ্দেশ্য করে বলেই বসলেন, "কারবারী বাবু! রাবন নিয়ে এসে দিলাম। উনি এক মাস সময় নিয়েছেন তো! আমি বলে দিলাম এর আগেই আপনাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।" ডিসি'র কথায় আস্থা রাখা কারবারীর জন্য বেশ কষ্ট সাধ্য হলেও মুখে কৃত্রিম হাঁসি ঝুলিয়ে চুপচাপ তা হজম করে নেয়া ছাড়া অবশ্য অন্য কোন উপায় ছিলনা। তবে অংসুথাই মারমা"র চোখে মুখে ছিল খুশির ঝিলিক। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে তার সমাধান হাতে পেয়ে গিয়েছে। যুলকারনাইনের সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান এবং তথ্য যে সে রাখে আপাততঃ এটা পরিস্কার যুলকারনেইনের নিকট। হয়তোবা সে-ই তার কমিউনিটিকে রাজী করিয়েছে রহস্য উন্মোচনে যুলকারনাইনের স্মরনাপন্ন হতে। পাহাড়িদের নিকট যুলকারনাইন সম্পর্কে এত তথ্য থাকবার কথা নয়, তাও আবার মারমা গোত্রের একটা পুঁচকে ছেলের নিকট। যুলকারনাইনের যদ্দুর জানাজানি, মারমাদের বেশ বড় একটা অংশ এখনও সেভাবে বিদ্যা-শিক্ষা কিংবা জ্ঞানার্জনে উঠে আসতে পারেনি। পাহাড় হতে বিদ্যা-শিক্ষা আর জ্ঞানে যে জাতিটি উঠে আসছে সেটি হল চাকমা সম্প্রদায়।

পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ ধরে কাপ্তাই উপজেলার উদ্দেশ্যে ফড়ফড় করে বলতে গেলে উড়েই চলছিল সিএনজিটা। পাহাড়ি খাঁড়া উচু রাস্তায় উঠবার সময় গতি প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে আসতে চাইলেও, সেই খাঁড়া হতে নামবার সময় দক্ষ চালক সিএনজি'র স্টার্ট বন্ধ করে নিতে ভুলছিলেন না। এসময় স্টার্ট ছাড়াই সিএনজি যে গতি লাভ করে তাতে সেটি যে ছিটকে পাহাড় হতে পড়ে গিয়ে উড়তে থাকে না, সেটিই এক রহস্য। বসন্তের নব সাজে সেজেছে পাহাড়! চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ! পাহাড়ের দৃঢ়তা আর নীল-সবুজের মাখা-মাখিতে একাকার হয়ে গিয়েছে পুরো পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড় কন্যা রাঙ্গামাটি যেন তার রুপের পসরা সাজিয়ে বসেছে কাপ্তাইয়ের কোল জুড়ে। হেডম্যান আর কারবারীর সাথে করে নিয়ে আসা সিএনজিটা চট্টগ্রাম ফেরতগামী পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা ধরে ছিড়ে ফুড়ে চলছিল বেশ দ্রুত গতিতে। রাঙ্গামাটির এই দিকটায় না আসলে পাহাড়ের এমন রুপ হয়তোবা কখনোই দেখা হতনা যুলকারনাইনের। চোখ-মুখ হা করে সিএনজি-র ছোট্ট দরজা হতে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে সে শুধু দেখেই চলছিল। পাহাড় আর অরণ্যের সাথে তার হৃদয় যেনো একাকার হয়ে মিশে গিয়েছে। যুলকারনাইন যেন কোন এক নাম-পরিচয়হীন পাহাড়ি যুবক যে কিনা দূর পাহাড়ে বসে পাতার বাঁশি বাজিয়ে চলে নিরন্তর।

পাহাড় ঘুরতে আসা পর্যটকেরা সচরাচর এইদিকটায় আসবার সাহস করেনা নিরাপত্ত্বার অভাবে। কিন্তু রাঙ্গামাটি শহর হতে কাপ্তাই উপজেলা, মোটামুটি ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের পাহাড়ি এই উঁচু নিচু পাকা সড়কটায় চলাচলকারী মানুষগুলোর কারও চোখে মুখে যুলকারনাইন ভয়ের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটাও দেখতে পায়নি, পাহাড়ে বসবাস করতে করতে হয়তোবা তারাও পাহাড়ের মত দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। পাহাড়, সবুজ আর পাহাড়ি মানুষ দেখতে দেখতে যুলকারনাইন ভুলেই গিয়েছিল যে সিএনজি তে তার সাথে আরও দুইজন সহযাত্রী বেশ জড়ো-সড়ো হয়ে বসে আছেন। অবশ্য জড়ো-সড়ো হয়ে থাকবারই কথা! চারটায় আসবার কথা বলে তারা পর্যটনে এসেছিলেন সোয়া পাঁচটায় তাও আবার উপজেলা পরিষদের বেশ সৌখিন একটা জিপ গাড়ি সাথে করে। নিজেকে বেশ পাংকচুয়াল একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে যুলকারনাইনের বেশ ভালো লাগে, অন্যের সময়জ্ঞানহীনতায় সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। তবে আজ হেডম্যান আর কারবারীর উপর তাদের দেরী করে আসা নিয়ে তিনি যতটা না রেগে গিয়েছিলেন তার থেকেও বেশী রেগে গিয়েছিলেন তাদের সাথে করে ভি-৬ মডেলের পাজেরো গাড়িটা দেখে। খুব সম্ভবত গাড়িটা জেলা প্রশাসনেরই হবে। যুলকারনাইন জানে, তারা খুব করে চেষ্ঠা করে যাচ্ছে যুলকারনাইনকে খুশি রাখতে কিন্তু এই গাড়িতে করে গিয়ে কমিউনিটিতে নামলে রহস্য তো আর উন্মোচন হবেই না উল্টো তার সাথে করে অনেকগুলো মানুষের জীবনও ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। সব কিছু বিবেচনা করে, পর্যটন মোটেল হতে গাড়ি বিদায় করে দিয়ে হেডম্যানকে বেশ রাগ দেখিয়েই লোকাল বাস কিংবা সিএনজি-র ব্যবস্থা করতে বলেছিল যুলকারনাইন। সেই রাগ দেখবার পর হতেই মানুষ দুইজন চুপ করে বেশ জড়ো-সড়ো হয়ে বসে আছে। তাদেরকে সহজ হবার সুযোগ দিয়ে এবার জুলকারনাইন জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা! আপনাদের এইদিকে দর্শনীয় স্থান কি কি আছে বলুন তো?" যুলকারনাইনের আচমকা প্রশ্ন শুনে প্রথমে দুইজন-ই প্রথমে চমকে ওঠে এবং একই সাথে উত্তর করা শুরু করলে কারবারী চুপ হয়ে গিয়ে হেডম্যানকে বলবার সুযোগ করে দেয়। আংগুলের মাথায় গুনতে গুনতে হেডম্যান বলতে থাকে, "১) কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ২) ওয়াজ্ঞা এস্টেট চা বাগান ৩) প্যানোরোমা জুম রেস্তোরা ৪) গিরি নন্দিনী পিকনিক স্পট ৫) প্রশান্তি পার্ক ৬) কর্ণফুলি নদী- এইসব ই স্যার! সময় তো হাতে আছে অনেক। একদিন আপনাকে বেরাতে নিয়ে যাবো স্যার।" হেডম্যানের আন্তরিকতাকে পাত্তা না দিয়ে যুলকারনাইন পাল্টা প্রশ্ন করে, " ওয়াজ্ঞা এস্টেট চা বাগানের বিশেষত্ব কি?" হেডম্যান যেন এবার দ্বিগুন সাহস পেয়ে বসে! কতকটা বুক ফুলিয়েই সে বলতে শুরু করে, "ওয়াজ্ঞা ছড়া চা বাগান হলো স্যার পুরো চট্টগ্রামের মধ্যে সব থেকে বড় আর সুন্দর চা বাগান! কর্ণফুলীর দুই তীর ধরে বেশ বড় একটা জায়গা জুড়ে এই চা বাগান। ১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ নাগরিক মিস্টার ডরিন-এর নেতৃত্বে এই বাগান তৈরি কাজ শুরু হয়েছিল। প্রায় ৫০ বছর ব্রিটিশদের হাতে বাগান থাকবার পর, হাত বদলের ধারাবাহিকতায় চা বাগানের মালিকানা লাভ করেন নুরুল হুদা কাদেরী। বর্তমানে কাদেরী পরিবারের ব্যবস্থাপনায় ‘ওয়াজ্ঞা টি লিমিটেড’ নাম দিয়ে এখানে চা শিল্পের পরিচালনা করা হচ্ছে। এর প্রাকৃতিক দৃশ্য এতই চমৎকার যে স্যার আমরা পাহাড়িরাও এর প্রেমে পড়ে যাই।" হেডম্যানকে এবার কিঞ্চিৎ পাত্ত্বা দিয়ে যুলকারনাইন বলে, "হেডম্যান সাহেব! আমার নাম যুলকারনাইন ইসলাম। আমি কোন স্যার নই। আপনি চাইলে আমার নাম ধরে ডাকতে পারেন, প্লিজ স্যার ডাকবেন না। আমি বিব্রত বোধ করি।"

যুলকারনাইনের এমন পরামর্শেও প্রতি উত্তরে হেডম্যান আবারও বলে বসে, "জ্বি স্যার! আর হবে না।" যদিও যুলকারনাইন জানে, শুধরিয়ে দেবার পরেও হেডম্যানের এই স্যার সম্বোধন বিহ্যাভিয়রাল সাইকোলজির একটা অংশ এবং সেটি যেতে বেশ সময় লাগবে তথাপি সে সিএনজি-র মধ্যে হো হো করে উচ্চ শব্দে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা বলেন! আমার থাকবার ব্যবস্থা কি করেছেন?" যুলকারনাইনের হাঁসিতে কতকটা লজ্জ্বিত হয়ে পড়ে হেডম্যান দীনু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, তাকে নিশ্চুপ দেখে জুলকারনাইনের প্রশ্নের উত্তর দেয় কারবারী সাজাই মারমা, "ডিসি সাহেব যেভাবে বলেছিল ঠিক সেভাবেই আপনার থাকার ব্যবস্থা আমার পাড়াতেই করা হয়েছে। ওখানে আপনার জন্য পুরো আলাদা একটা ঘর তৈরি আছে স্যার! আর খাবারটা তিন বেলা আমার বাসা থেকেই যাবে। কাপ্তাই ঢোকার আগেই আমার পাড়া পড়লেও আমরা আগে কাপ্তাই দীনু-র বাড়িতে যাবো স্যার। ওখানে চারটা ডাল ভাতের ব্যবস্থা করেছে সে, রাতটা সেখানে থেকে তারপর কাল সকাল হতে ছিংমং এ-ই থাকতে পারবেন আপনি স্যার।"

অন্য সময় হলে তাকে না জানিয়ে এমন আয়োজনের জন্য বেশ রেগেই যেত যুলকারনাইন, কিন্তু পাহাড়ি এমন পরিবেশে তার আর রাগ করতে ইচ্ছে করছিলনা বরং তার নিজেকে এখন পাহাড়ি সেই ছেলেটা ভাবতে ইচ্ছে করছিল যে কিনা দূর পাহাড়ে বসে পাতার বাঁশি বাজিয়ে চলে নিরন্তর। হেডম্যান দীনু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা'র বাড়িতে রাতের খাবারের নিমন্ত্রন নিয়ে কোন কথা না বলে, গলার স্বর যথা সম্ভব নিচু রেখেই সাজাই মারমাকে আস্তে করে যুলকারনাইন প্রতি উত্তর করে, "দীনু দা'র বাসা হতে খেয়ে, আজ রাতেই আমি আপনার গ্রামে চলে যেতে চাই। এটা জরুরী, আপনি ব্যবস্থা করুন। যেহেতু এই অঞ্চলের ভাষা আমি জানিনা সেহেতু আমার সাথে সার্বক্ষনিক একজন ট্রান্সলেটর হলে খুব সুবিধা হয়। গতকাল যে ছেলেটা ডিসি অফিসে ছিল, অংসাথুই মারমা! সে হলে খুব সুবিধা হয়। তাকে কি কোন ভাবে পাওয়া যেতে পারে, ছেলেটা বিশ্বস্ত এবং ভরষা করবার মত।" যুলকারনাইনের এমন প্রস্তাবে হেডম্যান এবার কতকটা সাহস পেয়ে মিটমিট করে হেঁসে উত্তর দেয়, "অংসুথাই তো আমাদের কারবারী'র-ই ছোট ছেলে। এই অঞ্চলের পাহাড়ি যুবকদের মানসিক শক্তি আর মনোবল বাড়ানোর জন্য আপনি রাঙ্গামাটি শহরে আসছেন এই খবর পত্রিকা মারফত জেনে প্রথম সে আমাকে আপনার সম্পর্কে জানায়, আপনি কিভাবে বিচিত্র সব জ্বীন-ভূত, দেব-দেবী সংক্রান্ত রহস্যের সমাধান করেছেন সেগুলোরও বিশদ আমাকে সে জানালে আমি ইউএনও সাহেবের সাথে আলাপ করি। এরপর একদিন ডিসি সাহেবের ওখানে আমাদের ডাক পড়লে, ডিসি সাহেব আমাদেরকে কথা দেন তিনি তার সাধ্যমত চেষ্ঠা করবেন। এর মাঝে অংসাথুই-র প্রচন্ড ইচ্ছার কারনে ডিসি সাহেবকে বলে আপনার সেই ক্লাসে তার উপস্থিতির একটা ব্যবস্থা করে দেই। আপনি কোন চিন্তা করবেন না স্যার! আমি তাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। আজ রাত হতেই সে সার্বক্ষনিক আপনার সাথে থাকবে।"

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১১:০৩
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×