আজ কয়েকদিন রাতে ঘুম হয় না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, ফুটপাতে মাথা চেপে ধরা ছেলেটাকে কয়েকজন কমবয়েসী ছেলে এখনও নৃশংসভাবে পেটাচ্ছে। একজন আবার তার প্যান্টের চেন খোলার চেষ্টা করছে কারণ তার পুরুষাঙ্গ থেঁতলে দিবে। মানুষ কি আর মানুষ আছে। আমি নিজে কি আর মানুষ আছি? নাকি মানুষ আকৃতির একটি জড়পদার্থে পরিণত হয়ে গেছি? এই যে কম বয়েসী কয়েকটি ছেলে তাদেরই সমবয়সী একটি ছেলেকে এলোপাতাড়ি বীভৎস ভাবে পেটালো, মাথাটা থেঁতলে দিল-আর রাস্তার লোকগুলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। আমিও তাদের সঙ্গী হলাম। এটা কি মনুষ্যত্ব? ঐ ছেলেটা তো আমি নিজেও হতে পারতাম! হতে পারত আমার নিজের ভাই! প্রিয় কোন বন্ধু! তাহলে কি আমি এটাকে অবজ্ঞা করে চলে যেতে পারতাম???
প্রশ্নবাণে জর্জরিত ভারাক্রান্ত মন! সেই যে ছেলেগুলি পেটাচ্ছিল তাদেও মধ্যে ২/৩ জন আবার স্কুল ড্রেস পড়া ছিল! এদের কি স্কুলে এই শিক্ষা দেওয়া হয়? কসাই এর মত মানুষকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা? আজ আইন করে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়------ কেন? আমরা স্কুলে থাকতে তো জন সম্মুখে দূরের কথা, বয়সে বড় কারও সামনে সিগারেট খেতাম না। জোর করে কি মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলা সম্ভব? আইন করে কি মানুষকে বাধ্য করা সম্ভব? তাদের স্বভাব বদলানো সম্ভব?
আজ দুপুরে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে গিয়েছিলাম এক ছোট ভাইয়ের সাথে। অবাক চোখে দেখলাম ব্যাংকের মোটা মোটা থামে উজ্জ্বল স্টীকার মারা- "Use Natural Light FIRST", কি সুন্দর মশকরা! আরে ব্যাংকের ভিতরেই তো অন্ধকার করে রাখা হয়েছে, চারপাশে জানালায় ভারী কাচ, তারওপর আবার ভারী পর্দা দিয়ে। আর কৃত্রিম বর্ণচ্ছটায় শোভিত হয়েছে অন্দরমহল। এটাই তো বাঙ্গালীর ঐতিহ্য-উপদেশ দিতে কেউ কার্পণ্য করে না।
ছাত্র নাকি জাতির ভবিষ্যৎ! ছাত্রদের জন্য বাসে হাফ ভাড়া একটি বহুল প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু ছাত্র বলে কি শুক্রবার/শনিবার ঘরে বসে থাকবে? স্কুল/কলেজ/ইউনিভার্সিটি তবে ইদানীং শুক্রবার/শনিবার খোলা থাকে কেন? আবার ছাত্র যদি ভবিষ্যৎ-ই হবে; তবে এই যে কতিপয় মহান রাজনীতিবিদ সমগ্র ছাত্রসমাজকে তাদের ঘৃণ্য থাবার নিচে আশ্রয়দান করে প্রতিনিয়ত নোংরা রাজনীতির কলুষিত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে আসছেন আর বিনিময়ে দিচ্ছেন যথেচ্ছ কালো ক্ষমতা সাথে নেশার মোহময় অন্ধকার। অপরাজনীতির আগ্রাসনে শিক্ষাঙ্গনের চিরউজ্জ্বল নক্ষত্র আজ স্তিমিত প্রায়।
ইদানীং রাস্তাঘাটে বের হলে দেখা যায় প্রতিনিয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-বাংলাদেশের প্রাচীনতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ- এর ছাত্র পরিবাহী বাসগুলি ট্রাফিক সিগনাল অমান্য করে রাস্তার উল্টপাশ দিয়ে চলছে। এর জন্য তৈরী হচ্ছে নতুন যানজট। তা না হয় কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এই অযৌক্তিক আইন ভঙ্গের কারণ কি? যদি একটু দেরীতে বিদ্যাপীঠে পৌছান, তবে কি বিদ্যা ফুরিয়ে যাবে? অন্যদিকে সরকারী, আধা-সরকারী, বেসরকারী চাকুরে, ব্যবসায়ীগণ ঘন্টার পর ঘন্টা অফিস যাওয়ার পথে জ্যামে বসে থাকেন। কিন্তু আমাদের বিদ্যার্থীগণ একবারও কি চিন্তা করেন যে, এই যে, ব্যস্ততা দেখিয়ে তারা আইন ভেঙ্গে জীবণের শুরুতেই দূর্নীতির অপচর্চা শুরু করেছেন-এর ভবিষ্যৎ পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে? তখন হয় তো পানি পানেও আইন অমান্য করার প্রবণতা তৈরী হতে পারে। দেশের বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, খুব শীঘ্রই সদ্যাগত শিশুও মায়ের জঠর ছেড়ে বের হতে চাইবে না। জন্ম নেওয়ার জন্যও ঘুষ চাইবে।
এই যে, ছাত্র রাজনীতির নামে একজন আরেকজনকে খুন জখম করে-তারা কি একটিবারের জন্য চিন্তা করে না যাকে সে মারছে, সে তো তারই সহপাঠী, না হয় একই ক্লাসের নয়, কিন্তু একই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো। আরে কোথাকার কোন নেতা, সে কি আপন হলো। দেখেন তো নেতাকে একটিবার অবজ্ঞা করে, বা নেতার কোন কাজ আপনি না করলে, নেতা আপনাকে চেনে কি-না? তবে আপনার ঐ বন্ধু তার একটি ছোট কাজে বিনা স্বার্থে সাহায্য করুন, সারা জীবন মনে রাখবে। কিন্তু এই নেতার কথায় চলে, ছাত্ররাজনীতি থেকে শিক্ষা নেওয়া নেতারা ভবিষ্যতে কি করতে পারে তার প্রমাণ তো এখনই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। দেশের মানুষের সাথে গার্দ্দারী করে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি নিয়ে আসে। আর্ন্তজাতিকভাবে নিজের দূর্বলতা উন্মোচন করে। নিজেদের বিভেদ তুলে ধরতে কার্পণ্য করে না বিশ্ব দরবারে। এতে তো নিজের দূর্বলতার সুযোগ করে দেওয়া হয়, সুযোগ সন্ধানীর কাছে-এটুকু তাঁরা কি বোঝে না নাকি বুঝতে চায় না।
আরে বাংলাদেশে নির্বাচন হবে তাতে আমেরিকা, ভারত, চীন, বৃটেন, রাশিয়া-কার কি? রাজনীতিতে যে যে পার্টিই করুক, আমরা তো বাঙ্গালী না-কি? তবে আমার সমস্যায় পড়শীর নাক গলানো কেন? ঐ যে ছাত্র রাজনীতির শিক্ষা-বাইরের নেতার কথায় ওঠা-বসা। স্বামী-স্ত্রীর সমস্যায় যখন বাইরের লোক মতামত দিতে আসে তখন সে সংসার আর টিকে না। এটুকু কি আমাদের এখনও বোঝা উচিৎ না যে, আমরা বানরের কাছে মাখন ভাগ করতে দেওয়ার গল্পের মত আমাদের নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুন্দর পাত্রে সাজিয়ে পরাশক্তির সামনে পরিবেশন করছি।
আমরা এত ঘটা করে ভোট দিয়ে জন প্রতিনিধি নির্বাচন করি। নির্বাচনের পর তাদের চলাচলের জন্য রাস্তা ফাঁকা করার নামে সাধারণ জনগণকে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তা বন্ধ করে দূর্ভোগে রাখা হয়। এটার নাম নাকি প্রটোকল! যাহোক দেশের স্বার্থে তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু কষ্ট লাগে তখন যখন দেখা যায় জনপ্রতিনিধির গাড়িতে প্রটোকলের নামে তাদের শিশু সন্তানেরা অনৈতিক আমোদে লিপ্ত থাকে। আরও বেশী কষ্ট লাগে, যখন দেখি আমার ই দেওয়া ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আসবে বলে নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকেই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বা কোন অনুষ্ঠান বা খেলায় ভিতরে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। আবার এসব জনপ্রতিনিধিদের বেতন-ভাতাও দেওয়া হয় আমারই আয় থেকে কর্তন করে। এতই যদি প্রাণের মায়া থাকে, হুমকি থাকে তবে ঘরেই বসে থাকেন না কেন? অযথা নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু লোককে কষ্ট দেন, সেই সাথে নিরীহ জনগণকে করেন হয়রানী। নিরপত্তা বাহিনী থাকবে জনগনের নিরাপত্তায়। সেখানে গুটিকয়েক নেতা-নেত্রীদের নিরাপত্তায় যদি কয়েক হাজার নিরাপত্তাকর্মী আর কয়েকশ’ কোটি টাকা খরচ করা হয়, তা আমাদের মত গরীব দেশের জন্য সত্যিই বিলাসিতা। সবচেয়ে বড় কথা এমন কাজ কেন করেন যে, সবাইকে আপনার শক্র মনে হয়?
একটাবার কি এদেশের মানুষ মন খুলে চিন্তা করে না! এই যে সম্প্রতি রাজাকার বিচার হতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং অতঃপর হানাহানি ও সংঘাত। কেউ কি চিন্তা করেছেন কে কাকে মারছে? আরে জামাত শিবির করে বলে যাকে জবাই করতে চাচ্ছেন সে তো আপনারই বাঙ্গালী ভাই। আর ধর্ম রক্ষার নামে আপনি যার মাথা ফাটাচ্ছেন সেও তো আপনার বাঙ্গালী ভাই।
একবারও কি চিন্তা করে দেখেন- আমি মুসলমান না বাঙ্গালী?- এই প্রশ্নটি আমার সামনে কেন আসলো? কে তৈরী করলো আমার সামনে এই প্রশ্নের মঞ্চ! মারামারি করে হাজারও লোক পঙ্গু হলো, নিহত হলো- এরা কারা? নিরীহ সাধারণ বাঙ্গালী। আরে দেশপ্রেমিক দাবীদার ভাইয়েরা আমার, কাকে তুমি মারছ?- তোমার দেশের জনগণকে। তুমি রাজাকারের বিচার চাও, কারণ তারা এদেশের জনগণকে মেরেছিলো। কিন্তু তোমরা কি করছ?
বাঙ্গালীর ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো, গৌরবময় ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাস কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে। মুখ থুবড়ে পড়বে দ্বিধাবিভক্ত জাতি! এতই দূর্বল বাঙ্গালীর বন্ধন? এই জন্য কি ৫২-য় প্রাণ দিয়েছিল ভাষা শহীদেরা?? এইজন্যই কি ৭১-এ রক্ত দিয়েছিল লাখো শহীদ, ইজ্জত দিয়েছিলো আমাদের অরক্ষিত মা-বোনেরা?? ইতিহাসের পাতায় ব্যর্থতার কালিতে এমনি জারজ জাতি হিসেবে বাঙ্গালী জাতির নয়া উন্মেষ হবে নাকি সাহসী, উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত স্বর্ণাক্ষরে জাতির নাম চিরভাস্বর রবে তা ঠিক করার এখনই সময়। জাগো বাঙ্গালী জাগো, স্রোতে গা ভাসিয়ে দিও না। রাস্তায় মার খাওয়া ছেলেটি তোমারই জ্ঞাতি, তাকে বাঁচাও।
অন্যায় করা লোকটি তোমারই জ্ঞাতি, তাকে ঠেকাও। আর মুখ বঁজে এড়িয়ে যাওয়া লোকটি তুমি নিজে, আর এড়িয়ে যেও না, মুখ বুঁজে থেক না- নইলে সময় যে সাক্ষী দিবে তোমার কাপুরুষতার।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৫০