আব্দুর রাহমান ইবনে ইব্রাহিম সোরি (প্রিন্স সোরি)
মুসলমান আমির--আমেরিকার ক্রীতদাস
১৭৬২ সালে আব্দুর রাহমান গিনির ট্যাম্বো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতার নাম আলমামী ইব্রাহিম সোরি।
১৭৭৬ সালে তাঁর পিতা আলমামী ইব্রাহিম সোরি ইসলামিক কনফেডারেশনস ফুটা জালোন (বর্তমান গিনি) নামে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উপাধি ছিল আমীরুল মোমেনীন। এই রাষ্ট্রের রাজধানীর নাম ছিল ট্যাম্বো, যেখানে আব্দুর রাহমান জন্মগ্রহণ করেন।
আব্দুর রাহমান (প্রিন্স সোরি) ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি আরবি এবং ইংরেজি ছাড়াও আফ্রিকার চারটা ভাষা জানতেন।
১৭৮১ সালে আফ্রিকার দেশ মালির টিম্বুকটুতে অবস্থিত সানকরে ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তখন তাঁর আব্বা রাষ্ট্রপ্রধান। ২৬ বছর বয়সে তিনি সেনাবাহিনীর একটা রেজিমেন্টের কমান্ডার (আমির) হিসাবে নিয়োগ পান। বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে মালির বামবারা অঞ্চল জয় করেন।
১৭৮৮ সালে আব্দুর রাহমান সেনাবাহিনীর একটা বিশেষ ইউনিটের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এই ইউনিটের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের উপকূল বিদেশী শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করা এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে নিরাপদ রাখা। ঐ বছরেই ব্রিটিশদের সাথে এক যুদ্ধে আব্দুর রাহমান (প্রিন্স সোরি) যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হন। তারপর ব্রিটিশরা তাকে আমেরিকার মিসিসিপিতে থমাস ফস্টার নামের এক তুলা খামারির কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত ৩৮ বছর আব্দুর রহমান ক্রীতদাস হিসাবে কাজ করেন।
১৭৯৪ সালে আব্দুর রাহমান ইসাবেলাকে বিয়ে করেন। ইসাবেলাও একই মালিকের দাস ছিলেন। তাদের ঘরে ৫ ছেলে এবং ৪ মেয়ে জন্ম নেয়।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আব্দুর রহমান কৃষি বিজ্ঞান পড়েছিলেন। সেই জ্ঞানকে তিনি এখানে কাজে লাগান। ফলে তার মালিক তাকে সাধারণ দাস শ্রমিক থেকে সুপারভাইজার হিসাবে নিয়োগ করেন। এই বিশেষ মর্যাদার জন্য তার মালিক তাকে নিজস্ব সবজি বাগান করার অনুমতি দেন। তিনি ঐ সবজি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন।
১৮০৭ সালে ঐ সবজি বাজারে তাঁর পূর্বপরিচিত ডাক্তার জন কক্সের সাথে দেখা হয়। ডাক্তার জন কক্স একজন আইরিশ শল্য চিকিৎসক, তিনি ব্রিটিশ জাহাজে কাজ করতেন। একবার জাহাজ থেকে তাকে ট্যাম্বো উপকূলে নামিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পরলে আব্দুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়। ঐসময়ে তিনি আব্দুর রহমানকে ইংরেজি শিখাতেন।
ডাক্তার জন কক্স আব্দুর রহমানকে "প্রিন্স" বলে ডাকতেন। তিনি আব্দুর রহমানের মালিক ফস্টারের কাছে অনেক আবেদন নিবেদন করেন যাতে তিনি আব্দুর রহমানকে মুক্তি দেন। যাতে আব্দুর রাহমান আফ্রিকাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু ফস্টার কিছুতেই রাজি হন নাই, কারণ ঐসময়ে আব্দুর রাহমান ঐ ফার্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তাকে ছাড়া তার মালিক ফার্ম চালানোর কথা ভাবতেই পারতেন না।
১৮১৬ সালে ডাক্তার জন কক্স মারা যান, তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে আব্দুর রাহমানের মুক্তির জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
১৮২৬ সালে আব্দুর রহমান আফ্রিকাতে তাঁর এক আত্মীয়র কাছে একটা চিঠি লেখেন। স্থানীয় পত্রিকার এক ডাচ সাংবাদিক ঐ চিঠিটা মিসিসিপি থেকে নির্বাচিত যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের সিনেটর থমাস রীডের কাছে পৌঁছে দেন। চিঠিটা আরবিতে লেখা বলে সিনেটর রীড মনে করেছিলেন যে আব্দুর রাহমান একজন মোরোক্কান (মুর)। তাই তিনি ঐ চিঠিটা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত মরক্কোর দূতাবাসে পাঠিয়ে দেন।
মরক্কোর সুলতান এই চিঠি পড়ার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সই এডামস (৬ষ্ঠ প্রেসিডেন্ট) এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি ক্লের কাছে অনুরোধ করেন যাতে আব্দুর রাহমানের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। আব্দুর রাহমানের মুক্তির বিষয়টা নিয়ে মরক্কো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়ন দেখা দিলে ১৮২৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী যুক্তরাষ্ট্র তাঁর মুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।থমাস ফস্টার আব্দুর রাহমানকে বিনা মূল্যে মুক্তি দিতে রাজি হন। কিন্তু শর্ত হচ্ছে তাঁকে আফ্রিকাতে ফিরে যেতে হবে। তিনি মুক্ত মানুষ হিসাবে আমেরিকাতে বসবাস করতে পারবেন না।
আমেরিকা ত্যাগের আগে আব্দুর রাহমান এবং তাঁর স্ত্রী আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট ভ্রমণ করে জাতীয় রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আসেন। সেখানে তাঁরা প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সই এডামসের সাথে সরাসরি দেখা করেন। মিসিসিপিতে রেখে আসা তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মুক্তির জন্য টাকা সংগ্রহের উদ্দেশ্য তিনি সাংবাদিক সহ বিভিন্ন লোকের সাথে দেখা করেন এবং সাহায্য কামনা করেনা। এই কথা জানার পর ফস্টার মনে করেন আব্দুর রাহমান মুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছেন। এটা একটা রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী অ্যান্ড্রু জ্যাকসন এই ইস্যুকে প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সই এডামসের বিপক্ষে ব্যবহার করেন।
দশ মাস চেষ্টা করার পর যে টাকা সংগ্রহীত হয় তা তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে মুক্ত করতে যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন তার থেকে মাত্র অর্ধেক। শেষ পর্যন্ত তাঁর ছেলে মেয়েদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা সহ ১৮২৯ সালের মার্চ মাসে লাইবেরিয়াতে ফিরে যান। লাইবেরিয়াতে ফিরার ৪ মাস পরে ৬৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তিনি তাঁর ছেলে-মেয়েদেরকে শেষ বারের মত আর দেখতে পান নাই এবং তার মাতৃভূমিতেও ফিরে যেতে পারেন নাই।
আব্দুর রাহমান এবং তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা যে টাকা সংগ্রহ করেছিলেন তা দিয়ে তাঁদের দুই ছেলে এবং তাদের পরিবারকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। তারা লাইবেরিয়াতে ইসাবেলার কাছে ফিরে যান।
আব্দুর রাহমান যে বছর মারা যান ঠিক ঐ বছরেই থমাস ফস্টারও মারা যান। ফস্টারের মৃত্যুর পর আব্দুর রাহমানের বাকি ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতনিরা ফস্টারের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন হয়ে যায়। ফলে তারা মিসিসিপি স্টেটের বিভিন্ন শহরে এবং দক্ষিণের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। এখন আব্দুর রাহমানের বংশধররা কিছু আছে লাইবেরিয়াতে আর কিছু আছে আমেরিকাতে। ২০০৬ সালে আব্দুর রহমানের বংশধররা ফস্টারের খামার বাড়িতে পুনঃএকত্রিত হয়েছিল।
আব্দুর রহমান (প্রিন্স সোরি) দুইটা আত্মজীবনীমূলক বই লেখেন। লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে তাঁর প্রতিকৃতি সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাছাড়া তিনি যদি দাস হিসাবে বন্দি না হতেন তা হলে তাঁর আব্বার মৃত্যুর পর তিনি হতেন আমীরুল মুমেনিন। তারপর তাঁর কোন উত্তরাধিকারী বর্তমানে আমীর হতেন তার একটা সম্ভাব্য ছক লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে লিপিবদ্ধ আছে। তাছাড়া ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লাইবেরিয়া এবং আমেরিকাতে বসবাস করা তাঁর সব বংশধরদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
১৯৭৭ সালে ইতিহাসে অধ্যাপক টেরি আলফোর্ড আব্দুর রহমানের জীবনী নিয়ে "Prince Among Slaves" নামে একটা বই লেখেন।
২০০৭ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এন্ড্রেয়া ক্লিন Prince Among Slaves অবলম্বনে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করেন।
আব্দুর রাহমানের দুই জন নাতির নাতি (পুতির ছেলে) তাদের নামের আগে প্রিন্স উপাধি ব্যবহার করেন যা জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরকারি ভাবে স্বীকৃত।
ছবি: ইন্টারনেট
তথ্য সূত্রঃ
১. https://www.history.com/
২. Wikipedia
৩. Documenting the American South (DocSouth)
৪. WBEZ Chicago’s NPR news station
৫. Face to Face Africa (https://face2faceafrica.com/)
৬. Muslim of USA (http://www.muslimsofusa.com)
৭. American-biography (http://american-biography.blogspot.com/)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২০ রাত ১০:৪৩