somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকাশলীনা] ১৮ :: ভিন্ন আয়োজনে অন্য সাময়িকী

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আকাশলীনা]
পৌষ ১৪১৮ :: ডিসেম্বর ২০১১ :: বর্ষ ০২ :: সংখ্যা ০৬
----------------------------------------------------------------------------------
:: পাঠ-পূর্বক বিজ্ঞপ্তি ::
আকাশলীনা- এটি একটি ছোট পত্রিকা।
তবে, বন্ধুকে কাছে পাওয়া, বন্ধুর সঙ্গে থাকা; গান-সিনেমা-বই; আড্ডা আর গল্পে মজতেই আকাশলীনা-র জন্ম। বন্ধুর কাছে মনের কথা বলার মূলমন্ত্র নিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও, এখন এটি মুক্ত প্রাণ আর স্বপ্নের সোপানের প্রত্যাশী।
প্রতি বাংলা মাসের প্রথম সপ্তাহে মুদ্রণ কাগজে এটি প্রকাশিত হয়। বলা যেতে পারে, সাদাকালোয় প্রকাশিত ২৪ পৃষ্ঠার এটি এক রঙিন স্বপ্নের গল্প!
যে কোনো বিষয়ে, যে কেউই লিখতে পারেন এখানে। লেখক-পাঠক আর বন্ধুতার মেলবন্ধন সৃষ্টি করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
০২.
এখানে মূল পত্রিকার বর্তমান সংখ্যাটি অনলাইন পাঠকদের জন্য সরবারাহ করা হয়েছে। ভালোলাগা-মন্দলাগা বিষয়ে যে কেউই মন্তব্য করতে পারেন।
পত্রিকাটির মুদ্রিত কপি নিয়মিত পেতে চাইলে; ফোন নম্বরসহ ডাক-ঠিকানা লিখে জানাতে পারেন। নতুন সংখ্যা প্রকাশের পরপরই পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়...
আমাদের সম্পাদনা পরিচিতি এবং সরাসরি যোগাযোগ করার ঠিকানা এই লেখার নিচে উল্লেখ আছে।
ধন্যবাদ। -সম্পাদক। []
----------------------------------------------------------------------------------
মূল পত্রিকা এখান থেকে শুরু-
----------------------------------------------------------------------------------
:: সম্পাদকীয় ::
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালোরাত্রির ভায়াবহ চিত্র দিয়ে শুরু হয়েছিলো যে যুদ্ধ, ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর সে যুদ্ধের শেষ হয়। ১৯৭১ থেকে ২০১১- এই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে আমারা ছুঁয়েছি বিজয়ের ৪০ বছরের অর্জন। এ শুভমূহূর্তে মনে পড়ছে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতা চেয়েছেন- তাঁদের সবার প্রতিই শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।
লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা পেয়েছি, তা নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিলো। স্বপ্ন এখনো আছে, থাকবেও। দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, যে বিপুল জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধকালে নৃশংস হানাদারদের কবলে থেকে আতঙ্কে দিন যাপন করেছেন- সবারই স্বপ্ন ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক। মানবিক, শান্তিময় ও সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিজয়ের ৪০ বছর উদ্যাপনের ঊষালগ্নে, আমাদের হিসাব মেলানো প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্ন আমরা কতোটা পূরণ করতে পেরেছি।
একটা জাতির ব্যর্থতা থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, পরিবর্তনের পথেই-বা আমাদের প্রচেষ্টা ছিলো কতোদূর?
তবু, স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা স্বপ্ন দেখবো। সাহসী বাঙালি বলে যে জাতি সারাবিশ্বে একদিন নাম কুড়িয়েছিলো, আজ যেনো আমরা হতাশ না হই। একদিন নিশ্চয় সোনালি সূর্য ঠিকই ধরা দেবে- এটাই হোক আমাদের শক্তি।
০২.
খ্রিস্ট ধর্ম্বালম্বিদের বড়দিনের শুভেচ্ছা।
এবং একই সঙ্গে সকলকে নতুন বছরের শুভকামনা। সবার জন্যই মঙ্গলময় দিন বয়ে আসুক... []
----------------------------------------------------------------------------------
:: বিজয়ের কবিতা ::
বিজয় কি ফিরেছে ঘরে
রীনা তালুকদার

এ কোন বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছি জিহ্বায়?
আমার কথাই বলতে পারি না আমি
মুখ থেকে শব্দ বেরোবার আগেই
অজস্র দানবীয় হাত প্রসারিত হয়
আমার জিভ কেটে নেবার জন্য।
শ্রাবণের বৃষ্টিকে বলতে পারি না
থামাও তোমার পাঁজরছেঁড়া কান্না
শরতের মেঘ বিচ্ছিন্ন মনে
এপাশ-ওপাশ করে হাঁপিয়ে ওঠে।
ক্ষেতের শস্যের হলুদাভ রঙ
চুরি হয়ে গেছে অসাবধানে
মটরশুটি ছড়ায় না সুঘ্রাণ
এখন আর এখানে আসে না বন্য ঘুঘু
কেবলই পরাধীন মাঠ বিস্তারিত হয়।
এ কোন বিজয়ের উচ্ছ্বাস
সর্বাঙ্গে শৃঙ্খলিত লেবাস
বঙ্গগিরি খাতের এ ভূভাগে
কেবলই কি সংগ্রাম করা
মননে স্মৃতিসৌধ আঁকা
নয় মাস যে বিজয় ছুটেছিলো প্রান্তরে প্রান্তরে
সত্যিই সে কি ফিরেছিলো বাংলার ঘরে?
কখনো কোথাও দেখেছে কি কেউ তারে? []
----------------------------------------------------------------------------------
:: গল্প ::
এখানে পৃথিবী নেই
মো. ফরহাদ চৌধুরী শিহাব

চাঁদটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। বাকিটা মেঘের ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে অনেকক্ষণ হয়। কেমন যেনো হলদেটে একটা রঙ চাঁদটার গায়ে। একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। সৈকত একটা নিঃশ্বাস ফেলে নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বাহিরে তাকায়। হলুদাভ চাঁদটা নদীর ওপর অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। নৌকা চলার সাথে সাথে মনে হচ্ছে চাঁদটাও সঙ্গে চলছে। ওর পায়ের কাছে এসে পড়েছে চাঁদের আলোটা। নিজের অজান্তেই পা দুটো আরেকটু বাড়িয়ে দিলো আলোতে। ছইয়ের গায়ে হেলান দিয়ে আপন মনে পায়ের নখগুলোর দিকে তাকায়। কয়েকটা নখ ভেঙ্গে উঠে গেছে। কালো হয়ে আছে ওই জায়গাগুলো। বাকি নখগুলো বেড়ে গিয়ে এমন দেখাচ্ছে, যেনো জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে মাত্র! আসলে সৈকতের সারা গায়ে কাদামাটি লেগে শুকিয়ে আছে।
ছইয়ের ভেতরে অন্ধকারে আরো কয়েকজন মানুষ বসে আছে। চেনে না কাউকে। মূর্তির মতো বসে রয়েছে সবাই। কথা বলছে না।
সৈকত আস্তে করে বলে ওঠে, ‘নোয়াপাড়ার কেউ আছেন নাকি?’
নিজের কাছে নিজের কণ্ঠটাই কেমন বেখাপ্পা শোনে সৈকত। গত ষোলো ঘণ্টা ধরে কোনো কথা বলেনি। হঠাৎ করে কথা বলে ওঠায়, কণ্ঠটা নিজের কাছেই অপরিচিত লাগলো।
জবাব দিলো না কেউ। বোধহয় নোয়াপাড়ার কেউ নেই। মাঝির দাঁড় টানার ছলাৎ-ছল শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ছইয়ের ভেতরে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা করা শুরু করেছে। সৈকত ছইয়ের বাহিরে বেরিয়ে এলো। নৌকার পাটাতনে পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় চাঁদটা ঠিক মাথার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকায়েছে সে। মেঘগুলো নড়ছে না, স্থির হয়ে চাঁদটাকে অর্ধেক ঢেকে দিয়ে চুপচাপ ঝুলে আছে। নদীর চারপাশ থেকে হাল্কা কুয়াশা উড়ছে। শীত শীতও লাগছে। গায়ের পাতলা চেক শার্ট আর পুরনো কালো প্যান্ট। গত নয় মাসে ঠিক কতোবার এগুলো খুলেছে- হাতে গুণে বলে দিতে পারবে।
মুখে হাত বোলায় সৈকত। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল হয়ে আছে। বাড়ি গেলে বোধহয় কেউ চিনতে পারবে না। আদৌ চেনার মতো কেউ বেঁচে আছে কিনা- তাও জানে না সে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হামিদ ভাই শেষবার যখন গ্রাম থেকে এসেছিলো, সেবার নাকি পুরো গ্রামটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিলো মিলিটারি বাহিনী। যাঁরা বেঁচেছিলো, সবাই বর্ডার পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে। কেউ থাকার কথা না। এতো তাড়াতাড়িও কেউ ফিরবে না। মাত্র দুদিন হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখনো বিচ্ছিন্নভাবে এখানে-সেখানে যুদ্ধ চলছে। দেশ যে স্বাধীন হয়েছে, অনেকেই পুরোপুরিভাবে খবরটা এখনো পায়নি।
চাঁদের আলোয় আবছাভাবে নোয়াপাড়া গ্রামটার অবয়ব চোখে পড়ছে। স্থির হয়ে আছে অন্ধকারের মাঝে পুরো গ্রামটা। জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।
মাঝি একমনে দাড় বাইছে। নিঃশব্দে নৌকাটা ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে চারপাশ। ঘাটের বিশাল বট গাছটা ঠিক আগের মতোই নদীর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। শীতকাল বলে সমস্ত পাতা জীর্ণ হয়ে আছে, লতাগুলো ঠিক আগের মতোই নদীর ওপর ঝুলে আছে। ইতস্তত বাতাসে এদিক-ওদিক দুলছে ওগুলো। হঠাৎ করে গাছটার দিকে তাকালে মনে হয়, কোনো এক ঋষি-সন্ন্যাসীর ঝাঁকড়া মাথার চুল! যেনো নদীর দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তামগ্ন।
ঘাটে ভিড়তেই সৈকত লাফিয়ে নেমে গেলো নৌকা থেকে। মাঝি কোনো কথা না বলে দাড় ঠেলে আবার নৌকা নদীতে নামিয়ে নিয়েছে। নদীর এখানে শেষ নেই। পা ভিজছে ওর। নৌকাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো, ছোট হয়ে আসছে দ্রুত যানটা। নদীর ওপর চাঁদের প্রতিবিম্বটা এখন আর নৌকার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেনো সৈকত এই ঘাটে নেমে গেছে বলে, প্রতিবিম্বটাও ওর সঙ্গে সঙ্গে এখানে থেকে গেছে!
সৈকত এখন আর নৌকাটা দেখতে পারছে না। সে চাঁদের প্রতিবিম্বটার দিকে তাকিয়ে থাকে, চাঁদের রঙটা এখনো হালকা, হলুদ। ওর বাবা, সুব্রত কুমার সাহেব এ রকম চাঁদ দেখলেই সৈকত আর ওর ছোট বোন সুনেত্রাকে ডেকে বলতেন, ‘দেখেছিস? আজকের চাঁদটার জণ্ডিস হয়েছে! কেমন হলুদ হলুদ দেখাচ্ছে বেচারিকে! ডাবের পানি খাওয়ানো দরকার চাঁদের বুড়িকে।’
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির হয়ে পানিতে দাঁড়িয়ে রইলো সৈকত। নৌকা থেকে নামার সময়ই প্যান্টের পা ভিজে গেছে। এবার উপরের দিকে ঘুরে হাটতে লাগে।
নদীর ধারের রাস্তাটা আগের মতোই আছে, বদলায়নি। দুপাশের ঝোপঝাড় বেড়েছে কেবল। অনেকদিন চুল না কাটলে যেমন দেখায়, তেমন লাগছে ঝোপগুলোকে। চাঁদের আলো এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সৈকত খালি পায়ে ধুলোমাখা পথটা ধরে হাঁটছে বাড়ির দিকে। এখনো পর্যন্ত কোনো আলো চোখে পড়েনি। সমস্ত গ্রামটা যেনো গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
আর একটা বাঁক পেরুলেই সৈকতদের দোতলা কাঠের বাড়িটা। রাস্তার মোড়ের দিক থেকে গরুর গাড়ির চাকার আর্তনাদ শোনা গেলো। সেদিকে তাকায় ও। হারিকেন ঝুলছে গরুর গাড়ির একপাশে। রোগা, পটকা দুটো গরু কোনো মতে টেনে নিয়ে চলছে গাড়িটা। চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে রাতের নীরবতা খান খান করে ভেঙে পড়ছে। সামনের দিকে বসে থাকা লোকটাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না অন্ধকারে। আরেকটু কাছাকাছি হতেই চেনা গেলো। গফুর চাচা!
অনেক শুকিয়ে গেছেন এ কয় মাসেই। সৈকত এক পাশে সরে দাঁড়াতেই গরুর গাড়ি থামিয়ে ফেললেন, ‘ক্যাডা? কুন বাড়ির পোলা তুমি? আগে তো দেখি নাই!’
সৈকত আড়ষ্ট গলায় বললো, ‘চাচা, আমি সৈকত। মাস্টার সাহেবের ছেলে।’
খুব অবাক হলেন গফুর চাচা, ‘তুমি বাঁইচা আছো, বাজান! আমি তো ভাবছিলাম সবাই গেছে তোমাগো বাড়ির... কই ছিলা এদ্দিন?’
শুকনো কণ্ঠে বললো, ‘যুদ্ধে। মুক্তি বাহিনীতে ছিলাম।’
চুপ হয়ে গেলেন তিনি। কয়েকমুহূর্ত পর আপন মনেই বললেন, ‘কই যাবা? ভিটাবাড়ি তো সব পুড়ায় দিয়া গেছে কুত্তার বাচ্চাগুলান। একটা হিন্দু বাড়িও রাখে নাই। আহারে! মানুষগুলারে কেমনে মারলো... একটুও মায়া হইলো না... এতোটুকুন তোমার বইনডা, তারেও পর্যন্ত কুত্তাগুলা ছাড়লো না!’
সৈকত নিচু স্বরে বলে, ‘সবাই কি পুড়ে মারা গেছে?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নীরবে মাথা ঝাকালেন গফুর চাচা। সৈকত আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে। পেছন থেকে গফুর চাচা আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার এগুতে শুরু করলো তাঁর গরুর গাড়িটা। চাকার একটানা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলে হারিয়ে গেলেন বাঁকের আড়ালে।
০২.
সৈকতদের বাড়ির উঠোনজুড়ে পোড়া কাঠের স্তূপ আর পান পাতা ঝোপ। তুলসি গাছটার চিহ্নই নেই, কেবল ছোট একটা খাম্বার মতো সিমেন্টে বাঁধানো তুলসির মঞ্চটা আছে। চুনের সাদা রঙ আর নেই; কালো হয়ে আছে, শ্যাওলা ধরেছে জায়গায় জায়গায়। বাড়িটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও। চেনার উপায় নেই আর। পুড়ে একেবারে কঙ্কাল হয়ে আছে সব। কেমন করে যেনো কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনো মতে। বারান্দা, দেয়াল, দরজা- কিছুই অবশিষ্ট নেই। চাঁদের আলোতে নীরবে অসহায় মুখে বাড়িটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সৈকত আস্তে আস্তে হেঁটে সিঁড়ির কাছে চলে যায়। কালো হয়ে থাকা একটা থামে ধরে ধীরে ধীরে বসে পড়েছে সে। হেলান দিলো সিঁড়ির ধাপগুলোয়। চোখ বুজে এলো আপনা-আপনিতে।
কান পাতলেই বাড়ির ভেতর থেকে শোঁ শোঁ শব্দে পাচ্ছিলো সৈকত। ছুটে বেড়ানো বাতাসের সঙ্গে যেনো মিশে আছে ওর বোনটার হাসির শব্দ! কে যেনো বলছে, ‘দাদা, পুকুরঘাটে যাবি? ভরদুপুরে আমার একলা যেতে ভয় লাগে। বরই পাড়বো। যাবি?’
বুক ভরে শ্বাস নিলো। পোড়া কাঠের গন্ধের মাঝে কোথায় যেনো মায়ের শাড়ির মিষ্টি ঘ্রাণ মিশে আছে। টের পাচ্ছে সৈকত, আস্তে আস্তে পাশ ঘুরেছে। সিঁড়ির ধাপগুলোয় বাবার পায়ের ছাপ কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। আধো অন্ধকারে খুঁজে পেলো না সেসবের কিছুই।
কেমন যেনো অস্থির লাগছে! সিঁড়ি থেকে নেমে পোড়া কাঠের মেঝেতে শুয়ে পড়লো চিত হয়ে। কিন্তু বেশি একটা সময় থাকতে পারছে না কেনো জানি। এবার উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলো। শার্ট-প্যান্টে কয়লার কালি আর শুকনো ছাই লেগে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। খুব ধীরে ধীরে একেকটা মুহূর্ত কাটতে লাগে। বাড়িটায় ভেতর সময়গুলো যেনো দম আটকে থেমে রয়েছে। সৈকত আবার চিত হলো। চোখ বন্ধ করে কান পাতলো। ‘সৈকত! আমার হুকোয় মুখ দিয়েছিস, হারামজাদা! এই বয়সে হুকো টানিস! চাবকে পাছার ছাল তুলে ফেলবো!’
এবার বাবার গলা শুনতে পেলো ও। হুকোটা কোথায়? অন্ধকারের মাঝে এদিক-ওদিক তাকায় সৈকত। কিছুই দেখতে পায় না। আবার চোখ বন্ধ করলো। অস্থির লাগাটা বাড়ছে ক্রমশ। ছটফট করছে সে। মায়ের গলাটা কেনো জানি শুনতে পাচ্ছে না। বিড়বিড় করে কেবল বললো, ‘মা, শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। তুমি সেলাই করে দেবে বলে আমি গত নয়টা মাস বোতাম লাগাইনি। একটু সেলাই করে দেবে?’
সৈকতের এ বিড়বিড়ের কোনো জবাব এলো না।
সৈকত শুয়ে শুয়ে মেঝেতে পা ঘষছে অস্থির ভঙ্গিতে। এমন লাগছে কেনো ওর?
হঠাৎ মুখের ওপর টর্চের আলো এসে পড়েছে। চোখ মেলে হাত দিয়ে আড়াল করলো মুখ, ‘কে?’
উঠে বসেছে সৈকত। বিস্মিত একটা কণ্ঠ শোনা যায়, ‘সৈকত! তুই বেঁচে আছিস!’
বয়স্ক একটা কণ্ঠস্বর। চেনা চেনা লাগলো ওর। কিন্তু মনে করতে পারলো না। টর্চটা নিভে গেছে। লোকটা প্রায় পাগলের মতো এসে সৈকতকে জড়িয়ে ধরে, ‘আল্লাহ! আমি তো বিশ্বাস করতে পারতেছি না!’
এরপর আচমকাই সৈকতের মনে পড়ে গেছে! ইমাম হুজুর। সৈকতের বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু উনি। পাশের বাড়িটা তাদেরই। নয় মাস আগেও এ-বাড়ি ও-বাড়ি মিলে একটা সংসার ছিলো। সৈকত খুব সাবধানে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে ইমাম হুজুরকে। অস্থিরতা বাড়ছেই ওর।
০৩.
মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের ম্লান আলোতে খেতে বসেছে সৈকত। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে খাচ্ছে। মাছের পেটিটা আগেই খেয়ে ফেলেছে। এখন মুরগীর মাংস দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাচ্ছে।
সালেহা বেগম সামনে বসে আছেন। আঁচল দিয়ে মুখ ধরে রেখেছেন। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। সৈকত বড় আগ্রহ নিয়ে পেঁয়াজ-মরিচের ভর্তাটা টেনে নিলো। এ বাড়িতে এলেই এই ভর্তাটা সবসময় বানিয়ে দিতে হয় সালেহা বেগমকে। ছোটবেলা থেকেই সৈকতের খুব পচ্ছন্দের। ওর ধারণা, সালেহা বেগমের থেকে ভালো করে আর কেউ এই ভর্তা বানাতে পারবে না, এমন কি ওর মাও না।
সৈকত গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে। দুবার ভাত নিলো। ইমাম সাহেব ওর পাশে বসে নীরবে খাওয়া দেখছেন। হারিকেনের আলোয় চিকচিক করছে তাঁর দুচোখ। সৈকত মুখ ঝুঁকিয়ে খেয়ে যাচ্ছে, কোনো দিকে তাকাচ্ছে না।
দরজার পাল্লা ধরে খুব রোগা, ফ্যাকাসে একটা মেয়ে এসে দাঁড়ায়। শাড়ি পরনে। ইমাম সাহেবের মেয়ে পারুল। সৈকতের বোন সুনেত্রার সঙ্গে স্কুলে পড়তো। সৈকত মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার খেতে থাকে। যেনো কতো জনমের খাওয়া বাকি রয়ে গেছে!
পারুলের বড় বড় চোখ দুটো ভরে যাচ্ছে পানিতে।
সালেহা বেগম কান্না ভেজা গলায় বললেন, ‘আরেকটু ভাত দিই, বাবা?’
মাথা নাড়ে সৈকত, ‘নাহ। পেট ভরে গেছে, খালা।’ বলে হাত ধুয়ে নেয়।
আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘তোমার আব্বা-আম্মা, বোন- কাউকেই বাঁচাইতে পারলাম না... গ্রামে ক্যাম্প হওয়ার পর থিকা, মিলিটারিগুলা খালি কম বয়সী মেয়েগুলারে ধইরে নিয়া যাইতেছিলো। এই জন্য সুনেত্রারে এই বাড়িতে এনে পারুলের সাথে সিলিঙের উপর লুকায়ে রাখছিলাম। কিন্তু আল্লায় যে কার মরণ কই রাখছে কে জানবে? তোমাদের বাড়িতে আগুন দিতেই মেয়েটা পাগলের মতোন সিলিং থেকে নোমে ছুটে গেলো...’ বলতে বলতে সালেহা বেগম আবার আঁচল দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফেলেন।
পারুল আস্তেু আস্তেু বললো, ‘সৈকত-দা, সুনেত্রা তোমার হারমোনিয়ামটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে পুকুরে ডুবিয়ে দিয়েছিলো। বলেছিলো, তুমি আসলে যেনো পাও। বাড়ি-ঘর কখন পুড়িয়ে দিয়ে যায় আবার...’ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো ওর কন্ঠস্বর।
সৈকত গ্লাস থেকে ঢক ঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলে। ক্লান্ত লাগছে ওর। খুব ঘুম পাচ্ছে। ইমাম সাহেব এতক্ষণে কথা বললেন, ‘চল, তোর শোয়ার ঘর দেখায়ে দি।’
সৈকত উঠে দাঁড়ায়।
০৪.
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলো পারুলের। দোতলার ঘরটার জানালাটা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। কেনো ঘুম ভাঙলো বুঝতে পারলো না। উঠে বসেছে সে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে কিসের শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছে। এরপরই শব্দটা পেলো, কিছু একটা দিয়ে কেউ যেনো মাটি খুঁড়ছে!
উঠে জানালার কাছে চলে এলো পারুল। শিক ধরে এদিক-ওদিক তাকাতেই থমকে যায়। বাড়ির পেছন দিকে পুকুরঘাট। বড় একটা বরই গাছ ঘাটের ওপর বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে। যতোটা দেখা যায়- পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে। তার মাঝে কোদাল হাতে নেমেছে সৈকত। পুকুরের কাদা খুঁড়ছে সে! যন্ত্রের মতো একটানা চারপাশে কুপিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঘেমে-নেয়ে গেছে ছেলেটা। পাগলের মতো কোদাল দিয়ে পুকুরের সবটা কুপিয়ে ফেলেছে এই মাঝ রাতে!
পারুল সরে এলো জানালার কাছ থেকে। কান্না পাচ্ছে ওর। ভয়ংকর কান্না।
০৫.
সৈকত অপ্রকৃতস্থের মতো কোদাল দিয়ে কুপিয়ে যাচ্ছে পুকুরের নরম কাদামাটি। শক্ত একটা কিছুতে হঠাৎ কোদালের ফলা লাগে। সঙ্গে সঙ্গে কোদালটা ফেলে হাত দিয়ে মাটি টেনে সরাতে শুরু করেছে। প্লাস্টিকে প্যাঁচানো চারকোণা হারমোনিয়ামটা চিনতে কোনো কষ্ট হলো না। টেনে ওঠায় ভারি হয়ে যাওয়া হারমোনিয়ামটা। ঘাটের দিকে হাঁটতে শুরু করে সে ওটা নিয়ে। বরই গাছটার নিচে এসে ঘাটের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসলো। প্লাস্টিকটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে। পানি ঢোকেনি ভেতরে। শুকনোই আছে। কাদামাখা হাত প্যান্টে মুছে কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেখলো হারমোনিয়ামটা। ও ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করার পর, এটা কিনে দিয়েছিলো বাবা। গান গাওয়ার খুব শখ ছিলো সৈকতের। সে জন্যই হারমোনিয়াম কেনা। নিজে নিজে গান লিখে সুর করতে পারতো। সুনেত্রার খুব পছন্দ ছিলো হারমোনিয়ামটা। প্রায়ই এটা নিয়ে বসে যেতো পাগলি বোনটা। সৈকতের জিনিস ধরেছে- এ নিয়ে অনেক ঝগড়া হতো দুই ভাই-বোনের। মা এসে মিটমাট করে দিতেন।
সৈকত হারমোনিয়ামের ঢাকনাটা খোলে। দেখে অবাক হয়, ওর স্মরলিপি রাখার জায়গায় একটা খাম রাখা! তুলে নিলো। বড় বড় করে লেখা- সৈকত দাদাকে, সুনেত্রা।
মুখ খুলতেই একটা ছোট চিঠি বের হলো। চাঁদের আলোয় সাধারণত পড়া যায় না। কিন্তু সৈকত পড়তে পারছে। একটু কষ্ট হলেও মনের তাগিধ থেকে পড়ে যায়Ñ
দাদা, বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিলে তোর এতো সাধের হারমোনিয়ামটাও যাবে। তাই প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে পুকুর রেখে গেলাম। অন্য কোথাও না রেখে পুকুরে কেনো রাখলাম, জানিস? কারণ, ছোটবেলায় তুই আমার হাড়ি-পাতিলগুলো পলিথিনে ভরে এখানে ফেলে দিতিস, আর ডুবসাঁতার দিয়ে আমাকে সেগুলো তুলে আনতে হতো। যা এবার, তোর হারমোনিয়ামটাও দিলাম ফেলে! তোল গিয়ে! আমাকে না জানিয়ে যুদ্ধে গেলি কেন?
তুই যাবার কিছুদিন পর থেকে আমি পারুলদের বাড়িতে আছি। ওদের দোতলার সিলিঙের ওপর লুকিয়ে থাকতে হয় আমাদের দুজনকে। অনেক মজা এখানে, জানিস? সারা দিনরাত গল্প করি আর বই পড়ি। লুকিয়ে থাকায় খুব মজা, তাই নারে? জানিস, সিলিঙে থাকতে থাকতে একটা দুলাইনের গান লিখে ফেলেছি! তুই এলে সুর করবি- একটা মাটির পৃথিবী গড়ে দাও/ যদি ফের তোমরা আমায় দেখতে আবার চাও...
ধুর! দাদা, আমি তোর মতো পারি না কেনো রে? তুই এতো সুন্দর করে লিখিস কীভাবে? আর হ্যাঁ, তোকে না জানিয়ে তোর জন্য একটা মেয়ে ঠিক করেছি! তুই বাড়ি এলেই আমি টুক করে তোদের বিয়ে দিয়ে দেবো! বড়রা যা বলে, বলুকগে!
আর লিখবো না, কলম তুলে রাখছি। তাড়াতাড়ি ফিরে আয়। আমার খারাপ লাগে অনেক। তোকে ছাড়া কখনো এতোদিন থাকিনি তো। -সুনেত্রা।
০৬.
পারুল আবার জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়েছে। সৈকত ঘাঁটের সিঁড়িতে শুয়ে আছে পা ছড়িয়ে। হারমোনিয়ামটা পাশে। কাঁদছে না সে একটুও। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। চাঁদের আলোয় অন্যরকম লাগছে ওকে। পুরো দৃশ্যটার মাঝে কোথায় যেনো ভয়াবহ রকমের একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। ধরতে পারছে না পারুল। কেবল ঠোঁট কামড়ে কান্না ঠেকানোর চেষ্টা করছে সে।
সৈকতেরও অস্থির লাগছে। চিত হয়ে শুয়ে থাকতে ভালোলাগছে না। উপুড় হয়ে শুলো এবার। অস্থিরতা বাড়ছে তবু। ছটফট করতে শুরু করেছে কেনো জানি। বুঝতে পারছে না। চিত হয়ে গেলো আবার, বুকের ওপর খুব ভারি কিছু একটা চেপে বসেছে ওর। পা ঘঁষা শুরু করেছে ঘাটের সিঁড়িতে। বিড়বিড় করে সুর করার চেষ্টা করছে সুনেত্রার লেখা লাইন দুটোয়- একটা মাটির পৃথিবী গড়ে দাও/ যদি ফের তোমরা আমায় দেখতে আবার চাও...
কাঁপছে সৈকত অস্থির ভঙ্গিতে, হিস্টিরিয়া রোগীর মতো। বারবার উপুড় হয়ে সিঁড়ি খাঁমচে ধরছে, আবার চিত হয়ে যাচ্ছে। পা ঘঁষছে সিঁড়িতে, ছটফট করছে পাগলের মতো...
পারুল বরই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। সৈকতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা এখনো বিড়বিড় গাওয়ার চেষ্টা করছে- একটা মাটির পৃথিবী গড়ে দাও...
পারুলের দম বন্ধ হয়ে আসছে কেনো জানি। আকাশের দিকে তাকায়, ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। চাঁদের আলোতে বরই গাছ আর পুকুর ঘাঁট ভেসে যাচ্ছে। সৈকত এখনো অস্থির ভঙ্গিতে পা ছুড়ছে ঘাটের উপর।
পারুল হঠাৎ খুব সাহসের কাজ করে ফেললো। ছুটে গিয়ে সৈকতের একটা হাত ধরে বসে পড়ে পাশে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘সৈকত ভাই, আপনি কাদতে পারছেন না? কাঁদছেন না কেনো?’
সৈকত অস্পষ্ট স্বরে বললো, ‘একটা মাটির পৃথিবী গড়ে দেবে? আমার বোনটাকে একটু দেখতে পেতাম...’
পারুল কিছু বলতে পারলো না। কেবল শক্ত করে ওর হাতটা ধরে থাকে। সৈকতের অস্থিরতা বাড়ছে ক্রমশ। চিত হয়ে পা ঘঁষছে সিঁড়িতে... এতো অস্থির লাগছে কেনো ওর? []
----------------------------------------------------------------------------------
:: বিশেষ রচনা ::
নতুন বছর ও প্রত্যাশা
আলমগীর কবীর

কালের আবর্তে নতুন আরেকটি বছর আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। আর সামন্য কটা দিন পরেই পদার্পণ করছি নতুন খ্রিস্টবছর- ২০১২ সালে।
শুভ হোক নতুন বছর। নতুন বছরের শুরুতেই এমনই প্রত্যাশা সবার। পূর্বের বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকালে, এই শেষ বছরটাও যে আমাদের জন্য পুরোপুরি সফলতা বয়ে এনেছে, তা বলা যাবে না। এর কারণ, নতুন বছরকে আমরা কেবল আমাদের শুভ কামনাকেই সীমাবদ্ধ রাখি; বাস্তবের পরিকল্পনা কিংবা কাজে এর প্রতিফলন ঘটে না কিংবা প্রতিফলন ঘটাতে আমরা পারি না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়- ব্যক্তি, সমাজ কিংবা সামষ্টিক জীবনে শুভবোধ এতো সহজে আমাদের কাছে ধরা দেয় না।
আমাদের বিগত ব্যর্থতাগুলো কিংবা না পাওয়াগুলো দূরে সরিয়ে রেখে, সামনের দিকে এগিয়ে যাবো- এই বোধ হয়তো বছরের শেষ পর্যন্ত আমাদের মনে সজাগ থাকে না। নতুন বছর উদযাপনের মূলে রয়েছে, বিগত বছরের জমা-খরচের হিসাব মিলিয়ে, নতুন করে নতুন বছরে পদার্পণ করা। বিগত বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার সঠিক মূল্যায়ন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
এসবের পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্য থাকে, তা হলো- পুরাতন বছরের ব্যর্থতাকে পেছনে রেখে সামনের সফলতা নিয়ে কাজ করা। এ রকম উপলব্ধিই আমাদের মন ও মানসে যদি বিরাজমান থাকে, তাহলে প্রতিটি উৎসব অর্থবহ হয়ে উঠবে। নতুন বছর আমাদের জন্য বয়ে আনবে শুভবার্তা। সব অশুভকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাতি এক ঐক্যবদ্ধের সড়কে এসে দাঁড়াবে। ফলে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ হবে গর্বের এক বাংলাদেশ, সমগ্র বিশ্ব হবে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো।
এসব তো গেলো আমাদের মানস-মনন ও ব্যক্তিগত নানা কল্পনা-পরিকল্পনা, উপলব্ধির কথা। এবার ফিরে আসা যাক রাষ্ট্রীয় কিংবা রাজনৈতিক জীবনে। রাজনীতিক জীবনে নতুন বছর আর পুরাতন বছরের মধ্যে, পরিবর্তনগত দিক দিয়ে কোনো নতুনত্ব নেই বলে মনে করি। বিশ্বাস করি, শুধু আমি নই- অনেক মানুষই আমার এ মতের সঙ্গে জোরালো সমর্থন জানাবেন। এই পরিবর্তন হলো দেশের মানুষের, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, এই পরিবর্তন হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক মূল্যায়ন ও পরিবর্তন। রাজনৈতিক জীবনে এ বছর যে ঘটনাটি তিল হয়েছে, পরের বছর তা বড়জোর তাল হবে। গড়াই গরম থেকে জ্বলন্ত চুলা। এরচেয়ে বেশি কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না।
সর্বশেষ বছরটায় মূল্যবৃদ্ধির যে পাগলা ঘোড়াটা আমাদের দাবড়িয়ে বেড়িয়েছে, সেই মূল্যবৃদ্ধির ঘোড়াটা যেনো শান্ত প্রাণীতে পরিণত হয়, এমনই প্রত্যাশা মানুষের।
নতুন বছরে অবশ্য রাজনীতির বিজ্ঞাপন ভালো চলে। বিগত বছরে যা হারিয়ে গেছে কিংবা আমরা যা পাইনি, রাজনৈতিক নেতারা নতুন করে এগুলো ফিরে পাওয়ার জন্যে আমাদের আশাবাদী করে তোলেন। সংকল্পে বুক বাঁধতে সাহায্য করেন। যদিও শেষতক কিছুতেই কিছু হয় না। আর লাগবেই বা কেনো? কে শোনে কার কথা? সোনার বাংলার গণেশ আজ উল্টে গেছে। রাজনীতিতে একই গালি, একই কথা, একই চরিত্রদোষ, কেবল দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, তারিখ বদলাচ্ছে। নতুন বছরে নতুন তারিখ, বাকি সব পুরনো। নতুন বছরে রাজনীতিতে কোনো অঙ্গীকার নেই, কোনো প্রত্যাশা নেই। স্বপ্ন, কল্পনা আর আশাভঙ্গের কারণে জনগণ রাজনীতির চোরাবালিতে আটকা পড়েছে। সবকিছু থেকেও যেনো আমাদের কিছু নেই। নতুন পুরোনো হয়ে ফের নতুন বছর আসে, কিন্তু আমাদের জীবনে নেমে আসা অন্ধকারের গলি আর ফুরোয় না।
গত দুই যুগ ধরে আমরা নেত্রীদের ভাষণে-শাসন দেখেছি, নতুন বছরে তাঁরাই আমাদের সহযাত্রী। তবু আমাদের রাজনীতি পাল্টায় না, অর্থনীতি বদলায় না, পরিবর্তন হয় না ভাগ্যের।
এবার অন্য কথা- শিল্প-অর্থনীতি, শিক্ষাঙ্গনে কোথাও কোনো সুসংবাদ। বিভেদ, হিংসা, বিদ্বেষ আমাদের রাজনীতিকে বেঁধে ফেলেছে। শিল্প হয়ে গেছে তেলবাজির জায়গা, শিক্ষাঙ্গন হয়েছে পুঁজিপতিদের ব্যবসার মাধ্যম। শিক্ষা বাণিজ্য চরমে উঠে দ্ররিদ্রের শিক্ষা লাভের সুযোগ কমে যাচ্ছে। তারপরেও নতুন বছর আসে। অভ্যাসবশত এ নিয়ে আমাদের মাতামাতি কম নয়। উঠতি মধ্যবিত্ত আর পশ্চিমা হাওয়ায় সিক্ত শিক্ষিত যুবসমাজ নতুন বছরে উদ্দেশ্যহীন ঝাঁপ দেয়। কোটি কোটি টাকা খরচ হয় মোবাইল কার্ড আর শুভেচ্ছা কার্ডে। লেখা হয়- হ্যাপি নিউ ইয়ার, কিন্তু এই শুভেচ্ছা-শাভকামনা কার জন্যে? এদিকে পুঁজিপতিদের কার্ডের ব্যবসায় পকেট গরম হয়, আর ওদিকে গরিবেরা পরনের কাপড় না পেয়ে শরমে মরে। কেউ-বা মরে পকেট গরমে আবার কেউবা মরে শরমে!
তবু এখনই সময়! কেনোনা, আমরা তরুণ। আমাদেরই ভাবতে হবে পরিবর্তনের কথা, ভাবতে হবে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের কথা। তাহলেই আমাদের নতুন বছর সার্থক হবে। আমরা শান্তি পাবো। []
::
[email protected]
----------------------------------------------------------------------------------
:: বন্ধুর কাছে মনের কথা ::
চেয়ে আছি পথপানে
মিজানুর রহমান মিজান

হিমালয়ের পাদদেশে গারো পাহাড়। এ পাহাড়ের গা বেয়ে চলা আঁকাবাঁকা ঝর্ণার পথ থেকে স্রোতের শব্দ শুনি। দুই ধারের স্বচ্ছ বালির বুকে দাঁড়িয়ে আছে সাদা সাদা কাশফুলের দল। আর গাঁয়ের মেঠোপথগুলো যেনো অনাদীকালের নকশী কাঁথায় মোড়ানো। শতো বৈচিত্র্যের হাতছানি আর প্রকৃতির বাহারি সাজ দেখে আকৃষ্ট হয় প্রকৃতি বিলাসী মানুষের হৃদয়।
বিশ্বাস করো, মনোমুগ্ধকর চির নির্মল এই পরিবেশে সারাক্ষণ তোমাকে মিস করি। তুমি পাশে না থাকার শূন্যতা করুণভাবে অনুভব হয়। কেমন আছো তুমি? আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে তোমার স্মৃতি বহমান। পড়ন্ত বিকেলের সুশীতল বৃক্ষের ছায়ায় পাশাপাশি বসে কথা বলা, আর হাতে হাত রেখে পাশে চলার সেই মধুময় স্মৃতি আজও ভাসে আমার হৃদয় সমুদ্রে। আমি ভুলতে পারি না। কর্মময় জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে উদ্ভাসিত হয় ফেলে আসা জীবনের সেই স্মরণীয় অধ্যায়গুলো। জীবনের প্রয়োজনে কতো যে কর্মব্যস্ততায় কাটে দিন। দিনের শেষে বিশ্রামের পরিবর্তে শতো বেদনায় রাত কাটে নির্ঘুম। রাতের আকাশে তারাদের মিটিমিটি লুকোচুরি খেলা, জোছনা ধোয়া পূর্ণিমা- সবই আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। একাকিত্বের যন্ত্রণায় ছটফট করি...
ভাবনার অজান্তে চলে আসি রাতের শেষ প্রহরে। সুমিষ্ট আযানের ধ্বনি আর পাখির কলকাকলিতে জাগে প্রভাতির হেমন্তের ভোর। হালকা শিশির ভেজা অফুরন্ত নবো পুষ্পকলি উঁকি দেয় সূর্যের আগমনে। বাগানে ফোটে নাম না জানা হাজারো ফুল। আর সে ফুলের মধু খেতে রঙবেরঙের সাজে রঙিন প্রজাপতি, মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায় ফুলে ফুলে। এ দৃশ্য কতো মধুর, কতো আবেগের আর কতো আনন্দের- তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।
সুতরাং আর অভিমান নয়! চলে এসো, কেমন? বসন্তের আগমনের চেয়েও সর্বোৎকৃষ্ট হবে তোমার ফেরা। সাথীহারা পাখির মতো অধীর আগ্রহে তোমার আগমনের পথ চেয়ে বসে আছি। থাকবো অনন্তকাল... []
::
হিৃলা, টেকনাফ, কক্সবাজার
----------------------------------------------------------------------------------
আকাশলীনা]
পৌষ ১৪১৮ :: ডিসেম্বর ২০১১ :: বর্ষ ০২ :: সংখ্যা ০৬

কৃতজ্ঞতা :: হিমেল অনার্য
সম্পাদক :: নোমান ভূঁইয়া
[email protected]
প্রধান সহকারী : আলমগীর কবীর
[email protected]
সহযোগী ::
জাহীদ ইকবাল, সাবরিনা আহমেদ, শফিক হাসান, মাহবুব আলম
মাসউদ আহমাদ, সাফায়েত হোসাইন, মেহেদী ফেরদৌস
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও পষ্ঠাসজ্জা :: রঙছুট
শব্দ বিন্যাস ও সমন্বয় :: সৈয়দা সুধন্যা
সার্বিক ব্যবস্থাপক :: সাইফুল আমিন
যোগাযোগ ::
+88 018 18731377
[email protected]
http://www.facebook.com/akashlina.mag
মূল্য :: ১০ টাকা
সম্পাদক ও প্রকাশক
নোমান ভূঁইয়া কর্তৃক সার্কুলার রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত;
এবং হাতিরপুল, ধানমণ্ডি, ঢাকা ১২০৫ থেকে মুদ্রিত।
================================================
দ্রষ্টব্য : মূল কাগজে প্রকাশিত সকল লেখা ব্লগে প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে, আমরা দুঃখিত। -সম্পাদক।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরোনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×