সে কয়েকদিন আগের কথা। পায়ে পাগলা কুকুরের কামড় খাওয়া অবস্থায় প্রায় ৫-৬ দিন পরে ও সুজিতের দোকানে ফেরে। এর আগে পূঁজার ছুটি নিয়ে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে। সেখানে চিকিৎসার সুযোগ তার হয়নি। কিভাবে, কোথায় কুকুর ওকে কামড়েছে, তা জানবার অবকাশ আমাদের ছিল না। দূর্গাপুরে আসার পরই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তার আগে বলা প্রয়োজন আমি আর সুজিত দূর্গাপুরের ছেলে। আর দশটা ছেলের মতই কলেজে যাই আর আসি; আর এলাকায় কলার উচিঁয়ে চলি। দূর্গাপুরে জলাতঙ্কের ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায় না তাই সুজিতের বাবা সুজিতকে আর আমাকে দিয়ে ময়মনসিংহে পাঠিয়েছে। বেশি দেরি হবার কারণে রোগী একসময় চিকিৎসার বাইরে চলে যায়। এখানকার ডাক্তারও ছেলেটাকে বাচাতে পারে নি। ময়মনসিংহ থাকা অবস্থায় দেহটাকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে উড়াল দিয়েছেন জনাব!
কি আর করা এখানে কোন আত্মীয় স্বজনও নেই যে রাতটা কাটিয়ে যাব। বাধ্য হয়েই মধ্যরাতে একটা লাশ নিয়ে ফিরতে হবে। ময়মনসিংহ থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল। অবশ্য প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা ভাল, ট্রেনে যাওয়া যাবে। কেউ কেউ উপদেশ দিল একটু টাকা বেশি খরচ করে মাল গাড়িতে করে নেবার। কিন্তু আমাদের কাছে যে অতিরিক্ত কোন টাকা নেই তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া জাতিতে হিন্দু হিসাবে অন্য সকল বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করলেও সুজিতের কৃপনতাটা ঠিকই বলবৎ। কথায় বলে বিপদ যখন আসে আট খাট বেধেই আসে। জানা যায়, ট্রেনে করে সাধারন বগিতে লাশ নেয়া যাবে না। এবার আমি সুজিতের উপর ভিষণ ক্ষেপে গিয়ে বললাম “তোর ঝামেলা এবার তুই সামলা”। সুজিতকে এই প্রথম একটু অনুনয় করতে দেখে খুশি লাগল। জানি মানবতার খাতিরে হলেও ওকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। এই ঝামেলার কারণে কয়েকবার মনে হল কোথাও লাশটা ফেলে পালিয়ে যাই। কিন্তু আমরা তা পারব কেন? আমরাও তো রক্ত মাংসের মানুষ।
যাই হোক এভাবে তো আর বসে থাকা যাবে না। তাই কিছু একটা করা উচিৎ ভেবে আমি একটু খোঁজ নিতে গেলাম। কিন্তু সুজিত বুদ্ধিমানের মত জানিয়ে দিল, লাশের কথা কাওকে কিছু আর না বলতে। আমিও বুঝলাম। তাই আমরা দুজন ঠিক করলাম যে প্রধান স্টেশন থেকে না উঠে যদি একটু সামনে গিয়ে টিকেট চেকারকে পান আর বিড়ি খাওয়ার পয়সা দেই তাহলে হয়ত কিছু একটা সম্ভব। তার পর আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একটা কাজ করে ফেললাম। একটা লাশকে কাধে নিয়ে প্রায় আধামাইল এগিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় স্টেশনে দাড়ালাম। এখনও যদি কখনও মনে হয় যে আমার দ্বারা কাজটা সম্ভব হয়েছে, তো বিশ্বাস হতে চায় না। কি যে সেই সময়ের পরিস্থিতি! লুঙ্গি আর শার্ট পরা একটা আস্ত লাশ কাধে পেচিয়ে অন্ধকারে বয়ে নেয়া, অবিশ্বাস্ব! একটু পর পরই মনে হচ্ছিল লাশটা যদি হটাৎ করে কথা বলে উঠে আর আমার গলা পেচিয়ে ধরে! কিন্তু তা ছিল শুধুই আমার মস্তিষ্কের কল্পনা। ওদিকে সুজিত গিয়েছে ওর প্রাণের সঙ্গী, ভালবাসার বস্তু, সিগারেট কিনতে। আমিও যে সে বস্তুটির দাস নই তা নয়; কিন্তু ওর মত এতটা হয়ত না। যাই হোক চেকারের সাহায্যে কোন মতে আমরা ট্রেনে উঠলাম। কিন্তু একটা কথা বললে বিশ্বাস হবে না; ট্রেনের কেউ বুঝলো না যে ওটা একটা লাশ। লাশটাকে একটা সিটের মধ্যে ঠিক একজন সুস্থ মানুষের মত বসিয়ে দিলাম এবং সুজিত ওর চাদরটা দিয়ে ঢেকে দিল। তাছাড়া রাতের ট্রেনে তেমন আলোও ছিল না যে ধরা পরে যাব। সে অন্ধকারের সুযোগই হয়ত আমরা নিয়েছি। এভাবে তো নিশ্চই একটা লাশ বয়ে নেয়া যায় না। কিছুক্ষন পর শক্ত হয়ে যাবে, আরেক বিপদশুর হবে। তাই আশেপাশের লোকজনকে বললাম খুবই অসুস্থ, একটু, জায়গা তাতে পাওয়া গেল। কোন মতে একটু কাত করে সারা রাস্তা লাশের পা কোলে নিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। সুজিত ছিল মাথার কাছে আর আমি লাশের পায়ের কাছে। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা তথা জাড়িয়া যাবার ট্রেন সমন্ধে অনেক মানুষই অনেক কিছু জানে; তার মধ্যে এমনও শোনা যায় যে, ট্রেনের থেকে নাকি গরুর গাড়িই আগে যায়। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা গেল না। মনে হল ট্রেন থেকে নেমে কেউ প্রাকৃতিক অতি-জরুরী কোন কাজ শেষে বিনা পরিশ্রমেই আবার উঠে আসতে পারবে। এভাবেই রাতের নিস্তব্ধতাকে চিরে দিয়ে ট্রেন এগিয়ে চলতে থাকল তার আপন গতিতে। ঘন কুয়াশাগুলো ক্ষনিকের জন্য জায়গা করে দিল বিশালাকার দানবকে। ঘন্টা দুই এর রাস্তাকে টেনে প্রায় দেড়গুন করতে বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখা গেল না বিশালাকার ওই দানবকে।
বরাবরের মতই নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে আমরা জাড়িয়া পৌছাঁলাম। সেই চির চেনা দৃশ্য, ট্রেন থামার সাথে সাথে চিৎকার চেচা মেচি আর আনন্দ ঝগড়া মিলে মিশে একাকার। তার ঠিক পঁচিশ কি ত্রিশ মিনিট পরেই সব চুপচাপ। একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু স্টেশনের ঘড়িটাই জানিয়ে দিল কোন এক ঘন্টা পড়ল তখন। চেয়ে দেখি রাত এগারোটা। যথেষ্ট রাতই বলতে হবে। আস্তে-আস্তে সব যাত্রী যে যার গন্তব্যে ছুটে গেল। হটাৎ মনে হল আমাদের সাথে একটা লাশ, খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে। দেখতে দেখতে প্রায় ত্রিশ মিনিট কাটিয়েছি। এবার আমার নয় সুজিতের পালা। সুজিতের কাঁধে চাপিয়ে হাঁপ ছাড়ে বাচলাম। কিন্তু ও এমনিতে ভীতু, তার উপর আবার রাত। তাই ওর সাথে সাথেই যেতে হল আমাকে। আশে পাশে চেয়ে দেখি আর কোন যাত্রী অবশিষ্ট নেই যে আমাদের পথের সাথী হবে। জাড়িয়া নদীটা পাড় হওয়াই প্রথম উদ্দেশ্য তারপর সিদ্ধান্ত নেব কি করব। নদীতে প্রায় হাটু জল। এই হাটু জল কিন্তু সেই কবিতার হাটু জলের মত এত মজার মনে হল না। যেখানে গরুর গাড়ি পাড় হয়ে যেত, শিশুরা গামছায় মাছ ধরত। নদীটা হটাৎ করে অনেক বড় হয়ে গেছে বলে মনে হল। ঠান্ডার মধ্যে পানিটাকে বিষাক্ত মনে হল। পানিতে পা দেয়ার সাথে সাথে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে চাইল। কোন ভাবে নদীটা পাড় হয়ে গেলাম। আমরা এখন জন প্রানীহীন নির্জন এক পৃথিবীতে পা রাখলাম। চারিদিকে শুন্য দৃষ্টি চারন করে শুধুমাত্র একটি খাবার দোকানই খোলা পেলাম। যেখানে একটি মাত্র ছোট বাতি জ্বলছে তাও আধ মাইল দুরে। ওখানে পৌছে দেখলাম দোকানি তার ছোট দোকানের বৃহৎ এক হিসাব মিলাচ্ছে। জানতে পারলাম যে কোন খাবার অবশিষ্ট নেই, দোকান বন্ধের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু দোকানিকে আমাদের ঘটনা খুলে বলতেই তার চোখ ছানাবড়া। প্রথমে তাকে কুঞ্চিত ভ্র“র বিরক্ত মনে হলেও এবার তার মধ্যে সহযোগী সুলভ চেহারা ফুটে উঠল। খুবই আগ্রহের সাথে অবশিষ্ট কিছু খাবার নিয়ে আসল। কিন্তু সেই খাবারের যে কি স্বাদ তা হয়ত বেহেস্ত ছাড়া দুনিয়ায় আর কোথাও পাওয়া সম্বব নয়। আমি আর সুজিত সেই অর্ধপুরে যাওয়া নিচের ভাত আর কৈ মাছ দিয়ে রান্না করা বেগুন তরকারি দিয়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। যদিও কোন মাছই সেখানে ছিল না তবে বোঝা যাচ্ছিল কৈ মাছের অস্তিত্ব। আবার যে কখন খাবো বা আর খাওয়া কপালে আছে কি না তা তখন জানতাম না। কোনমতে খাওয়া শেষ করলাম। তারপর আমাদের অবস্থা দেখে দোকানি নেজে থেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। একটা বাশ আর কিছু দড়ি নিয়ে আসল এবং বলল ঐ সামনে নাকি একটা কাঠের খন্ড পাওয়া যাবে। নিয়ে আসতে দেরি করলাম না আমি। কাঠের দুই পাশে দড়িটা বেধে লাশটাকে তার উপর উঠিয়ে দিলাম এবং দড়ির মাথাটা বাশের সাথে বেধে পালকির মত বানিয়ে নিলাম। এই সুবিধা পাওয়ার পর মনে হল প্রায় অর্ধেক কষ্ঠ কমে গেল। তারপর অনেক ভেবে চিন্তে, সিদ্ধান্তে পৌছালাম যে জাড়িয়া থেকে দূর্গাপুর না গিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত ভাবে সরাসরি ছেলেরটার বাড়ি পৌছাতে পারি। কিন্তু সে রাস্তাটা মূলত কোন রাস্তাই নয়। সমস্তই হল ক্ষেতের আইল ধরে। এতে করে জাড়িয়া থেকে দূর্গাপুর ৭ মাইল ও দূর্গাপুর থেকে ওই ওই ছেলের বাড়ি আরো ৩ মাইলের পরিবর্তে মোট ৮ মাইল হাটলেই হয়ে যায়।
শুরু হল আর এক ভয়ানক তীর্থ যাত্রা। যার শুরুই আছে শেষ নেই। তখন দোকানি জিজ্ঞেস করল “যাইতে পারবেন তো ভাই?” আমি মুখে হাসি বুকে বল নিয়ে বললাম “কেন পারব না”? আসলে ঠিক তা নয়, তখনকার অবস্থা হল বুকে ভয় মুখে হাঁসি। যাই হোক রাতের অন্ধকারে পকেটে কয়েকটি সিগারেট আর বুকের মাঝে বৃহৎ এক সাহসের খোলাস নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। হায়রে সুজিত তোকে বন্ধ ুহিসাবে পেয়ে আমাকে এই অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে সাহায্য করা ছাড়া আর কোন উপাকারই তুই করতে পারলি না।
জীবনে বহুবার বহু মানুষের সামনে নিজেকে সাহসী বলে প্রমান করেছি, কিন্তু আমি তো জানি ভয় কি জিনিস। এটি মানুষের একটি আজন্ম সৃষ্ট দোষ বা গুণ। কোন মানুষই এর বাইরে নয়। সামান্য একটু মাটির রাস্তা ধরে এগিয়েই আমরা ক্ষেতের উপর দিয়ে রওনা দিলাম। ঐ রাস্তা ধরে যেতে হলে আমাদের সময় এবং শ্রম অনেক বেশি প্রায় দ্বিগুন লাগবে। তাই সামান্য কষ্ঠ হলেও আমরা সোজাসুজি হাটা শুরু করে দিলাম। দু’পাশে শুধুই সদ্য লাগানো ধান গাছের চারা। এখনো ওগুলো তুলে পরিপূর্ণ ভাবে বপনের কাজ শেষ করা হয় নি। চারদিকে সবুজের হাতছানি, মাথার উপরে আবছা চাঁদ। অন্যরকম এক সৌন্দর্য। কিন্তু এই সৌন্দর্য আমাদের কাছে অন্যান্য দিনের মত মুগ্ধতা নিয়ে আসতে পারল না। কারণ আমরা তখন যুদ্ধের ময়দানে। সেখানে নিজের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি।
অন্ধকারে সামান্য একটু পথ যেতেই অস্থির হয়ে গেলাম দু’জনই। একটা প্রাণহীন দেহ নিয়ে বয়ে চলা কোন সামান্য কথা নয়। ভাগ্য ভাল যে আমরা দু’জন ছিলাম। একজন হলে পরদিন হয়ত একটির জায়গায় দুটি লাশ কুড়িয়ে পেত গ্রামবাসি। দুজন হলেও যে খুব সাহসি হয়ে উঠছি তা বলা যাবে না। যাই হোক এতক্ষন আমি সামনের দিকে ছিলাম, হঠাৎ সুজিত আমাকে থামতে বলল। বুঝতে পারলাম যে সে ভয় পেয়েছে। তার নাকি পেছনে ভয় লাগছে। আমি তাই ওকে সামনের জায়গা ছেড়ে দিলাম। সুজিত যে কি পরিমান ভিতু তা আমি এর আগেও টের পেয়েছি। দু’জন মনুষ সাথে একটা লাশ, ভয়ানক এক পরিবেশ চারপাশে। মনে হচ্ছে বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বার বার মনে হচ্ছিল পেছন থেকে কেউ যেন আমাকে ডাঁকছে। সে ডাকে সাড়া দেবার মত বোকা আমি যেমন ছিলাম না তেমনি সুযোগও ছিল না। একটু পর পর লাশের পা দুটো আমার পেটের কাছে বাড়ি খাচ্ছিল। কি যে বিদঘুটে এক অবস্থা। আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, লাশটা যখন আমারা নিয়ে আসছি, তখন থেকেই কেন যেন একটু পর পর মৃত্যুর ভয় আমাকে জাপটে ধরছিল। সব কিছু ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাতে ইচ্ছা করছিল। দু’জন কোন কথা না বলে যার যার মন মানসিকতা নিয়ে বয়ে চলছি একটা লাশ। আমি জানি দুজনের মনের ভেতরই পৃথক পৃথক ঘটনা ঘটতে থাকল। অবশ্য ভয়কে হ্রাস করার জন্য দু’জনের হাতেই একটা করে সিগারেট ছিল।
তারও কিছুক্ষন পরের কথা। কথা নেই সামনে থেকে একটু টান অনুভব করলাম কাঁধে। মুহুর্তের মধ্যেই সুজিত লাশটাকে কাধ থেকে ফেলে দিয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরল। ততক্ষনে লাশটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ট্যাঁরা চোখে চেয়ে দেখি লাশের মুখ দিয়ে বিশ্রীভাবে লালা গড়িয়ে পড়ছে। এই লালা সুস্থ কোন মানুষের গায়ে লাগলে তারও জলাতঙ্ক হতে পারে। বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পেলম সবুজ এক জোড়া চোখ। ভয় পেয়ে দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরে সূরা পড়তে লাগলাম। সুজিতকেও পড়তে বললাম। ও পড়ল। অবশ্য এতে অবাক হবার কিছু নেই। ওকে নিয়ে আমি মসজিদে নামাজও পড়িয়েছি। যাই হোক বিড়ালটা চলে গেলে আমরা আবার রওনা হলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম রাতের বেলা বিড়াল নাকি এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে বেড়ায় সামান্য আহাড়ের খোজে। আরো একটু এগিয়ে যেতেই সামনে এক বাড়ির একটু মৃদু আলো দেখতে পেলাম। খুব দ্রুত পা চালিয়ে সেখান পৌছলাম। কোন ভাবে ভয়কে জয় করা যায় কি না ভেবে। বাড়ির উঠানে গিয়ে অনেকক্ষন ডাকাডাকি করার পর মাঝ বয়সী এক লোকের গলা শুনতে পেলাম। বলল, “কেডা? এত রাইতে কি চান?” সুজিত গলাটা যতটুকু সম্ভব নামিয়ে অনুনয়ের সাথে বলল “খুব বিপদে পড়ে এসেছি, একটু পানি যদি পেতাম?” বিকট ক্যাচ ক্যাচ শব্দে দরজাটা খুলল। নিস্তদ্ধ পরিবেশে শব্দটা অনেক বেশি গুরুত্ব পেল। তারপর আমরা সব কিছু খুলে বললাম। আমাদের প্রতি তার দয়া হল বলে মনে হল। কারণ মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত শরবত চলে এল। শরবত খাওয়া শেষে আমরা বাড়ীর গৃহস্থের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তারপর আবার রওনা হলাম। এভাবে যেতে যেতে আমরা বহুবার বিভিন্ন ভাবে ভয় পেলাম। তবে সে ভয়গুলো পাওয়ার কারণ অবশ্যই ছিল। অবশেষে রাত যখন প্রায় শেষ, একটু পরেই যখন সূর্যের মুখশ্রী দেখা যাবে ঠিক তার কিছুক্ষন আগেই আমরা ওই ছেলেটার বাড়িতে পৌছলাম। কেমন করে যেন তারা আগেই জানতে পেরেছে ওর মৃত্যুর কথা। এমনিতে এক ধাপ কান্নার পর্ব শেষ, তারপর আমরা পৌছানোর পর শুরু হলো আরেক ধাপ। আমরা যে কি করে, কিভাবে, কি কষ্ঠ করে, কি অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে আসলাম তা জানার কৌতূহল কেউ প্রকাশ করলনা।
তারপর আমি আর সুজিত আস্তে করে দূরে সরে গিয়ে একটি খড়ের গাঁদার উপর বসলাম। হটাৎ একটি দমকা হাওয়ার মত অনুভব করলাম, যা কোন স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পড়ে না। শিতল দমকা হাওয়ায় এক ধরনের কাপুনি আমার সারা গাঁ ছুয়ে গেল। মাথা হতে সব স্মৃতি যেন নিঃচিহ্ন হয়ে গেল, হারিয়ে গেলাম এক অন্ধকার জগতে। ঐ ঘটনার ব্যাখ্যা আমি আজ অবধি পাই নি। পরে অবশ্য সুজিত কে জিজ্ঞেস করেছিলাম; কিন্তু ওর এরকম কিছু মনে হয় নি।
পর দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল, দেখলাম সৎকার শেষ। আমরাও তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে র্দূগাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভীড়ে গেলাম আমাদের নিত্ত নৈমিত্তিক কাজে। আগের রাতের ঘটনা আমাদের আর মনে আছে বলে মনে হলো না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১১ রাত ১:৩৭