৫। সূদ নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ
সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে নিশ্চিত আয়ের অর্থাৎ অবধারিতভাবে সূদ প্রাপ্তির লোভে অনৈতিক ও অনৈসলামী কাজে মূলধন বিনিয়োজিত হয়। উদাহরণস্বরূপ মদের ব্যবসা, ফটকাবাজারী, মজুতদারী, অনৈতিক ও কুরুচিপূর্ণ গান-বাজনা, সিনেমা, এমনকি পর্ণোগ্রাফির মতো বিষয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে। এসব কাজে যেহেতু মুনাফা অর্জিত হয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী হারে, সেহেতু প্রদেয় সূদ পরিশোধের পরও বিস্তর মুনাফা থেকে যায় উদ্যোক্তার হাতে। তাই তার পক্ষে চড়া হারেও সূদ পরিশোধ করা আদৌ কঠিন নয়। এই পথ ধরে সমাজে অনৈতিক ও অসামাজিক কাজের প্রসার ঘটে সহজেই। পরিণামে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী ও কিশোর-কিশোরীর সহজাত বোধ-বিশ্বাসে চিড় ধরে। ধীরে ধীরে তাদের ঈমানী চেতনার বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে। ক্রমেই মূল্যবোধের ক্ষয় হয় এবং প্রায় অলক্ষ্যেই সমাজে নৈতিক অধঃপতন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে। সমাজের অবক্ষয় তথা ধ্বংস হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রতিরোধ্য। বস্তুতই মুনাফার হার তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কারণে সমাজ হিতকর ও কল্যাণধর্মী প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্যে পুঁজি সংগ্রহ করা বর্তমান সময়ে অতীব দুরূহ কাজ।
৬। সূদ সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে
সূদখোর মহাজন ও পুঁজিপতিরা তাদের প্রদত্ত ঋণের বিনিময়ে হাযার হাযার লোকের কঠোর শ্রমের ফসলে অন্যায্য ভাগ বসায়। শুধু তাই নয়, অনুৎপাদনশীল কাজের জন্য গৃহীত ঋণের বিপরীতে যেহেতু কোন বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই সেহেতু এই ঋণ পরিশোধ করতে ঋণগ্রহীতার সহায়-সম্পত্তির উপরেও চাপ পড়ে অনিবার্যভাবেই। এমনকি ঋণের দায়ে অনেকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক হয়, পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ওঠে নিলামে। মানুষের আপদকালে দাবীকৃত বাড়তি এই অর্থ অর্থাৎ সূদ তাই স্বভাবতই ঋণ গ্রহীতাদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে। মানুষ তাদেরকে বিপদের দিনে দাতা মনে করার পরিবর্তে রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারই মনে করে। এরা হয়ে ওঠে সমাজে ঘৃণার পাত্র।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকায় বাইতুল মাল হ'তে সাহায্য বা করযে হাসানা পাওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় সূদভিত্তিক ঋণ নিতে বাধ্য হয় সমস্যাগ্রস্থ নারী-পুরুষ। উপরন্তু সূদখোররা গরীব ও অসহায় কৃষকদের জমি-জিরাত ঋণের দায়ে দখল করে, ফসলের সূদ খেয়ে খেয়ে ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে ওঠে, হয়ে ওঠে বিপুল সম্পদের মালিক। কখনও কখনও এমনও দেখা যায়, গৃহস্থ চাষী, ক্ষুদে খামারের মালিক সূদখোর মহাজনের ঐ জমিতে বর্গাচাষ করতে বাধ্য হচ্ছে, একদিন যে জমির মালিক ছিল সে নিজেই। স্বভাবতই তখন তার মনে সৃষ্টি হয় বিদ্বেষ ও আক্রোশ যার পরিণাম ফল মোটেই শুভ নয়।
৭। সূদের কারণেই দরিদ্র আরও দরিদ্র এবং ধনী আরো ধনী হয়
সূদের পরিণামে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্থ মানুষ প্রয়োজনের সময়ে সাহায্যের কোন দরজা খোলা না পেয়ে উপায়ন্তর না দেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সেই ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে তার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। পুঁজিবাদী সমাজে করযে হাসানার কোন সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনী খাতে ঋণ তো দূরের কথা, উৎপাদনী খাতেও বিনা সূদে ঋণ মেলে না। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো তাকে সূদ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে সে তার শেষ সম্বল যা থাকে তাই বিক্রি করে উত্তমর্ণের ঋণ শুধরে থাকে। এই বাড়তি অর্থ পেয়ে উত্তমর্ণ আরো ধনী হয়। অধমর্ণ হয় আরও দরিদ্র। বৃদ্ধি পেতে থাকে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য।
বাংলাদেশে একশ্রেণীর ধনী যে আরও ধনী হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ সূদভিত্তিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ দানের নীতি ও কৌশল। যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় জামানত দিতে না পারার কারণে সূদী ব্যাংকগুলো হ'তে ঋণ পায় না, অথচ বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তারা সহজেই ঋণ পায়। ব্যাংক হাযার হাযার লোকের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে, কিন্তু ঐ অর্থ ঋণ আকারে পায় মুষ্টিমেয় বিত্তশালীরাই। এ থেকে উপার্জিত বিপুল মুনাফা তাদের হাতেই রয়ে যায়। ফলে সঞ্চয়কারী হাযার হাযার লোক তাদের অর্থের প্রাপ্য উচিত আয় থেকে বঞ্চিত হয়। বিত্তশালী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহকে যে সূদ পরিশোধ করে তা জনগণের কাছ থেকে সেবা ও দ্রব্যের মূল্যের সাথেই তুলে নেয়। ফলে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করেও তাদের মুনাফার কোন কমতি হয় না, পরিণামে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরীবরা হয় আরও গরীব। সমাজহিতৈষীরা তাই যতই 'গরীবী হঠাও' বলে চিৎকার করুক সূদের মতো এই দৃঢ়মূল, সুকৌশলী ও সর্বব্যাপী শোষণ প্রক্রিয়া বহাল থাকা অবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের কোন প্রেসক্রিপশনই কার্যকর হবে না।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




