somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একছত্র বিষাদমেঘ

০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৯:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :








মিজান সাহেব ইদানীং ঘরেই থাকেন। বাইরে খুব একটা যান না। কথা খুব কম বলেন। যেটুকু বলেন তা শুধু জাহানারার সাথে। জাহানারা মিজান সাহেবের স্ত্রী। খুবই ধর্মভীরু মহিলা। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন।
তেরো বছরের বৈবাহিক জীবন। কিন্তু এই দীর্ঘসময়ে তিনি একটাবারের জন্যও মিজান সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেননি। কোন কথায় দ্বিমত জানাননি। তিনি জানেন তার স্বামী যা বলবেন তাই করবেন। তার কথার খেলাপ হয় না। এবং তিনি অসম্ভব রাগী একজন মানুষ।

কথিত আছে মিজান সাহেব যখন যুবক ছিলেন জমিজমা নিয়ে ঝামেলার এক পর্যায়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে তামাম গ্রামের সামনে কষে এক চড় মেরেছিলেন। এও জনশ্রুতি আছে সেই চড়ের শব্দ নাকি আশপাশের তিনগ্রামে শোনা গ্যাছিল। যদিও ওই প্রধান শিক্ষক সেইকারণে আত্মহত্যা করলে তাকে কিছুটা আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়। তবে তেমন কিছু না। দেশের আইনকানুন তখন সবই তার আব্বা গণি মোল্লার পকেটে থাকতো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শিবরামপুর গ্রামে যে ক'জন লোক রাতারাতি বিশাল টাকাপয়সার মালিক হ'য়ে উঠেছিল গণি মোল্লা তাদের মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধের পর গ্রামের সবাই ভেবেছিল মোল্লা সাহেব হয়তোবা পরিবার পরিজন নিয়ে পাকিস্তান চ'লে যাবার দ্বারা গ্রামে শান্তি কায়েম করবেন। কিন্তু সবাইকে নিতান্ত নিরাশায় ডুবিয়ে তিনি গ্রামের মাথার উপর ছড়ি ঘুরানোর সিদ্ধান্ত নেন।

যুদ্ধের পর নয় বছরের মাথায় মোল্লা সাহেব পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। সমগ্র গ্রাম কান্নায় ভেঙে পড়ে। মানুষকে এতো কাঁদতে কেউ কোনদিন দেখে নাই। ছেলে-বুড়ো-নর-নারী নির্বিশেষে কেঁদেছিল। পুরো শিবপুর গ্রাম কেঁদেছিল। কেঁদেছিল শোকে না সুখে সেটাই প্রশ্ন! মৃত্যুশোকে আনন্দ অশ্রুর এইরকম নজির দেশে আর একটাও পাওয়া যাবে না। তবে মিজান সাহেব গ্রামবাসীর এইরকম কান্না দেখে যারপরনাই বিগলিত হ'য়ে যান এবং বছর পার না হ'তেই সপরিবারে ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাধীনতার এক দশক পর গ্রামের মানুষ প্রথম তা উদযাপন করে।



মিজান সাহেব বেশ অস্বস্তি নিয়েই বসে আছেন। এবং তিনি যে তা নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন তা তার চোখে তীর্যক চাহুনিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গত চারবছরে তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে এলাহি কাণ্ড। এহেন ব্যবসা নেই তিনি করেননি। আর যাতেই হাত দিয়েছেন তাতেই সোনা ফলেছে। তবে এই সোনার নিচে চাপা মরে যাওয়া অগুনিত মানুষের কান্না আহাজারি তার কানে পৌঁছালেও মন অবদি পৌঁছায় না।

মেয়েটার দিকে তাকাতেই আবার অস্বস্তি জেঁকে বসে মিজান সাহেবের মধ্যে। মেয়েটার নাম বেণী। তার গ্রাম শিবপুর থেকেই এসেছে।

মেয়েদের প্রতি মিজান সাহেব একটুআধটুু দুর্বল। এব্যাপারে তার বেশ সুনাম আছে। তার অফিসের মহিলা স্টাফ থেকে শুরু করে বাড়ির কাজের ঝি পর্যন্ত বয়সের বাছবিচার না করেই তিনি বিছানায় নিতে চান।

একবার অফিসের এক নতুন স্টাফ, ইয়াসমিন নাম ছিল মেয়েটার। উচ্চশিক্ষিত। মার্জিত। বাবা মুক্তিযোদ্ধা। অতীব সুন্দর দেখতে। চাকরির প্রথমদিন থেকেই মিজান সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েটার অপছন্দ ছিল। তবে ভাবতে পারেনি লোকটা এতোটা ইতর চরিত্রের হবে।
সেদিন একটা অ্যাসাইনমেন্টের বাহানা দেখিয়ে অফিস আওয়ারের পরেও মেয়েটাকে আটকে রাখা হয়েছিল। তারপর মেয়েটার অসতর্কতায় মিজান সাহেব যখন তার বুকটা খাবলে ধরেছিল, হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিল মেয়েটা। বাবার বয়সী একটা লোক যে এতটা জঘন্য হ'তে পারে তার চিন্তায়ও আসেনি। ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে মেয়েটার। কিন্তু সম্বিৎ ফিরতেই পেপার ওয়েট দিয়ে মিজান সাহেবের মাথাটা ফাটিয়ে দেয়।
আসার সময় বলে এসেছিল 'আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আবার আসবো। যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এখনো বাকি আছে। এবার যুদ্ধ তোদের মতো ভণ্ডদের বিরুদ্দে।'

মেয়েটাকে আর কোনদিন দেখা যায়নি। তবে তার বাবাকে প্রায়ই মিজান সাহেবের অফিসের বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যেত। কী যেন বিড়বিড় করে! কেউ পাত্তা দেয় না। পাগল মানুষ। কার সময় আছে তাকে নিয়ে ভাববার!

'চাচা, খালা আমারে আপনের কাছে পাঠাইছে। সে আপনারে চিনে। বলছে কিছুদিনের মধ্যেই আপনেরে পত্র লিখবে।' মেয়েটা কথাগুলো ব'লেই ঘরের মেঝেতে আবার আঙুল দিয়ে নকশা আঁকতে থাকে।
মিজান সাহেব মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। ফুলতোলা সবুজ রঙের শাড়ি প'রে আছে মেয়েটা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চুলগুলো বেণী ক'রে বাঁধা। বয়স আর কতো হবে? সতেরো কিংবা আঠারো। তার বেশি নয়। শরীরে যৌবন আসতে শুরু করেছে যা দেখে মিজান সাহেবের ভেতর বাস করা জন্তুটা সজাগ হ'য়ে ওঠে।
যদিও মেয়েটার চোখগুলো খুব চেনা মনে হয় তার কাছে। খুব পরিচিত। ঘন কালো চোখগুলোতে গ্রামের দস্যিপনা খেলা করছে। যদিও মেয়েটা এখন ভয়ে জুবুথুবু হ'য়ে বসে আছে। কিন্তু এই চোখ, মিজান সাহেবের অস্বস্তি সবকিছু ছাপিয়ে যায় বীণার শরীর, শরীরের ভাঁজ।

জাহানারাকে ডেকে বীণাকে নিয়ে যেতে বলেন। আর বলেন, 'এখন থেকে ও এখানেই থাকবে। আমার ঘরের পাশের ঘরটা পরিষ্কার ক'রে দাও।'
স্বামীর কথার অবাধ্য তিনি হন না। যদিও জানেন মিজান সাহেবের ঘর আর ওই ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। তার একটা চাবি মিজান সাহেবের কাছেই থাকে। জাহানারার বুকটা হু হু ক'রে ওঠে মেয়েটার জন্য। কী পবিত্র একটা মুখ! তার যদি সন্তান থাকতো তবে এই মেয়েটার মতোই বড় হতো।



মিজান ভাই,

আপনার বোধকরি আমারে স্মরণ নাই। আমি আকলিমা। কেমন আছেন? শুনেছি আপনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। শুনে আনন্দ লাগছে। আপনি আরো বড় হোন।

বীণাকে আপনার কাছে পাঠাইলাম। আপনি ওকে চেনেন। জোহরার মতো চোখ পেয়েছে মেয়েটা। পানিতে ভাসানো। একবার চাইয়া দেইখেন জোহরার মুখ ভেসে থাকবে। ওরে আপনি দেইখে রাইখেন। আপনার রক্ত বইছে ওর শরীরে। মেয়ে ব'লে স্বীকৃত ওকে দিতে হবে না। শুধু দুইবেলা খাইতে দিয়েন। মেয়েটা ঠিকমতো খাইতে পারে না। বড় হচ্ছে। গ্রামের জুয়ান পোলারা খারাপ চোখে তাকায়। তাই আমি সাহস ক'রে আপনার কাছে পাঠাইলাম। আপনে ছাড়া ওর আর কেউ নাই। তাছাড়া আমার শরীরডাও বেজায় খারাপ। ক'দিন বাঁচি ব'লতে পারি না।

খোদা হাফেজ মিজান ভাই। আল্লাহ আপনার ভালো করুক। পত্র মারফত বীণার কথা জানাবেন।

ইতি
আকলিমা

পুনশ্চঃ বীণা জানে আপনি তার বাবা। তবে সে কাউরে বলবে না। আমি আপনের কাছে স্বীকার যাইতেও নিষেধ করেছি। পাছে আপনি ছোট হ'য়ে যান মেয়ের কাছে। আপনে ওর বাবা এই কথা শুনে সে যে কী খুশি হয়েছিল আমি আপনেরে লিখে বুঝাইতে পারবো না।

মিজান সাহেব ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তার হাত থেকে চিঠিটা পড়ে গিয়ে ফ্যানের বাতাসে পাক খেতে থাকে। একটা ব্যথা বুকের মধ্যে শুরু হতেই শেষ হয়ে যায়। মিজান সাহেব বুঝতে পারেন কেন মেয়েটা একবারো চিৎকার করেনি? কেন বাধা দেয়নি? শুধু চোখে জন্মাতীত বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল। ঠোঁটের কোণে ছিল বিষাদ। মেয়েটা কাঁদেনি। একবারের জন্যও না।
মেয়েটা শুধু সিলিঙের ঘূর্ণায়মান পাখার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নাকি খোদার দিকে কেউ জানে না।

অচিন্তনীয় সম্পদের মালিক মিজান সাহেবকে আইন কিছু ক'রতে পারেনি। কখনোই পারে না।
বীণাও গ্রামে ফিরে গেছে। জন্মদাতা পিতা অপেক্ষা ওই মানুষগুলো ভালো যারা রাতের শেষ ভাতের পয়সা দিয়ে যায়।



শুভ্র সরকার
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৯:৪২
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×